বধূ_কোন আলো_লাগলো_চোখে পর্ব-১+২

0
820

গল্প #বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে
লেখিকা #Esrat_Ety
#সূচনা_পর্ব

“স্ত্রী হচ্ছে বিছানার সৌন্দর্য। এদের সেভাবেই দেখবে। বাড়তি লাই দেওয়ার প্রয়োজন নেই। আর স্ত্রী শব্দটার ইংরেজি একটা প্রতিশব্দ আছে জানো তো? শব্দটা হচ্ছে “বেডফেলো”, মানে শয্যাসঙ্গী। এদের সাথে কাহিনী ওই শয্যা পর্যন্তই রাখবে। এই স্ত্রী দের এতো লাই দিও না। দেখবে তোমাদের ভেড়া বানিয়ে রেখে দেবে। পুরুষ হয়ে জন্মেছো, পুরুষ হয়ে বাঁচো, পৌরুষ নিয়ে বাঁচো, আমার দলে আমি কোনো ভেড়া রাখবো না। ফের যদি আজকের এই ইম্পরট্যান্ট মিটিং-এর সময় কারো স্ত্রীর নাম্বার থেকে ফোন আসে তাহলে তাকে আজ এই সামিন ইয়াসার পশ্চাৎদেশে লাত্থি মেরে রুম থেকে বের করে দেবে। ”
সামিন ইয়াসার কথাটা বলে শেষ করতে না করতেই মিটিং রুমের সবাই যার যার ফোন বের করে ফোনটা সাইলেন্ট করে ফেলে। তারা তাদের নেতা সামিন ইয়াসারকে খুব ভালো করে জানে। আজ সমাবেশের আগে পশ্চাৎদেশে লাত্থি খাওয়ার শখ নেই কারো।

সামিন চেয়ারের হাতলে তার বা হাতটা রেখে দুটো টোকা মেরে বলে,”চোখ কান খোলা রাখবে সবাই। পুলিশ যতই থাকুক না কেনো, নিজেদের সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। আমি নির্বাচনের আগে আমার কোনো ছেলে হারাতে চাই না।”

“জ্বি ভাই।”
সবাই একসাথে বলে ওঠে। সামিন ইয়াসার হাতঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে থাকে,তার দু’চোখ বন্ধ।

“ভাই আতাউরের বাচ্চার খবর শুনছেন? মনে হয়না বাঁচবে। জানিনা কাজটা কে করছে,তবে সুবিধা হইছে আমাদের। একটা বড় কাঁটা পথ থেকে সরে গেছে। বেশি ফাল পারতেছিলো হারামজাদা।”

জামিলের কথায় সামিন ইয়াসার চোখ খুলে তার দিকে চায়। গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,”ভদ্রভাবে কথা বলো জামিল। আতাউরের বাচ্চা আবার কি ধরনের কথা? মুরব্বি মানুষ। সম্মানের সাথে ডাকবে। ওনার নাম আতাউর আলম।”

জামিল থতমত খেয়ে যায়। ইয়াসার ভাইয়ের মন বোঝা বড় দায়। প্রতিদিন যে লোক এই আতাউর আলমকে তুলোধুনো করতে ছাড়ে না সে আজ মুরব্বি জ্ঞানের পাঠ পড়াচ্ছে। কি অদ্ভুত!

সামিন ইয়াসার কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলে,”আমার তরফ থেকে একটা ফ্লাওয়ার বুকে নিয়ে গিয়ে হসপিটালে দিয়ে আসিস কেউ। বাড়ির লোকদের গিয়ে বলে আসবি “সামিন ইয়াসার পাঠিয়েছে, সে খুবই দুঃখ প্রকাশ করেছে।”

দলের দুজন তরুণ প্রতিনিধি মাথা নাড়ায়। সামিন ইয়াসার উঠে হেলতে দুলতে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। দলের সবাই তাদের নেতাকে অনুসরণ করে কালো পিঁপড়ার দলের মতো লাইন ধরে দলীয় মিটিং রুম থেকে বের হয়।

জনসমুদ্রের উত্তাল ঢেউ উপচে পরেছে আজ এই এলাকায়। সরকার দলীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য ইমতিয়াজ মির্জার বড় ছেলে সামিন ইয়াসার যে কিনা খোদ নিজেও ছাত্রনেতা সে আজ সমাবেশের ডাক দিয়েছে। মানুষটাকে দেখার জন্য উত্তপ্ত মরুভূমির মতো বিশাল মাঠটাতে ঠেলাঠেলি করে দাড়িয়ে আছে স্কুল পড়ুয়া ছাত্র থেকে শুরু করে বৃদ্ধদের দল। সবাই অপেক্ষা করছে কখন নেতা তার ভাষণ শুরু করবে। সবার অপেক্ষার পালা শেষ হয়। সিংহের মতো হেলে দুলে মঞ্চে উঠে জনতার দিকে ফিরে হাত নাড়িয়ে মাইকের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বয়সের চেয়ে গম্ভীর এবং রাশভারী কন্ঠে জনতাকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,”আসসালামুয়ালাইকুম আমার প্রান প্রিয় ভাইয়েরা।”
জনসমুদ্রে মৃদু গুঞ্জন শোনা যায়। সবাই সালামের উত্তর দিচ্ছে। সামিন ইয়াসার বলতে থাকে,”আপনাদের সবার জন্য প্রানঢালা ভালোবাসা নিয়ে আজ আমি সামিন ইয়াসার মির্জা এই মঞ্চে এসে দাঁড়িয়েছি। আপনারা আমাকে গ্রহণ করুন। আমি আমার বাবা ইমতিয়াজ মির্জার আদর্শে বেড়ে ওঠা……..”

আর কিছু বলার আগেই নরম একটা মেয়েলী হাত সামিন ইয়াসারের বাহু ধরে ঘুরিয়ে দেয়,সামিন ইয়াসার কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার ডান গালে স্বশব্দে একটা চড় বসিয়ে দেয় তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একজন তরুণী। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে যায় সামিন ইয়াসারের দলীয় তরুণ কর্মীরা। জনতার সমুদ্রে গুঞ্জন শোনা যায় মুহুর্তেই। হচ্ছে টা কি আসলে!

ডানগালে হাত দিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তরুণীর দিকে বিস্ময় ও প্রচন্ড রাগ মিশ্রিত দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে সামিন। কয়েক মুহূর্ত সময় নিয়ে মেয়েটিকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে নেয় সে। লম্বায় পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চির মতো হবে,পাতলা ফিনফিনে শরীর,তুলে একটা আছাড় মারা যাবে অনায়াসেই। মেয়েটি সুন্দরী, উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের সুশ্রী মুখটা যেকোনো তথাকথিত ফর্সা সুন্দরীদের হারিয়ে দেবে। মেয়েটি তার দিকে ঘৃণার দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে। সামিন ইয়াসার বুঝতে চেষ্টা করে মেয়েটি কে হতে পারে। নিশ্চয়ই মেয়েটি বিরোধী পার্টির একটা গুটি। যাকে আজ সামিন ইয়াসারের সমাবেশ বানচাল করতে পাঠানো হয়েছে।

মুহুর্ত কেটে যায়,মেয়েটি একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে কান্না মিশ্রিত কিন্তু তেজী কন্ঠে বলে ওঠে,”বাবার আদর্শ? একটা নিরপরাধ মানুষকে রাস্তা থেকে সরানোর জন্য তার জানের ওপর হামলা করাটাও বাবার আদর্শ? রাজনীতির পাঠে আপনার আদর্শবান পিতা বুঝি এসব শিখিয়েছে আপনাকে? নির্বাচনে জেতার এতো লোভ যে কাপুরুষের মতো পেছন থেকে ছুড়ি বসিয়েছেন। সম্মুখ সমরে নামার মুরোদ নেই তাইনা? কাপুরুষ। আপনার মুখে আমি থুতু দিলাম।”

দ্বিতীয়বারের মতো সবাইকে হতবাক করে দিয়ে মেয়েটি সামিন ইয়াসারের গাঁয়ে থুতু ছুড়ে মারে। ইয়াসার হাত মুষ্টিবদ্ধ করে মেয়েটির ঔদ্ধত্য দেখতে থাকে চুপচাপ। মেয়েটি ঘার ঘুরিয়ে জনতার দিকে তাকায়। ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে মাইকের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, চেঁচিয়ে বলতে থাকে,”একটা আস্ত ক্রিমিনাল এই লোকটা,জনসেবার আড়ালে লুটতরাজ, মানি লন্ডারিং,সরকারের টাকা মেরে দেওয়া,খুন খারাবি করে বেড়ায় এই লোকটা। এদের পারিবারিক ইতিহাস ভুলে গিয়েছেন আপনারা সবাই? আজ একটা অপরাধীর ডাকে সাড়া দিয়ে এখানে এসেছেন সবাই? লজ্জা করে না? লজ্জা করে না আপনাদের?”

সামিন ইয়াসারের দলের ছেলেরা ক্ষেপে গিয়ে মঞ্চের দিকে এগিয়ে আসে। ইয়াসার তাদের হাত দিয়ে ইশারা করে থামিয়ে দেয়। মেয়েটি সামিন ইয়াসারের চোখের দিকে তাকিয়ে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে মঞ্চ থেকে নেমে যায়। কিছুক্ষণ সেখানের সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। কয়েকজন পুলিশ কনস্টেবল হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যায় মেয়েটিকে ধরতে। সামিন ইয়াসার তাদের পেছন থেকে ডেকে ওঠে,”দাঁড়ান।”

সবাই দাঁড়িয়ে পরে। অবাক হয়ে সামিন ইয়াসারের দিকে তাকায়। ইয়াসারের দলের একটা ছেলে ছুটে এসে তার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,”ভাই। আতাউর আলমের বড় মেয়ে।‌ আলো।”

সামিন ইয়াসার চোখ তুলে মেয়েটিকে আবারো দেখবে বলে তাকায়। কিন্তু মেয়েটি ভীড়ের মধ্যে মিলিয়ে গিয়েছে। সামিনের দিকে সবাই ভীত চোখে তাকিয়ে আছে। পুলিশ কনস্টেবল এসে বলে,”লেডি কনস্টেবল দের পাঠিয়ে দিয়ে ধরে নিয়ে আসি?”

সামিন ইয়াসার জনতার দিকে একবার তাকায়, তারপর পুলিশ কনস্টেবলকে বলে,”এটা আমার মামলা। আমি বুঝে নেবো।”
***
মুখমণ্ডলের ঘাম মুছতে মুছতে ওরনার এক কোনা চটচটে হয়ে গিয়েছে। আজ সূর্য্যের তাপটা অসহনীয় পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। আলো সিএনজির ভাড়া মিটিয়ে ব্যাগটাকে মাথার উপরে ছাতার মতো ধরে রোদের তাপ প্রতিহত করে, কিছুক্ষন ওখানে ওভাবে দাড়িয়ে থেকে নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে চলে যায় কেবিন নাম্বার দুইশো নয়ের কাছে। কেবিনের সামনে এসে তার পা ফেলার গতি কমে যায়। শরীরটা অজানা আতঙ্কে একটু একটু করে কাঁপছে। গত একদিনে মুখে কিছু দেয়নি সে, ব্লাড প্রেশার লো হয়ে গিয়েছে,মনে হচ্ছে এক্ষুনি মাথাটা চক্কর দিয়ে নিচে পরে যাবে। কেবিন নাম্বার দুইশো নয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আজান এবং আয়াত। আলোর ছোটো দুই ভাই। ওরা জমজ। দু’জনেই এবার কলেজে ভর্তি হয়েছে। বড় আপুকে দেখতে পেয়ে ছুটে আসে দু’জনেই।
আলো হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,”জ্ঞান ফেরেনি তাই না? আরে ঘাবড়াচ্ছিস কেনো? ডাক্তার বলেছে আটচল্লিশ ঘন্টার পরে দেখা যাবে। আটচল্লিশ ঘন্টা হতে এখনো সাত ঘন্টা বাকি।”

আয়াত কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলে,”আম্মুকে সামলানো যাচ্ছে না আপু। তুমি কিছু একটা করো!”

আলো একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে, তারপর বলে,”তোরা দুজনে এখানে তাহলে আম্মুকে দেখবে কে? আজান তুই বাড়িতে যা। আয়াত আমার সাথে থাকুক।”

_তুমি কোথায় গিয়েছিলে আপু? কোনো থানা পুলিশের ঝামেলায় গিয়েছো নাকি? আমার খুব ভয় করছে!

আজানের কথায় আলো মুখটাকে হাঁসি হাঁসি করার বৃথা চেষ্টা করে বলে,”অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করে এসেছি। যেটা না করলে আমার বিক্ষিপ্ত মন শান্ত হতো না।”

আয়াত আর আজান দু’জনেই তাদের বড় আপুর কথা কিছু বুঝতে পারছে না। আলো সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে তার বাবা আতাউর আলমের কেবিনের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। দরজার কাচ দিয়ে চোখ রেখে নিজের বাবার অক্সিজেন মাস্ক লাগানো ক্ষতবিক্ষত শরীরটার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে ওঠে,”আমি ওই লোকটাকে উচিৎ শিক্ষা দিয়ে ছাড়বো আব্বু।”

***
“হ্যা আমি ওই মেয়েটার সম্পূর্ণ খবরাখবর চাই। কোন কলেজে পড়ে। কোথায় কোথায় যায়। মানে ওকে নজরে নজরে রাখবে। কেনো বলছি? কারন আমার দরকার তাই, এখন ফোনটা রাখো এবং যা করতে বলেছি করো।”
সামিন ইয়াসার ফোন কেটে দিয়ে বিছানার ওপর ছুঁড়ে মারে ফোনটা। তারপর ধপ করে নিজেও বসে পরে বিছানায়। মাথা থেকে কিছুতেই ওই দৃশ্যটা সে সরাতে পারছে না। চড়ের শব্দ টা এখনো তার কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ওই মেয়েটির তার গাঁয়ে থুতু ছুড়ে মারার দৃশ্যটা মস্তিষ্কে দামামা বাজিয়ে যাচ্ছে। সামিন ইয়াসার চোখ বন্ধ করে বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকে। কিছুক্ষণ যেতেই হুরমুর করে তার ঘরের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে তার ভাই ইলহাম। সামিন ইয়াসার মাথা তুলে তাকায়। সে কিছু বলার আগেই ইলহাম বলে ওঠে,”টিভি অন করো ভাইয়া। কুইক!”

সামিন উঠে টিভি অন করে। ইলহাম বলে,”চ্যানেল নাম্বার থার্টিন।”

“ছাত্রনেতা সামিন ইয়াসারকে জনসম্মুখে চড় মেরেছে তরুণী। কে এই তরুণী?”

সংবাদ উপস্থাপিকার মুখে বাক্যটি শুনে সামিন ইয়াসার হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলে। তার চড় খাওয়ার ভিডিওটি খবরে বারবার দেখানো হচ্ছে। সামিন রিমোট টিপে চ্যানেল পাল্টায়। সেখানেও সেই একই খবর। সামিন ইয়াসার ক্ষুব্ধ দুটি চোখ নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছে।

“ভাইয়া প্রায় প্রত্যেকটা খবরের চ্যানেলে ভিডিও ক্লিপটা ছড়িয়ে গেছে।”
পাশ থেকে আমতা আমতা করে ইলহাম বলে।

_কে করেছে ভিডিওটা?
তেজী কন্ঠে জিজ্ঞেস করে সামিন ইয়াসার।

_জানার চেষ্টা করছি ভাইয়া।

“ছাত্রনেতার গালে তরুণীর চড়। এই তরুনীর সাথে কি কোনো অসভ্যতা করেছিলো ছাত্রনেতা সামিন ইয়াসার?”

সামিন আর শুনতে পারেনা, হাতের রিমোটটা ছুঁড়ে মারে টিভির দিকে।
ইলহাম ভয়ার্ত দৃষ্টিতে বড় ভাইকে দেখে। সিংহ এক্ষুনি গর্জন শুরু করবে,একে সামলানো তার একার পক্ষে দায় হয়ে যাবে। সে তার বাবা ইমতিয়াজ মির্জাকে ডাকতে উদ্যত হবে তখনি ইমতিয়াজ মির্জা দরজার পর্দা সরিয়ে হনহন করে ঘরে ঢোকে সামিন ইয়াসারের।

সামিন ইয়াসার তার বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। ইমতিয়াজ মির্জা ধীরে ধীরে বলে,”শান্ত হও। মানহানির মামলা করবো। শান্ত হও।”

_এতে হয়ে যাবে বাবা?
ঠান্ডা গলায় বাবাকে প্রশ্ন করে সামিন। ইমতিয়াজ মির্জা তার ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে। সামিন কন্ঠে অস্বাভাবিক শান্ত ভাব বজায় রেখে বলে,”এতে ওই ভিডিও ক্লিপ টা মুছে যাবে?”

_আমি ওটা সব যায়গা থেকে সরানোর ব্যবস্থা করছি।

_আর মানুষের মস্তিষ্ক থেকে? সেখান থেকে কিভাবে সরাবে বাবা? পারবে না তো। সামিন ইয়াসার জনসমক্ষে একটা মেয়ের হাতে চড় খেয়েছে, মেয়েটা তার গায়ে থুতু মেরেছে এটা তো তাদের মস্তিষ্কে গেঁথে গিয়েছে বাবা। ওরা আজীবন মজা ওড়াবে এটা নিয়ে। আজীবন!

ইমতিয়াজ মির্জা চুপ করে থেকে বলে,”আমি মানহানির মামলা দেবো।”
_না।
ঠান্ডা গলায় বলে ইয়াসার।
_বাধা দিচ্ছিস কেনো? একটা বিহিত তো করতেই হবে।

_তোমাকে কিছু করতে হবে না। যা করার আমি করবো।
ওই মেয়েটাকে এর দাম দিতে হবে। আমি ওই মেয়েটার খুব খারাপ অবস্থা করে ছাড়বো বাবা। ও আজীবন মনে রাখবে এই সামিন ইয়াসারকে।

চলবে…..?

#বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে
#পর্বসংখ্যা_২
#লেখিকা_Esrat_Ety

হাসপাতালের করিডোরে একটা লম্বা ধরনের বেঞ্চিতে পা উঠিয়ে বসে আছে আলো। কিছুক্ষণ পরে হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে দেয় সে। কিচ্ছু ভালো লাগছেনা তার। ইচ্ছে করছে বাচ্চাদের মতো গলা ছেড়ে,হাত পা ছুড়ে কাঁদতে, কিন্তু এটা করা যাবে না। মা, দাদী, আয়াত,আজান তাকে দেখেই কিছুটা ভরসা পাচ্ছে। এখন যদি সেও ভেঙে পরে তবে তো সব ভেসে যাবে! দু’টো ঘনিষ্ঠ আত্মীয় স্বজনও নেই যে তাদের ভরসায় সবাইকে ছেড়ে দিয়ে সে শোকপালন করবে।

“এই আপু।”
আয়াতের গলার আওয়াজ পেয়ে আলো মাথা তুলে তাকায়। আয়াতের দিকে তাকাতেই বুকটা হুহু করে ওঠে তার। কত প্রাণোচ্ছল ছেলে দুটোর মুখ শুকিয়ে কি হয়েছে ! সহ্য করা যাচ্ছে না এসব।

“আপু একটু ডাল পুরি এনেছিলাম কিনে। মুখে দেবে একটু?”
আলোর চোখ দুটো ভিজে উঠেছে। সবসময় বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজে থাকা ছেলেটা আজ খেয়াল রেখেছে বোন কিছু খায়নি। বোনকে খাওয়াতে হবে।
আলো একবার মাথা নাড়িয়ে না বলতে চেয়েও পারে না। ডালপুরির ঘ্রানে তার পেটের খিদে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সে হাত বাড়িয়ে প্যাকেট টা নিয়ে গোগ্রাসে গিলতে থাকে খাবার টা। আয়াত চোখের চশমা খুলে চশমাটা পরিষ্কার করতে করতে বলে,”সত্যি করে বলো তো, কোথায় গিয়েছিলে? থানায়?
_না। ওখানে যাবো কোন দুঃখে? সব তো ইয়াসারের পা চাটা চামচা।
_তাহলে?
_তোর জেনে কাজ নেই। শোন না,আমায় একটু ওয়াশ রুমের কাছে নিয়ে যা।
আয়াত উঠে দাঁড়ায়। আলো আয়াতের পিছু পিছু যাচ্ছে। হঠাৎ করে সে বুঝতে পারলো লোকজন তাকে দেখছে,তার দিকেই তাকিয়ে আছে আগন্তুকরা , অস্বাভাবিক লাগছে আলোর কাছে ব্যাপারটা। আলো আয়াতকে বলে,”শোন না,আমার মুখে কি কিছু লেগে আছে দেখতো!”
_না আপু। কেনো?

আলো কিছু বলে না। হাঁটতে হাঁটতে ওয়েটিং রুমের কাছে এসে সে থমকে যায়। আয়াত মাথা ঘুরিয়ে চোখ বড়বড় করে আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। ওয়েটিং রুমের বড় স্ক্রিনের টিভিতে সামিন ইয়াসারকে থাপ্পর মারার ভিডিওটি চোখে পরতেই সে স্তব্ধ হয়ে যায়। লোকজন হা করে দেখছে। প্রত্যেকটা লোকাল খবরের চ্যানেলে একই জিনিস দেখানো হচ্ছে। আলো হতভম্ব হয়ে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকে। আয়াত আতংকিত হয়ে তার বোনকে দেখতে থাকে, বিড়বিড় করে বলে,”আপু,এটা তো তুমি!”

আলো কোনো কথা না বলে আশেপাশে তাকায়। সবার দৃষ্টি টিভির দিকে। তাকে এখনো সম্ভবত ওয়েটিং রুমে বসে থাকা মানুষ গুলো দেখতে পায়নি। কেউ দেখে ফেলার আগেই আলো তড়িঘড়ি করে হ্যান্ডব্যাগ থেকে মাস্ক বের করে পরে নেয়। আয়াতের হাত ধরে দ্রুত ওখান থেকে আড়াল হয়ে যায়।

“আপু। তুমি এটা কি করলে ! ওই লোকটাকে কেনো চড় মারলে!”

_ওটা ওই লোকটার প্রাপ্য ছিলো।
_তাহলে এখন? এখন কি হবে। দেখলে প্রত্যেকটা চ্যানেলে তোমাকে দেখাচ্ছে। এই উটকো ঝামেলার মোকাবেলা কিভাবে করবে।

_যা হয় হোক। আমার আব্বুর গাঁয়ে হাত দিয়েছে। ওই লোকটাকে এর দাম দিতে হতোই। যে এই ভিডিওটি করেছে তাকে ধন্যবাদ দিতে হবে,ওই লোকটার মান সম্মান সব ধুলোয় মিশে যাক। বেশ হয়েছে। পশু একটা।

_কিন্তু আপু ও যদি তোমার কোনো ক্ষতি করে দেয়!

_নির্বাচনের আগে কিছূ করতে পারবে না ও। ওর হাত পা বেঁধে রেখেছে ওর ক্ষমতার প্রতি লোভ। আমার কিছু হলে সবাই ভাববে ও করিয়েছে। আমার মনে হয় না ও এই রিস্ক নিতে চাইবে। তোরা চিন্তা করিস না। কিচ্ছু হবে না আমার।

***
“পুরো নাম অদ্রিতা আলো। অনার্স চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী, ইংরেজি বিভাগ, স্থানীয় মহিলা কলেজে পড়ে। পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি করে বেড়ায়। খুবই আত্মমর্যাদাসম্পন্ন একটা মেয়ে। সবার মুখে যেরকমটা শুনেছি তাতে মেয়েটিকে বেশ ভালোই মনে হয়েছে।”

_ভালো? ভালো না খারাপ তা দিয়ে আমার লাভ? আমি শুধু ওই মেয়ে টাকে শিক্ষা দিতে চাই।

চেঁচিয়ে কথাটি বলে সামিন ইয়াসার। তার সামনে বসে আছে তার খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ফুয়াদ।
সামিন বলতে থাকে,”মেয়ে মানুষের এতো ঔদ্ধত্য আমি নিতেই পারি না। ওই মেয়ের সাহস কি করে হয় ওর অহেতুক সন্দেহের বসে সামিন ইয়াসারের মুখোমুখি হওয়ার? আমি ওর বাপকে মেরেছি?

_একেবারে বাবার ফটোকপি আলো। প্রচন্ড দুঃসাহসী। তবে ওর জমজ দুটো ভাই আবার তেমন নয়। খুবই ভীতু প্রকৃতির। সদ্য এস.এস.সি পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়েছে। দু’জনেই সাইন্সের স্টুডেন্ট, সৃষ্টি কোচিং সেন্টারে যায় নিয়মিত। চশমা পরে, সবসময় কাঁচুমাচু মুখ করে থাকে, একেবারে মায়ের দুধের খোকা টাইপ। দু’জনেই আলোর কলিজা।

_ওর ভাই দুটোর উপরেও নজর রাখবি।

ফুহাদ বলে,”একটু মাথা ঠান্ডা কর। আংকেলের কথা মতো মান হানির মামলা দিয়ে দে। নিজে কেনো জড়াতে চাইছিস ব্যাপারটায়? একটা ব্লান্ডার হয়ে গেলে পার্টি তোকে নমিনেশন দেবে?

_ওসব পরে দেখবো, এখন আমি শুধু আর শুধু ওই মেয়েটার ভোগান্তি দেখতে চাই। এই বত্রিশ বছরের জীবনে আমার নিজের মা কখনো আমার গায়ে হাত তোলেনি আর ঐ মেয়েটা সবার সামনে দাঁড়িয়ে……!
আর কিছু বলে না ইয়াসার। রাগ,ক্ষোভ, প্রতিহিংসার মিশ্র অনুভূতি নিয়ে ফুঁসছে সে।

ফুয়াদের ফোনে একটা ফোন আসে, সে ফোনটা রিসিভ করে “হু হা” আওয়াজ করে উত্তর দিয়ে ফোন রেখে দেয়। ইয়াসারের দিকে তাকিয়ে বলে,”আতাউর আলমের জ্ঞান ফিরেছে গতকাল রাতে। স্ত্রী কন্যা এখন হসপিটালেই আছে। তার জমজ ছেলে দুটো কোথাও বেড়িয়েছে।”

_দুটোকে আমার কাছে ধরে নিয়ে আয়।
_এখন?
_হু।
_ওদের দিয়ে কি করবি? বাচ্চা ছেলে। খুবই শান্ত এবং মেধাবী দুটি ছেলে।

ইয়াসার চোখ গরম করে ফুয়াদের দিকে তাকায়। ফুয়াদ ঘাবড়ে গিয়ে বলে,”লোক পাঠাচ্ছি!”

ফুয়াদ উঠে চলে যায়। ফুয়াদ চলে যেতেই ইলহাম ঘরে ঢোকে। সামিন ইয়াসার মাথা না তুলে বলে,”ফুল এনেছিস?”
_হ্যা,আনিয়ে রেখেছি। কিন্তু কেনো? এখন ফুল দিয়ে কি করবে?

_সাংবাদিক আতাউর আলমের জ্ঞান ফিরেছে। কাউকে দিয়ে আমার নাম করে পাঠিয়ে দে। রাজনীতির মাঠে শত্রু হলেও আমরা তো উভয়ই দেশের সেবায় নিয়োজিত। একটু সহমর্মিতা প্রকাশ করা উচিৎ।

ইলহাম সামিনের কথা শুনে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। সামিন ইয়াসার মৃদু হেসে বলে,”ছোটো ফোন করেছিলো।”

_কি বললো?
_বারবার বলেছে কোনো ঝামেলা না করতে এটা নিয়ে।
_ও বরাবর ভীতু,ছেলেটার কিচ্ছু হবে না ভাইয়া। বাবা শুধু শুধু ওকে অপছন্দ করে না। বাবার তিন ছেলের মধ্যে বাবার কাছে ও সবচেয়ে বেশি অযোগ্য।

সামিন শুকনো হাসি হাসে। বাবা পছন্দ না করলেও সামিনের কাছে তার ছোট্ট ভাইটা তার কলিজা। ভাইয়ের জন্য জান দিতেও সর্বদা প্রস্তুত থাকে সে। অথচ এই ভাইটাই বুঝতে চায় না। অভিমানে তাদের থেকে কতটা দূরে সরে গিয়েছে।

লিভিং রুমে কান্নাকাটির আওয়াজ কানে যেতেই ইলহাম এবং সামিন ইয়াসার উঠে দাঁড়ায়। কাঁদছে ইলহামের পাঁচ বছর বয়সী ছেলে ইহান।‌ তার পাশে লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছে ইলহামের স্ত্রী রিতু। তাকে আটকানোর চেষ্টা করছে ইশিতা,সামিন ইয়াসারের একমাত্র ছোটো বোন। রিতুকে আটকানো যাচ্ছে না,সে ভীষণ ক্ষেপে গিয়েছে ইহানের উপর।

“হচ্ছে টা কি এখানে!”
গর্জে ওঠে ইলহাম। রিতু স্বামীর গলার আওয়াজ পেয়ে কিছুটা কেঁপে ওঠে।

ইলহাম লিভিং রুমের দিকে এগিয়ে যায়। তার পেছনে পেছনে যায় সামিন ইয়াসার। বড়বাবাকে দেখে ইহান দৌড়ে এসে তার কোলে উঠে যায়। সামিন ইয়াসারকে সে বড় বাবা বলে ডাকে। সামিন ইহানের চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে রিতুর দিকে চায়, কপাল কুঁচকে বলে,”ওকে মারছো কেনো রিতু?”

স্বামী আর ভাসুর দু’জনকে দেখে রিতুর আত্মারাম খাঁচাছাড়া অবস্থা। একটা ঢোক গিলে বলে,”ওর দাদার মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে সব টাকা ছিঁড়ে ফেলেছে, সবগুলো একহাজার টাকার নোট ছিলো ভাইয়া।”

ইলহাম রিতুর দিকে তেড়ে যায়,”তো? তোর বাপের টাকা ছিঁড়েছে ফকিন্নির বাচ্চা?”
রিতু ইশিতার পেছনে লুকায়। ইশিতা রিতুকে আগলে নিয়ে ইলহামকে বলে,”এখন তুমি সিনক্রিয়েট করো না ভাইয়া প্লিজ।”

সামিন ইয়াসার ঠান্ডা গলায় বলে,”টাকা ছিঁড়েছে বলে ওকে মারবে তুমি? কত টাকা ছিঁড়েছে? পাঁচ হাজার? দশ হাজার? ভবিষ্যতে আমার ভাইপোর গাঁয়ে হাত তুললে তোমাকে শাস্তি পেতে হবে রিতু। এখন যাও এখান থেকে, আমি ইহানকে নিয়ে বাগানে যাচ্ছি।”

তারপর ইহানের দিকে তাকিয়ে বলে,”চলো চাচ্চু। ফুটবল খেলবো আমরা।”

সামিন ইয়াসার ইহানকে নিয়ে চলে যায়। রিতু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। দু’চোখ বেয়ে দুফোঁটা তরল গড়িয়ে পড়েছে তার। ইলহাম গলার আওয়াজ নিচু করে বলে,”অনেকদিন গাঁয়ে মার পরেনি তাইনা? তাই এতো বাড় বেড়েছিস। তোকে আজ বোঝাবো।”

গটগট করতে করতে চলে যায় ইলহাম। ইশিতা করুণ দৃষ্টি দিয়ে তার মেজো ভাবীকে দেখে। কি সুন্দর পুতুলের মতো দেখতে ২৩ বছরের মেয়েটা। সতেরো বছরে বিয়ে,আঠেরো বছরে বাচ্চা। স্বামীর ভালোবাসা তো দূরে থাক কখনো তুই তোকারি ছাড়া কথাই বলে না মেজো ভাইয়া। এতো সুন্দর,নরম মনের একটা মেয়ের সাথে কেউ কিভাবে এতো অমানবিক আচরণ করতে পারে! ইশিতা রিতুর গায়ে হাত রেখে বলে,”ভাবী।”
রিতু কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,”তুমি খুব ভাগ্যবতী আপু। তোমার বাপ ভাইদের কত টাকা দেখেছো? পাঁচ হাজার,দশ হাজার টাকা ছিঁড়ে ফেললেও তাদের যায় আসে না। তুমি অনেক ভাগ্যবতী। তাদের টাকার অভাব নেই, তাই টাকার কষ্টে, মোটা টাকার মোহরানার বিনিময়ে তোমাকে তোমার বাপ ভাইয়েরা কোনো জানোয়ারের কাছে অন্তত বিয়ে দেবে না,আমার মতো অবস্থা হবে না তোমার। তুমি খুব ভাগ্যবতী আপু।

***
রেহেনা আক্তার মেয়ের দুই বাহু ঝাঁকিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে,”বল কেনো করলি এমনটা! বল।”

আলো চুপ করে আছে। রেহেনা কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলে,”তোর বাবার এই অবস্থা। মাথার উপর শক্ত কোনো হাত নেই। কেনো জড়াতে গেলি এই ঝামেলায়,বল আমায়। এর পরিণাম কতটা ভয়ংকর হতে পারে তুই জানিস? তোকে ওরা কি কি করতে পারে জানিস?”

_এতো কিছু জানার দরকার নেই আমার। চড় মেরেছি বেশ করেছি। ওকে জুতা দিয়ে মারা উচিৎ ছিলো।

রেহেনা মেয়ের কথা শুনে বলে,”তোর বাবার মাত্র জ্ঞান ফিরেছে। সে সুস্থ হয়ে যদি জানতে পারে তার মেয়ে এতো বড় একটা কান্ড ঘটিয়েছে কি হবে বুঝতে পারছিস?”
_বাবা আমাকে বাহবা দেবে।

রেহেনা আহত চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। আলো গিয়ে একটা চেয়ারে বসে পরে। আতাউর আলমের জ্ঞান ফিরেছে। যেটুকু স্বস্তি পাওয়ার কথা আলো তা পাচ্ছে না। সবাইকে না বুঝতে দিলেও ভেতরে ভেতরে সে খানিকটা ভয় পাচ্ছে। তবে তার নিজের জন্য না,আয়াত এবং আজানের জন্য। খুবই ভীত স্বভাবের ছেলে দুটো,ওরা বাইরের লোকজনকে ফেইস করবে কিভাবে! কিছুক্ষণ এসব কথা ভাবতে গিয়ে টের পায় তার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। এই দুদিনে মোটে এক-দু’ঘন্টার জন্য চোখের পাতা বন্ধ করেছিলো সে। ক্লান্তিতে তার পুরো শরীর ছেয়ে গিয়েছে। ফোনের রিংটোন বেজে উঠলে স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই তার ক্লান্তি চলে যায়। ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে কেউ একজন বলে ওঠে,”অদ্রিতা আলো।”
_শুনছি। বলো।
_কেনো করলে ওমন? একটু ঠান্ডা মাথায় থাকা যেতো না?
_বেশ করেছি ‌। আরো করবো। জানোয়ারের বংশধর একটা।

ওপাশের ব্যক্তি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,”তুমি তো নিশ্চিত না কাজটা যে সামিন ইয়াসারের লোকই করেছে। কেনো সন্দেহের বশে অহেতুক ঝামেলায় জরালে? যতটুকু তাদের সম্পর্কে জানি তাতে মনে হয়না তারা কাজটা করবে।”

আলো একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,”কি বলো তো ইশমাম? তোমাকে সবসময় দেখেছি তুমি ওই মির্জা বাড়ির লোকজন আর ওদের পার্টিকে সাপোর্ট করে কথা বলো। একটা কথা বলো তো,তুমি কি ওই দলের ছেলে নাকি? ওদের পার্টির সমর্থক?”

ইশমাম ফোনের ওপাশে বসে একটা মৃদু হাসি দিয়ে বলে,”কি যে বলো না অদ্রিতা, আমি বিদেশে থেকে দেশীয় পলিটিক্স করবো?”

আলো কিছু বলে না। ইশমাম বলে,”আচ্ছা ঠিকাছে। সামিন ইয়াসার এবং তার চৌদ্দ গুষ্টি খারাপ,খুউউব খারাপ। খুশি?
আমার তোমার জন্য চিন্তা হচ্ছে অদ্রিতা। আর ওই সামিন ইয়াসারের সাথে লাগতে যেও না। আংকেলের এই অবস্থা! তুমি প্লিজ সেইফ থাকো। পরিবারের জন্য সেইফ থাকো,আমার জন্য সেইফ থাকো!”

শেষের কথাটা শুনে আলো পুলকিত হয়। শুকনো মুখে হাসির রেখা ফোটে। ইশমাম ওপাশ থেকে বলে,”লাভ ইউ!”
আলো অস্ফুট স্বরে জবাব দেয়,
_মি টু।

“আপু বাবা চোখ খুলে তাকিয়েছে। দেখবে না?”

আজানের কথায় আলো ফোন রেখে এক লাফে উঠে দাঁড়ায়। দৌড়ে গিয়ে দরজা ঠেলে আতাউর আলমের কেবিনে ঢুকে পরে। আতাউর আলমের মাথার কাছে রেহেনা বসে আছে। স্বামীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে তিনি। আলো ধীরপায়ে হেটে গিয়ে গিয়ে আতাউর আলমের পায়ের কাছে দাড়ায়। আতাউর আলম তার আদরের বড় মেয়ের মুখের দিকে পিটপিট করে তাকিয়ে আছে। মুখে খানিকটা চেষ্টা করলো হাসি ফুটিয়ে তুলতে কিন্তু সে ব্যর্থ হলো। তীব্র যন্ত্রনায় শরীরটা বিষিয়ে উঠেছে। আলো মৃদু স্বরে বলে,”খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না আব্বু!”

_না আম্মু। একটুও ব্যথা করছে না।
_ওই লোকটাকে আমি উচিত শিক্ষা দিয়েছি আব্বু।
আতাউর আলম মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,”কাকে?”
_সামিন ইয়াসার মির্জাকে। ওর অকাদ বুঝিয়ে দিয়েছি। ও এখন হারে হারে টের পাচ্ছে।

আতাউর আলম কিছু বুঝতে পারছে না।

আলো ম্লান হেসে বেডে বসে বাবার হাতটা টেনে নিজের কোলের উপর রাখে। আতাউর মেয়েকে দেখতে থাকে,মুখ শুকিয়ে কি হাল হয়েছে মেয়েটার! আলো বলতে থাকে,”তুমি খুব শিগগিরই সেরে উঠবে আব্বু। তারপর ইলেকশনে লড়বে। দেখি কে তোমাকে আটকায়।”

রেহেনা আতংকিত হয়ে বলে,”পাগল হয়েছিস তুই? কিসব উল্টো পাল্টা বকছিস এই সময়ে।”

_আহা। ওকে বকছো কেনো? ঠিকই তো বলেছে। আমি এতো সহজে হার মেনে নিয়ে বসে থাকবো নাকি!

অত্যন্ত ক্ষীণ কন্ঠে বলে আতাউর আলম। রেহেনা স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে অভিমানী সুরে বলে ওঠে,”ক্রাইম রিপোর্টারের স্ত্রী হয়ে পাপ করেছি পাপ। প্রতিনিয়ত সন্তানদের বিপদের কথা,স্বামীর বিপদের কথা ভেবে ভয়ে তটস্থ হয়ে থেকেছি। শেষ বয়সে এসে রিপোর্টারের পেশা ছেড়ে এখন রাজনীতির ভুত মাথায় চেপেছে তাইনা? দেখলে তো ফল কি হলো? একটুর জন্য তোমার স্ত্রী বিধবা, তোমার মা সন্তান হারা আর তোমার তিন ছেলেমেয়ে এতিম হয়নি। আর যদি কখনো এসবে জরিয়েছো তাহলে আমি কিন্তু এই সংসার ছেড়ে চলে……”

“ম্যাম পেশেন্টের সাথে কেউ দেখা করতে এসেছে।”

নার্সের কথায় আলো মাথা ঘুরিয়ে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকায়। কে দেখা করতে আসবে এখন!

রেহেনা বলে,”কে এসেছে?”

“আমরা।”
অচেনা পুরুষালি গলার আওয়াজ পেয়ে রেহেনা মাথায় ঘোমটা তুলে দেয়‌। আলো উঠে দাঁড়িয়ে যায়। পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢোকে দুজন ছেলে। আলো হতভম্ব হয়ে চোখ কপালে তুলে ঘনঘন নিশ্বাস ফেলতে থাকে। এই দুজনের একজনকে সে চেনে। জামিল নাম লোকটার,সামিন ইয়াসারের ডানহাত। লোকটার হাতে একটা ফুলের তোড়া। আলো রেগেমেগে বলে,”আপনারা!”

জামিল ফুলের তোড়াটা আতাউর আলমের বেডের উপর রেখে বলে,”ইয়াসার ভাই পাঠিয়েছে। আপনার বাবা জলদি জলদি সুস্থ হয়ে যাক,এই কামনা করে সে।”

আলো একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে ফুলের তোড়াটা ঠেলে মেঝেতে ফেলে দিয়ে পা দিয়ে কুচলে দেয়। তারপর গম্ভীর কন্ঠে বলে,”বেড়িয়ে যান। আর আপনার ইয়াসার ভাইকে বলে দিবেন এসব নাটক আমাদের সাথে না করে জনগণের সামনে গিয়ে করতে, দুয়েকটা ভোট পেলেও পেতে পারে।”

জামিল শীতল চোখে একবার আলো আর একবার মেঝেতে পরে থাকা ফুলের তোড়া টার দিকে তাকায়। তারপর কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়।
আলো মাথা ঘুরিয়ে বাবাকে দেখে, তারপর নিচু গলায় বলে,”তেলাপোকা কতগুলো!”

আতাউর আলম মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,”আমার বাঘের বাচ্চা।”

আলো বাবার মাথার কাছে বসে পরে, বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে মৃদু হেসে বলে,”হুম,আর তুমি বাঘ!”

_তা তোমার মেনি বিড়াল ভাই দু’টো কোথায় গিয়েছে?

_ওদের কোচিং-এ পাঠিয়ে দিয়েছি আব্বু। বেশ কয়েকদিন ধরে যায়নি।
_ভালো করেছিস।

বাপ-বেটিতে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। আলোর ফোনের রিংটোন বেজে উঠতেই আলো সেদিকে তাকায়। আজানের ফোন, আলো রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে কান্না মিশ্রিত কন্ঠে আজান বলে ওঠে,”আপু।”

চলমান…….