#বিনিদ্র_রজনী
#পর্ব_৬
#মুমতাহিনা_তারিন
তুলি আজকে ভীষণ খুশি বিয়ের এতদিন পর প্রথমবার আদনান নিজে থেকে কিছু ওকে এনে দিয়েছে।আদনান কফি ক্যালারের একটা শাড়ি এনেছে তার সাথে ম্যাচিং চুড়ি লিপস্টিক । ঘুরছে ফিরছে আর শাড়ী চুড়ি নেড়ে নেড়ে দেখছে তুলি । রাহেলা বানুর মুখেও হাসি লেগে আছে । মেয়েটাকে এতদিন পরে কত খুশি লাগছে । যদি ও তুলি সবসময় হাসি খুশি থাকা মানুষ । হাজার কষ্ট বুকে চেপে রেখেও হাসতে পারার অসীম ক্ষমতা আছে তুলির তাও আজকে যে আনন্দ তার চোঁখে মুখে উপচে পড়ছে তাতে কোনো খাদ নেই।
” দেখলে খালা আমি বলতাম না আদনান ঠিক আমাকে ভালোবাসবে । আমার আম্মু আমাকে বলেছিল ভালোবাসা দিলে ভালোবাসা পাওয়া যায় সেটা দেরি হলেও । ধীরে ধীরে আমাকে মনের কোণে ঠিক ঠাই দেবে দেখো ”
আলু ভর্তা করতে করতে বললো তুলি । পাশে বেগুন ভাজি করছে রাহেলা। তুলির কথায় তৃপ্তির হাসি দিল । তুলির মতোই তো রাহেলার একটা মেয়ে আছে নাম নিতু। তুলিকে হাসি খুশি দেখলে মনে হয় নিতু হাসছে । নিজের মধ্যে একটা আলাদা প্রশান্তি অনুভব করে রাহেলা।
” আমি তো জানতাম তুই সফল হবি । আল্লাহর কাছে এতো চাস আল্লাহ না দিয়ে যাবে কই! স্বামীর ভালবাসা পাওয়া তো প্রতিটা স্ত্রীর অধিকার ।সেখানে তুই আদনানকে কত ভালবাসিস”
” ধুর খালা লজ্জা দিচ্ছ কেন?”
” আর লজ্জা পেতে হবে না তোর ”
তাদের এই মিষ্টি কথোকথনের মধ্যেই বাসার কলিং বেল বেজে উঠলো । এখন আদনান ,তুলি আর রাহেলা একটা তিন রুমের ফ্ল্যাটে থাকে । আদনাননের চাকরির সুবাদে তারা নারায়ণগঞ্জ এ থাকছে । প্রথমে লিতুন বেগম তুলিকে আদনানের সাথে পাঠাতে রাজি না হলেও স্বামীর কথায় রাজি হয়। আরো যতই লিতুন তুলিকে না মানুক কিন্তু আদনানের খেয়াল রাখার বিষয়টা কখনো অস্বীকার করতে পারবে না । ঐখানে গিয়ে কেমন খাবে থাকবে সেই দুশ্চিন্তা থেকেই তুলিকে পাঠাতে রাজি হয়েছিল লিতুন। কিন্তু সাথে পাঠালেন রাহেলাকে ।
দরজা খুলতেই ভেসে উঠলো হাস্যজ্জ্বল দুটো মুখ । অরোরা আর শিউলী এসেছে । তাদের দুজনকে দেখে তুলি আরো খুশি হয়ে গেলো সোফায় বসিয়ে রেখে রান্নাঘরে গিয়ে শিউলির জন্য চা আর অরোরার জন্য কফী বানিয়ে গল্পঃ করায় ব্যাস্ত হয়ে গেলো । তুলি আদনানের দেওয়া শাড়ী চুড়ি শিউলী আর অরোরা কে খুশি মনেই দেখাতে লাগলো ।
” আজকে সন্ধায় আমরা সবাই ঘুরতে যাবো সেখানে তোমাকে ও নিয়ে যাবে আদনান তাই এতো কিছু কিনে দিয়েছে”
” সত্যি আপু আমি অনেকদিন বাইরে যায় না । আমাকে শহরটা দেখাবে”
” হ্যা হ্যা কেনো নয়”
শিউলির কথাতে অরোরাও মাথা দোলালো । দেখতে দেখতে বিকেল হয়ে গেছে অরোরা আর শিউলী তুলিকে সাজাচ্ছে । শরীরের রংটা চাপা হলেও তুলির গোলগাল চেহারার সাথে খুব সুন্দর লাগছে শাড়িটা । হাত ভর্তি চুড়ি ঠোঁটে হালকা কফি শেডের লিপস্টিক । চোঁখে কাজল।হাজার চেষ্টা করেও অরোরা আর শিউলী তুলিকে ভারী মেক আপ করাতে পারলো না ।
সন্ধ্যা হতেই আদনান গাড়ি নিয়ে হাজির ।তুলি খুশিতে আত্মহারা ঘরের জানালা দিয়ে দেখা শহরটা আজকে দেখতে পারবে । সামনে বসেছে শিউলী আর অরোরা আর পিছনে আদনান আর তুলি । আদনান ড্রাইভ করতে চাইলেও অরোরা করতে দেইনি । তুলিকে অন্যরূপে দেখে প্রথম থমকে গিয়েছিল আদনান । মায়া জড়ানো মুখটায় হাসি আর লজ্জার আভা! কি অসাধারণ লাগছে। গাড়ির জানালা দিয়ে উৎসুক চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে তুলি । শহরজুড়ে যেনো আলোর মিছিল নেমেছে । রাস্তা জুড়ে নিয়ন আলো কত মানুষ কত উদ্দেশ্য নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে । এমন রাস্তায় একদিন আদনান আর তুলি ও হাত ধরে হাঁটবে ভেবে মুখে লেগে থাকা হাসিটা চওড়া হলো । মুখ ঘুরিয়ে আদনানের মুখটা দেখে নিল ।
গানের মৃদু ধ্বনি ঘর জুড়ে । অনেক মানুষের সমাগমে কেমন অস্বস্তি লাগছে তুলির ।কিন্তু আদনান অরোরা সাভাবিক। আদনানের বন্ধুদের মধ্যে কেউ একজন পার্টিটা অ্যারেঞ্জ করেছে । তুলির নামটা ঠিক মনে নেই । । শিউলী পাশে বসে বিভিন্ন কথা বলছে তুলিকে তুলি হাসছে গল্পঃ করছে । অরোরা আর আদনান সবার জন্য কোল্ড ড্রিংকস আনলো।
” আপু আমি খাবো না আসলে বিকেলে খেলাম তো আর খেতে মন চাচ্ছে না ”
অরোরা তুলিকে একপ্রকার জোর করেই কোল্ড ড্রিংকস খাওয়ালো । আদনান বন্ধুদের সাথে গল্পে ব্যাস্ত এদিকে কি হচ্ছে না হচ্ছে তাতে কোনো হুশ নেই । কিছুক্ষণ পরে তুলির শরীর খারাপ হতে শুরু করলো । মাথা ভার হয়ে আসছে ।
” শিউলী আপু আমার খুব খারাপ লাগছে উনাকে ডেকে দেন আমি বাসায় যাবো ”
” কিছু হবে না তুলি একটু বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে ।”
” না আপু আমার মাথা ব্যাথা করছে খুব ”
শিউলি একবার অরোরার দিকে তাকালো । চোখের ইশারায় অরোরা শিউলীকে চুপ থাকতে বললো।
” তুলি এইখানে একটা বেডরুম আছে তুমি ঐখানে চল একটু রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবে তাই না শিউলী ‘
” হ্যাঁ”
তুলি অরোরার কথায় সম্মতি দিল। সাদা চাদরে ঢাকা বিছানায় শুয়ে আছে তুলি চুলের খোঁপা খুলে দিয়েছে অরোরা । খোঁপায় থাকা গোলাপ গুলো ফ্লোরে পরে আছে। ঘন দীঘল চুলগুলো এলোমেলো।
তুলির বুকে থাকা আঁচল এক টানে খুলে ফেললো অরোরা । যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে হাতে বেশি সময় নেই । বেশিক্ষণ ওদের না দেখলে আদনান খোঁজাখুঁজি শুরু করবে । শিউলির মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে ।
” অরু আমরা ঠিক করছি তো! আমার কেমন লাগছে ”
” চুপ কর তুই এখন উল্টো পাল্টা কিছু বলবি না । যা হওয়ার হবে আমি তোর বেস্ট ফ্রেন্ড না ? তোর কাছে কোনটা বেশী ইম্পর্টেন্ট বেস্ট ফ্রেন্ড নাকি তুলি?”
শিউলি একবার তুলির মুখের দিকে তাকালো । কি নিষ্পাপ লাগছে তুলিকে ! কত সহজে বিশ্বাস করেছিল ওদের কিন্তু তার প্রতিদানে তারা তুলির সব থেকে বড় ক্ষতিটা করছে । আরেকবার অরোরার মুখের দিকে তাকালো শিউলী । অরোরার শিউলির বেস্ট ফ্রেন্ড কত খারাপ সময়ে অরোরা পাশে ছিল । নিজের সকল দ্বিধা ভেঙে বিশ্বাসঘাতকতার পথটাই বেছে নিল শিউলী।
আকাশে থালার মত চাঁদটা জোছনার আলো ছড়াচ্ছে শহরজুড়ে। প্রবাহিত বাতাসে ভেসে আসা এক ঝাঁক কালো মেঘ ঢেকে ফেললো চাঁদকে ।
ঘরে প্রবেশ করল দীর্ঘকায় এক ব্যক্তি । অরোরার সাথে কিছু কথা বললো । শিউলি ঘরে রাখা সিঙ্গেল সোফায় বসে আছে । নিজের ভিতরের অপরাধ বোধটা খুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে শিউলীকে । অরোরা শিউলীকে ডাক দিয়ে পরিচয় করিয়ে দিল লোকটার সাথে তার নাম সুমন । আলাপ শেষে সুমনের সাথে তুলির কিছু অশ্লীল ছবি তুললো অরোরা ।
এখন রাত দশটা গাড়িতে আদনানের কাধে মাথা রেখে শুয়ে আছে তুলি । অগোছালো চুল গুলো বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে জ্বালিয়ে যাচ্ছে আদনানকে । সামনে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে বসে আছে শিউলী । অরোরা নিজের স্বাভাবিকতা বজায় রেখে গাড়ি ড্রাইভ করছে ।
সুমন চলে যাওয়ার দুমিনিট পরেই আদনান ওদের খুঁজতে খুঁজতে ঘরে আসে । তুলির কি হয়েছে জানতে চাইলে অরোরা নানা কথা বলে আদনানের কথাটা এড়িয়ে যায় । কেনো না এতক্ষন সুস্থ থাকা মানুষ হুট করে অজ্ঞান হয়ে যাওয়াটা খুব অস্বাভাবিক । আদনান অতোটা মাথা ঘামায়নি ।
গাড়ির ঝাঁকুনিতে দুলছে তুলি । আদনান তাই শক্ত করে ধরে বসলো ওকে । মিরোরে সব কিছু আড় চোখে খেয়াল করছিল অরোরা নিজের মনে মনে ধরে রাখলো ওই বুকে তার মাথা থাকবে কিছুদিন পর ।
তুলির সাথে এমনটা করতে চাইনি অরোরা। নিজের ছোটো বেলার ভালোবাসাকে অন্যের কাছে দেখলে যে জ্বলন অনুভব হয় সেটা কিছুতেই সহ্য করতে পারছিল না অরোরা । তবুও নিজের মনকে অনেক বুঝিয়েছিল এখন সব কিছু হাতের বাইরে চলে গেছে । কিন্তু যখন দেখলো আদনান বিয়েতে সুখি না তখন যেনো আকাশের চাঁদ পেয়ে গেলো হাতের কাছে । নিজের ভালোবাসা পূর্ণতা দেওয়ার লোভে তুলি কেনো এমন হাজার তুলিকে সরাতে পারবে অরোরা।
অরোরা একটা ফার্মে চাকরী করে তাই ঢাকায় থাকা হয় না তেমন । নিজের বদলির জন্য অনেক গায় গুই করে শেষমেশ ঢাকতে আসতে পেরেছিল । ভেবেছিল নিজের মনের কথা সব বলে দেবে আদনানকে কিন্তু তার আগেই আদনানের দাদি তুলির সাথে আদনানের বিয়ে দিয়ে দিলেন । আদনাননের পরিবারের কেউ রাজি ছিলো না বিয়েতে কিন্তু নিজের মা কে কখনো যত্ন করেনি আদনানের বাবা শেষ বয়সে যখন তার মধ্যে মরণব্যাধি দেখা দিল । শেখ সাহেবের হাতে হাত রেখে রুকু নিজের শেষ ইচ্ছা হিসেবে তুলির সাথে আদনানের বিয়ের কথাটা তুললেন । তুলির পরিবার অনেক খেয়াল রাখতো আদনানের দাদীর । তাই অনিচ্ছা সত্বেও সব কিছু মেনে নিতে হয়েছিল সবাইকে । আদনান ও দাদীর খুশির জন্য খুশি থাকার অভিনয় করে বিয়েটা করে নিল ।
বিয়ের এক বছরের মাথায় দাদি মারা গেলো আর সব কিছু বদলে গেলো । উপর উপর দিয়ে ভালোবাসা দেখালেও সবার আসল রূপ প্রকাশ পেতে শুরু করলো । কিন্তু তুলি সংসারটা আকড়ে ধরে থাকতে চেয়েছিল হোক সেটা আদনানকে ভালোবাসার জন্য অথবা নিজের মায়ের কাছে বোঝা না থাকতে চাওয়ার কারণে ।
আদনানের পোস্টিং নারায়ণগঞ্জ হওয়ায় অরোরার জন্য খুব কষ্টকর ছিল আদনান আর তুলির সাথে দেখা করা। শহরে থেকেই অরোরা মোক্ষম সময়ের অপেক্ষা করছিল। ঘটনার তিন চারমাস কেটে যাওয়ার জন্য শিউলী ভেবেছিল অরোরা হয়তো কিছু করবে না ।কিন্তু যখন তুলির প্রেগন্যান্সি সম্পর্কে জানতে পারলো বিনা বাক্যব্যায়ে ঢাকায় আদনানের বাসায় চলে আসলো ।আর যা ঘটানোর ঘটিয়ে ফেললো ।
এতক্ষন রাস্তার পাশে থাকা ফুটপাতে বসে রোহান সব হিসাব মিলাচ্ছিল।অনেক চেষ্টা করে ও তুলির কোনো খোঁজ পায়নি । তুলির ভাবির কাছে কল দিয়েছিল রিনা বলেছে সেখানে তুলি যায়নি । তুলিকে নিজের ছোটো বোনের মতো দেখতো রোহান । কত শখ ছিল একটা ছোটো বোনের যা তুলির কাছ থেকে পাওয়া সম্মান শ্রদ্ধা বড় ভাই হওয়ার স্বাদ দিত। আল্লাহর কাছে মনে মনে একটা দোয়ায় করতে থাকলো রোহান যাতে তুলি ভালো থাকে যেখানেই থাকুক!
__________________________
আদনান ঘরের জানালা দিয়ে রাস্তার অন্য পাশে তাকিয়ে আছে । প্রতি শুক্রবার নাকি এইখানে একটা দম্পত্তি আসে ফুচকা খেতে । তুলি প্রতি শুক্রবার সেই দম্পতি আসার অপেক্ষায় থাকতো ভালোবাসা দেখতেও নাকি ভালো লাগে । তুলির চলে যাওয়ার এক সপ্তাহ পর হয়ে গেছে । তুলি যাওয়ার পরের দিন যেমন অনুভূতি আদনানের হয়ে ছিল এখন ও তেমন অনুভূতি হচ্ছে । মাঝে মাঝে আদনানের মনে হয় ও পাগল হয়ে যাচ্ছে দিন কে দিন । যেখানে যাই সেখানেই তুলির স্মৃতি তাড়া করে বেড়ায় । এক রত্তি শান্তি নেই কোথাও।
চলবে,,,,,