বিয়ে পর্ব-২৯

0
677

#বিয়ে
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২৯

ধ্রুব জিজ্ঞেস করে,
— কাকে চাই?
ওপাশ থেকে ছেলেকন্ঠটি বলে,
— মিস্টার ধ্রুবকে।
— বলুন…
ওপাশ থেকে কয়েক সেকেন্ড বিরতি নেয়। এরপর দৃঢ় স্বরে বলে,
— আমি অদ্রির ব্যাপারে আপনার সাথে কিছু বলতে চাই। আসলে বুঝতে পারছিনা আপনি ব্যাপারটা কিভাবে নেবেন….
ধ্রুব থমকে গেলো। এই অচেনা লোক অদ্রির ব্যাপারে কি বলতে চায়? তাও এত রাতে? আর অদ্রির সাথে এই লোকের পরিচয় কিভাবে? ধ্রুব হালকা কেশে বলল,
— ঠিক কি ব্যাপারে আপনি কথা বলতে চাইছেন?
ওপাশ থেকে ইতস্তত কন্ঠে বলে,
— আপনারা বোন অদ্রিকে নিয়ে।
ধ্রুব বিস্ময়ের চূড়ান্ত সীমানায় পৌঁছে যায়। ছেলেটা কি ওর সাথে মজা করছে নাকি? অদ্রির ভাই? ধ্রুব’র গলায় কথা আটকে আসে। ভ্রু আপনাআপনি কুঁচকে যায়। বলে,
— অদ্রি আমার বোন হয়?
ওপাশ থেকে আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলে,
— আমি তো সেটাই জানি। সেজন্যই আমি কথাগুলো আপনাকে বলতে চাচ্ছি। আপনি আমাকে তুমি করে বলুন। আমি বয়সে আপনার অনেক ছোট। যদিও আমার একটু ভয় হচ্ছে…
ধ্রুব তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,
— ভনিতা না করে বলুন…
ওপাশ থেকে পিনপতন নীরবতা টের পেলো ধ্রুব। ওর মনে হলো ছেলেটা দম নিচ্ছে। কি এমন বলবে যে ছেলেটা এমন নার্ভাস হয়ে পড়ছে বারবার? ধ্রুব ভাবনার মাঝখানেই সেই ছেলের গলা আবার শুনতে পেলো,
— আমি অদ্রিকে ভালোবাসি স্যার। ওকে আমি আমার জীবনসঙ্গী হিসেবে চাই। আপনি হয়তো আমার কথা শুনে খুব রেগে যাবেন। তবুও বলছি, আমি ওকে আমার সর্বস্ব দিয়ে প্রতিটি মুহূর্তে চাই। বাকিটা জীবন ওর হাতে হাত রেখে বুড়ো হতে চাই। আমি চাই ওর সাথে ভোর হওয়া, সন্ধ্যা নামা দেখতে। কথা দিচ্ছি, ওকে ভালোবাসায় একবিন্দু খাদ পাবেন না আপনি….

একটানা কথাগুলো বলে ছেলেটা থামলো। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলো। যেন সে কোনো যুদ্ধ জিতে ক্লান্ত। এদিকে ধ্রুব হতবিহ্বল, বিস্ময় নিয়ে ফোনটা কানে ধরে রেখেছে। কথাগুলো ওর বোধগম্য হচ্ছে না। মস্তিষ্কে অবধি পৌঁছাতে বেশ সময় নিলো। আস্তেধীরে ওর চেহারায় নেমে আসে কঠোরতা। ওর বউকে ভালোবাসার জন্য, বিয়ে করার জন্য ওর থেকেই পারমিশন চাইছে ছেলেটা? যে মেয়ের জন্য ধ্রুব’র চিন্তা-চেতনা, ওর জীবনটা পুরোপুরি পালটে গেছে, যার মুখ দেখে প্রতিটি রাত নির্ঘুম কাটিয়ে দিতে পারে, যার কঠোরতার মাঝে ভালোবাসা খুঁজে নেয় ; তাকে অন্য কেউ এত আকুলভাবে চাইছে স্বয়ং ধ্রুবর কাছে? ধ্রুব বাস্তবে ফিরে এলো। একটু ক্ষণ সময় নিয়ে প্রশ্ন করলো,
— আমি তোমার সাহস দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি। এতোটা দুঃসাহস দেখানোর সাহস পেলে কোথায়?
ওপাশ থেকে উত্তর এলো,
— ভালোবাসায় ভয় বলতে কোনো শব্দ নেই স্যার। এটা এক যুদ্ধের ময়দান। সেখানে দুঃসাহস না দেখালে চলবে কেমন করে? প্রয়োজন বোধে কেড়ে নিতেও জানতে হয়। তবে আমার ভাবনাতে এমন কোনো চিন্তা নেই। আমি অদ্রির প্রতি লয়্যাল বলেই সরাসরি আপনাকে প্রস্তাবটা দিচ্ছি, আপনার পরিবার যদি সবটা মেনে নেয়, তাহলে আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকবো…
ধ্রুব কাঠ কাঠ গলায় বলল,
— আর যদি না মানি?
— তবে আমার কিছুই করার থাকবে না। অদ্রির চাওয়ার ওপর সব ডিপেন্ডে করবে। ও বললে দূরে কোথাও পালিয়ে যেতে পারি।
ধ্রুব এবার জোরে চেঁচিয়ে ওঠলো,
— এই দু:সাহস দেখালে ফল ভালো হবে না।
— আচ্ছা আপনি কি চান না অদ্রি ভালো থাকুক?
ধ্রুব দৃঢ় কন্ঠে বলল,
— অবশ্যই, কিন্তু আমার থেকে দূরে গিয়ে না…
ওপাশ থেকে অবাক সুরে বলল,
— মানে?
ধ্রুব শক্ত গলায় বলল,
— কে তুমি? নিজের নাম-পরিচয় দাও সাহস থাকলে।
— হুমকি দিচ্ছেন নাকি আপনি? লাভ নেই, আমি ভয় পাই না।
ধ্রুব চেঁচিয়ে ওঠলো। বলল,
— অদ্রির থেকে দূরে থাকো। ভালো হবে না…

বলে ফোন কেটে দিলো। ওর মাথা গরম হয়ে আছে। হাতের ফোনটাকে দুমড়েমুচড়ে ফেলতে ইচ্ছে করলো। ছেলেটা নিজের অনুভূতি নিয়ে কতটুকু কনফিডেন্ট সেটা ওর কথাবার্তায় বোঝা যাচ্ছে। ধ্রুব’র সবকিছু ধ্বংস করে দিতে ইচ্ছে করছে। ওর হার্টবিট দ্রুতগতিতে ছুটছে। কপাল ঘেমে আছে। সবকিছু অসহ্য, অসহনীয় লাগছে।

গত রাত থেকে ধ্রুব অদ্রির সাথে ভালোভাবে কথা বলছে না। কেমন এড়িয়ে এড়িয়ে চলছে। অদ্রি তখন ব্যাপারটা ধরতে পারেনি। কিন্তু পরদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যখন ধ্রুব ওর সাথে স্বাভাবিকভাবে কথাবার্তা বলছিলো না তখন একটু খটকা লাগলো ওর। প্রশ্ন করলে শুধু “হ্যাঁ, না” তে উত্তর দিচ্ছিলো। মুখে কোনো হাসির রেশ দেখতে পেলো না অদ্রি। ও প্রথমে একটু অবাক হলো ওর এমন আচরণে। ভাবলো শরীর ভালো নেই সেজন্য এমন করছে। সেজন্য আর ঘাঁটালো না ওকে। তবে গ্রামে এসে অদ্রি সবকিছু খুব খুশি মনে উপভোগ করছে। মিহিরদের সাথে গ্রামের এদিকওদিক সকলে মিলে ঘুরতেও বেড়িয়েছে। বিকেলের দিকে ঠিক হলো সকলে মিলে নৌকা করে বিল দেখতে যাবে। সবাইর কথা শুনে শায়লা অদ্রিকে পাঠালো ধ্রুব’কে রাজি করানোর জন্য। অদ্রি অস্বস্তি নিয়ে গেলো ঠিকই ধ্রুবকে রাজি করানোর জন্য৷ কিন্তু উল্টো ওকে ঘরে ঢুকতে দেখে ধ্রুব রাগ দেখিয়ে কোথায় যেন চলে গেলো। যাওয়ার আগে তাচ্ছিল্য করলো অদ্রিকে, ওর বউ বউ আচরণের জন্য। অদ্রির ভীষণ মন খারাপ হলো ওর কথায়, চোখ টলমল করতে লাগলো। ধ্রুব এর আগে কোনোদিনও এই টোনে কথা বলেনি অদ্রির সাথে। ও ঘরেই বসে রইলো, গেলো না কোথাও!

পরদিন! রোদের তির্যক রশ্মি লুকোচুরি খেলছে ঘরের কোণে, ঘুমন্ত অদ্রির চোখেমুখে। আড়মোড়া ভেঙে অদ্রি বিছানায় ওঠে বসলো। রাতে ওর মোটেও ভালো ঘুম হয়নি। বিষন্ন হয়ে আছে মন মস্তিষ্ক। পাশে ঘুমিয়ে থাকা ধ্রুব’র দিকে চোখ পড়তেই ওর মন আরও ভার হয়ে গেলো। লোকটা ওর সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে না, ওর হাতের কোনোকিছু খাচ্ছে না।৷ এককথায় ধ্রুব’র যে স্বভাব গুলোর সাথে অদ্রি অভ্যস্ত হয়ে গেছে সেসব কিছুই করছে না বলে অদ্রির ভালো লাগছে না। এই এড়িয়ে চলা ব্যবহারে ওর বুকের ভেতর রক্তক্ষরণ হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

আজ আদিবার গায়ে হলুদ। সকাল থেকেই বাড়িতে নানা আয়োজনের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে।
বাড়ির ড্রয়িং রুমেই ঘরোয়া আয়োজন, সেখানে কোনো ভিডিয়ো করা হবে না। ঐশী সাজগোজ করাতে বেশ পটু, সে আদিবাকে বেশ সুন্দর করে সাজিয়ে দিলো।
বাড়ির অন্যান্য মেয়েরা শাড়ি পরবে, ফ্লোরাও। সে শাড়ি পরার জন্য বেশ উত্তেজিত হয়ে ঘরময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু অদ্রি শাড়ি ঠিক করলো ও শাড়ি পরবে না। ফ্লোরা যখন শুনলো এটা তখন সে বেশ মন খারাপ করলো।একপর্যায়ে সবাই অদ্রিকে জোরাজুরি করতে লাগলো। অগত্যা বাধ্য হয়েই অদ্রিকে শাড়ি পরতে হলো। ঐশী ওকে লাইট হলুদ কালারের একটা শাড়ি পরিয়ে দিলো।
এরপর সুন্দর করে সাজিয়ে দিলো। কাঁচা ফুলের গয়না, খোলা চুলে ওকে দারুণ দেখাচ্ছিলো। অদ্রির শাড়ি পরার কোনো পরিকল্পনা ছিলো না। সুন্দর ফুলের কাজ করা একটা জামা পরতে চাইছিলো। কিন্তু শাড়ি, কাঁচা ফুলের গয়না, খোলা চুলে ওকে দারুণ দেখাচ্ছিলো। ফ্লোরা তো সেলফি নিতেই ব্যস্ত৷ সে অদ্রির বেশ কয়েকটা ছবি তুলে ধ্রুব’র হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দিলো।

ধ্রুব ঘর অন্ধকার করে বসে আছে। চোখমুখ কঠিন। সেদিন রাতে আসা উড়ো ফোনটা ওর মন ভেঙে দিয়েছে। অদ্রি! মেয়েটার সবকিছু তো ও মেনে নিয়েছে। ওর রাগ, জেদ সবকিছু। তাহলে কেন সে ধ্রুবকে নিজের লাইফ পার্টনার হিসেবে বাইরে কোথাও পরিচয় করিয়ে দেয় নি? ওর কি এখানেও সমস্যা? ধ্রুব ভেবে পায় না। বাইরের মানুষ এখন ধ্রুবকে এসে ফোন দেয়, ওর কাছে অদ্রিকে ভালোবাসার, বিয়ে করার পারমিশন চায়। ধ্রুব’র ব্যক্তিত্বে আঘাত করার জন্য এতদূর যাওয়ার কি প্রয়োজন ছিলো অদ্রির? রাগে ধ্রুব’র মুখ রক্তিমবর্ণ ধারণ করে। ও জানালায় দাঁড়িয়ে বাড়ির উঠোনে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। বিয়ে বাড়ির আমেজের ভেতর ধ্রুব’র দম বন্ধ হয়ে আসছে। ঠিক তখনি ওর ফোনে টুংটাং শব্দ হলো। ফোনটা হাতে নিতেই দেখতে পেলো ফ্লোরা অদ্রির কিছু ছবি পাঠিয়েছে। ধ্রুব’র ইচ্ছে করলো না সেসব দেখতে।
অদ্রির প্রতি ক্ষোভে ও জ্বলেপুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছিলো প্রতিনিয়ত!

[দুঃখিত, দুঃখিত। টেকনিক্যাল সমস্যার জন্য দিতে দেরি হলো। ভুলভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ]

চলবে….