#বিয়ে
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব- ৪১
ধ্রুব জিজ্ঞেস করলো,
— এভাবে বসে আছো যে? কি হয়েছে?
— কিছু না।
— উহু, কিছু তো একটা হয়েছে।
শায়লা ধীর স্বরে বললেন,
— কিচ্ছু হয়নি।
ধ্রুব’র ভ্রু কুঁচকে আসে,
— তাহলে তোমাকে এরকম দেখাচ্ছে কেন? তুমি কি আমাকে মিথ্যা বলছো? বলো আমাকে…
শায়লা ম্লানমুখে তাকান ছেলের দিকে। ওর উদ্বিগ্নতা টের পান। মাকে সে বরাবরই ভালোবাসে। মায়ের কথা শুনে৷ রাগী হলেও মায়ের অনুগত ধ্রুব। তিনিও বন্ধুর মতো ছেলের সাথে মিশেছেন ছোটবেলা থেকে। সেজন্য ধ্রুব’র কিছু হলে যেমন তিনি বুঝতে পারেন তেমনি মায়ের কিছু হলেও ধ্রুব টের পায়। শায়লার থেকে আশানুরূপ জবাব না পেয়ে ধ্রুব’র ভ্রু জোড়া কুঁচকে আসে৷ থমথমে গলায় বলে,
— তুমি কি আমাকে অবিশ্বাস করো? কি লুকাতে চাচ্ছো…
শায়লা চমকে ওঠলেন,
— কি লুকাবো?
— তাহলে তো এত দ্বিধাবোধের তো কোনো কারণ দেখছি না…
শায়লা ধ্রুবকে বলতে চাচ্ছিলো না। কিন্তু ছেলের কথা শুনে এখন মনে হচ্ছে ধ্রুব’র জানাটা দরকার। কারণ অদ্রি এখন ওর সবকিছু। ওকে না বলাটা অন্যায়। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে কথা গোছালেন। ছেলে রেগে যাবেন জানেন তিনি। সময় নিয়েই বললেন,
— জামিউল ভাই, তিনি সপরিবারে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছেন।
ধ্রুব অবাক হলো। চিনতে পারলো না কার কথা
বলছে শায়লা হাসান। ও বলল,
— সে যাবে। কিন্তু তুমি চিন্তিত কেন?
শায়লা কপট রাগ নিয়ে তাকান,
— মেয়েকেও নিয়ে যেতে চান।
ধ্রুব বোঝে না মায়ের সমস্যা! অকপটে বলে
ওঠে,
— নিয়ে যাবে। তাতে কি?
শায়লা বিরক্ত হোন,
— ধ্রুব সে অদ্রিজা, আমাদের অদ্রি।
মায়ের কথা শুনে ধ্রুব হতবিহ্বল হয়। ভ্রু কুটি করে অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে থাকে। তার মনে পড়ে অদ্রির বাবার নাম জামিউল৷ বিয়ের দিন প্রথম আর শেষবার দেখা হয়েছিলো তাদের। তারপর কত সময়, দিন, মাস গড়ালো, তিনি একটা দিনও মেয়ের খোঁজ নেন নি। ভাবতেই চোয়াল শক্ত আসে ধ্রুব’র। মনে ক্রোধ জন্মে। বিয়ের পর একটা দিনও যে লোকটা নিজের মেয়ের খোঁজ নেয়নি সে হঠাৎ একেবারে মেয়েকে দেশের বাইরে নিয়ে যেতে চাচ্ছেন মানে কি? তাছাড়া তিনিই বা কে মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার? অদ্রি এখন ধ্রুব’র অর্ধাঙ্গিনী। ওর ব্যাপারে এসব হাবিজাবি চিন্তা করার অধিকার তাকে কে দিয়েছে? ধ্রুব’র গায়ে আগুন জ্বলে ওঠলো। প্রশ্নবোধক চোখে মায়ের দিকে তাকায়। শায়লা বললেন,
— জামিউল ভাইয়ের ধারণা তিনি ভুল, অন্যায় করেছেন মেয়ের সাথে। এখন ভুল শুধরাতেই তিনি অদ্রির সাথে সবকিছু ঠিক করে নিতে চান। তাদের জমজ সন্তান হয়েছে। ছ’মাস বয়স। একজনের একটু সমস্যা আছে জানালেন। সেজন্য চিকিৎসার জন্য মানে এককথায় উন্নত জীবনের জন্যই বাইরে শিফট হচ্ছেন তিনি। সেজন্য অদ্রিকেও নিজের কাছে রাখতে চান, মেয়ের প্রতি কর্তব্য পালন করতে চান।
— হঠাৎ ওনার মেয়ের প্রতি কর্তব্য পালন জেগে ওঠলো কেন? এতদিন কোথায় ছিলেন?
শায়লা ছেলের কন্ঠে ক্রোধ দেখতে পান। তিনি রয়েসয়ে ঢোক গিললেন। জামিউল সাহেবের কথাগুলোয় বাবা হিসেবে নিজের ব্যর্থতার কথা জানান দিচ্ছিলো। স্পষ্ট টের পাচ্ছিলেন শায়লা বেগম। কিন্তু সাথী বেগমের কথাগুলো তার মোটেও পছন্দ হয় নি৷ কথার মাঝে খোঁচা আর অদ্রির প্রতি তীব্র হিংসা, রাগ প্রকাশ পেয়েছে। তার কথা শুনে
মনে হয়েছে অদ্রির ভালো থাকা তিনি সহ্য করতে পারছেন না। ওর জন্য জামিউল সাহেবের সাথে হয়তো সাথী বেগমের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না।
সেজন্য স্বামীর কাছে ভালো সাজার জন্য এ প্রচেষ্টা তার। এই উসিলায় ভুংভাং বুঝিয়ে তিনি জামিউল সাহেবকে উস্কেছেন! যেটা জামিউল সাহেব টের পাননি, কিন্তু মেয়ে হিসেবে শায়লা কিছুটা আন্দাজ করেছেন।
মায়ের কাছে এগুলো শুনে বিস্মিত ধ্রুব ভাষা হারিয়ে ফেললো। একজন বাবা! নিজের খেয়ালখুশি মতো যা খুশি তা-ই করতে লাগলো। ইচ্ছে হলো একটা মেয়ের সব ধূলিসাৎ করে নিজের সুখী জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। আবার নিজের স্বার্থের প্রয়োজনে মেয়েকে ডাকেন, কাছে রাখতে চান। এরকম পাশবিক চরিত্রও মানুষের হয়? ধ্রুব ভাবে। ওর তীব্র রাগ হয়। হাত-পা নিশপিশ করতে থাকে। অদ্রি! এইটুকুন মেয়েটা কিভাবে এতকিছু চুপচাপ সামলায় এটা খানিকটা হলেও আন্দাজ করতে পারে সে। কতটা দুর্ভাগ্য হলে এরকম একজন মানুষ কারো বাবা হয় ভেবেই ওর চোখ জ্বলে ওঠে। ক্রোধ সংরবণ করে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ায় ধ্রুব। এরপর কঠোর গলায় মাকে বলে,
— অদ্রি এখন আমার স্ত্রী, আর আমার স্ত্রী কোথায় যাবে না যাবে সেটা আমি ঠিক করবো, ওনি না…
শায়লা ম্লানমুখে ছেলের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলেন। তার মন স্তম্ভিত৷ জামিউল সাহেবের থেকে এরকম কিছু প্রত্যাশা করেন নি। যে লোকটা মেয়ে বেঁচে আছে কি নেই এতদিন সেটারই খোঁজ নেন নি হঠাৎ তার আবার কিসের এত চাওয়া? কষ্ট দিতে দিতে মেয়েকে কাঠপুতুল হতে বাধ্য করেছেন তিনি। উহু! মেয়ের মতো ভালোবাসেন যাকে, এত সহজে তাকে কাছ ছাড়া করবেন না শায়লা।
ভার্সিটির ক্লাস শেষ করে ফ্রেন্ডদের সাথে মাঠে বসে নোটস লিখছিলো অদ্রি। টানা চার চারটে ক্লাস করে ও ক্লান্ত, বিধস্ত। খানিকক্ষণ বিরতি নেওয়ার জন্য গাছের সাথে হেলান দিয়ে বসলো ও। ব্যাগ থেকে বোতল বের করে পানি বের করে খাওয়ার সময় দেখলো দূর থেকে দেখলো ধ্রুবকে। রাস্তার ওপাশে গাড়ি পার্ক করে হেঁটে আসছে। পরণে কালো শার্ট-প্যান্ট। চুলগুলো বাতাসে ওড়াওড়ি করছে। দেখতে ভালো লাগছে, অদ্রির ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠলো। কিন্তু হাসাহাসির শব্দ শুনে ভ্রু কুঁচকে পাশে তাকাতেই দেখলো ওর মেয়ে ফ্রেন্ডগুলো ধ্রুব’র দিকে হা করে তাকিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে, প্রশংসা করছে ওর। অদ্রির চেহারার রঙ পালটে গেলো। ততক্ষণে ধ্রুব ওর কাছে চলে এসেছে। অদ্রি ঠাঁই বসে রইলো, ওঠলো না। ধ্রুব কাছে এসেই ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল,
— সরি। ড্রাইভ করছিলাম তোমার কল রিসিভ করতে পারিনি।
— ইট’স ওকে। বাট এত সাজগোজের কারণ কি? ডেটে যাবেন নাকি?
অদ্রি ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো ধীর স্বরে।
ধ্রুব বোকা বনে গেলো। সবসময় যেভাবে থাকে সেভাবেই এসেছে। তাহলে ও এরকম বলছে কেন? পরক্ষনেই ধ্রুব তীক্ষ্ণ গলায় সে বলল,
— যাওয়া যায়!
অদ্রি কাঠ গলায় বলল,
— তাই?
— চলো…
বলে আশেপাশে চোখ পড়লো ওর৷ দেখলো অদ্রির পাশে বসা মেয়েগুলোকে। ওরা হা করে তাকিয়ে আছে। যেন অদ্রির সাথে এই সুন্দর পুরুষটির কি সম্পর্ক তা নিয়ে বেশ কৌতূহল আছে ওদের। একজন অদ্রিকে ডেকে জিজ্ঞেস করেই ফেললো কে ইনি?
ধ্রুব এসব দেখে অস্বস্তি নিয়ে অদ্রিকে নিচু স্বরে,
— এরা কে? তোমার বান্ধবী…
অদ্রি শীতল গলায় বলল,
— আপনার ভবিষ্যৎ বউ…
ধ্রুব হেসে ফেললো। মেয়েগুলো আরও কৌতূহলী চেহারা নিয়ে নিজেদের মধ্যে ফিসফাস শুরু করলো। অদ্রির কানে আসছিলো সেসব। ও নিজের রাগ সামলে এবার পেছনে ফিরে ওদের দিকে তাকালো। এরপর মুখে হাসি ফুটিয়ে জোরালো কন্ঠে বলল,
— আমার হাজব্যান্ড। সহজ কথায় তোদের দুলাভাই। হয়েছে? নে এবার আরও প্রশংসা কর। কে কে যেন ক্রাশ খেয়েছিলি?
অদ্রির মুখে এসব শুনে মেয়েগুলোর মুখ শুকিয়ে গেলো। ধ্রুব কেশে ওঠলো। এই মেয়েটা যতটা চুপচাপ, ততটাই অভদ্র। সোজাসাপ্টা, মুখের ওপর কথা বলে দেয়।
এতক্ষণ ধ্রুবকে নিয়ে আজেবাজে মজা করা ওর বান্ধবীগুলো লজ্জিত ভঙ্গিতে সরি জানালো। অদ্রি আর এক মুহূর্ত সেখানে থাকলো না। নিজের বই,নোটস গুছিয়ে ধ্রুবকে নিয়ে সেখান থেকে চলে এলো। অদ্রি গাড়িতে চুপচাপ বসে ছিলো। ড্রাইভ করতে থাকা ধ্রুবকে আচমকা বলল,
— কাছে আসুন…
ধ্রুব হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকালো,
— এখানে?
— প্রশ্ন করবেন না…
ধ্রুব এলো। অদ্রি দু’হাতে ধ্রুব’র সেট করা চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে হেসে বলল,
— এবার ঠিক আছে।
ধ্রুব অবাক গলায় প্রশ্ন করলো,
— তোমার হয়েছে কি?
— আপনাকে হ্যান্ডসাম দেখাচ্ছে।
অদ্রি শক্ত মুখ করে বললো। ধ্রুব বিস্ময়ে হতবাক। মাথার ভেতর সব এলোমেলো হয়ে যাওয়ায় গাড়ি থামালো রাস্তার ধারে। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
— আমি কি ঠিক শুনলাম?
অদ্রির দৃষ্টি সামনে। গোমড়ামুখেই উত্তর দিলো,
— সবসময় ভুল বলি আমি?
— এবার কি ঠিক শুনলাম?
— হ্যাঁ ঠিক।
ধ্রুব’র ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠলো। নিচে তাকিয়ে হাসি আটকালো। এরপরই একটা ফোন এলো, শায়লার। ধ্রুব রিসিভ করলো, ওপাশ থেকে কিছু একটা শুনে ওর চোখমুখ কঠোর হয়ে গেলো। ধ্রুব অনিচ্ছায় গাড়ি ঘুরিয়ে নিলো। অদ্রি লক্ষ্য করলো সেটা, তবে কিছু জিজ্ঞেস করলো না। বেশ কিছুক্ষণ পর একটা রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি থামালো ধ্রুব। অদ্রি জিজ্ঞেস করল,
— বাড়ি যাবো না?
— নামো…
অদ্রি নামলো। ধ্রুব ওকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে ঢুকতে নিলে অদ্রি কৌতূহলী গলায় বলল,
— আপনি কি সত্যিই ডেটে যাচ্ছেন? আমি তো এমনি বলেছিলাম।
ধ্রুব উত্তর দিলো না। কাচের দরজা ঠেলে ওরা রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকলো। লোকজন কম, লাঞ্চের সময় পেরিয়েছে অনেক আগে। অদ্রি এদিকওদিক ডেকোরেশন দেখতে লাগলো। আচমকা উজ্জ্বল আলোয় সামনে বসে থাকা মানুষটাকে দেখে অদ্রির ঠোঁটের কোণে থাকা হাসিটা মিলিয়ে গেলো। জামিউল সাহেব স্নেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন মেয়ের দিকে। পাশে বসা সাথী বেগম বিরক্ত, তবে মুখটা হাসি হাসি করে রেখেছেন। তার কোলে তোয়ালে মোড়ানো বাচ্চা, পাশে বসা বিলকিসের কোলে আরও একজন। অদ্রির চোখ অন্ধকার হয়ে এলো। সুখী পরিবার তার বাবার! ধ্রুব কি এ জন্য ওকে এখানে নিয়ে এলো? অদ্রি ওর দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো। ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
— দেখা করতে চেয়েছিলো তোমার সাথে।
— আমি এই অপরিচিত লোকের সাথে কেন দেখা করবো? চলুন আপনি…
জামিউল সাহেব মেয়েকে দেখে ওঠে এলেন। কতদিন পর তার আদরের মেয়েকে নিজের দু’চোখে দেখছেন! বাবা পাগল মেয়ে এখন তাকে “বাবা” বলে ডাকে না।।
এরচেয়ে কষ্টের আর কি হতে পারে? তিনি অদ্রিকে বুকে আগলে নেওয়ার জন্য কাছে আসতে গেলে অদ্রি কঠোর গলায় বলল,
— একদম না। যেখানে আছেন সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকুন। আমার কাছে আসার চেষ্টা করবেন না।
জামিউল সাহেব হতভম্ব হয়ে গেলেন,
— তুমি আমার মেয়ে অদ্রি, আমি তোমার বাবা।
— কোনো কাপুরুষ আমার বাবা হতে পারে না।
অদ্রির গলায় তাচ্ছিল্য। ধ্রুব নিশ্চুপ। জামিউল সাহেব আশা করেন নি অদ্রি এমন কিছু বলবে। মেয়েটা তো আগে এরকম ছিলো না। তাহলে? তিনি তবুও বললেন,
— আমার উপর এখনো রেগে আছো? কতদিন হয়ে গেলো মা, এবার তো সব ঠিকঠাক করে নাও…
অদ্রির চোখ জ্বলে ওঠলো,
— আমি রেগে নেই তো। সবকিছু তো ঠিকই দেখতে পাচ্ছি। এসব প্রশ্ন আসছে কেন?
— এমন বলে না মা…
— আপনি পরিবার নিয়ে সুখী থাকুন। আর আমি এখানে দাঁড়িয়ে আপনার কথাই বা শুনছি কেন!
অদ্রি বললো স্থির, শীতল গলায়। কিন্তু ওর চেহারা রাগে লাল হয়ে গেছে। ধ্রুব টের পেলো ওর হাত-পা কাঁপছে। অদ্রি ওর হাত চেপে ধরে বলল,
— নিয়ে চলুন তো আমাকে…
ধ্রুব ওকে নিয়ে বেরিয়ে এলো। পেছন পেছন জামিউল সাহেবও এলেন। অদ্রিকে আটকানোর চেষ্টা করলেন। ধ্রুব কঠোর গলায় তাকে বলল,
— ও আপনার সাথে কথা বলতে চাচ্ছে না…
জামিউল সাহেব স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। অদ্রি তার দিকে ফিরেও তাকালো না। তিনি বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলেন। হতাশ হয়ে ফিরে গেলেন ভেতরে। বিলকিস মুখ লুকিয়ে চোখের পানি মুছলো, সাথী বেগম এত আদিক্ষেতা সহ্য করতে পারছিলেন না। সেজন্য ধমক দিলেন বিলকিসকে। তিনি অদ্রির ভালো থাকা সহ্য করতে পারছেন না, ওর জন্য জামিউল সাহেবের কাছে তিনি পাত্তা পান না। সারাক্ষণ মেয়ে মেয়ে করতে থাকেন এই বুড়ো। নিত্যদিন ঝগড়া, অশান্তি করেও কোনো লাভ হয়নি৷ বরং স্বামীর কাছে নিজের মর্যাদা হারিয়েছেন। এজন্য তিনিও মনেপ্রাণে চান অদ্রি যাতে অসুখী হোক, সারাজীবন তার পায়ের তলায় পড়ে থাকুক। কোনোভাবে ঘর ভাঙিয়ে নিজের বাচ্চাদের দেখাশোনার কাজে লাগাতে পারলেই তার শান্তি। দেমাগী মেয়ের গোমড় তিনি ভেঙে দেবেন। স্বামীর কাছে ভালো সাজার মতলবেই তো তাকে তিনি ক খ বুঝিয়েছেন! জামিউল সাহেবকে শুনিয়ে শুনিয়ে
তিনি এবার বললেন,
— হুহ! ভালা শ্বশুর বাড়ি পাইয়্যা দেমাগে মাটিতে পা পড়ে না মাইয়্যার। বাপের খাইয়া, পইড়া বড় হইয়া এহন বাপেরে দাম দেয় না। দেখো এই মাইয়ার জন্য আবার হা হুতাশ করো তুমি…
জামিউল সাহেব বিরক্ত হলেন স্ত্রী’র কথায়। বড্ড বেশি কথা বলেন এই মহিলা। ইচ্ছে হয় টুটি চেপে ধরতে। কিন্তু তিনি মাথা গরম করলেন না। অফিস থেকে বিদেশে লাইফ স্যাটেল করার মতো বড় অফার এসেছে। সন্তানদের ভবিষ্যৎ সুন্দর করতে তাই সবদিক বিবেচনা করেই তিনি দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু অদ্রিকে দূরে রেখে যেতে তার মন কিছুতেই সায় দিচ্ছে না। বিয়ের দিন মেয়েকে থাপ্পড় দেওয়ার কষ্টটা আজকাল গলায় কাঁটা হয়ে বিঁধছে, মানসিক শান্তি তো কবেই বিনষ্ট! এতদিন বহু ভুগেছেন, আর ভুগতে চান না। তিনি মনে মনে বললেন,
— ওকে আমি বোঝাবোই। দরকার হলে ওদের বাড়ি যাবো। আমি ওর বাবা, ও ঠিক আমাকে ক্ষমা করবে…
অদ্রি বিছানায় এলোমেলো, মনমরা হয়ে শুয়ে ছিলো। কাঁদছিলো নাকি বোঝা গেলো না। পুরো রাস্তা এমনকি বাড়ি ফেরার পর থেকে একটা কথাও বলে নি৷ খাবারও খায়নি। শায়লা জোর করতে চেয়েছিলো, ধ্রুব মানা করেছে। অদ্রির মনের অবস্থা বুঝতে পেরেছে সে। ওর নিজেরই যেখানে রাগে রি রি করছিলো শরীর, সেখানে অদ্রি যে চুপচাপ চলে এসেছে এটাই তো বেশি! ধ্রুব ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়। ইদানীং বেশ ঠান্ডা পড়েছে। মিনিট গড়াতেই ধ্রুব টের পেলো অদ্রি আদুরে বেড়ালের মতো ওর পাশে ঘেঁষেছে। ও শক্ত হয়ে গেলো, দম আটকে আসছে যেন! অদ্রি অন্যরকম গলায় বলল,
— আপনি কখনো আমাকে ছেড়ে যাবেন না।
ধ্রুব কোনোমতে বলল,
— যাবো না।
— ভালোবাসি!
ধ্রুব তখন স্থির, শান্ত দৃষ্টিতে এই মধুর শব্দটি শুনলো। মনের ভেতর শীতল বাতাসের ঝড় বয়ে গেলো। গলা দিয়ে শব্দ আসছিলো না। তবুও কিছুটা অবাক হয়ে বলল,
— অদ্রিজা কাউকে ভালোবাসতে জানে?
অদ্রি নির্লিপ্ত কন্ঠে দু’বার বলল,
— ভালোবাসি।
অদ্রির কন্ঠে কি ছিলো জানে না ধ্রুব। ও বিমোহিত হয়ে গেলো। কতদিনের প্রতীক্ষার অবসান ঘটলো কে জানে! হিসেব রাখেনি কখনো। শুধুমাত্র এই অদ্ভুত, চাপা স্বভাবের জেদি মেয়েটাকে খুব করে চেয়ে গেছে প্রতিটি দিন একটু একটু করে। অদ্রি ধ্রুবকে চুপ থাকতে দেখে কিছু একটা ভাবলো। পরক্ষণেই কিছু একটা মনে পড়তেই দূরে সরে গিয়ে জিজ্ঞেস
করল,
— বাবা আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলো সেটা আমাকে কেন জানান নি আপনি?
চলবে…