নক্ষত্রের রূপালী রাতে পর্ব-০১

0
177

#নক্ষত্রের_রূপালী_রাতে (পর্ব ১)
নুসরাত জাহান লিজা

কাজী অফিসের সামনে অস্থিরভাবে পায়চারি করছে মৃন্ময়। পৃথা আসতে পারবে কিনা কে জানে! দু’ঘণ্টা চলে গেছে, এখনো আসছে না। সে কী আসবে না, শেষ মুহূর্তে ওকে না জানিয়েই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করল! কয়েকবার কল করেও কোনো সাড়া পেল না। হাতে ধরা ফুলগুলো একবার দেখল। বিয়ের পর প্রথম উপহার হিসেবে আটটা গোলাপ এনেছে সে। সংখ্যাটায় বিশেষত্ব নেই, তবে এই ফুলগুলো ওর কাছে বিশেষ। মৃন্ময়ের ভাড়া বাসার ছাদঘরে একদিন এসেছিল পৃথা। সেদিন ছাদের টবে গোলাপের চারা লাগিয়ে এসেছিল। মৃন্ময় ভীষণ যত্নে গাছগুলোর পরিচর্যা করেছে। চারাগাছগুলোর সাথে সাথে সে যেন ভালোবাসাকেও পরিচর্যা করেছে। আজ সেই গাছে ফোটা আটটা লাল গোলাপ উপহার হিসেবে দিলে মেয়েটা ভীষণ খুশি হবে। বিশেষ দিনের বিশেষ উপহার।

বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে আর অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারি করছে মৃন্ময়, এরমধ্যে তিনটা সিগারেট শেষ করেছে। কিন্তু যার প্রতীক্ষায় সে এতটা উতলা সে কেন আজ এত দেরি করছে! ধরা পড়ে গেল? অজানা আশঙ্কা কালবৈশাখীর আঁধারিয়া মেঘের মতো আচমকা গাঢ় অন্ধকার গ্রাস করছিল ওর পুরো মনকে।

পৃথার সাথে ওর দেখা হয়েছিল অদ্ভুতভাবে। মৃন্ময় চশমা হারিয়ে ফেলেছিল, চশমা ছাড়া সে খুব একটা দেখে না। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই ওর চশমা পরতে হয়। ধীরে ধীরে দৃষ্টি শক্তি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়েছে। মৃন্ময় ব্যস্ত রাস্তায় প্রায় অন্ধের মতো দিশেহারা হয়ে হাঁটছিল, তখনই একটা মিষ্টি গলায় সে নিজের মধ্যে খানিকটা সাহস যুগিয়েছিল।

“আপনি এভাবে হাঁটছেন কেন? গাড়ির নিচে চাপা পড়বেন তো!”

পৃথার গলায় সেদিন যে আন্তরিক চিন্তার ছায়া ছিল সেটা মৃন্ময়কে স্পর্শ করেছিল। ওমন শুভচিন্তক ওর জীবনে কেউ ছিল না কখনো।

“কী হলো?”

আবারও প্রশ্ন, এবার আর উপেক্ষা করতে পারল না, মৃন্ময় বলেছিল, “আমার চশমা হারিয়ে গেছে। আসলে আমি…”

“চশমা হারিয়ে যায় কীভাবে? চোখ থেকে খুলে পড়ে গেছে?”

“না, আসলে আমি মেস থেকে বেরুবার আগেই খুঁজেছি, পাইনি। মনে হয় রুমমেটদের কেউ দুষ্টুমি করে লুকিয়ে রেখেছে।”

এবার মিষ্টি গলায় রাগের আভাস, মৃদু ঝাঁঝের সাথে পৃথা বলল, “এটা কেমন ধরনের দুষ্টুমি? তারা কি ছোট বাচ্চা নাকি! আপনার বড় একটা এক্সিডেন্ট হয়ে গেলে তার দায় তারা নেবে?”

ভীষণ আপন মানুষ বলে মনে হচ্ছিল মৃন্ময়ের, অথচ তখনও মেয়েটাকে সে স্পষ্টভাবে দেখতেই পারেনি। সে বলতে পারল না, এর থেকে ভয়ংকর ভয়ংকর ফাজলামো ওরা তার সাথে করে। বললে যদি এই মেয়েটাও ওকে বোকা ঠাওরে ফেলে! বোকাদের জন্য এই পৃথিবীটা বড্ড শক্ত জায়গা।

তবে মৃন্ময় কি সত্যিই বোকা! কারোর ভালো চাইলে, একটু সমঝোতা করে চলতে চাইলে, আগ বাড়িয়ে ঝামেলা করার মতো মনোভাব না থাকলেই বুঝি লোকে তাদের বোকা মনে করে! ওর বিনয়, ওর নিষ্ঠা, সততা এসব যেন বাকি দুনিয়ার কাছে ঠুনকো মূল্যহীন এক জিনিস।

সেই স্কুল থেকেই সবাই ওকে নিয়ে আড়ালে, কেউ সামনেই হাসিঠাট্টা করত। কখনো সখনো কেউ কেউ যে সত্যিকারের সহানুভূতি ওকে কেউ দেখায়নি, তাও পুরোপুরি সত্য নয়। তবুও সংখ্যাটা নগন্য। আবার সেই নগন্যতেও সেদিনকার পৃথার মতো মায়া ছিল না।

“আপনি চলুন তো!”

“কোথায়?” পৃথার কথা বোধগম্য না হওয়ায় প্রশ্ন করল মৃন্ময়।

“আরেকটা চশমা কিনতে হবে না?”

মৃন্ময় আপত্তি করে বলল, “ওটা ওরা নিশ্চয়ই ফেরত দেবে।”

পৃথা বলল, “ওটার আশা ছেড়ে দিন। কেউ হয়তো দুষ্টুমি করে লুকিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সেটা ঠিকঠাক থাকলে আপনি বাইরে আসার আগে তারা সেটা অবশ্যই ফেরত দিত।”

কথাটা যৌক্তিক মনে হলো মৃন্ময়ের কাছে। তাই পৃথার তাড়ায় কয়েক পা এগুতেই হোঁচট খেয়ে পড়তে পড়তে সামলে নিল সে।

“আমার হাতটা ধরে এগুন তো।”

এতটা অকপটে কোনো মেয়ে একটা অপরিচিত ছেলের দিকে এভাবে হাত বাড়িয়ে দিতে পারে!

“এত ভাবাভাবির কিছু নেই। আপনি এই মুহূর্তে বিপদগ্রস্ত। একজন মানুষ হিসেবে আরেকজন মানুষকে সাহায্য করাটাই সমীচীন। তাই সংকোচ ঝেড়ে আসুন তো।”

মৃন্ময় ইতস্তত করে যখন পৃথার হাতটা ধরেছিল, তখন এক অচেনা ভালো লাগায় সে শিহরিত হয়েছিল। না, ভয়ে সে অন্য অনুভূতিকে সেদিন প্রশ্রয় দেয়নি। অগ্রাহ্য করতে চেয়েছিল। মেয়েটাকে দেখার আকাঙ্খা সুতীব্র আকার ধারণ করছিল, মৃন্ময়ের মনে।

“আমি মৃন্ময়। আপনার নামটা বলা যাবে?”

“পৃথা।”

আর কথা বাড়ানোর সুযোগ হয় না, চশমা চোখে দিতেই সবার আগে সে পৃথাকে দেখেছিল। স্নিগ্ধ মিষ্টি একটা মুখ। মেয়েটার চোখের দৃষ্টিতে অদ্ভুত স্থিরতা আছে, একইসাথে গভীরতা। যে চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না, ডুবে যেতে ইচ্ছে করে। মৃন্ময় নিজেকে শাসন করে গুটিয়ে নেয়। কে জানে, যদি ভুল বুঝে আর কথাই না বলে!

মনকে কী আর সবসময় শাসনে বাঁধা যায়! তাই সেদিন ফিরে এসে পৃথার শান্ত মুখ আর গভীর চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মৃন্ময়ের মনে আছড়ে পড়ছিল বারবার। সারারাত একফোঁটা ঘুম হয়নি ওর।

দ্বিতীয়বার দেখার প্রাণান্তকর ইচ্ছেতে সে তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়েছিল। তবে প্রতীক্ষার ক্ষণ দীর্ঘ হয়, এক্ষেত্রে সময়টাও দীর্ঘ-ই ছিল। কী আর করা, প্রবল তৃষ্ণায় সে ঘুরে বেড়াত। ওর সাথে আরেকবার দেখা হয়েছিল নীলক্ষেতে, বই কিনতে গিয়ে। সেদিন আলাপে আলাপে জানা গেল পৃথা তার মতই বইপোকা। একটা রেয়ার বই মৃন্ময়ের সংগ্রহে ছিল। সেটা খুঁজছিল পৃথা। এই ছুতোয় মুঠোফোনের যোগাযোগ শুরু হলো।

কীভাবে কীভাবে যেন বিশ্বাসের বসতি গড়ে শাশ্বত অনুভূতি দুই তরফ থেকেই রঙ ছড়াচ্ছিল। পরস্পরের জন্য খুলে দিতে মনের বন্ধ কপাট। অজানা সমস্তই জানা হয়ে গিয়েছিল ততদিনে।

একসময় মৃন্ময়ের চাকরি হলো, ছোট্ট কিন্তু ওর জন্য স্বস্তির। পৃথা ওকে প্রথমেই মেস ছাড়তে বলল।

মৃন্ময় বলেছিল, “কেন? সমস্যা হচ্ছে না তো।”

“মৃন্ময়, ফাজলামো, মজা আর মানসিক অত্যাচার, দুটোর মধ্যে একটা সূক্ষ্ম সীমারেখা থাকে। ফাজলামো ততক্ষণ পর্যন্ত ধরা যায়, যতক্ষণ পর্যন্ত মানসিক শান্তি লঙ্ঘিত না হয়। যখন সেটা সীমারেখা অতিক্রম করে তখন সেটা মেন্টাল ট র্চা র। সরে এসো।”

মৃন্ময় আজন্ম ভালোবাসা আর মমতার কাঙাল। একলা থাকতে তাই ভয় হতো। সে পৃথার প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছিল, উপলব্ধি করতে পারে। আসলেই কথাগুলো ঠিক। আর রুমমেটদের সাথে বচসায় যাওয়া মানে পাত্তা দেয়া। এখন আর সেটা সে করতে চায় না। একটা শান্তির নীড় চাই ওর। তাই নিভৃতে সরে এলো।

খুব কম ভাড়ায় ছাদের চিলেকোঠার ঘর পেয়ে যায় একটা। সেখানেই থাকতে শুরু করে। পৃথা নিজে এসে সব গুছিয়ে দিয়ে গেছে। তখনই কয়েকটা নানা প্রজাতির ফুল গাছ টবে লাগিয়ে দিয়ে এসেছিল। মৃন্ময় সেগুলোকে ভীষণ যত্নে বড় করেছে। এগুলোতে পৃথার ছোঁয়া মিশে ছিল। মেয়েটা আর ওর বাসায় যায়নি। তবে যোগাযোগ বন্ধ হয়নি। বরং নির্ভরতা বেড়েছে। কোনোদিন যদি পৃথা কল না ধরে সেদিন ভীষণ অস্থিরতা অনুভব করে।

এরমধ্যে সপ্তাহ দুই আগে হুট করে একদিন এসে বলল, “বাসা থেকে আমার বিয়ে ঠিক করেছে। বাবার ব্যাবসা বাড়াতে সেই পরিবারের সাহায্য লাগবে। তারা একটা ভালো মেয়ে চায়। আমি কোনো পণ্য নই। চলো আমরা বিয়ে করি।”

মৃন্ময় কিছুটা সময় নিয়েছিল। বিয়েটা তো হুট করে হয় না। পৃথা গতকাল জানায় ওর বাবা নাকি ভীষণ মরিয়া।

মৃন্ময় আর কিছু ভাবতে পারেনি। এই কয়দিনে সে বুঝতে পেরেছে, পৃথা ওর জন্য অক্সিজেন।

আগে-পিছে কিছু না ভেবে তাই বলে দিয়েছে, “তাহলে কাল কাজী অফিসে চলে এসো। আমার অফিসের ডানদিকে যেটা আছে, সেখানে।”

এরপর সারারাত ঘুমাতে পারেনি। ভোরের দিকে খানিকটা তন্দ্রামতো এসেছিল। তখন দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙেছে। সকালে কিছু খেতেও পারেনি। ছুটোছুটি করে বিয়ের এরেঞ্জমেন্ট করেছে। এরপর একটা নীল রঙের পাঞ্জাবি পরে চলে এসেছে।

হাতের ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখল এখনো বেশ সতেজ আছে। কিন্তু পৃথার দেখা নেই। ফোনটাও বন্ধ। যদি ওকে আসতে না দেয়! এমনিতেই লম্বা সময় ধরে না খাওয়া, তার উপর প্রচণ্ড মানসিক ধকলে মৃন্ময় হড়হড় করে বমি করে ফেলল।
………