বীরাঙ্গনা হইতে বারাঙ্গনা পর্ব-২৬ এবং শেষ পর্ব

0
378

#বীরাঙ্গনা_হইতে_বারাঙ্গনা (৩য় পরিচ্ছেদ)
#মম_সাহা

অন্তিম পর্বঃ ১ম অংশ

ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মাঝে কাঁদা মাটিতে মাখামাখি রূপমাধুরী। মাটির বুকে কুড়ালের আঁচড় টেনে মাটির দলা উঠিয়ে নিচ্ছে। তার একটু দূরেই মাথায় ছাতা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বিজলি উৎকণ্ঠা নিয়ে বার বার বলছে,
“আপ্পা, আপনি চলে আসেন না, আমি করে দিচ্ছি কাজটা। আপনি ইশারা দিলেই যেখানে আপনার সব কাজ হয়ে যায় সেখানে আপনি কেন কষ্ট করছেন? আমি করে দেই।”

“একদম না, তোকে বলেছি আমার উপরে কথা বলতে? ছাতা ছেড়ে ভুলেও বের হবি না। তোর ঠান্ডার সমস্যা অনেক। তুই চুপ করে দাঁড়া।”

“ঠিক আছে দাঁড়াচ্ছি। কিন্তু আপ্পা, আপনি কী করবেন এই গর্ত খুঁড়ে?”

“কলঙ্ক ঘুচাবো।”

বিজলি রূপমাধুরীর হেয়ালি কথার অর্থ বুঝলো না। কিন্তু ততক্ষণে রূপমাধুরীর গর্ত খুঁড়ানো শেষ। মহিলা গর্ত খুঁড়তে খুঁড়তে ক্লান্ত হয়ে গেলো। অতঃপর কাঁদায় চিপচিপে মাটির মাঝেই বসে পড়লো। বিজলি তৎক্ষনাৎ ছাতা নিয়ে ছুটে আসতে নিলেই থামিয়ে দিলো রূপমাধুরী, গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“ভিজতে দে আমায় বিজলি, ভিজতে দে। অনেক গুলো বছর আমি ভিজি না মন খুলে। ধুয়ে নিতে দে আমার সকল পাপ, সকল কলঙ্ক।”

বিজলি থেমে গেলো আপ্পার আদেশে। পাশের কেটে রাখা গাছের মোটা অংশে বসলো। বৃষ্টি তখন অকৃপণ হাতে দান করছে তার সকল অশ্রুকণা। রূপমাধুরী মাথা নত করে গর্তের দিকে তাকিয়ে কোমল কণ্ঠে বললো,
“বিজলি, একটা জীবন কাহিনী শুনবি? একটা গা ছমছমে গল্প?”

বিজলি উত্তর দেয় না কিন্তু উপর-নীচ মাথা নাড়িয়ে তার সম্মতি জানান দেয়। আকাশে তুমুল বেগে বজ্রপাত ঘটে। চারদিক আলোকিত হয় সেই বজ্রপাতে। তুমুল শব্দে বিজলির বুক কিঞ্চিৎ দুরুদুরু করে উঠে। কিন্তু কোনো ভ্রুক্ষেপ দেখা যায় না সামনের গোলগাল নারীটার দিকে। বৃষ্টির ঝপঝপ শব্দ ছাপিয়ে রূপমাধুরীর কণ্ঠ শোনা গেলো,
“যে মেয়েটার কথা বলছি, তার বিয়ে যখন হয় বয়স তখন কমই কিন্তু তখনের যুগের তুলনায় সে বেশ বড়ো নারী। নিজের ভাগ্যকে সে মেনে নিয়ে ছিলো খুব স্বাভাবিক ভাবে। মা-বাবা ছিলো না, জেঠা জেঠির কাছে মানুষ হয়ে ছিলো। তার বিদায়ের দিন জেঠিমা বলেছিলেন, ‘এ বাড়ির থেকে যাচ্ছিস, আর মুখও দর্শন করবি না বাড়ির।’সে মেনে নিয়ে ছিলো সেই কথাটাও। আর মুখও দর্শন করে নি। তাছাড়া স্বামী ছিলেন দেবতুল্য মানুষ, তাকে আর ছেড়ে আসার সাধ্যি তার হয় নি। কিন্তু তখনও প্রেমিকের সাথে তার যোগাযোগ ছিলো কিন্তু প্রেমিক হিসেবে না, কেবল আর কেবল মাত্র শুভাকাঙ্খী হিসেবে। সে নিজের স্বামীকে কখনো সংশয় ঠেলে বলতে পারে নি নিজের এক কালীন প্রেমিকের কথা। বিয়ের পর দেবতুল্য স্বামী আর ননাস পেয়েছিলো। ননাস ছিলো বিধবা। তার সাথে ননাসের গলায় গলায় ভাব হয়ে যায়। বছর ঘুরতেই কোল আলো করে রাজকন্যা এলো। তার স্বর্গের মতন সংসার। সব ভালো ই চলছিলো। কিন্তু একদিন তার সব ভালো নিমিষেই চুরমার হয়ে গেলো। তার ননাসকে খুব আপত্তিকর অবস্থায় সে দেখে ফেললো আরেকজন বিবাহিত পুরুষের সাথে। তার ঘরের মাঝে যে লাগোয়া জানালা ছিলো, তা দিয়েই সেই অনাকাঙ্খিত ঘটনা দেখে ফেলে। অতঃপর তার মনে ননাসের প্রতি তুমুল ঘৃণা জন্মায়। প্রেম সবাই ই করতে পারে কিন্তু প্রেমের নামে পাপকে সে মানতে পারছিলো না কোনোভাবেই। এর কিছুদিনের মাথায় দেখে তার ননাসের দেহের পরিবর্তন হচ্ছে, উনি বমি করছেন, মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাচ্ছেন। সংসারের বেড়াকলে পড়ে সেই মেয়ে তখন পাঁকা গিন্নী। ওসব লক্ষণের কারণ বুঝতে তার তেমন কাঠখড় পোড়াতে হয় নি। যখন জানলো ননাস সন্তান সম্ভবা তার মাথায় তখন আকাশ ভেঙে পড়লো কারণ এই সন্তান যার সে রীতিমতো বিয়ে করে একটা পুত্র সন্তানের জনকও হয়ে গেছে। সেদিন রাতে পারিপার্শ্বিক অবস্থার কথা চিন্তা করে সে মেয়ে সিদ্ধান্ত নিলো ননাসের সাথে সরাসরি কথা বলবে। ততদিন অবশ্য ননাস জানতেন না যে তার ভাইয়ের বউ সব জানে। ননাসের সাথে সেদিন রাতেই নিবিড়ে সব কথা হলো। ননসকে শর্ত দিলো এ সন্তান রাখতে পারবে না কিন্তু তার ননাস তা মানতে নারাজ। বহু কথা কাটাকাটির পর ঠিক হলো তার কথা, সেই মহিলা মানবে শর্ত তবে তার পরিবর্তে সে মেয়ের কোলে যে সন্তান আসবে সেটা তার ননাসকে দিয়ে দিতে হবে। তারও তো ইচ্ছে করে ছেলেমেয়ে পালতে। সেদিন সে মেয়ে বুকে পাথর বেঁধে রাজি হয়। ঐ সন্তানের কোনো দোষ ছিলো না কিন্তু এই সন্তান যে সমাজ মেনে নিবে না। তখনের সময়ে সমাজ তো আরও পিছিয়ে ছিলো। এরপর সে খুব বুদ্ধি করেই সদরে পাঠিয়ে দেয় তার ননাসকে। তার প্রাক্তন প্রেমিক সাহায্য করেছিল এ কাজে। সেই প্রেমিক অনেক গুলো দিন মেয়েটার ননাসকে শহরে রাখে। মেয়েটা স্বামীর কাছে বলেছিলো তার বাবার বাড়ি বেড়াতে পাঠিয়েছে ননাসকে। খুব ঝুঁকি নিয়ে অনেক গুলো মাস লাগিয়ে ছোট্টো প্রাণটা শেষ করে তারা। তারপর থেকেই মনের মাঝে অপরাধ বোধে মেয়েটা ক্ষণে ক্ষণে পুড়তো। তখন থেকেই কেমন একটা মানসিক সমস্যা শুরু হয় মেয়েটার। নরম, সহজ মেয়েটাই আর সহজে সব নিতে পারতো না। উচ্চস্বরে কথা বলতো, কর্কশ কথা বলতো, রেগে যেতো। তবে বরাবরই মেয়েটা সাহসী ছিলো। তার প্রেমিক তাকে সাহসী কন্যা ডাকতো। সে নাকি বীর কন্যা। সেই বীর কন্যাই সংসারের চাপে হয়ে যাচ্ছিলো নেতানো ফুলের মতন। তারপর তার আর তার ননাসের মাঝে ঝামেলা লেগেই থাকতো এসব নিয়ে। মেয়েটা নিজের ননাসকে সব ছেড়ে দেওয়ার কথা বলতো বার বার অথচ সেই মহিলা সবকিছুতেই জড়িয়ে পড়তো বেশি। এরপর মেয়েটার কোল আলো করে আরও দু’টো যমজ কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। নিজের কথা অনুযায়ী তাদের মাঝে একজনকে তুলে দেয় ননাসের হাতে। ননাস সব দিক দিয়ে খারাপ হলেও সন্তান পালনে কখনো কার্পন্য করেন নি। কিন্তু মেয়েটা মানতে পারতো না সেসব আহ্লাদ, তার মন তো জানতো সে ননাসের কী কী দেখেছে দু’চোখে। এরপর কিছুটা রাগ ফেলতো নিজের সন্তানের উপরও কারণ সে সহ্য করতে পারতো না তার ননাসের সাথে নিজের সন্তানের চলাফেরা। মেয়েকে আকারে ইঙ্গিতে না করতো ননাসের সাথে মিশতে অথচ সে শুনতো না। অবশেষে কেমন বিরক্ত, খিটখিটে মেজাজের হয়ে উঠলো সে। আর ননাস তার বেচারি চেহারা নিয়ে প্রিয় স্থান চা বাগানে করে গেলো নানান রকম কাজ যা মানতে কষ্ট হতো মেয়েটার, কিন্তু চুপ করে মেনে নিতো সব। তার স্বামীও ততদিনে কিছুটা ধারণা করেছিলেন কিন্তু সব তাদের হাতের বাহিরে ছিলো তখন। সময় নিজের মতন গড়িয়ে যেতে থাকে, সাথে মেয়েটার বেশ পরিবর্তন ঘটে। ঐ যে নিষ্পাপ শিশুকে মেরেছে, সেই অপরাধবোধ তাকে ধীরে ধীরে মানসিক ভাবে অসুস্থ করে তোলে। যার ফলস্বরূপ সে নিজের তিন মেয়ের মাঝে একজনকে দেখতে পারতো না। আর তার ননাস যখন ওকে আদর করতো তখন তার সেই অপরিপক্ক ভ্রূণটার কথা মনে পড়তো যার জন্য সে নিজের মেয়ের থেকেও দূরে দূরে থাকতো। কেটে গেলো এমন করে অনেক গুলো বছর। তার মেয়েরা সব বড়ো হয়ে উঠে। সেও তখন তেরো চৌদ্দের নব বধূ থেকে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশের প্রাপ্তবয়স্কা ঘরণী। সংসারের হাল ধরে রেখেছে শক্ত হাতে। তারপর তাদের চা বাগানে আমদানি হয় শহুরে একদল ছেলের, আর সেখানে দ্বিতীয় বারের মতন রচিত একটি মেয়ের হৃদয়হীনা হওয়ার গল্প।”

দীর্ঘ কথার পর বিরতি নেয় রূপমাধুরী কিন্তু সবটা শোনার উত্তেজনায় তুমুল বৃষ্টির মাঝেও ঘেমে-নেয়ে একাকার বিজলি। রূপমাধুরীকে থামতে দেখেই ব্যস্ত কণ্ঠে বলে,
“তারপর? তারপর?”

রূপমাধুরী হাসে মাথা নিচু করে। দ্বিতীয় দফায় বজ্রপাত হয়। চারদিকে রাত তখন গভীর হয়ে আসে। কেঁপে উঠে বিজলির শরীর। আশপাশে কেমন গম্ভীর আবহাওয়া। কিন্তু সবটাকে আরও গম্ভীর করে দিয়ে রূপমাধুরী আবার বলা শুরু করলো,
“তার বড়ো মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়, সব ঠিকই চলছিল কিন্তু অনাকাঙ্খিত ভাবে বিয়ের আগের দিন বর পালিয়ে যায় যার ফলস্বরূপ থেমে যায় বিয়ে। অন্যদিকে চা বাগানকে বিধ্বস্ত করতে প্রস্তুত একদল শহুরে হায়েনা। তার মানসিক রোগটা তখন আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। কিছু ভয়ঙ্কর করে ফেলার আকাঙ্খা জাগে। সে আবার নিজের পরিবারের সবাইকে নজরে রাখা শুরু করে। নিজের বড়ো মেয়ে আর মেঝো মেয়ের মাঝেও সে পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছিলো। এর মাঝে একদিন সাংসারিক কলহ হয়, আর মানসিক ভাবে তখন বিপর্যস্ত ছিলো মেয়েটা। তাই অনাকাঙ্খিত ভাবেই নিজের মেয়েকে মারতে গিয়ে ভুল বশত ননাসের শরীরে হাত লেগে যায় তার। তাকে আঘাত করার কোনো ইচ্ছে মেয়েটার কোনো কালেই ছিলো না। আঘাত করতে হলে তো অনেক বছর আগেই করতে পারতো তাই না? পিসিভক্ত মেয়ে ততদিনে নিজের মাকে অপছন্দ করতো যা তার রাগে আগুনে ঘি ঢালার মতন কাজ করতো।
সেদিন দুপুরের পরের ভাগই তার ননাসের লাশ পাওয়া যায় পুকুর পাড়ে। সবাই ভাবলো আত্মহত্যা কিন্তু তার চোখ তো দেখেছে অন্যকিছু, অন্যরকম কিছু। কিন্তু সে তা প্রকাশ করতে পারলো না কারণ সে ছিল নিরুপায়, প্রমাণ ছাড়া ছিলো। তারপরেই ননাসের প্রেমিকের ছেলের লা/শ পাওয়া গেলো। পচা গলা লা/শ। তার খটকা তখন পরিষ্কার হলো। তার মাঝেই তার এক মেয়ে ছড়ালো সে নাকি মৃত দু’জন ব্যাক্তিকেই দেখতে পাচ্ছে। নিজের মেয়ে গুজব ছড়ালেও সেটাকে সত্যি করে দিলো সে। মৃত্যুর রহস্য উদঘাটন করার জন্য সাজলো তার ননাসের সাজ। সবাইকেই ভয় দেখাতে থাকলো। এমনকি সে এমন ভাবে সবটা উপস্থাপন করেছিলো যে সবাই ভেবেছে অস্বাভাবিক কিছু ঘটছে চা বাগানে। এটা সাহায্য করলো,চা বাগানকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতেও। যে ধ্বংসাত্মক প্রজেক্টের কাজ হওয়ার কথা ছিলো তা থেমে যায়। সে নিজেও বলেছে সে ননাসের আত্মাকে দেখেছে কিন্তু সেটা একদমই বানোয়াট ছিলো। এসব কিছুর মাঝে তার বড়ো মেয়ের প্রেমের তথ্য ফাঁস হলো। আর ততদিনে সে কলঙ্কের বীজ বপন করে ফেলেছিল তার শরীরে কিন্তু এবার আর অপরাধ করলো না সেই নারী, নিজের মেয়েকে একটা সঠিক হাতে তুলে দিলো। কিন্তু ততদিনে তার মানসিক রোগটা ধীরে ধীরে বাড়ছিলো। প্রথম ভয় দেখাতে গেলো সে ননাসের প্রেমিককে কিন্তু ভুল বশত তাকে দেখে ফেলে ননসারে প্রেমিকের বউ এবং সে অসুস্থ হয়ে যায়। মেয়েটা ততদিনে ননাসের ঘর হাতড়ে বেরিয়েছে কিছু পায় কি-না সেজন্য। পরে ননাসের একটা ডায়েরিতে হরেক রকমের আশ্চর্য জনক তথ্য মেয়েটা পায়। সেকালের পড়াশোনা জানা মেয়ে ছিল তার ননাস। আর সে ডায়েরি পড়েই জানতে পারলো মেয়েটা তার ননাসের প্রেমিক নিজের ছেলেকে খু/ন করেছে যা তার ননাস মানতে পারেন নি। সে নিয়ে তাদের এত বছরের প্রেমের মাঝে কলহ সৃষ্টি হয়েছে। তখন মেয়েটার মস্তিষ্কের অস্বচ্ছ ধারণা পরিষ্কার হলো। যেদিন তার ননাস মারা যায়, সেদিন ঠিক দুপুরের কিছুক্ষণ আগে সেখান থেকে সে ননাসের প্রেমিককে বেরুতে দেখে ছিলো। তার একটু পরই নিজের মেয়ের চিৎকার শুনে। সে বুঝতে পারে, তার মানে কিছু তো একটা গন্ডগোল আছেই। অতঃপর নিজের ননাসের প্রেমিকের সামনে সে গেলো ননাসের অবয়ব হয়ে, লোকটা কী বললো জানিস? লোকটা বললো, ‘আমায় ক্ষমা করো। তোমাকে আমি ইচ্ছে করে মারি নি। গলায় চাপ দিয়ে ছিলাম রাগের বশে কিন্তু কখন যে তোমার জান চলে গেলো বুঝি নি।’ মেয়েটা মুহূর্তেই চমকে গেলো এ কথা শুনে। নিজের ননাসকে সে হয়তে বড্ড বেশিই ভালোবাসতো না-হয় এমন কথা শুনে তার রাগ এত বেড়ে যাওয়ার কথা ছিলো? যে মেরেই ফেলবে লোকটাকে।”

আবারও পিনপতন নিরবতা। বিজলি চোখে মুখে উপচে পড়া বিস্ময়, কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,
“মেয়েটা, মেয়েটা খু/ন করেছে!”

“করেছে, তাও একটা না, দু’টো। আরে না ভুল বললাম, তিনটে।”

বিজলির কথা থেমে গেলো। অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো সামনের মানবীর দিকে। গলা শুকিয়ে গেছে তার। রূপমাধুরী নতুন উদ্যমে বলা শুরু করলো,
“একে একে আরও নতুন খবর ছড়ানো শুরু হলো। চা বাগান বিপর্যস্ত হলো সাথে মেয়েটার পরিবারও। তার স্বামীকে পঙ্গু করা হলো। তার বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হলো। সেও মনে মনে ভাবলো, ওদের ছাড়বে না। কিন্তু তার মাঝেই আশ্চর্য রকমের একটা জিনিস মেয়েটা জানতে পারলো। তার ননাসের সন্তান টা,,,”

কথাটা বলেই ছলছল করে উঠলো রূপমাধুরীর চোখ। আকাশে তখনও অফুরন্ত বৃষ্টির ছাঁট। নতুন কিছু শোনার জন্য মুখিয়ে আছে বিজলি নামের মেয়েটিও।

#চলবে

#বীরাঙ্গনা_হইতে_বারাঙ্গনা (৩য় পরিচ্ছেদ)
#মম_সাহা

অন্তিম পর্বঃ শেষ অংশ

চা বাগানের ভীত রাত্রি। সম্রাট যে ভয় পেয়ে জ্ঞান হারালো, জ্ঞান ফেরার আর কোনো নাম-গন্ধ নেই। তাকে ঘিরেই বসে আছে বাকি তিনজন। বাহিরে তখন প্রবল বাতাস। সবাই চেয়ে আছে সম্রাটের দিকে। চোখেমুখে জলের ছিটা দিতেই জ্ঞান ফিরে এলো সম্রাটের। ভীত নয়ন জোড়া নিয়ে সে আশপাশে তাকালো। কিছু একটা মাথায় ঢুকতেই সে চট করে উঠে বসলো। ভয়ে তার কথা জড়িয়ে আসছে তবুও সে উৎকণ্ঠা নিয়ে বলতে লাগলো,
“আমি এখানে থাকবো না, একটুও থাকবো না। গ্রামের মানুষ বলেছে এখানে অনেক বছর আগে এক মহিলা বটগাছে ঝুলে গিয়েছে। তারপর থেকেই নাকি তার আত্মা ঘুরে বেড়ায়৷ আজ আমি নিজের চোখে দেখেছি। আমি থাকবো না এখানে আর। তোরা থাক, আমি চলে যাবো।”

সম্রাটের পাগলামো দেখে বাকি তিনজনও কিছুটা ঘাবড়ে গেলো। ঠিক তখনই তাদের ঘরের হলুদ রাঙা বাল্ব টা বেশ শব্দ করে ভেঙে গেলো। আলো গিয়ে আধাঁরে নিমজ্জিত হলো চারপাশ। ঠিক তখনই জানালার বাহিরে দেখা গেলো মেয়েলি অবয়ব। নুপুরের রিনিঝিনি শব্দও শোনা গেলো। সাথে বিকট হাসি। ছেলেগুলো ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেলো। বেশ বিকট শব্দ করে বজ্রপাত হলো আশেপাশে। সকলের মনেই অদ্ভুতুরে ভয় জেঁকে বসেছে। তার কিছু সময় পড়েই বাহিরে দেখা গেলো হলুদ আভার প্রতিচ্ছবি। লোক গুলোর মাঝে একজন সাহস করে জানালায় উঁকি দিয়েই চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
“বাহিরে আগুন লেগেছে। তাড়াতাড়ি বের হও। আগুন।”

শহুরে বেশ বড়সড় একটা ফ্লাটের বেডরুমে শুয়ে আছে একজন নারী। তুমুল জ্বরে তার চোখ-মুখ লাল হয়ে আছে। তার মাথার কাছে বসে জলপট্টি দিচ্ছে তার স্বামী। মেয়েটার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো অশ্রুকণা, স্বামীর হাতটা চেপে ধরলো পরম আহ্লাদে। অসহায় কণ্ঠে বললো,
“আপনি আমায় ক্যান এত ভালোবাসেন, রাতুল?”

ছেলেটা চশমাটা আরকটু শক্ত করে চোখে চাপিয়ে মিষ্টি হেসে বললো,
“তোমারে ভালোবাসার নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। তোমাকে ভালোবাসতে ভালো লাগে।”

স্বামীর কথায় কেঁদে উঠলো সে, কাঁদতে কাঁদতে বললো,
“আপনার জীবনটা আরও সুন্দর হতে পারতো।”

“উহুম, তুমি আর আমার মেয়ে আছে বলেই আমার জীবনটা সুন্দর। তোমার মা, বাবা, বোনেরা থাকলে আরও সুন্দর হতো। কিন্তু তাদের আমরা হারিয়ে ফেলেছি। তবে তোমরা থাকলেই হবে। এর চেয়ে বেশি সুন্দর যে আমার প্রয়োজন নেই পদ্মাবতী।”

পদ্ম রাতুলের কোমড় পেচিয়ে কেঁদে উঠলো। তা দেখে দরজায় দাঁড়ানো তাদের নয়-দশ বর্ষীয়া মেয়ে খিলখিল করে হেসে উঠলো। পদ্মের আজ নিজ বলতে স্বামী আর প্রেমিকের দেওয়া শেষ উপহারটিই আছে। পৃথিবীর বাস্তবতাই যে তার পরিবার ভেসে গেছে অচিন পুর। বাবার পুড়ে যাওয়া দেহটা পেলেও পায় নি মা বোনদের অস্তিত্ব। কি জানি কোন অনলে পুড়লো তারা! কোন বর্ষায় মুছে নিলো তাদের অস্তিত্ব। চোখের সামনে ভেসে উঠলো তার নিজের সেই চা বাগানের স্মৃতি। কানে ভেসে এলো অতীতের সেই সকালে মায়ের ডাক, পত্রের বোকা বোকা কথা আর পুষ্পের কাজল কালো নয়ন যুগল। বাবার সেই আদুরে স্নেহে ডাক, পিসির সেই সাদা শাড়ি পড়া কোমল দেহ। চা বাগানের সেই সহজ সরল মানুষগণ! কোথায় আজ সব? হারাতে হারাতে নিঃশেষ হয়ে গেছে প্রিয় মানুষদের অস্তিত্ব। দশ বছরে বদলে গেছে সব। সময়ের স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে গেছে সব।

শহরের বুকে একটানা বর্ষণ তেমন দেখা যায় না। অথচ আজ মধ্য রাতেই কেমন ঝড় চারপাশে! সেই অক্লান্ত বর্ষণ ধারায় ভিজছে দু’জন নারী। গর্তের কাছে কৃষ্ণচূড়া গাছের ফুল গুলো ভিজছে মহা আনন্দে সাথে ভিজে যাচ্ছে স্মৃতির পাতা, মনের দগ্ধতা। বেশ খানিকটা সময় পার হওয়ার পর বিজলি ক্ষীণ স্বরে বললো,
“তারপর বলবেন না, আপ্পা? আপনার ননাসের বাচ্চাটা কী হয়েছিল? তাকে কী ফালানো হয় নি? বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে?”

রূপমাধুরী সেই কথার জবাব তৎক্ষনাৎ দেয় না, বরং বিরস কণ্ঠে বাকি ঘটনা টুকু বলা আরম্ভ করে,
“সেই মেয়েটা ননাসের বহু পুরানো কাগজ, পত্র, চিঠি, ডায়েরি ঘেঁটে একদিন জানতে পারে তার ননাসের বাচ্চাটা আসলে মারা যায় নি। সে জীবিতই ছিলো। অথচ মেয়েটার প্রেমিক মেয়েটাকে বলেছিল তার ননাসের নাকি সঠিক ভাবে গর্ভপাত করানো হয়েছে। মেয়েটা বেশ অবাক হয় প্রাক্তন প্রেমিকের এমন ছলে। কোন কারণে প্রাক্তন প্রেমিক মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বাচ্চাটাকে বাঁচিয়ে রাখলো, কোথায় বা লুকিয়ে রাখলো জানার জন্য মেয়েটা তখন উৎকণ্ঠা প্রায়। পুড়ে যাওয়া ঘর থেকে এমন গোপন সত্য উদঘাটন হবে মেয়েটা ঘুণাক্ষরেও টের পায় নি। কিন্তু মেয়েটা চালিয়ে গেলো আত্মা হয়ে ঘুরার নাটক। হুট করেই একদিন সেই চা বাগানে আসা শহুরে এক ছেলে মারা যায়। যা নতুন রহস্যের সৃষ্টি করে। মেয়েটার কাছে মৃত্যু টা কেমন আশ্চর্যজনক ঠেকে। তার উপর সে ছেলের সাথে মেয়েটার এক কন্যা সন্তানের একটা সম্পর্কও গড়ে উঠেছিল যথাসম্ভব। কিন্তু মেয়েটা খেয়াল করলো, চা বাগানের সেই শহুরে ছেলের মৃত্যুতে তেমন ভাবান্তর দেখা গেলো না তার কন্যা সন্তানের মনে। তার সন্দেহ তখন গাঢ় থেকে গাঢ় হলো। সে বেশ সন্ধানী মস্তিষ্কে হাতড়ে কিছুই পেলো না কিন্তু বুঝতে পারলো গন্ডগোল টা ঐ শহুরে ছেলে গুলোর মাঝে। তারপরেই শহুরের অবশিষ্ট তিনজন ছেলে গুলোর মাঝে একজন পালিয়ে যায় কিন্তু চা বাগানের প্রজেক্ট বন্ধ করে না বাকি দু’জন। মেয়েটা তাই এমনই একদিন মধ্যরাতে অশরীরী সেজে ভয় দেখানোর জন্য সেই কোয়াটারে যায়। কিন্তু অস্বাভাবিক এক কথা শুনে মেয়েটা চমকে উঠে। তার নিজের পায়ের তলারই মাটি সরে যায়।”

রূপমাধুরীর এমন টান টান উত্তেজনা ময় জায়গায় থামতে দেখে অধৈর্য হয়ে গেলো বিজলি, কিছুটা তড়িঘড়ি করেই বললো,
“কি দেখেছিল মেয়েটা? কি হচ্ছিল?”

রূপমাধুরী দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে যায় তার গোপন অশ্রু গুলোও। কণ্ঠ ধরে আসে। সেই কণ্ঠ নিয়েই বলে,
“মেয়েটা শহুরে দুই ছেলেকে বলতে শুনে তার পরিবারকে যেন শেষ করে দেওয়া হয়। সাথে চা বাগানের কয়েকটা পরিবারেরও তারা ক্ষতি করবে যেন ভবিষ্যতে প্রজেক্ট নিয়ে কোনো ঝামেলা নাহয়। ছেলে গুলো নেশায় মগ্ন ছিলো যার জন্য মেয়েটার উপস্থিতি তারা টের পায় নি। দু’জন ছেলের মাঝে একজন নেশায় তখন এত মগ্ন ছিলো যে সাথে সাথে তার চোখ নিভে এলো। বিভোর ঘুমে তলিয়ে গেলো নিজের বিছানায়। মেয়েটা মোক্ষম সুযোগ পেয়ে যায়। ঘরের বাহিরে নুপুরের শব্দ তুলে, চুড়ির ঝঙ্কার তুলে। নেশায় আচ্ছন্ন হওয়া দ্বিতীয় ছেলেটি তখন চিন্তাশক্তির বাহিরে। সে দুলতে দুলতে চলে আসে বাহিরে। মেয়েটা খিল খিল করে হেসে ছুটে যায় বাগানের দিকে। তার পেছনে ছুটে সেই ছেলেও। অতঃপর গভীর আঁধারে দ্বিতীয় খু/নটাও করে ফেলে মেয়েটা। সেই রাতেই একা হাতে মাটি খুঁড়ে মাটিচাপা দিয়ে দেয় সেই মৃত দেহ। ততক্ষণে প্রায় ভোর হয়ে আসে প্রকৃতিতে। মেয়েটা বাড়ির পথে রওনা দেয়। সকাল হওয়ার আগেই তাকে বাড়িতে যেতে হবে। কেউ দেখে ফেললে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। হাতে, শরীরে তার রক্তে মাখামাখি। কিন্তু মেয়েটার ভাগ্য সেদিন তার সহায় ছিলো না। তার বাড়ির কাছেই এসে থেমে যায় সে কারণ,,”

রূপমাধুরী থামে, কেঁপে কেঁপে উঠে বিজলির শরীর। সে যেন অনাকাঙ্খিত কিছু টের পাচ্ছে, কিন্তু শোনার সাহস পাচ্ছে না। অথচ কৌতুহল তাকে বাধ্য করছে পরের টুকু জানার জন্য। কী হয়েছিল তারপর! তাই সে চুপ না থেকেই বললো,
“তারপর! কী হয়েছিল তার সাথে?”

“বিশ্বাসঘাতকতা।” রূপমাধুরীর কঠিন জবাব।

বিজলি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে মানবীর দিকে। তার বোধগম্য হয় না উত্তরের অর্থ টা। রূপমাধুরী হয়তো টের পায় বিজলির অবাক ভাব, তাই মুচকি হেসে বললো,
“বুঝিস নি তো? মেয়েটা সেদিন বিশ্বাসঘাতকতার সম্মুখীন হয়। তার বাড়ির সামনেই তার সাথে দেখা হয় তার প্রাক্তন প্রেমিকের। তাকে রক্তে মাখামাখি দেখে প্রাক্তন প্রেমিক যখন অবাক হয়ে জানতে চায় কারণ তখন মেয়েটা বিশ্বাস করে সবটা বলে দেয়। কিন্তু মেয়েটা কি আর জানতো সব কলকাঠি নাড়ছে যে মানুষটা তার সামনেই এসে সে পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো ভুল করেছে। মেয়েটাকে সেই প্রেমিক জানায় শহর থেকে নাকি মেয়েটার বড়ো কন্যা সন্তানের খবর এসেছে, খুব দ্রুতই যেতে হবে বলে প্রাক্তন প্রেমিক তাকে নিতে এসেছে। বড়ো মেয়ের কথা শুনে কেঁপে উঠে তার অন্তর আত্মা। বাড়িতে প্রবেশ না করেই পুকুর থেকে হাত মুখ ধুয়ে সে ছুটে চলে প্রেমিককে বিশ্বাস করে। অতঃপর তার ঠিকানা হয় নিষিদ্ধ পল্লী।”

শেষ কথাটা কিছুটা বিজলির মাথার উপর দিয়ে যায়। সে বোকা বোকা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“কীভাবে? প্রেমিক কী করেছিল?”

“মেয়েটাকে মিথ্যে বলে প্রেমিক শহরে এনে একটা ঘরে আটকে রাখে। মেয়েটার বয়স তখন পঁয়ত্রিশের এপাড় ওপাড়। মেয়েটা যখন জানতে চায় তাকে আটকানোর কারণ তখন চাঞ্চল্যকর তথ্য ভেসে আসে। প্রজেক্টের জন্য যাবতীয় বুদ্ধি নাকি প্রদান করেছে তারই প্রেমিক। তাদের সাথে যাবতীয় ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু সেই প্রেমিকই। এমনকি আরও একটা ঘটনা সে জানতে পারে। তার ননাসের যেই বাচ্চাটা সে ফেলে দিতে চেয়েছিল এটা আর কারো না, স্বয়ং তার প্রেমিকের। তার অগোচরে তার প্রেমিক আর ননাস অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলে। দু’জনের দেহের টানে দু’জন কাছে আসে। আর সেই ফলস্বরূপ সেই বাচ্চা যাকে ফেলে দিবে বলেও ফেলে নি। তার ননাস সঞ্চিত রেখেছিল প্রেমিকের কাছে। প্রেমিক ননাসকেও বাজে ভাবে ঠকিয়েছে যা সে নারী জানতে পারে নি কভু। তার দেহের তৃষ্ণা মিটানো পুরুষ যে সে সন্তানকে বিক্রি করে দিয়েছিল তার অগোচরে সেটা সেই হতভাগা নারীর অগোচরেই রইলো। এসব জেনে মেয়েটার সেদিন পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায়। তার অগোচরে তাকে কী বাজে ভাবেই না ঠকিয়েছিল তার এক কালীন প্রেমিক! সে বুঝতেও পারলো না? অতঃপর এই নিষিদ্ধ পল্লীই হয় তার ঠিকানা। মেয়েটা অনেক বার পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু পারে না। অতঃপর সহ্য করে থাকতে থাকতে আজ সে নেতিয়ে পড়েছে। তার শিকড় মাটির অনেক গভীরে চলে গেছে। চাইলেও সে আর ফিরে যেতে পারবে না।”

বিজলি নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ। সে কিছু বলতে চায় কিন্তু তার কণ্ঠ কেমন কেঁপে কেঁপে উঠছে। তবুও বেশ শক্তি সঞ্চয় করে বললো,
“সে মেয়েটা তৃতীয় খুনটা কাকে করলো? আর সে মেয়েটা কে? আপনি!”

শেষের শব্দটায় ছিলো বিস্ময় ভাব। তা দেখে হাসলো রূপমাধুরী। ব্যস্ত কণ্ঠে বললো,
“যা তুই গিয়ে জামা কাপড় বদলে ঘুমা। অনেক রাত হয়েছে। আমি কাজটা শেষ করে আসি।”

বিজলি আজ তার আপ্পার আদেশ মানলো না, বরং কেমন শান্ত কণ্ঠে বললো,
“আপ্পা, গর্তটা কেন খুঁড়েছেন? কী করবেন এখানে?”

রূপমাধুরী হেয়ালি করে উত্তর দিলেন, “গর্তটা দেখে কিসের কথা মনে পড়ছে?”

বিজলি নিখুঁত ভাবে তাকায় গর্তটার দিকে। এতক্ষণে সে খেয়াল করে গর্তটা। ভীত কণ্ঠে বলে,
“কবর!”

রূপমাধুরী হেসে উঠে বেশ ভয়ঙ্কর ভাবে। তুমুল শব্দে বিদ্যুৎ চমকায় আকাশে। খোলা চুলের পয়তাল্লিশ বর্ষীয়া নারীকে কেমন অপরূপ, গা ছমছমে সৌন্দর্যে মুড়িয়ে নিয়েছে প্রকৃতি। বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় রূপমাধুরীর পেছনের সাদা কাপড়ে মোড়ানো মৃত ব্যাক্তিকে চোখে পড়ে বিজলির। তার হাত কেঁপে উঠে। ছাতা উড়িয়ে নেয় বাতাসে। সে তুমুল ভয়ে ছুটে চলে যায় নিজ ঘরে। রূপমাধুরী হাসতে হাসতে বসে পড়ে, তাচ্ছিল্য করে বলে,
“যে প্রেমিকের হাত ধরে এসেছিলাম এখানে, তাকেই আজ দাফন করবো। দশটা বছর লেগে গেলো তাকে দাফন করার মহা উৎসব পালন করতে। আমি ছাড়ি নি কাউকে। যারা আমার বাড়ি পুড়িয়ে মেরে ফেলেছে আমার স্বামী, মেয়েকে, নিখোঁজ হয়েছে আমার আরেক মেয়ে তাদের আমি ছাড়ি নি।”

রূপমাধুরীর সাথে উন্মাদনায় মাতে প্রকৃতিও। ক্ষণে ক্ষণে বজ্রপাত হয়, রূপমাধুরী নিস্তেজ দেহটায় হাত বুলিয়ে, চোখের অশ্রু বিসর্জন দিতে দিতে বলে,
“প্রিয় প্রেমিক, খুব তো বলতে- ‘ছায়া তুই বড্ড সাহসী, একদম বীরাঙ্গনার ন্যায়।’ সেই বীরাঙ্গনাকে বারাঙ্গনা বানাতে তুমি একবারও ভাবো নি? ছায়ার পরেশ এতটা নিষ্ঠুর কীভাবে হলো? এতটা পাষাণ সে কী প্রেম বিচ্ছেদেই হয়েছিল? নিজের কন্যা সন্তানকেও এই পল্লীতে বিক্রি করতে তুমি একবারও ভাবলে না প্রেমিক? কতটা নোংরা ছিলে তুমি! তবে শোনো, আমি না বিজলির দিকে তাকালেই তোমাকে দেখতে পাই, এটা কখনোই বিজলিকে জানতে দিবো না। নরক জীবনকে আর নরক বানিয়ে কোনো লাভ আছে বলো?”

শেষের কথাটুকু প্রায় ফিসফিসিয়ে বলেই হা হা করে হেসে উঠলো ছায়া। কৃষ্ণচূড়া গাছ থেকে কয়েকটা লাল টকটকে কৃষ্ণচূড়া উঁকি মেরে দেখলো এই রহস্যময় বীরাঙ্গনার গল্প।

মধ্যরাতে কালো হুডি পড়ে বড়ো রাস্তা দিয়ে বাইক চালিয়ে যাওয়া মেয়েটার ফোন কেঁপে উঠলো। জানান দিলো তাকে কেউ স্মরণ করছে। মেয়েটা এক কিনারায় বাইক থামালো। মাথা থেকে হেলমেট খুলে ফোন রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে একটা মেয়েলি ব্যস্ত কণ্ঠ ভেসে এলো,
“কিরে পুষ্প, কাজ কতদূর? ভয় দেখাতে পারলি?”

হুডির পকেটে হাত ঢুকিয়ে মিষ্টি হেসে পুষ্প উত্তর দিলো,
“যে আগুনে আমাদের পুড়িয়ে ছিলো। সে আগুনই লাগিয়ে দিয়ে আসছি। আবার কয়েক বছরের জন্য চা বাগানের চিন্তা নেই, বিন্নী।”

অপর পাশ থেকে বিন্নী কোমল কণ্ঠে বললো,
“ভুলে যা অতীত। তুই আর চা বাগানের পুষ্প না। তার গল্প অনেক বছর আগেই মাটিচাপা পড়েছে।”

“তুই ভুলতে পেরেছিস সে গল্প, বিন্নী? সেদিন রাতে তোরা এসে আমাকে না বাঁচালে বাবার সাথে আমার লাশটাও পাওয়া যেতো। আর আমার বোন পত্র, তার কোনো খোঁজ আছে বল! কোনে খোঁজ নেই। না ঐ ছেলে গুলোর খোঁজ পেলাম। কেবল নভ ছেলেটা এখানের বাস দিয়ে যাওয়ার সময় বাস দুর্ঘটনায় মারা গেছে। কিন্তু আমার বোনটা কই গেলো বল?”

বিন্নী কেঁদে দেয়, ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“আমার পাতা হারিয়ে গেছে, আমার পাতা টা কই হারালো পুষ্প।”

“কাঁদিস না বিন্নী। আমি আসছি। তুই কাঁদলে আমারা ভালো থাকি কীভাবে বল? আসছি আমি।”

কথা শেষ করেই ফোন কাটলো পুষ্প। চোখ গুলো কেমন ঘোলা হয়ে গেলো! বিন্নী মেয়েটার দয়ায় আজও সে বেঁচে আছে অথচ তার সুন্দর পরিবার হারিয়ে গেছে কোথায়! সব শূন্য!

চোখের জল মুছেই বাইক স্টার্ট দিলো পুষ্প। মুহূর্তেই চলে গেলো অনেক দূর। বড়ো রাস্তার পাশ ঘেঁষে বসে থাকা নোংরা পাগলি বিড় বিড় করে বলতে লাগলো,
“তুমি আমায় ভালোবাসো নি, নভ। ভালোবাসো নি।”

একটা ভালোবাসা নামক শব্দ ভিন্ন মানুষকে ভিন্ন জায়গায় নিয়ে দাঁড় করিয়েছে। ভালোবাসা ভুল নয় তবে ভুল মানুষকে ভালোবাসা পৃথিবীর অন্যতম ভুল। যার জন্য রচিত হয় পাগল হওয়ার গল্প কিংবা বীরাঙ্গনা হইতে বারাঙ্গনা হওয়ার গল্প।

[সমাপ্ত]

(এতদিন ধৈর্য ধরে আমার পাশে থাকার জন্য এক মুঠো প্রেম দিলাম। নতুন বছর নতুন কোনো কিছু নিয়ে আমাদের দেখা হবে। প্রিয় পাঠক, আপানারা আমার শখের নক্ষত্র।)