বৃষ্টিস্নাত তুমি পর্ব-১২+১৩

0
443

#বৃষ্টিস্নাত_তুমি – (১২)
হুযাইফা মাইশা

সোফার একপ্রান্তে বসা পুর্ণতা। অন্য প্রান্তে ইয়াভকিন। পায়ের উপর পা তুলে আয়েশ করে বসে, হাতের দু আঙুল কপালে ঠেকানো। নেত্রযুগল বন্ধ, কপালে গুটি কয়েক ভাঁজ। এই মূহুর্তে কেউ তাকে দেখলে, নিঃসন্দেহে বলে দেবে সে চিন্তিত।
সময় গড়ায়। গভীর ভাবনা শেষ করে, চোখ বন্ধ রেখেই শান্ত কণ্ঠে বলে,
‘ এবার বলো, কি হয়েছে?’

পূর্ণতা নিরুত্তর। শান্ত দেখাচ্ছে তাকে, অত্যাধিক শান্ত! স্বাভাবিকও বটে, অথচ সে মোটেও স্বাভাবিক নয়! নিজেকে স্বাভাবিক বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টায় মত্ত সে। কর্ণকুহরে প্রশ্নটা দ্বিতীয়বারের মতো প্রবেশ করলেও, বিশেষ ভাবাবেগ সে দেখাল না। নিরুত্তর, নিশ্চুপ হয়ে দৃষ্টি রাখে অফ করা টিভিটায়। এতে যে ওপর প্রান্তে বসা মানুষটা ভয়ং’কর রেগে গেছে তা বিন্দুমাত্র খেয়ালে নেই ওর। গা’লে চাপ অনুভব করতেই সে তড়াক করে দৃষ্টি সরায়।
ইয়াভকিন উঠে এসে, একহাতে ওর দু’গাল শক্ত করে চেপে ধরে,
‘ কিছু জানতে চেয়েছি আমি!’
‘ বলতে বাধ্য নই।’
‘ বাধ্য তুমি, একশবার বাধ্য!’
ধ’মকের স্বর অথচ, কি প্রবল অধিকারবোধ!

মুখ ফেরাতে চাইল পূর্ণতা। না পেরে মাথা পেছনে সরিয়ে দূরত্ব বাড়াতে চেষ্টা করলো। বিশেষ লাভ হলোনা। আরো ঝুঁকে এল ইয়াভকিন। চোখে চোখ রেখে বলল,
‘ আমাকে বললে কি হবে?’
‘ কিছুনা।’
‘ তাহলে বলো..’
‘ না।’
‘ তাহলে তোমার ফ্ল্যাট থেকে বের হওয়া পুরোপুরি বন্ধ। ভার্সিটিতেও যেতে পারবেনা।’
‘ অধিকার দেখাচ্ছেন? জোর খাটাচ্ছেন?’
‘ যা আছে, দেখাবোই। আমাদের মধ্যকার সম্পর্ক কি, সেটা তুমিও জানো। এমন একটা সম্পর্ক, যেখানে তোমার উপর আমার অধিকার বেশি।’

বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় পূর্ণতা। গাল ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসল ইয়াভকিন। শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
‘ কি কারণে কেঁদেছ? দেখো, এবার উত্তর না দিলে কিছু একটা করে ফেলবো আমি। তুমি আমায় চেনোনা, মেয়ে। বিন্দুমাত্র চেনোনা।’

ভয় পেয়েই হোক আর যা, পূর্ণতা মিনমিন স্বরে বলল,
‘ ভার্সিটিতে ছোটখাটো ঝা’মেলা হয়েছে। খুবই ছোট। আপসেট ছিলাম তো, তাই হুট করে কান্না পেয়ে গেল। আর কিছুনা।’

বাক্যগুলো যে সম্পূর্ণ মিথ্যা, তা ধরতে বেশ সময় লাগলোনা ইয়াভকিনের। চোখ বন্ধ করে নিজেকে ধাতস্থ করে উঠে দাঁড়াল। রুমের দিকে পা বাড়াল। রাগে তখন মাথায় ধপধপ করে আগু’ন ধরেছে যেন। অথচ, সে বাইরে থেকে শান্ত, স্বাভাবিক!

তরকারির বাটি একে একে টেবিলে সাজিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইল পূর্ণতা। ত্রিশ মিনিট অতিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও, ইয়াভকিনের দেখা নেই। এক ঘন্টা লাগিয়ে এখনো সে ফ্রেশ হচ্ছে?
না পারতে উঠে দাঁড়ায়। পা বাড়ায় ইয়াভকিনের রুমের দিকে। দরজাটা পুরো খুলে রাখা। একটু উঁকি দিতেই ইয়াভকিনের দেখা পেল। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে সে দিব্যি সিগা’রেট ফুঁকছে। পরনের সাদা শার্ট পালটিয়ে খয়েরী রঙের শার্ট জড়িয়েছে গায়ে। চুলগুলো অবিন্যস্ত হয়ে কপালে ছড়ানো, কিছুটা দেখা যাচ্ছে। লম্বাটে মুখশ্রীর একাংশ দেখা যাচ্ছে স্পষ্টভাবে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করে নিচের দিকে চোখ গেল পূর্ণতার। দামী লাল কার্পেটের উপর কয়েকটা সিগা’রেটের ক্ষুদ্র অংশ গড়াগড়ি খাচ্ছে। লোকটা এতো সিগা’রেট খায়! ধুপধাপ ফেলে এগিয়ে যায়। ইয়াভকিনের হাতে থাকা সিগা’রেটটা কে’ড়ে নিয়ে ফেলে দেয়। পরপরই স্থির কণ্ঠে বলে,
‘ খাবার বেড়ে রেখে এসেছি, ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। চলুন।’

মাথায় চড়া রাগ তখন মিইয়ে গেল ইয়াভকিনের। কাতর স্বরে বলল,
‘ এতো কাছে এসোনা, পূর্ণতা। উল্টা পাল্টা কিছু করলে তখন দো’ষ দিবে!’

পূর্ণতা হকচকিয়ে সরে গেল। ওদের মধ্যকার দূরত্ব ছিলো ইঞ্চি খানেক। ইয়াভকিনের এরূপ কথায় ওর মনে হলো, সে গুরুতর কোনো এক অপ’রাধ ঘটিয়ে ফেলেছে! নিজেকে ধাতস্থ করে কাঁধের দিকটার ওড়না টেনে নিল আরেকটু। বলল,
‘ খাবার?’
‘ খাবোনা, চলে যাও। একা থাকতে দাও।’

অপমানে থমথমে হলো পূর্ণতার চেহারা। ধুপধাপ পা ফেলে বেরিয়ে গেল। সে বেরিয়ে যেতেই আবারও নতুন আরেকটা সিগা’রেট ধরাল ইয়াভকিন।

কোনোমতে কয়েক লোকমা ভাত গিলে উঠে সব রেখে দিয়ে রুমে এল পূর্ণতা। মাথা চাড়া দিয়ে উঠল দুপুরের ঘটনাটা। তন্ময়ের মুখের সেই বি’শ্রী হাসি! ওসব ভাবতে ভাবতে হেলেদুলে এগিয়ে গিয়ে বিছানায় বসে পড়ল। তক্ষুনি হন্তদন্ত পায়ে রুমে ঢুকলো ইয়াভকিন। ভ্রু কুঁচকিয়ে ফোন এগিয়ে দিল পূর্ণতার দিকে। ভাবনায় ছেদ পড়েছে অনেক আগেই, হাত বাড়িয়ে ফোন নিয়ে পূর্ণতা ফোন ঠেকালো কানে। ওপাশ থেকে ভেসে এল ফারুক সাহেবের কণ্ঠস্বর,
‘ ফোন কোথায় থাকে তোমার? তোমার মা তো চিন্তা করতে করতে অস্থির! কবে একটু বুদ্ধি হবে তোমার!’

হকচকিয়ে একবার ব্যাগের পাশে রাখা ফোনের দিকে তাকায় পূর্ণতা। সেটা হাতে তুলে অন করার চেষ্টা করে। চার্জ নেই ফোনের! তাই কল এসেছে কিনা খবর জানা নেই ওর। ইয়াভকিনের ভ্রু জোড়া বাঁকানো। পূর্ণতা ফারুক সাহেবের সাথে কথা সেড়ে হেনার সাথেও কথা বললো। মেয়েকে কড়া কড়া কয়েকটা উপদেশ দিলেন উনি। ফোন টোন না ধরা যেন এক বিরাট অপরা’ধ। আশ্চর্যজনক কান্ড!

কথা শেষে ফোনটা এগিয়ে দেয়ার জন্য উদ্যত হলো পূর্ণতা। তক্ষুনি আরেকটা কল এল। স্ক্রিনে নাম্বার ভেসে উঠল। তার উপর গুটি গুটি ইংরেজি অক্ষরে লেখা নাম ভেসে উঠল, ‘Tiha’। না চাইতেও কৌতুহলবশত সেটা দেখে ফেললো পূর্ণতা। কৌতুহল মা’রাত্মক জিনিস!
সে এক মূহুর্তের জন্য থমকে গেল। তিহার সাথে ইয়াভকিনের যোগাযোগ আছে! মন-মস্তিষ্কে এই কথাটা গেঁ’থে গেল। ইয়াভকিন নিজ থেকেই ফোনটা নিয়ে নিল। তিহার নাম্বার দেখে সে নিজেও অপ্রস্তুত হল। সেই সাথে খেয়াল করল পূর্ণতার অসন্তুষ্ট চেহারা। পূর্ণতা উঠে দাঁড়িয়ে সরে গেল অন্যপাশে। ইয়াভকিন এগিয়ে এল একটু। ফোনটা তখনও বাজছে বিকট শব্দে। সেটা সাইলেন্ট করার চেষ্টা চালিয়ে ইয়াভকিন পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ পূর্ণতা, শুনো.. এদিকে তাকাও।’
‘ আমি ঘুমাবো, রুমে যান। মাথা ধরেছে আমার, ঘুম পাচ্ছে। ডিস্টার্ব করবেন না।’
ইয়াভকিনের বলতে মন চাইল, ‘ করব করব! একশবার করব!’

কিন্তু এই মূহুর্তে পূর্ণতাকে আরও তেঁতিয়ে দিতে মস্তিষ্ক সায় দিলোনা। সে বেরোনোর কথা কানেই তুললনা। ততক্ষণে কল কেটে গেছে। সেকেন্ড কয়েক গড়াতেই আবারও বিকট শব্দে বেজে উঠল ফোন। তিহা অনবরত কল করছে! ইয়াভকিন বিরক্ত হয়ে গেল। পূর্ণতা একটা বই হাতে নিল। সেদিকে নজর তার। ঝাঁ’ঝাল কণ্ঠে বলল,
‘ কানের কাছে ফোন বাজছে, রিসিভ করুন।’

আবার কল কেটে যাওয়ার সাথে সাথে ম্যাসেজ এল, ‘ কল ধর, ইম্পর্ট্যান্ট কথা আছে। কাইন্ডলি, ধর।’

না চাইতেও কল রিসিভ করল ইয়াভকিন। ইচ্ছে করেই লাউড স্পিকারে দিয়ে দিল। পূর্ণতা তখন তীক্ষ্ণ চোখে ফোনের দিকে তাকিয়ে। কল ধরতেই ওপাশ থেকে তিহার কণ্ঠ ভেসে এল,
‘ হ্যালো, ইয়াভকিন? তোর অফিসে গেছিলাম। ভাবলাম, দেখা করে আসি। কিন্তু গিয়ে তোর ম্যানেজার এর থেকে শুনলাম তুই চলে গেছিস। দেখাটা হলোনা!’

অপ্রস্তুত হয়ে লাউড স্পিকার অফ করতে চাইল ইয়াভকিন। অমাবস্যার ন্যায় দেখালো পূর্ণতার মুখশ্রী। সে ইয়াভকিনকে থামিয়ে দিল। হাত দিয়ে স্পিকার অফ করার জন্য মানা করল। রীতিমতো শা’সিয়ে ইশারা করল যেন।

‘ শুধু শুধু অফিসে আসার মানে হয়না তিহা।’
‘ দেখ, পাস্ট ইজ পাস্ট। রিলেশনের ব্যাপারটা বাদ দিলে কিন্তু আমরা গুড ফ্রেন্ডস।’
‘ ফ্রেন্ডশিপের ইতি টানা হয়নি শুধু মুখে। সত্যি বলতে তোর মতো ফ্রেন্ড রাখার ইচ্ছা নেই। বাড়াবাড়ি করিস না।’

কথা শেষে কল কেটে দিল ইয়াভকিন। ধুম করে ব্ল’ক’লিষ্টে ফেলল তিহার নাম্বার। মেয়েটা এমন কেন!
পূর্ণতা আচমকা তাকে ঠে’লা শুরু করলো। ঠেলেঠুলে বাইরে বের করল রুমের। মুখের উপর ধরাম শব্দে দরজা চাপিয়ে দিল। ওপাশ থেকে ইয়াভকিনের চেঁচানো কণ্ঠস্বর ভেসে এল,
‘ দরজা খুলো, আমার তোমার সাথে কথা আছে পূর্ণতা। এক্সপ্লেইন করতে দাও এটলিস্ট! প্লিজ!’

চলবে।

#বৃষ্টিস্নাত_তুমি – (১৩)
হুযাইফা মাইশা

পরদিন। রাতে খাবার নিঃশব্দে খেয়ে আবার রুমে গিয়ে দরজা চাপিয়ে দিয়েছিল পূর্ণতা। ইয়াভকিন বারান্দায় ছিল বিধায় দেখেনি। যখন বুঝেছে, ততক্ষনে আবারও রুমে চলে গেছে পূর্ণতা। হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে সে নিজেও রুমে চলে এসেছিল। না খেয়েই রাত পার করল।

পূর্ণতা নাশতা না করেই বের হলো। গন্তব্য ভার্সিটি। তন্ময়ের কারণে ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাস মিস দেয়ার মত কাজ সে করবেনা। সামনে এক্সাম, বুঝেশুনে চলাই মঙ্গল। তন্ময়কে এত দিনে এটুকু চিনেছে সে, ওত সহজে পিছু ছাড়বেনা ছেলেটা।

পূর্ণতা একটানা তিনটে ক্লাস করে হাঁপিয়ে উঠল। স্যারদের লেকচার মাথায় ঢুকছেনা আর। এক ঢোক পানি গিলে আবার মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা চালায়। বিশেষ লাভ হলোনা তাতেও। মাথায় কিসব উদ্ভট চিন্তাভাবনা ঘুরছে। সেসব একপাশে সরিয়ে রেখে ক্লাসে মনোযোগ দেয় খুব কষ্ট করে। ক্লাস শেষ হতেই ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে আসে। নওশিনের তখন ক্লাস চলছে। মেয়েটাকে চেনে সে, সেই ফার্স্ট ইয়ার থেকে। বর্ষাকে চেনে তার কয়েক মাস পর থেকে। দু’জনের মধ্যে বর্ষা তার সবচেয়ে বেশি ক্লোজ। বেস্ট ফ্রেন্ডই বলা চলে। পূর্ণতা ক্লাস থেকে বের হওয়ায় সেও বের হলো পিছু পিছু। চটপটে কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘ মনমরা দেখাচ্ছে কেন?’
‘ কই, কিছুনা।’
‘ কালকে হুট করে চলে গেলি…’

প্রত্যুত্তর দেয়ার আগে নজর যায় এদিকটায় হেঁটে আসা তন্ময়ের দিকে। পেছনে তার পুরো বন্ধু বাহিনী! আর কিছু না বলে পূর্ণতা বর্ষার হাত চেপে ধরল,
‘ লাইব্রেরিতে যাই, চল।’

কিন্তু যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই তন্ময় চঞ্চল পায়ে হেঁটে এসে পথ আটকায়। বলে,
‘ পালিয়ে যাওয়ার রাস্তা নেই আপাতত। এতো পালাই পালাই করে তো লাভ নেই, ঘুরেফিরে আমার কাছেই আসতে হবে।’

এই ছেলের এমন চালচলন, কথাবার্তা! দুদিন আগে যে ক’ষে একটা থা’প্প’ড় খেয়েছে, তাও ভরা ক্যাম্পাসে, সেটা মনেহয় ভুলে গেছে। রক্তিম চোখে চেয়ে পূর্ণতা বলে,
‘ লজ্জা শরম কি বাজারে বিক্রি করে এসেছেন? থা’প্প’ড় খেয়েও মন ভরলোনা?’
‘ ওমন নরম হাতের ছোঁয়া পাওয়ার জন্যে যদি থা’প্প’ড় খেতে হয়, তবে তাই শ্রেয়। আচ্ছা, এবার চলো। অনেকদিন পিছু পিছু ঘুরেছি। এবার সোজা ডেটে যাবো দু’জনে।’

বলতে বলতে সে হাত চেপে ধরে পূর্ণতার। বর্ষা আতঙ্কিত হয়ে কিছু উচ্চারণ করতে চাইলে, পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা তাকে ধ’ম’ক দিয়ে উঠে। তবুও বর্ষা খানিকটা গলা উঁচিয়ে তন্ময়কে পূর্ণতার হাত ছাড়তে বলে। কিন্তু সেসব তন্ময় কানে তুললে তো! সে একপ্রকার টেনেই নিয়ে যেতে উদ্যত হয় পূর্ণতাকে। বলিষ্ঠ দেহের তন্ময়ের কাছে নিঃসন্দেহে পূর্ণতার শক্তি খুবই নগণ্য। সেদিন তন্ময় তেমন শক্তি প্রয়োগ করেনি বিধায় ঠা’স করে থা’প্প’ড়টা দিয়েছে পূর্ণতা। কিন্তু আজ দুই হাতই তন্ময়ের হাতের মুঠোয় ব’ন্দি। বর্ষা পিছু আসতে নিলেই তাকে আগের মেয়েটা আটকে দেয়। পূর্ণতা চেঁচিয়ে উঠে। গেটের পাশে মানুষজন কম। হাতে গোনা যারা আছে, তারা নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে মজা দেখছে। কম বেশি সবাই-ই তন্ময়কে চেনে।

কিন্তু গেটের পাশটায় আসতেই হাতের বাঁধন ঢিলে হয়ে এল। সেই সুযোগে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল পূর্ণতা। দৌঁড়ে গিয়ে গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার পেছনে আড়াল করল নিজেকে। মেয়েটা হাঁপিয়ে গেছে, জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে ঘনঘন। সেদিকে শান্ত নজরে চোখ বুলিয়ে দরজা খুলে দিল ইয়াভকিন। উঠে বসার জন্য বলতে হলোনা পূর্ণতাকে। ইয়াভকিন একবার তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে উঠে পড়ল গাড়িতে।

তন্ময়ের চোখে সামনেই গাড়িটা ধুলো উড়িয়ে দৃষ্টিসীমানার বাইরে চলে গেল। সেদিনও এই ছেলেকে দেখেছে, আজও! ছেলেটা নিশ্চিত পূর্ণতার আপন কেউ, খুব আপন…

পূর্ণতাকে এপার্টমেন্টের সামনে নামিয়ে দিয়ে, গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেল ইয়াভকিন। আসার সময় একটা শব্দ উচ্চারণ করেনি, বরং ভীষণ শান্ত হয়ে ড্রাইভ করছিল। পূর্ণতাও যেচে কিছু বলেনি। নামানোর পূর্বে কেবল ওর লালচে হওয়া হাত দু’টোয় চোখ বুলিয়ে চলে গেছে ইয়াভকিন।

_

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামল। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছিল এতক্ষণ। এবার শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টি। ইয়াভকিনের ফোন বন্ধ, বারবার কল করায় এটাই বলছে। ক্লান্ত পূর্ণতা একসময় বৃথা চেষ্টা থামিয়ে দিল। লোকটা এতক্ষণ অফিসে? অফিস কোথায় সেটাও জানেনা। তাছাড়া বাইরে তুমুল বৃষ্টি। জানালা গলিয়ে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পূর্ণতাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে বারংবার। হঠাৎ গায়ে সাদা জর্জেটের ওড়না জড়িয়ে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে এদিক সেদিক তাকায়। প্রত্যেক ফ্লোরে তিনটে করে ফ্ল্যাট। বিল্ডিংটা নয়তলা। এই ফ্লোরে একটা ফ্ল্যাট খালি। অন্য আরেকটায় মানুষ, তবে সময়ের অভাবে কোনোদিনই কথা কিংবা দেখা হয়নি। সেই ফ্ল্যাটের দরজা পুরোপুরি খোলা। ভেতর থেকে চেঁচানোর শব্দ কানে আসছে। না চাইতেও ওদিকে চোখ বুলাল পূর্ণতা। তক্ষুনি মাঝ বয়সি এক মহিলা দরজা লাগাতে এলেন। বলাবাহুল্য, এই ফ্ল্যাট দু’টো মুখোমুখি। তিনি পূর্ণতাকে দেখে দরজা লাগালেন না, হাস্যোজ্জ্বল মুখে জিজ্ঞেস করেন,
‘ এই ফ্ল্যাটে থাকো নাকি তুমি?’
‘ জ্বি,আন্টি!’
‘ বাসায় কেউ নেই নাকি?’
‘ আমার হাজবেন্ড অফিসে, আপাতত একাই..’ সৌজন্যতামূলক হাসলো পুর্ণতা। ভদ্র মহিলা বোধহয় একটু বেশিই মিশুক। তিনি আবারও বলেন,
‘ তাহলে দরজা লাগিয়ে আমার ফ্ল্যাটে আসো। তোমায় সেদিন একবার দেখেছিলাম। কথা হয়নি।’

পূর্ণতা অবাধ্য হলোনা। ফ্ল্যাটের দরজা লাগিয়ে এগিয়ে গেল।
সোফায় বসে লিফটের ওদিকটা সরাসরি দেখা যায়। দরজা যেহেতু পুরো খোলা। ভদ্র মহিলা চট করে এক গ্লাস শরবত করে নিয়ে এলেন। এমন ঠান্ডা ঠান্ডা পরিবেশে উনি শরবত কেন বানালেন, এই প্রশ্ন মনে জাগলেও জিজ্ঞেস করলনা পূর্ণতা। উনি এগিয়ে দিলেন গ্লাসটা। হাতে নিয়ে নিল ও। ভদ্রমহিলা বসলেন সামনের সোফাটায়। বললেন,
‘ আমাদের ঘরে পুরুষ মানুষ বলতে শুধু তোমার আঙ্কেল। উনি ঢাকার বাইরে গিয়েছেন ক’দিনের জন্য। আমার মেয়ে আর আমি এই দু’দিন ধরে একাই আছি। তা তোমাদের বিয়ে কবে হলো?’
‘ এইতো গত মাসেই হলো।’
‘ নিউলি ম্যারিড, বাহ!’

টুকটাক কথা বলতে সময় গড়াল। ভদ্র মহিলার নাম রাফিয়া। ভীষণ স্মার্ট মহিলা, অত্যাধিন মিশুকও। জব করতেন এক কালে। এরপর মেয়ে হওয়ায় নিজ ইচ্ছায়ই জব ছেড়ে দিলেন। মেয়ে কলেজ-কোচিং এ থাকাকালীন সময় বড্ড একাকী থাকে উনি। এতোদিন পর কথা বলার মতো পেয়ে নিজের প্রেম কাহিনী শুনাচ্ছেন। পূর্ণতাও আগ্রহ নিয়ে শুনছে, সাথে লিফটের দিকে তাকাচ্ছে। হঠাৎ ইয়াভকিনকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। চঞ্চল কণ্ঠে বলল,
‘ আজ আসি আন্টি। উনি চলে এসেছেন।’
রাফিয়া হেসে বিদায় দিলেন।

পূর্ণতা দেখল, ইয়াভকিন ভিজে জবুথবু। পাশে আরেক অপরিচিত পুরুষ।
শাফায়াত পূর্ণতাকে সালাম দিলো। স্যারের বউকে আজ প্রথম দেখছে সে। ইয়াভকিন ভ্রু কুঁচকে পূর্ণতাকে দেখছে। অফ হোয়াইট শার্টটা ভিজে লেগে আছে গায়ে। ব্যান্ডেজ করা হাতটা তখন পেছনে লুকানো। পূর্ণতা সালামের উত্তর দিয়ে ফ্ল্যাটের দরজা খুলল। ইয়াভকিন ঢুকে শাফায়াতকে বলল,
‘ ভেতরে আসো শাফায়াত।’
‘ না স্যার, বাসায় ফিরতে হবে। সাবধানে থাকবেন স্যার, কিছু লাগলে ফোন করবেন। ঔষধের প্যাকেটগুলো?’
‘ আস্তে বলো।’
বলতে বলতে শাফায়াতের হাত থেকে সেগুলো নিয়ে নিল। শাফায়াত যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। পেছন হতে ইয়াভকিন চেঁচিয়ে বলল,
‘ গাড়ির চাবিটা নিয়ে যাও শাফায়াত। এই বৃষ্টিতে যাবে কি করে?’
শাফায়াত হেসে বলে,
‘ যেতে পারবো স্যার। গাড়ি লাগবেনা।’
লিফটে চড়ে সে চলে গেল।

‘ কিসের ঔষধ?’

চমকে তাকাল ইয়াভকিন। পূর্ণতা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। সে উত্তর দেয়ার প্রয়োজনবোধ করলোনা। গা ছাড়া ভাবে রুমে যেতে যেতে প্রশ্ন রাখল,
‘ ওই ফ্ল্যাটে কি করছিলে?’
‘ আন্টি ডাকছিলেন।’ বলতে বলতে পূর্ণতা গেল পিছু পিছু। নজরে আসে ইয়াভকিনের ব্যান্ডেজ করা হাত। আঁতকে উঠে জিজ্ঞেস করে,
‘ হাতে কি হয়েছে?’
‘ সামান্য কে’টে লেগেছে।’
‘ কিভাবে, দেখি হাতটা।’

বলতে বলতে সে এগিয়ে যায়। হাতটা অতি সন্তপর্ণে নিয়ে নেয় নিজের নরম দু’হাতের মু’ঠোয়। চিন্তিত নেত্রযুগলে এপিঠ-ওপিঠ পরখ করে। ইয়াভকিন শান্ত চোখে তাকায় ওর দিকে। ডানহাতে জ’খ’ম। সেজন্য বাম হাত দিয়ে থুতনি ধরে পূর্ণতার মুখ উঁচিয়ে ধরে বলে
‘ ভার্সিটিতে থাকতে টুকটাক মা’রা’মা’রি করেছি। সেই কাজটা আজ আবার করতে হলো। ব্যাক্তিগত জিনিসে অন্য কারোর হস্তক্ষেপ বরাবরই আমার অপছন্দ।’

থুতনি থেকে হাত সরিয়ে, হালকা করে চেপে ধরে পূর্ণতার দু’গাল। অত্যন্ত শান্ত, ঘোর লাগা কণ্ঠে ফিসফিস করে শুধায়,
‘ এখন বলো, মিথ্যা বলার জন্যে পা’নি’শ’মেন্ট কি দেব? থা’প্প’ড় নাকি চুমু?’

চলবে।