#বৌপ্রিয়া
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#অন্তিম পর্ব
কুসুমের জ্ঞান ফেরে ততক্ষণে কুসুমের মা, ভাই, ভাবি কুসুমের পাশে এসে বসে। কুসুম নিজের পরিবারকে দেখে উচ্ছসিত হয়ে উঠে বসার চেষ্টা করল,
‘তোমরা কখন এলে? আমাকে ডাকো নি কেন? এতক্ষণ ঘুমাচ্ছিলাম।’
ঊষা ইয়াহিয়ার পাশে বসে ছিল। আড়চোখে ইয়াহিয়ার গুরুগম্ভীর চেহারার দিকে চেয়ে ঢোক গেলে। কুসুমের পিঠের পিছনের বালিশ ঠিক করে দিয়ে বলে,
‘তুই ঘুমে ছিলি না, বরং অজ্ঞান ছিলি।’
কুসুম ফ্যালফ্যাল চোখে তাকাল ঊষার দিকে। ইয়াহিয়া ঊষার দিকে কিছু একটা ইশারা করল। ঊষা চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করল ইয়াহিয়াকে। ইয়াহিয়া মায়ের দিকে তাকাল।
‘আম্মা, আমরা বাইরে যাই? ঊষা কথা বলুক।’
সাহেদা ছলছল চোখে মেয়ের কপালে হাত রেখে তাপমাত্রা মাপেন। স্বাভাবিক গায়ের তাপমাত্রা। সাহেদা মেয়ের চুলে হাত বুলিয়ে বেরিয়ে যান ঘর ছেড়ে। দরজার বাইরে পারুল দাড়িয়ে। সাহেদা বোনকে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। ইয়াহিয়াকে অন্য ঘরে যেতে বলে বোনের সঙ্গে একা থাকেন। পারুল ভ্রু কুচকে বোনের দিকে চেয়ে আছেন। সাহেদা বললেন,
‘তুমি আমাকে কথা দিয়েছিলে, আপা। তবুও?’
পারুল কিছু বলার আগে উচ্ছ্বাস ফলের প্লেট নিয়ে দরজার সামনে আসে। দুজনের কথা একটু-একটু শুনে। তারপর নিজেই উত্তর দেয়,
‘কুসুম সুস্থ আছে খালামনি। ওর প্রেশার স্বাভাবিক, ওজন বেবি ক্যারি করার জন্যে ঠিকাছে, তাছাড়া আগামীকাল ওর টেস্ট করানো হবে। এসব খবরের ন্যায় বাকি খবরও আশা করি ভালো আসবে। বাকি রইল, ওর পড়াশোনা। কুসুম পুরো পড়াশোনা কমপ্লিট করবে, এটা আম্মার না, আমার ওয়াদা। আমি অর্ধ শিক্ষিত বউ আমার ঘরে এলাও করব না। ডোন্ট ওরি, খালামনি।’
সাহেদা আর কিইবা বলবেন। বোনের ছেলের মুখে যা যা জানতে চেয়েছেন, সব জেনে ফেলেছেন জিজ্ঞেস করার পূর্বেই। আরো কিছু জিজ্ঞেস করা মানে লজ্জা শরমের জলাঞ্জলি দেওয়া। মেয়ের মা হয়ে মেয়ের প্রেগনেন্ট হওয়ার ব্যাপারে অতটা জিজ্ঞেস করা যায় না, মুখে বাঁধে। তাই সাহেদা তখনের মত চুপ থাকলেন।
উচ্ছ্বাস দরজা খুলে রুমে ঢুকবে, পেছন থেকে শিউলি জানিয়ে দেয়,
‘রুমে ভাবির সঙ্গে জরুরি কথা বলছে ঊষা আপা। তুমি একটু পরে ঢুকো, ভাইয়া।’
উচ্ছ্বাস থেমে যায়। ঠাই দাঁড়িয়ে থাকে দরজার ওপাশে।
______
‘এসব কি কুসুম? তোকে আমি বিয়ের আগে বলেছিলাম না সতর্ক থাকতে। অযথা পাগলামি না করতে? এখন তোর পড়াশোনা গোল্লায় যাবে। এত তাড়াহুড়োর কি ছিল? উচ্ছ্বাস কিভাবে তোকে সাপোর্ট করল এই ব্যাপারে। ওকেও তো বলা হয়েছে। ফুপু তোর বিয়ে এজন্যেই এত দ্রুত দিতে চায়নি। তবুও দিয়েছে তোর শাশুড়ির মুখের দিকে চেয়ে। অথচ আসল ঘর শত্রু বিভীষণ তো তুইই।’
কুসুম কি ঊষার এসব বকাঝকা শুনছে? সে তো পেটের উপর হাত রেখে কল্পনায় ভাসছে। সেদিন উচ্ছ্বাস কিছুটা অসাবধান না হলে আজকে এমন একটা মুহুর্ত মোটেও পাওয়া হত না কুসুমের। কুসুমের মেঝেতে নাচতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আপাতত সে মুখ দুঃখী বানিয়ে রেখেছে। ঊষা বকছে, এখন হাসলে বকার মাত্রা দ্বিগুণ হবে। ঊষা কুসুমের খুশি হয়ত কিছুটা বুঝতে পারল। তাই ঊষা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘এখন থেকে একটু সতর্ক থাকিস, কুসুম। কখন কি হয়ে যায় বলা যায় না। যা লাগবে, এ বাড়ির মানুষের সঙ্গে শেয়ার করিস। যদি মনে করিস এদের সঙ্গে শেয়ার করা যাচ্ছে না, তাহলে আমাকে কল করিস। আমি সর্বদা তোর পাশে ছায়ার মত আছি।’
কুসুম আবেগপ্লুত হল। কিছুটা এগিয়ে ঊষাকে জড়িয়ে ধরে। ঊষা উপলব্ধি করে কুসুম কাঁপছে। ঊষা কুসুমের মাথায় হাত বুলায়। ভেজা কণ্ঠে বলে, ‘মা হয়ে যাচ্ছিস, কুসুম। ভাগ্যটা কতটা তোর পক্ষে কাজ করল, অনুভব করছিস?’
কুসুম ঊষার ঘাড়ে মুখ রেখে বলল, ‘তোমরা সবাই আমার ভাগ্যে এতটা সুখ নিয়ে কেন এসেছিলে আপা? এই বিয়ে, এই পরিবার, এই বাচ্চা, আর তোমরা কোনো কিছু নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই আমার আপা। একটুও না। আমি সুখী, নীল আকাশের মত করেই আমি খুব সুখী আজ, আপা।’
__________________________
উচ্ছ্বাস কিছুক্ষণ আহাম্মকের ন্যায় কুসুমের দিকে চেয়ে রইল। কুসুম বমি করছে অনবরত। উচ্ছ্বাস একবার নিজের শার্টের দিকে, আরেকবার কুসুমের দিকে তাকাচ্ছে। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল,
‘ব্র্যান্ডের পারফিউমের গন্ধেও বমি? কোথায় যাব আমি। কুসুম, শেষ তোমার?’
কুসুম থামল। ক্লান্ত হয়ে হেলে পরল উচ্ছ্বাসের বুকের উপর। উচ্ছ্বাস
সঙ্গেসঙ্গে আগলে নিল কুসুমের নরম গা। ভেজা টাওয়াল দিয়ে কুসুমের মাথায় মুখ মুছে নিয়ে অসহায় কণ্ঠে বলল,
‘আরো হবে বমি?’
কুসুম মাথা নাড়িয়ে মানা করল। উচ্ছ্বাসকে নিশ্চিন্ত হতে দেখা গেল। কুসুমকে আঁকড়ে ধরে বিছানায় এনে বসাল সে। কুসুম বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে। উচ্ছ্বাস কুসুমের পাশে বসে কুসুমের ঘামে ভেজা হাত নিজের হাতে চেপে ধরে। ধীমে স্বরে বলে,
‘কেন আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কনসিভ করতে গেলে কুসুম? কি হত কটা দিন অপেক্ষা করলে? ততদিনে নিজেও কিছুটা শক্ত হতে। আমিও বাবা হবার জন্যে প্রস্তুত হতাম।’
কুসুম শুকনো গলা লালা দিয়ে ভেজাল। ক্লান্ত হাতে উচ্ছ্বাসের গাল ছুঁয়ে দিল। বলল,
‘আপনি বাবা হবার জন্যে প্রস্তুত না হলেও, আমি মা হবার জন্যে প্রস্তুত ছিলাম। আচ্ছা ভাবেন তো, ছোট্ট হাত পা আপনি ছুঁয়ে দিচ্ছেন, কোলে নিচ্ছেন, তার নরম গালে চুমু দিচ্ছেন, সে আপনাকে প্রথমবার বাচ্চা কণ্ঠে বাবা বলে ডাকবে, আমাকে মা ডাকবে, আপনি হসপিটাল থেকে এলে সে দৌঁড়ে ঝাঁপিয়ে পরবে আপনার বুকে। আপনি কি কল্পনা করতে পারছেন এসব? আমি করছি। যতবার করছি, আমার কেমন যেন অস্থির লাগছে। বিশ্বাস করেন, আমি নিজেকে আটকাতে পারিনি, এত এত নিয়ম এক বাচ্চার জন্যে মেনে নিতে পারিনি। বাচ্চাটা আমার কাছে স্বপ্নের মত, ডাক্তার সাহেব। এ স্বপ্নের জন্যে আমি আমার আপনার স্বপ্ন বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়েছি।’
উচ্ছ্বাস কল্পনায় এসব দেখছে, অনুভব করতে পারছে। উচ্ছ্বাসের বুকের ভেতর কেমন করছে। সে নিজেকে সামলাতে পারল না। ঝাঁপিয়ে পরে কুসুমকে জড়িয়ে ধরে তার ঘাড়ে মুখ গুজে দিল। মিনমিন করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল,
‘আম প্রাউড অফ ইউ, কুসুম। তুমি আমাকে আমার ভাবনার চেয়েও সেরা উপহার দিয়েছ। আমার বাচ্চা জন্ম দেবার জন্যে তুমি এতটা কষ্ট করছ, অথচ এক ফোঁটা অভিযোগ নেই তোমার। আমি চিরকাল তোমার কাছে আকন্ঠ ঋণী থাকব, কুসুম। ভালোবাসি, অনেক অনেক অনেক বেশি। এমন ভালোবাসা আমি কখনও পরিমাপও করতে পারব না।’
____________________________
সাগর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে এক কপোত-কপোতীর জোড়া। পুরুষ সঙ্গী পেছন থেকে পরম ভালোবাসায় আগলে ধরে আছে স্ত্রী সঙ্গীকে। স্ত্রী সঙ্গীর কোলে ছোট্ট এক পরীর মত মেয়ে বাচ্চা। দুজনের গাঢ় দৃষ্টি সেই পরীর দিকে। পরী গালে হাত দাবিয়ে মিটমিট করে চেয়ে আছে ওদের দিকে। স্ত্রীটি পরীর গালে চুমু এঁকে দিল। পরী খিলখিল করে হেসে উঠল। দুজনের চোখ জুড়িয়েই গেল। পরম মমতায় দুজন আগলে নিল সেই পরীকে।
স্ত্রীটি পুরুষের কানেকানে বলল,
‘আপনি আমাকে জীবনের সেরা সুখের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছেন, ডাক্তার সাহেব। এমন পরীর মত মেয়ে আমার, ভাবলেই আমার কান্না পেয়ে যাচ্ছে। ইশ!’
পুরুষটি স্ত্রীর কানে ঠোঁট রাখল। গাঢ় করে চুমু এঁকে বলল,
‘আমার সুখের অপর নাম তুমি, মিস বৌপ্রিয়া।’
‘আর আমার সুখ আপনি আর আমাদের দুজনের অংশ, আমাদের পরী মেয়ে শুভ্রতা।’
দুজনের আদর-ভালোবাসাবাসির কথা ছড়িয়ে গেল সমুদ্রের পাড়ে। ভালোবাসার কথা মিশে গেল জলে, উত্তাপ ছড়াল এক অভুদপূর্ন সুখের। মন খারাপেরা লজ্জায় নিভে গেল, সুখেরা উঁকিঝুঁকি দিল দুজনের ভালোবাসার ঘরে।
সুখের রানী ফিসফিস করে বলে গেল কানেকানে,
‘ভালোবাসা এমনই হয়। কখনো সুখ, কখনো দুঃখ, কখনো সুখের ছড়াছড়ি। ভালোবাসার ভালো থাকুক, ভালো থাকুক পৃথিবীর সকল বৌপ্রিয়া, ঠিক তোমাদেরই মত।’
#সমাপ্ত