গোধূলি রাঙা আলোয় পর্ব-০১

0
551

#গোধূলি_রাঙা_আলোয়
#পর্ব_১

“আম্মা, বাড়িওয়ালা আঙ্কেল ফোন দিলেন বাসা ভাড়ার জন্য। তুমি ওনাকে ভাড়া দাওনি?”

“নাহ্। দেওয়া হয়নি। তুই চিন্তা করিস না, আমি বলে বুঝাই দেবনে ওনারে।”

“সমস্যা নেই। আমি আঙ্কেলকে আসতে বলেছি। টাকা নিয়ে যাবেন সন্ধ্যায়।”

“আমাকে জিজ্ঞেস না কইরা আসতে বললি ক্যান?”

“ভাড়া তোমাকে দিয়ে দিলাম না! আবার জিজ্ঞেস কী করবো! আসলে দিয়ে দিও।”

“ভাড়া কয়দিন পর দিলে কী হয়! পাঁচ তারিখেই দিতে হইবো এমন কোন কথা আছে? বেশি খাইস্টা বাড়ি ওয়ালা। মানুষ একমাসের ভাড়া আরেক মাসে দেয়। মাস শেষ হলে ভাড়া পাইলেই তো হইলো। তা না অগ্রীম ভাড়া নিতে হইবো।”

“এখন কোথাও মাস শেষে ভাড়া দেওয়ার নিয়ম নেই আম্মা। সবাই এডভান্সই নেয়। আর মাসের শুরুতেই নেয়। কিন্তু তোমার হঠাৎ কী হলো?”

“টাকা নাই।”

“টাকা নাই মানে? পাঁচ তারিখেই তো পনেরো হাজার তোমার হাতে দিলাম। দশ হাজার বাসা ভাড়া। আর গ্যাস, কারেন্ট বিলসহ সপ্তাহের বাজার খরচ মিলিয়ে পনেরো হাজার টাকা তোমার হাতে দিয়েছি না? টাকা কই গেল?”

দেলোয়ারা বেগম মুখ ভার করে কাপড় ভাঁজ করতে থাকেন। আতিয়া উত্তরের অপেক্ষায় মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

“আম্মা, কথা বলো।”

“কী বলবো! তোর কোন খবর আছে পরিবারের? তিনমাস আগে আয়েশার জামাই ব্যবসায় লস খাইলো। কী করছিস ছেলেটার জন্য? বোনটা আসলো না তোর কাছে সাহায্যের জন্য।”

“কী কথার কী উত্তর দিচ্ছ! খলিলের কিছু হয়নি। আমি খোঁজ নিয়েছি। আয়েশা তো কিছু না হতেই চোখের পানি ঝরায়। খলিল কোথায় জানি টাকা খাটাতে চায়। তাই ধার চেয়েছিল। ধার দেওয়ার টাকা কই আমার? তাছাড়া এসব জুয়া মনে হয় আমার। এখন বলো ভাড়ার টাকা কী করেছ ?”

“খাইছি তোর টাকা! খাইছি আমি।!আল্লাহ মরণ দেয় না ক্যান আমার! মাইয়ার কাছে এমনে টাকার হিসাব দেওয়ার চাইতে গলায় দড়ি দেওন ভালো। আল্লাহ আমার কপাল এমন করছে যে মাইয়ার কামাই খাইতে হয়। এত মানুষ মরে, আল্লাহ আমারে চোখে দেখে না! মাইয়া চাকরির টাকার গরম দেখায়, ভুইল্লা গেছে এই চাকরি তারে তার বাপ দিছে। এমনে এমনে হয় নাই।”

আতিয়া বুঝে যায় মা সঠিক কথা বলবে না। এসব বিলাপ কান্নাকাটির আড়ালে টাকা কোথায় কী করেছে তার সঠিক হদিস আর পাওয়া যাবে না। নিজের চুল ছিড়তে ইচ্ছে করে আতিয়ার। কেন মায়ের কাছে এতগুলো টাকা দিতে গেল! মায়ের এই টাকা নষ্ট করার স্বভাব তো ওর জানা। তবে এইবার আতিয়াও কঠোর হবে।

আতিয়াদের বাড়িওয়ালা এই বাড়িতে থাকে না। ছোটো ছোটো দুই ইউনিটের এই পাঁচতলা বাড়িটিতে শুধু ভাড়াটিয়ারা থাকেন। বাড়িওয়ালা সোবহান মোল্লা সাহেব সপ্তাহে সপ্তাহে এসে ঘুরে দেখে যান। ভাড়া ওঠান, ভাড়াটিয়াদের কোন অভিযোগ থাকলে শুনেন। সময়ে সময়ে ভাড়াটিয়াদের শাসন করেন, খবরদারি করেন। এই বাড়িতে মূলত নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষেরা থাকেন। যাদের আয় সীমিত, কিন্তু সমাজে সম্মান আছে। প্রতিটি ইউনিট খুবই ছোটো। ছয়শো স্কয়ার ফিটের এই বাসায় দুটো ছোটো ছোটো রুম। একটা রুমের সাথে এক চিলতে বারান্দা, যাতে একসাথে দু’জন মানুষ দাঁড়াতে পারে না। আর ছোট্ট একটা বসার ঘর। রান্নাঘরটা এতই ছোটো যে কুটা বাছা করতে হলে বসার ঘরের দিকে মুখ করে বসতে হয়। দুই রুমের একটায় আতিয়া একাই থাকে। আগে আয়েশা আর আতিয়া একসাথে থাকতো। এখন আয়েশার বিয়ের পর আতিয়া একাই থাকে, আলোকে সাথে রাখেনি। আরেক রুমে মা দেলোয়ারা বেগম, ছোটো মেয়ে আলোকে নিয়ে থাকেন। আতিয়ার ছোটো ভাই আশিক থাকে বসার ঘরে। বসার ঘরে কোন সোফা সেট নেই। চারটে আরএফএলের প্লাস্টিকের চেয়ার আর ছোটো একটা হার্ডবোর্ডের টেবিল আছে যা ডাইনিং টেবিল, পড়ার টেবিল দুই কাজেই ব্যবহার হয়। একপাশে একটা সিঙ্গেল খাট রাখা, আশিক সেই খাটেই ঘুমায়। একটাই কমন বাথরুম, সেটার বসার ঘরের পাশেই।

আয়েশার বিয়ের পর দেলোয়ারা বেগম ইনিয়ে বিনিয়ে রুমটা আশিককে ছেড়ে দিতে বলেছিলেন। আতিয়া আগের মতো হলে হয়তো ছেড়ে দিত। কিন্তু এখন আতিয়া অনেকটা পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। নিজেকে আর ব্যবহার হতে দিতে ভালো লাগে না। দেলোয়ারা বেগম মেয়ের এই পরিবর্তনে খুশি হন না। আতিয়াকে সময়ে সময়ে মনে করিয়ে দেন, আজ যে আতিয়া চাকরি করতে পারছে এটা ওর বাবারই বদৌলতে।

আতিয়া চুলটা টাইট করে বেঁধে গালে পাউডার দেয়। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক বুলায়। চোখে একটু কাজলও দিয়েছে। নিজেকে দেখে সন্তুষ্ট হয়। পঁয়ত্রিশ বছর বয়স হলেও চামড়ায় এখনো বলিরেখা পড়তে শুরু করেনি। চামড়া টানটান আছে। মাথায় এখনো ঘন-কালো চুল।গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা। কারও প্রেয়সী হওয়ার সময় আতিয়ার পেরিয়ে যায়নি। স্বামীর মৃত্যুর পর অনেকদিন তো একা ছিল। আবার বিয়ের কথা যে মাথায় আসেনি তা নয়। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর পরিবারের কারও যেন আর আগ্রহই ছিল না আতিয়ার বিয়ের ব্যাপারে। আতিয়াও লজ্জায় মুখ ফুটে বলতে পারেনি।

দেলোয়ারা বেগম বিলাপ করার ফাঁকে মেয়ের রেডি হওয়া দেখে। ওনার কথার খোঁচায়ও আতিয়া নিরুত্তাপ দেখে একটু হতাশ হন। ভেবেছিলেন আতিয়া নরম হয়ে যাবে। বাড়ি ভাড়ার টাকাগুলো আসলে তিনি মেঝো মেয়ে আয়েশার স্বামী খলিলকে দিয়েছেন। দিন তিনেক আগে খলিল বাসায় এসেছিল। আতিয়া তখন ডিউটিতে ছিল। খলিল কাগজপত্র সাথে নিয়ে এসেছিল। একটা স্কিমের কথা বুঝিয়েছে দেলোয়ারা বেগমকে।
“গোল ২০২৫” নামক এই স্কিমে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা রাখলে তার তিনগুণ লাভ সহ ফেরত দিবে। যেমন এক লাখ টাকা রাখলে দেলোয়ারা বেগম তিনলাখ পাবেন!

খলিল এতকিছু বোঝালো যে দেলোয়ারা বেগম লোভে পড়ে যান। তবে এক লাখ টাকা তিনি কই পাবেন! এত টাকা ওনার নাই। খলিল তখন বুদ্ধি দেয়, যা আছে তাই দিতে। খলিলের কাছেও বেশি নেই। তবে শাশুড়ির টাকার সাথে নিজের টাকা মিলিয়ে একলাখ টাকা সে স্কিমে দিবে। স্কিমে শাশুড়ির নামই থাকবে। লাভ আসলে টাকা ভাগ করে নিবে। লাভের এক লাখ সহ শাশুড়িকে পুরো দুই লাখ দিবে খলিল। এক লাখ নিজে রাখবে। এরপর আর না করতে পারেননি দেলোয়ারা বেগম। আগে আতিয়া বেতন পেলে টাকা পয়সা সব ওনার কাছে রাখতো। গত ছয়মাসে মেয়েটা আস্তে আস্তে পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। বাড়ি ভাড়া আর বাজারের টাকা হিসেব করে হাতে দেয়। আগের মতো দেলোয়ারা বেগমের হাতে টাকা থাকে না। নিজের মতো খরচও করতে পারেন না।

নিজের জমানো এগারো হাজার, আতিয়ার দেওয়া পনেরো হাজার আর এক জোড়া স্বর্ণের কানের দুল খলিলের হাতে তুলে দেন দেলোয়ারা বেগম। কতগুলো টাকা পাবেন। তখন বড়ো এক জোড়া কানপাশা বানাবেন। আতিয়ার বাবা জীবিত থাকতে টুকটাক এসব শখ পূরণ করতে পেরেছিলেন। এখন আর পারেন না। আতিয়া যখন বেতনের টাকা হাতে দিতো তখন টুকটাক সৌখিন জিনিসপত্র কিনতেন। আতিয়া রাগ করলেও কিছু বলতে পারতো না। কিন্তু ইদানীং কার মন্ত্রণায় যেন আতিয়ার পরিবর্তন হচ্ছে। কোন পুরুষের পাল্লায় পড়েছে কিনা কে জানে। বিয়েশাদি করতে চাইছে মনে হচ্ছে। আলোর বিয়ে, আশিকের চাকরির আগে আতিয়া বিয়ে করলে বিপদে পড়তে হবে।

আতিয়া জুতোয় পা গলানোর আগে মায়ের দিকে ফিরে বলে, “আম্মা, সন্ধ্যায় বাড়িওয়ালা আসলে ভাড়া দিয়ে দিও। না দিতে পারলে কী বলবে আমি জানি না।”

“তোর সমিতি থেকে টাকা তুলে দিয়ে দে না। তোর হাতে নাই কিছু?”

“সমিতি থেকে আমি কোন টাকা তুলবো না। সুদ আমাকে টানতে হয়। আমার হাতে কোন বাজে খরচের টাকা নাই। আমি গেলাম।”

(চলবে)