#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো
(৫)
বাড়ির সামনের গেইট থেকে পেছনের গেইট পর্যন্ত লাবিবার বিচরণ। ছাদের দোলনায় বসে শুয়ে চলে তার দিনের অর্ধকাল। ঘরে তার মন টেকে না। শুন্য লাগে। লম্বা বেড, ডেস্ক,ড্যাসিন, আলমারি, শো পিস ফিল করলেও মনে হয় কোথায় যেনো কি নেই। বই খাতা প্রায় সব তার চিলেকোঠায় থাকে। নিচ থেকে ডাক আসতেই ছাদ ছাড়ে। দুপুর দুটো বেজে গেছে। ক্ষিধেয় পেট চো চো করছে। টেবিলে ডিমের কোরমা,ডাল, সবজি দেখেই মুখটা আমরে ফেলে। এসব সে ভুলেও খাবে না। খাবে তো শুধু ঝাল মাংশ, ইলিশ চিংড়ি আর ভাজা পোড়া। শুঁটকি ও বাদ যায় না। সাবিনা জানে লাবিবা এসব কিছুই খাবে না। তবুও জোড় করা যায়। যদি একটু খায়! ভাত মাখিয়ে মুখের সামনে ধরলো। লাবিবা নাক উপরে তুলে ফেললো।
‘ইসসসস না, এগুলো কি?’
‘ ডিমের কোরমা। নে মুখে দে এক লুকমা।’
‘ এ মা! না। এগুলো কি মানুষ খায়?’
‘ না। এগুলো গরু ছাগলে খায়। তুই গরু তাই গিলবি। নে হা কর।’
‘ না। খাবো না।’
‘ লাবি মা হা কর। একদম জ্বালাবি না।’
‘ উহু না।খাবো না।’
ঘাড় ধরে জোর করে খাওয়াতে গেলে সরে যাওয়ার জন্য লাফালাফি করতে গিয়ে চেয়ার ছেড়ে ফ্লোরে পড়ে যায়। ইসমাইল খাবার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।
‘ আহ! করছো টাকি? জানোই তো খাবে না। ‘
‘ একটা ডিম অন্তত খা। ‘
‘ আর কতো খাবো? খেতে খেতে তো পড়েই গেলাম। তাও তোমার হলো না?’
ইসমাইল হাত ধরে লাবিবাকে টেনে উঠায়। সাবিনা রাগে গজগজ করতে করতে হাত ধরে কিচেনে চলে যায়। ফিরে আসে ফেফি মাছের শুঁটকি পোড়া নিয়ে। সাথে দুটো কাচা মরিচ পোড়া। লবণ দিয়ে কচলিয়ে গরম ভাতে ঠান্ডা করে মাখায়। লাবিবা শুঁটকিতে কামড় দিয়ে লোকমা খায়। তাও চার পাঁচ লোকমাতেই খাওয়া শেষ। সাবিনা চেঁচায়।
‘ আর দু লোকমা খা।’
‘ উহু। আর খাবোনা।’
‘ মেয়েটা একদমি ভাত খায় না। তুমি কিছু কেনো বলোনা?’
‘ আহা! ভাত খেতেই হবে এমন তো কোন কথা না। অন্যকিছু খেয়ে তো পেট ভরায়। সুস্থ থাকলেই হলো আর কিছু লাগবেনা। ‘
লাবিবা ফ্রিজ খুলে আইসক্রিম নেয়। সারা বাড়ি ঘুর ঘুর করবে আর খাবে। মন চাইলেই মুখে এটা ওটা ঠুসে চিবুতেই থাকে। ভাতের অভাব এটা ওটা খেয়েই মেটায়। ইসমাইল ও বুদ্ধি করে সব ফলমুল আর আইসক্রিম আর ভালো চকলেট দিয়ে ফ্রিজ ভরিয়ে রাখে। প্রতিদিন আসার সময় এটা ওটা আনতেও ভুলে না। একটা মাত্র মেয়ে তার! কলিজা।
ডাইননিং এ না বসে আইক্রিমের বাটি সহ রুমে যেতে নিলেই ইসমাইল পিছু ডাকে। লাবিবাকে বলে,
‘ সোফায় বসো। আব্বু খাওয়া শেষ করে আসছে। ‘
লাবিবা মাথা হেলিয়ে গিয়ে সোফায় বসে। টিভিটা অন করে গোপাল ভাঁড় দেখতে দেখতে আইক্রিম খায়। ইসমাইল খাওয়া শেষ করে লাবিবার পাশে এসে বসে। হাতের ফাঁক দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে ইসমাইলের বুকে মাথা সেঁধিয়ে দেয় লাবিবা। ইসমাইল ও মেয়েকে আগলে নেয় বুকের মাঝে। সাবিনা কে ডাক দেয়। ওঁদের সাথে বসতে বলে। সাবিনা আপত্তি জানায়।
‘ তোমরা বসোনা! কাজ গুলো শেষ করে আসি।’
‘ পরে করো। এখন এখানে বসো। কথা আছে তোমাদের দুজনের সাথে।’
‘ কি কথা?’
‘ আগে বসো।’
সাবিনা বসে। ইসমাইল একটু সময় নিয়ে বলে,
‘ আমি লাবিবার বিয়ে দিতে চাই।’
শোনা মাত্রই লাবিবা ছিটকে ইসমাইলের থেকে দূরে সরে যায়। ভয়ঙ্কর মুখে ইসমাইলের দিকে তাকায়। সেদিন কার প্রিন্সিপালের রুমের ঘটনা মনে পড়ে যায়। জোড় গলায় বলে,
‘ আব্বু আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই । বিয়ের কথা মুখেও আনবেনা।’
‘ বিয়ের পরেও পড়াশোনা করা যায় মা। আজকাল অনেক মেয়েই বিয়ের পর পড়াশোনা করে বড় বড় চাকরি করছে। তাছাড়া আমি যে ছেলেকে তোমার জন্য চয়েজ করেছি ছেলেটা ইঞ্জিনিয়ার। উচ্চবিত্ত। তাদের ফ্যামিলির প্রত্যেকেই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ওসি, ব্যাংকার। এরকম একটা ফ্যামিলিতে তোমাকে না দিলে আমার আফসোস থেকে যাবে। সেখানে বিয়ে হলে তোমার সুখের সীমা থাকবে না। ‘
‘ আমি আমার এই জীবনেও অনেক সুখী আব্বু। দুই নৌকায় পা দিয়েছে আমাকে চলতে বলো না। স্টাডি আর সংসার একসাথে আমার পক্ষে চালিয়ে নেওয়া সম্ভব না। আমি কোন সুপার ব্রিলিয়ান্ট না যে সব জায়গায় স্টার হবো। নেহাত এতো পড়ার চাপ। তার উপর মাস্টার্স শেষ করেই জবের জন্য দৌড়াতে হবে। আর তুমি আমাকে সংসারে ঢুকে যেতে বলছো?’
‘ আমি জেনে বুঝেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বাংলাদেশ যতই উন্নত হোক তুমি যেভাবে চলতে চাও সেভাবে চলার এখনো সময় হয়নি। বিয়ে হয়ে যাক তারপর তুমি যেভাবে চাও সেভাবেই হবে। চাকরী করতে চাইলে তাই করবে। শ্বশুড়বাড়ি না যেতে চাইলে যাবে না। ছেলেটা ঢাকায় চাকরি করে। যখন ছুটিতে আসবে তখন ই শ্বশুড় বাড়িতে যাবে। সে চলে গেলে আবার এখানে চলে আসবে। ‘
‘ তুমি যতটা সহজে বলছো ততোটা সহজ নয় আব্বু। আজকাল কোন ছেলেটা বিয়ের পর বউ বাপের বাড়ি ফেলে রাখে? ‘
‘ কেউ না রাখলে তারা রাখবে। সেই পরিবার জেনে বুঝেই এগিয়েছে। আর পাঁচটা মেয়ের বাপের বাড়ি হলেও তোমার ক্ষেত্রে তা নয়। এটা তোমার নিজের বাড়ি। ‘
‘ বিয়েতো যখন তখন করা যায়।স্টাডির সময় চলে গেলে আর পাওয়া যায়না। আমি জব পাওয়ার পর বিয়ে করতে চাই আব্বু। আমার পক্ষে এখন বিয়ে করা সম্ভব না।’
‘ তোমার বিয়ে আটকে রাখাও আমার পক্ষে সম্ভব না।চারদিক থেকে যেভাবে মানুষ উঠে পড়ে লেগেছে কখন না জানি কি ঘঠিয়ে ফেলে। বড় হয়েছো। তোমার সিকিউরিটি নিশ্চিত না করা অব্দি আমি স্বস্থি পাচ্ছি না। ‘
‘ আমি ঠিক আছি আব্বু। বিশ্বাস করো আমার কলেজে কোন প্রব্লেম হয়না। আমি কলেজের বাইরে একদমি যাইনা। তুমি কেনো দুশ্চিন্তা করছো?’
‘ তুমি এসব মাথায় নিওনা মা। তুমি ততোক্ষন সেফ আছো যতক্ষন আমি আমি তোমার সেফটি দেবার ক্ষমতা রাখি। এক তোমার পেছনে থাকলেই আমার এবার চলছে না। তোমার ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য আমাকে এবার নিয়োজিত হতে হবে। বিজনেস টাকে এগিয়ে নিতে হবে। আমার পৈতৃক সম্পত্তি ভাইদের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিতে হবে। তোমার জন্য সদরের বাড়িটাও কমপ্লিট করে দিতে হবে। জীবনে চলার পথে কোন স্থানে যদি ঠেকে যাও নিজের টা দিয়েই যেনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারো,অন্যের মুখাপেক্ষী না হতে হয় সেই সব ব্যবস্থায় আমি এখন করে যাবো। তুমি আমার জীবন মা। তোমার প্রতি সকলের লোভ। আশা করি তুমি যথেষ্ট বোঝদার আর আমার কথাটা মেনে নিবে।’
‘ আমি তোমাকে সমর্থন করি কিন্তু আমার নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পর কেনো নয়? এখনিই বা কেনো? আমার সপ্ন এখানেই শেষ হয়ে যাবে আব্বু। আমি এখন বিয়ে করতে পারবো না।’
‘ তুমি বিয়ে করবে আর এখনি করবে। আমি কিছু শুনবো না। যাও রুমে যাও।’
‘ আব্বু _’
‘ নো মোর ওয়ার্ডস।’
হুটহাট এমন একটা সিদ্ধান্ত লাবিবা মেনে নিতে পারলো না। কলেজে ক্লাস শেষে একান্তেই কথা বলার জন্য প্রিন্সিপালের কেবিনের সামনে এলো। পিয়ন কে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
‘প্রিন্সিপাল স্যার আছেন? দেখা করতে চাই। ‘
‘ ভেতরে বাইরের লোক আছেন। আধঘন্টা পর আসো।’
লাবিবা বেরিয়ে এলো। সবুজ ঘাসের উপর ব্যাগ রেখে বসে রইলো। আধ ঘন্টা পর এসে দেখলো এখনো মিটিং শেষ হয়নি। দশ টাকার বাদাম কিনে আনলো। বসে বসে বাদাম খেলো। আরো কিছুক্ষণ পর গিয়ে জানলো স্যার এখনি বেরিয়ে যাবেন। লাবিবা তাড়াতাড়ি করে দরজা ঠেলে ঢুকে গেলো। ভেতরে গিয়েই জিজ্ঞেস করলো,
‘ ম্যা আই কাম ইন?’
তানভীর উঠে যাচ্ছিলো। লাবিবাকে দেখে দাঁড়ালো। লাবিবাকে একবার দেখে নিয়েই গিয়ে আবার চেয়ারে বসলো। প্যান্টের পকেট থেকে ফোনটা বের করে টেবিলে রাখলো। লাবিবার দিকে এবার মনোযোগ দিলো।
‘ জুতো পড়ে আসো।’
‘ জি স্যার?’
‘ সেদিন ও জুতো খুলে এসেছিলে। লুক! ফ্লোর ইজ সো ডার্টি।’
লাবিবা লজ্জা পেলো। কেউই জুতো খুলে আসেনা। লাবিবাই একমাত্র এই কাজটি বার বার করলো। আবার স্যারের নজরেও পড়লো। তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে জুতো পড়ে নিলো। সে কিভাবে জানবে সবাই জুতো নিয়েই ঢুকে! কোন দিন প্রিন্সিপালের রুমে এসেছে নাকি! তানভীর ইশারায় বসতে বললে লাবিবা চেয়ার টেনে বসলো। সমস্ত সংকোচ বোধ একপাশে রেখে বললো,
‘ স্যার সেদিন যে পিক নিলেন। তারপর আপনি কথা বলতে চেয়েছিলেন। ‘
‘ বাসায় কি কেউ কিছু জানায়নি?’
‘ স্যার আব্বু আমাকে জানিয়েছে। কিন্তু স্যার আমি এই মুহূর্তে বিয়েটা করতে চাইছি না। আমি নিজেকে নিয়ে অনেক আশাবাদী স্যার। আমার উপর অনেক দায়িত্ব। আমি আগে আমার ক্যারিয়ার গড়তে চাই। তারপর বিয়ে করতে আমার কোন সমস্যা নেই।’
‘ তোমার গার্ডিয়ান কে জানাও। ‘
‘ আব্বু শোনেননি। বিয়ের পর ক্যারিয়ার গড়ার কথা বলেছেন। কিন্তু স্যার আমার কাছে এটা খুবই ট্রাব ব্যাপার। পসিবল ই না। ‘
‘ তোমার আব্বু যেহেতু ডিসিশন নিয়েছেন অবশ্যই ভেবে চিন্তে নিয়েছেন। তবুও আমি কথা বলবো এই আশ্বাস দিচ্ছি। আর পরিস্থিতি যতই খারাপ থাকুক লেখাপড়া কখনো কম্প্রোমাইজ করবেনা। ‘
‘ জি স্যার।’
‘ এবার তুমি আসতে পারো। আমি উঠবো। ‘
কলেজ একদমি খালি। তানভীর ভাবলো লাবিবাকে পৌঁছে দিতে হবে। কিছুদূর এগিয়ে গেলো ডাক দেবার জন্য। তার আর প্রয়োজন হলো না। লাবিবাকে নিতে ইসমাইল এসে দাঁড়িয়ে আছে দেখে তানভীর মুচকি হাসলো। কেমন যেনো শান্তি লাগে তার সম্পর্কের টান গুলোতে। নি:শ্বার্থ ভালোবাসা গুলো সবার মাঝেই শান্তি ছড়াতে সক্ষম। সেই নিঃস্বার্থ ভালোবাসার প্রয়োজনে জীবনের একটি স্থান এখনো শূন্যের কাতারে পড়ে আছে।
চলবে__
#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো
(৬)
খবর এসেছে ফাহাদ ছুটিতে বাড়িতে এসেছে। এবার মেয়ে দেখার পর্ব শুরু করতে হয়। যদিও দেখার কিছু নেই। লাবিবাকে চেনেনা অত্র এলাকার কেউ নেই। ইসমাইলের মেয়েকে সবাই একনামে চেনে। চেনার কারণটাও অবশ্য লাবিবা নিজেই। ছোটবেলা স্কুল থেকেই তার পরিচিতির শুরু। বরাবরে ক্লাসে টপ থ্রিতে জায়গা করে আসছে। নাচে জেলায় ফাস্ট গার্ল হিসেবে চার বার পুরষ্কার পেয়েছে। অসম্ভব মায়াবী এই মেয়েটার জন্য ইসমাইলের উপর উপযুক্ত ছেলের বাবাদের বিশাল চাপ পড়ে। বখাটেদের ব্যপারটা খেয়াল রাখে ইসমাইলের বন্ধু এসপি তারেক রেজাউল আর ভাইয়ের ছেলে কবির। ইসমাইল চায়না তার মেয়ের চলার পথে কখনো কেউ সামনে দাঁড়াক। সাধারণ জীবনযাপন দেবার জন্য গুনতে হয় বড় অঙ্কের টাকা। পুলিশ জাত টাকা ছাড়া এক পা ভুল করেও ফেলে না। মেয়েকে সুপাত্রে দান না করা অব্দি এবার যেনো আর হচ্ছেনা। লাবিবাকে সাজিয়ে গুছিয়ে ফিটফাট করে দেয় সাবিনা। পার্পেল রঙের আনারকলি,সবুজ উড়না,পার্পেল হিযআপে মেয়েটাকে কচুরিপানা ফুলের মতো লাগছে। হাসে সাবিনা। প্রাপ্তির হাসি। কপালে চুমু এঁকে বলে,
” ছেলেটার নাম ফাহাদ। দেখতে মাশাআল্লাহ। খুবই পছন্দ হয়েছে আমার। তোর ও খুব ভালো লাগবে। যা বলবে তার উত্তর টুকুই দিবি। উল্টাপাল্টা কিছুই বলবিনা। আমি যেনো কিছু না শুনি। মনে থাকবে?”
” আম্মু আমার ভয় লাগছে। ”
” কেনো? ভয় কিসের। ”
” লোকটাকে বলে দাও আমার থেকে যেনো দুরত্ত্ব বজায় রেখে চলে। ওতো বড় মানুষ আমার ভয় লাগে।”
‘ এটা আবার কেমন কথা? চলো দেড়ি হয়ে যাচ্ছে। তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আমি আমার বান্ধুবীর বাসায় বসবো। কথা শেষ করে ফোন দিবে চলে আসবো। ‘
রেস্টুরেন্টের সামনে লাবিবাকে নামিয়ে দিয়ে চলে যায় সাবিনা। লাবিবা ধীরে ধীরে ভেতরে যায়। আন্দাজ করে কোনায় বসা একজনের দিকে এগিয়ে যায়।
‘ এক্সকিউজ মি? মি. ফাহাদ? ‘
‘ ইয়েস। লাবিবা। বসেন প্লিজ। ‘
‘ হু? হ্যা। ‘
লাবিবা বসে। ফাহাদের দিকে না তাকিয়ে এদিক ওদিক চোখ বুলায়। ভেতরে ভেতরে অস্থিরতা কাজ করছে। ফাহাদ লাবিবার দৃষ্টি অনুসরণ করে এদিক ওদিক তাকায়। গলা পরিষ্কার করে বলে,
‘ কেউ আসবে?’
‘ হু?’
‘ ফ্রেন্ড।’
‘ হ্যা।’
‘ আসুক। আমরা কথা বলতে থাকি। কফি অর্ডার করি?’
‘ হ্যা।ক্যাপাচিনো।’
ফাহাদ অর্ডার দিয়ে বলে,
‘ আমার সম্পর্কে নিশ্চয় জেনেছেন। তাও বলি। আমি ইঞ্জিনিয়ার ফাহাদ। রাজউকে আছি। কোন বেড হ্যাবিট নেই বললেই চলে। আমি কোন রিলেশনশিপেও নেই। আমার ফ্যামিলি স্ট্যাটাস সম্পর্কে তো জানেন ই। আমার আপনাকে বেশ ভালো লেগেছে। আপনি অনেক কিউট। আমাকে আপনার কেমন লাগে?’
‘ আপনি? দেখতে মাশাআল্লাহ। সাদা লেয়ার মুরগির মতো ব্রয়লার মুরগি বলা যায় না। ‘
‘ হুয়াট?’
‘ আপনি সুন্দর। টল ফিগার। আপনাকে আমি দেখেতো পুরোই বাঁশ খেলাম। লম্বা, ইয়া বড়, সাদা সাদা।’
‘ হা হা হা। আপনি একটু ফানি আছেন।’
‘ ফানি না। আ’ম কনফিউজড।’
‘ কোন বিষয়ে?’
‘ আপনি মানুষ কিনা!’
‘ আবার ফান! ওকে। একটু সিরিয়াস হয়ে বলুন তো শুনি। ‘
‘ আপনি এতো বড় মাপের একজন মানুষ। নিঃসন্দেহে প্রত্যেকটি মেয়ের ড্রীম বয়। আমার আপনাকে খুব ভালো লেগেছে। সত্য কথা ভাববেন না। কফি এসেছে। খাবেন? আমার কফি ভীষন পছন্দ। একটাতে হবে না। দিন দুটোই খাই। সরি। পান করি। ‘
ফাহাদ থম ধরে থাকে। লাবিবা তাড়াহুড়ো কিসব বললো ধরতে পারলেও বুঝতে পারেনি। তবে এই যে চটপট ভাব ভীষণ ভালো লাগছে। লাবিবাও ভাবছে ছেচড়ার মতো এভাবে দুইটাতেই মুখ দেওয়া উচিত হয়নি। পরক্ষনেই ভাবে কফিখোরের আবার উচিত অনুচিত কি! উর্মিলাকে দেখে লাবিবা হাত নাড়ায়। উর্মিলা দৌড়ে এসে লাবিবাকে হাগ দেয়। পাশাপাশি ফাহাদকেও হাগ দিতে যাবে ফাহাদ ভয় পেয়ে উঠে দাড়ায় চেয়ার ছেড়ে। লাবিবা হাসি মুখে উর্মিলাকে টেনে কাছে নিয়ে বসিয়ে ফাহাদকে বলে,
‘ আরে আপনি উঠলেন কেনো? বসুন না। উমম একচুয়েলি সরি। আমার বান্ধুবীটা আসলে এমনি। যখন থেকে শুনেছে আপনার সাথে আমার বিয়ে হবে জিজু জিজু বলে অস্থির হয়ে আছে। কখন আপনার সাথে মিট করবে!তাইতো চলে এসেছে। বাই দ্যা ওয়ে, ও হচ্ছে উর্মিলা! কি মিষ্টি নাম! দেখতে সুন্দর না? দেখুন দেখুন।’
ফাহাদ তাকাতেই উর্মিলা চোখ মেরে দেয়। ফাহাদ কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে আরেকদিকে তাকায়। লাবিবা উর্মিলার প্রসংশা করতে থাকে। উর্মিলা বেশ খেতে পারে। নানা রকম অর্ডার দেয়। খেয়ে দেয়ে একদম পেট পুরে ফেলে। ফাহাদ এতো গুনকৃর্তন শুনে ফ্যালফ্যালিয়ে হাসে। মাঝে মাঝে বলে,
‘ লাবিবা আপনার সম্পর্কে কিছু বলুন।’
লাবিবা পাত্তা না দিয়ে উর্মিলার কথাই বলতে থাকে। এতো গুলো টাকা ঢালিয়ে বাসায় ফিরে ভাবে লোকটা মনে হয় নিগেটিভ মন্তব্য জানাবে। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো ফাহাদ বিয়েতে হ্যা বলে দেয় ।দুই পরিবারকে জানায় লাবিবাকে ভীষন পছন্দ হয়েছে। বিয়ে করলে লাবিবাকেই করবে। নিউজটা তানভীরের কানেও যায়। তানভীর এবার একটু নড়েচড়ে উঠে। ফাহাদের সাথে কথা বলতে চায়।
ফাহাদকে তানভীর কলেজে ডাকে। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে না বলে প্রব্লেম গুলো সরাসরি তুলে ধরে।
‘ ফাহাদ তোমাদের আর আমাদের অনেক আগের থেকেই পরিচয়। সো তোমাদের ফ্যামিলিতে একটা রিচিউল চলে আসছে যা আজকালকার যুগের সাথে সামঞ্জস্য নয়। এখনকার যুগে ছেলে মেয়ে উভয়েই কাঁধে কাঁধ রেখে চলে। তুমি যাকে বিয়ে করতে যাচ্ছ তার কথা বলি। বাবা মার একমাত্র মেয়ে। ব্রিলিয়ান্ট, ব্রাইট ফিউচার আছে। শুধু তার হাজবেন্ড হলেই চলবেনা তার ক্যারিয়ার গড়ে তুলার দায়িত্ব ও নিতে হবে। এখন সবাই ক্যারিয়ারের পেছনে ছুটছে। এর জন্য ফ্যামিলি, হাজব্যান্ড এভোয়েড করতেও ছাড়ছে না। যার জন্য তোমার ফ্যামিলিতে ব্যতিক্রম কিছু ঘটতে পারে। তুমি কি চাও ব্যতিক্রম কিছু করতে? ‘
ফাহাদ মুচকি হাসে। তানভীর কে আশ্বস্ত করে।
‘ আমি সব দেখে শুনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন।’
‘ হ্যা। তোমার মতো ব্রাইট ছেলের থেকে আমি এটাই আশা করি। তবুও কনফিউশন দূর করা উচিত। লাবিবার বাবার সকল সম্পত্তির মালিক সে। তার পরিবারের ভবিষ্যত ও সে। সো তাকেও স্পেস দেওয়া উচিত। আশা করি তুমি হাজব্যান্ড হিসেবে তার পাশে থাকবে। ‘
‘ আমি আমার সবটা দিয়ে চেষ্টা করবো। যুগ চেঞ্জ হয়েছে এটা আমিও মানি স্যার। আমার উপর ভরসা করতে পারেন। ‘
তানভীর সন্তুষ্ট হয় ফাহাদের উপর। এবার তাহলে এগিয়ে নেওয়া উচিত। বের হবার সময় ফাহাদকে দূর থেকে দেখতে পায় লাবিবা। ফাহাদ চলে যেতেই লাবিবা তাড়াহুড়ো করে তানভীরের কাছে আসে। তানভীরের সামনে দাঁড়িয়ে ডাকে , ‘ স্যার….’
কি অসহায় মুখ! মনে হচ্ছে প্রিয় কিছু পাবার আবেদন জানাচ্ছে। তানভীর সেচ্ছায় লাবিবার মাথায় হাত রাখে। লাবিবা চোখ জোড়া বন্ধ করে নেয়। মিনিট খানেক পর হাত নামিয়ে নিয়ে বলে,
‘ নিশ্চিন্তে বিয়েতে মত দিয়ে দাও। আমার মনে হয় তোমার জন্য উত্তম কাউকেই পছন্দ করা হয়েছে। চাপ নিও না। মন দিয়ে লেখা পড়া চালিয়ে যাও। ‘
‘ আমি এখন সংসারে ঢুকতে চাই না। ‘
‘ তোমাকে হিউজ স্পেস দেওয়া হবে। বড় হয়েছো। চলার পথে একজন সঙ্গী প্রয়োজন। তোমার বাবা কতদিন আর তোমাকে এভাবে আগলে রাখবে? ‘
‘ এতো দিন যেভাবে আগলে রেখেছে সেভাবে কি পারবেনা? আমি কি বেশী হয়ে গেছি যে এখনি আমাকে দূরে পাঠিয়ে দেবার জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছে? নাকি আমার আব্বুর শক্তি কমে গেছে,টাকা কমে গেছে? ‘
অভিমান গলায় কান্না চলে আসে। লাবিবা বুঝতে পারেনা কার সামনে নিজের আবেগ ঠেলে দিচ্ছে। যে কিনা তার বিয়ের মাধ্যম তার কাছেই অভিমান ভেঙ্গে দেখাচ্ছে। তানভীর কিছুই বলেনা। অল্পবয়সী মেয়েরা এরকম আবেগ প্রবণ হয়ে থাকে। কিন্তু তাদের আবেগে তো জীবন চলবে না। বড়দের সিদ্ধান্ত সঠিক এটা বুঝতে সময় লাগলেও ঠিকই একদিন বুঝতে পারবে। তানভীর নিশ্চুপ দেখে লাবিবা চোখের পানি ছেড়ে দেয়। কিছু না বলেই চলে যায়। তার বোঝা হয়ে গেছে এই তার ভাগ্যে আছে। কেউ তাকে হেল্প করবেনা।
তানভীর লাবিবার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। যেখানে সবাই তানভীর খানকে সমীচিন করে চলে। প্রয়োজনের বেশী কথা বলে না। তানভীর এতো আন্তরিকতা পূর্ণ বজায় রাখা সত্ত্বেও মনের ভেতর সংকোচ রেখে চলে আর এই মেয়েটা কত নির্দিধায় তার অভিমান জানিয়ে গেলো। অভিযোগ করে গেলো বাবার সম্পর্কে যেনো কত আপন সে! এই অভিযোগের বিচার করবে। চোখের জল ফেলে কষ্টের জানান ও দিয়ে গেলো। ঠিক কতটা কষ্টে আছে মেয়েটা।
তানভীর চোখ নামিয়ে নিচে নিজ হাতে তাকায়। তালুতে চিক চিক করছে দু ফোটা জল। লাবিবার চোখের জল!
বইয়ের এপাশ থেকে ওপাশ পড়া শেষ। নিতু ইসলামের ক্লাসে বসেই শেষ পড়েছে বইটা। নিতু ইসলাম কিছুই বলেনি। তার লাবিবার উপর রাগ। ভীষন রাগ। তার ভাগিনাকে নাকি বলে পাগলের ডাক্তার! কলিজার টুকরা ভাগিনা কে ছোট থেকে কত কষ্ট করে পড়িয়ে আজ এতো বড় ডাক্তার বানিয়েছেন তাকে নাকি এখন ডাকে পাগলের ডাক্তার! ছিহ! কি বিচ্ছিরি শুনতে! এই মেয়েটা এতো বিচ্ছিরি ডাক কিভাবে ডাকতে পারে? ম্যামের ভাগিনা বলেও তো ভদ্রতা পোষন করতে পারতো। ভয় পেতো। ভয় কি আদৌ জানে? কখন ভয় পেতে হয়? কিছুই জানে না। রাগে আর কথাই বললো না। নাকিব বইটা কেড়ে নিয়ে বলে,
‘ এই কি পড়ছিস রে? এতো মনোযোগ দিয়ে?’
‘ ফাও পড়ছিলাম। কাজের কাজ কিছুই হলোনা। ‘
‘ কি খুজছিলিস?’
‘ একটা সপ্নের ব্যাখা। কিন্তু নেই এতে। ফাও ফাও গেলো আমার এতোগুলো টাকা। ‘
‘ কাহিনী কি দোস্ত?’
লাবিবা চুপ থাকে। কি বলবে? বলতে ইচ্ছে করছে না। উর্মিলাই বলে,
‘ লাব্বুর বিয়ে ঠিক করেছে। লাব্বুকে আর আমরা পাবোনা আমাদের মাঝে।’
‘ বলিস কি ? কবে বিয়ে? কার্ড ছাপানো হয়ে গেছে? ‘
‘ ডেট ফিক্সড হয়নি। শুক্রবার আসবে উনারা ডেট ফিক্স করতে। ‘
‘ ভালো লাগলো না দোস্ত। এখনি বিয়ে! বড়লোক নাকি? প্রাইভেট কলেজে পড়স জানে?’
লাবিবা রাগ নিয়ে তাকায়। নাকিব সরে বসে।
‘ আরে রাগছিস কেনো? ছেলের নাম বল। ঠিকানা দে। খোঁজ খবর আনি। হবু দুলা হবে। দায়িত্ব আছে না?’
‘ পারলে বিয়েটা ভেঙ্গে দে।’
‘ আরে কি বলিস? আমি এতো বড় পাপ কাজ করার মানুষ! ফরজ কাজটা সেরে নে। শুভ কাছে দেড়ি করতে নাই। কতদিন বিয়ে খাইনা! এবার আমরাও একটা দাওয়াত পাই। ‘
উর্মিলা কৌতুহল হয়ে উঠে।
‘ এই নাকিব! তোরা তো ছেলে মানুষ। একটা ছেলেই একটা ছেলেকে সত্যিকার চিনতে পারে। একটু দেখ না নতুন দুলা কেমন লাগে! খোঁজ নে না আশেপাশে।বিয়ে ভাঙার জন্য নয়। কোন উইকনেস জানা গেলেও পরবরর্তীতে তো দুলাকে নাকে জল খাওয়ানো যাবে। ‘
উর্মিলা নাকিব দুষ্টু হাসে। কিভাবে কি করবে প্লেন করতে থাকে। লাবিবার এসব ভালো লাগে না। ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ধীরে ধীরে উঠে আসে। গেইটের দিকে এগুতেই প্রিন্সিপালের নোহা গাড়িটা পার্ক করা দেখে। আশেপাশে কোন গাড়ি নেই। লাবিবা গিয়ে গাড়ির সামনে দাঁড়ায়। তার এতো পছন্দের গাড়িটা! তবুও যেনো বিরক্ত লাগছে। সামর্থ্য থাকলে লাঠি দিয়ে এতোক্ষনে এক বাড়িতে কাঁচ ভেঙে গুড়ো করে ফেলতো। তা করতে না পারলেও কিছু একটা করার জন্য হাত পা নিশপিশ করছে। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে লাবিবা ইচ্ছা মতো গাড়িতে একটা লাথি ছুঁড়ে। তবুও মন ভালো হয়না। ব্যাগ থেকে মার্কার পেনটা বের করে চকচকে বুনেটের উপর লিখে।
” আমি কলেজের মেয়েদের ধরে ধরে বিয়ে দেই, ঘটক মি.তানভীর খান। ”
চলবে__
®লাবিবা তানহা এলিজা