ভালোবাসার কাব্য গাঁথবো পর্ব-৭+৮

0
767

#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো

(৭)
লাবিবার দিন কাটে হতাশায়। মেয়েটা আজ ছাদ ছেড়ে নিচে এলো না। কিচেনেও ঢুকলো না।খেলোও না। ইসমাইল রাতে বাড়ি ফেরার সময় হাতে করে মলাই এনেছে। চিনি দিয়ে মলাই লাবিবার খুব ফেভারিট। সাবিনা বাটিতে করে মলাই নিয়ে রুমে এলো। লাবিবাকে পেলো না। বারান্দাতেও নেই। ছুটলো ছাদের দিকে। চুল গুলো ছেড়ে দিয়ে দোলনায় শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। কপালে তাঁর চিন্তার ভাজ। এতো কিসের চিন্তা! সাবিনা ডাকে,
‘ এভাবে শুয়ে আছিস কেনো? বলেছিনা রাতের বেলা চুল ছেড়ে শুয়ে থাকবিনা? মুখ টাও শুকিয়ে গেছে। সারাদিন খেতে দেখিনি। কি হয়েছে মা? ‘
লাবিবা উঠে বসে। চুলগুলো কয়েকটা চুল দিয়েই মুড়িয়ে উপুড় করে ঝুটি বাঁধে। বাটিটা হাতে নিয়ে চামচে তুলে মুখে দেয়। সাবিনা যায়না। মোড়ার উপরে বইগুলো গুছিয়ে রাখে। মেঝেতে খাতা কলম পড়ে আছে সেসব তুলে এনে ঠিক করে রাখে। লাবিবা গম্ভীর স্বরে ডাকে।

‘ আম্মু! বস।’
তারপর কিছুক্ষণ নিরবতা। ধীরে সয়ে বলতে থাকে,
‘ বিয়ের পরের জীবন আর আগের জীবন অনেক পার্থক্য। কখনোই এক হয়না। আমি যে অলস! যে রকম মেয়ে! বিয়ে হলে রান্নাঘরে না গেলেও মাঝে মাঝে হাজবেন্ডের মন রক্ষার্থে ঠিক ই যেতে ইচ্ছে করবে। আমি কাউকে ফোন দেই না। বিয়ের পর শ্বাশুড়ি কে, শ্বশুড়কে,ননদ ননদাই, ভাসুর, জাল, খালা শ্বশুড় শ্বাশুড়ি, মামা শ্বশুর শ্বাশুড়ি, কাজিন দেবর ননদ প্রত্যেকের সাথে কথা বলতে হবে। সবার সাথে প্রতিদিন না বললেও নিজের শ্বশুড় বাড়িতে ঠিকই সবার সাথে কথা বলতে হবে। নয়তো কথা শুনাবে। আমি যে এ বাড়িতে দিনের পর দিন পড়ে থাকবো এতে তারা বিরক্ত হবে। ওদের ও ইচ্ছে করবে শেষ বয়সে ছেলের বউয়ের কাঁধে পুরো সংসার ছেড়ে আরাম করতে। বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে হাজবেন্ড ও একদিন না একদিন ঠিকই প্রেশার দিবে। এইযে আম্মু তোমরা যে এতো চাপ সামলাও, এতো টাকা পয়সা খরচ করো, আমাকে পাবার জন্য যে এতো লোক পাগল! তোমার কি ধারণা বিয়ের পর আমাকে এখানে ফেলে রাখবে? পুরুষ মানুষের ধৈয্য আছে? নেই। চার পাঁচ মাস পর পর ছুটিতে আসবে সপ্তাহ খানেকের জন্য তারা মেনে নিবে? বউ ছাড়া একটুও চলবে না। ঠিকই তার কাছে নিয়ে রাখবে। নতুন একটা সংসার সামলাতে হবে। এদিকে আমার পড়া লেখা গোল্লায় যাবে। তুমিও তো সংসার করো। কতটুকু ফুসরত পাও আম্মু বলবে? ভালো ক্যারিয়ার গড়ার জন্য কি এইটুকুন সময় এনাফ! এইটুকু সময় ও কি আমি পাবো? মন চাইলেই ঘুরতে বেরোবে, আনুসাঙ্গিক আরো কতো কি! জীবনটা আমার সেভাবেই ভেসে যাবে।’
‘ এতো দূর চিন্তা করছো তুমি! সবকিছু নিগেটিভলি নিচ্ছো কেনো? পজিটিভ ভাবে নাও। এসব বিষয়ে কথা বলেই এগুচ্ছি। সব শর্ত মেনেই তারা তোমাকে নিতে চাইছে। তুমি দুশ্চিন্তা করা বাদ দাও না।’
‘ আমি এখন থেকেই প্রিপারেশন নেওয়া শুরু করেছি। দুইটা বছর অন্তত সময় দাও। জবটা পেয়ে যাই। জব পেয়ে গেলে দেখবে কেউ কিছু বলার ফাঁক পাবেনা। ‘
‘ সারাদিন না খেয়ে না পড়ে এসব উটকো চিন্তা নিয়ে আছো না? তুমি নাও তোমার প্রিপারেশন। কিসের দুইটা বছর দুইটা বছর করছো? বিয়ে হলে কি আর মানুষ জব করেনা? বিসিএস ক্যাডার হচ্ছেনা? আমরা তোমার ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করবো। এখনো বেঁচে আছি। নাকি তোমার কাছে মরে গেছি আমরা?’
সাবিনা বেশ রেগে যায়। লাবিবা মায়ের রাগের উপর অভিমান করে চোখের জল ফেলে। কাঁদতে কাঁদতেই বলে,
‘ বিয়ের পরে যদি বলে বাড়ি থেকে বেরোতে দিবে না তখন বেঁচে থেকেই কি করবে তোমরা? কয়টা লোক আছে সংসার করা বাদ দিয়ে বাপের বাড়ি রাখে বউকে? যদি এমন করে কি করবে তোমরা? নিজেও তো এক বাপের এক মেয়ে ছিলে। দাদু যেতে দিয়েছে ঘন ঘন তোমাকে বাপের বাড়িতে? মরনের কালে আমার নানু একটা মানুষ কেও পাশে পায়নি। দুই দিনের মরা লাশটা ঘর থেকে বের করতে হয়েছে। যখন দুইদিন খবর না পেয়ে হাউমাউ করে কেঁদে দাদুকে রাজি করিয়ে গিয়েছো তখন। আত্বীয় স্বজন পাশেই থাকা সত্ত্বেও একটা মানুষ ও বুড়ো মানুষটার খোঁজ নেই নি। পঁচা লাশ! কী দুর্গন্ধ! ভুলে গেছো? আমি ভূলি নি। ‘
ধপ ধপ পা ফেলে ছাদ থেকে নেমে আসে লাবিবা। সাবিনার চোখ দুটো ছলছল করছে। চোখে ভেসে উঠেছে বাবার পচা মৃত লাশ টা। তাদের ও কি একি অবস্থা হবে? মেয়েটা তা হতে দিবে? তাদের নিয়ে এতো চিন্তা! আল্লাহর কাছে দুহাত তুলে দোয়া করে। আঁচল পেতেই হু হু করে কেঁদে উঠে সাবিনা।

ফোন কলে ওপাশে ফাহাদ একের পর এক কথা বলছে। লাবিবা শুধু মাঝে মাঝে উত্তর দিচ্ছে হু হ্যা। তার মাথায় ঘুরছে অন্য চিন্তা। নাকিব কি বললো এসব? কতোটুকু সত্যি?রবিবারে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে যেতে হবে নাকিবের সাথে এক জায়গায়। পুরোটা সেখানেই জানা যাবে। এর আগে না। ফাহাদ বলে,
‘ এই যে মেডাম! কাল কিন্তু একটা লাল টুকটুকে শাড়ি পড়ে সামনে আসবেন। আমার ধারণা আপনাকে লাল শাড়িতে অসম্ভব সুন্দর লাগবে। সত্যি বলতে লাল টুকটুকে বউ রুপে আপনাকে ঠিক কতটুকু সুন্দর লাগবে তা দেখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছি আমি। তাই লাল শাড়িতে আপানাকে দেখার ইচ্ছা। যাকে বলে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো। হা হা হা।’
এতো প্রশংসনীয় প্রেমালাপে সব মেয়েই হয়তো একটু লজ্জা পাবে। লাবিবার লজ্জার ছিটেফোঁটাও পেলো না। বরং প্রশ্ন করে বসলো,
‘ আপনি বুঝি রুপের পুজারী? রুপের সাথে সংসার করবেন? ‘
‘ মেডাম এভাবে প্লিজ প্রশ্ন করবেন না। রুপের পূজারী সবাই। ছেলেরাও যেমন সুন্দরী মেয়ে চায় মেয়েরাও তেমন সুন্দর ছেলে চায়। প্রথমে দর্শন দারী পরে গুনবিচারী। সামনে দিয়ে একটা সুন্দরী মেয়ে গেলে সবাই ছেলে মেয়ে উভয়েই তাকাবে। মুগ্ধ ও হবে আবার কেউ কামনার চোখেও দেখবে। সুন্দর ছেলেরা গেলেও মেয়েরা দেখবেন ক্রাশ ক্রাশ বলে এক বান্ধবী আরেকবান্ধবীকে খোঁচা দিবে ইশারা করবে। অহংকার করছি না। আমাকে দেখে ও অনেক মেয়ে ক্রাশ নামক বাঁশ টা খায়। আমিও তাকাই তাঁদের দিকে। কেনো আপনি আমার দিকে তাকান নি? আমি কি সুন্দর না?’
‘ চোখ সবার ই পড়ে। কিন্তু সবাই এক না। কেউ কেউ দৃষ্টি নত ও করে নেয়। মুগ্ধ হলেও প্রকাশ করতে চায়না। মাথায় ভরসার হাত রাখে। ছুয়ে দিবে সেই মনোভাব পোষণ করে না। ‘
‘ কে এই সন্ন্যাস গো?’
‘ আপনি চেনেন না। আমি চিনি। ‘
‘ তা ভালো। অন্যের কথা নাই বলি। এবার আমরা আমাদের কথা বলি। ‘
‘ আমাদের থেকে আমার কথা হলো আমি ঘুমাবো। আপনার টা বলে যান। ‘
‘ ওহো! রাত তো অনেক হলো। আমার এতো এক্সাইটিং লাগছে কি বলবো! কাল তোমার সাথে আবারো দেখা হবে..সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি । সরি। তুমি বলার অভ্যাস টা এখন থেকেই করে নিই। গুড নাইট।’
লাবিবা ফোন রেখে দেয়।‌ উদাস দৃষ্টিতে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে। বেলী ফুলের কড়া স্মেল নাকে আসছে। আজ আর তার মন পুলকিত করতে পারেনা। মনের উপর পাথর চাপা পড়েছে। ধীরে ধীরে তার সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

বাদ জুম্মা ফাহাদের বাড়ি থেকে লোক আসবে। রান্নাঘরে চলছে এলাহি কাণ্ড। পূব পাড়া থেকে দূজন মহিলা আনা হয়েছে। তারাই কুটে বেছে দিচ্ছে। রান্না করছে লাবিবার দুই কাকি । ছোট কাকির হাতে রান্না বেশ হয়। কাজিন গুলোও আজ এ বাড়ি। ছাদে খেলছে। লাবিবা বার বার সাবধান করে দিয়েছে, খবরদার ফুল গাছ গুলো যেনো একটারো পাতা অব্দি না ছেড়া হয়। ওরা ছিড়বেও না। রাগ উঠলে লাবিবা যা মারে না! হাড্ডি গুড্ডি ওয়ালা ভাই বোনদের মেরে তার ই হাত ব্যথা হয়। তারপর হাউমাউ করে কাদে। তখন লাবিবাকেই তাঁদের সামলাতে হয়। বিনিময়ে গচ্চা যায় চিফিনের টাকা বাঁচানো চুরি করে কেনা চকলেট। উর্মিলা এসেছে সকাল বেলায় ঘুম থেকে উঠেই। সাবিনা ঢেকেছে। একটু সাজিয়ে গুজিয়ে দিবে। এযুগের সাজ কি আর সাবিনা ভালো সাজাতে পারে! কিন্তু লাবিবা বলে বসেছে, ‘ আমি সাজবোনা। না সাজিয়ে যেভাবে রেডি করানো করাও তোমরা।’

এই মেয়ে যে জেদ ধরে সেটাই বজায় রাখে। সাবিনা আর না পেরে কিচেনে ছুটে যায়। ছোট কাকিকে একাই রান্না করতে বলে মেজো কাকিকে লাবিবার কাছে পাঠায়। মেজো কাকি এসে লাবিবাকে দেখেই হৈ হৈ করে উঠে,
” একি! লাবি মা এখনো রেডি হওনি! কি অবস্থা! আমার নতুন বাবা এসে এভাবে ই দেখবে নাকি? মুখ দেখাবো কিভাবে আমরা? আমরা থাকতে লাবি মাকে সাজানো হবে না এটা তো হতে পারে না। উঠো উঠো দেখি এদিকে আসো। কোন শাড়ি পড়বে?দাও আমি সিলেক্ট করে দিচ্ছি।’
লাবিবা আলমারির সামনে গিয়ে কাকির হাতের শাড়িগুলো দেখে। উর্মিলাকে জিজ্ঞেস করে,
‘ লালের অপজিট কি রে?’
‘ কালো। ‘
‘ আমাকে কালো শাড়ি পরা । আর একদমি সাজাবি না। ‘
দুজনে মিলে লাবিবাকে কালো একটা শাড়ি পরিয়ে দেয়। চুলগুলো আচড়িয়ে পেছনে ছড়িয়ে দেয়। থুতনি ধরে এদিক ওদিক মুখ ঘুরিয়ে দেখে।
‘ একটু মুখে পাউডার দিয়ে দাও তো উর্মিলা। একটু ব্লাসন ও দিও। একেবারে সাঝ ছাড়া ভালো লাগছেনা। ‘
‘ লাল লিপস্টিক দিবি লাব্বু? সেই লাগবে। আয় একটা টিপ দিয়ে দিই। ‘
‘ একদম না। যা হয়েছে তাতেই এনাফ।’
‘ লিপবাম টা দে অন্তত। একেবারে ফ্যাসফ্যাসা ঠোঁট কেমন লাগছে! ‘
‘ বসার ঘর থেকে আওয়াজ আসছে না? লোকজন কি চলে আসছে? ‘
‘ গিয়ে দেখে আয় তো। ‘
উর্মিলা উকি দিয়ে দেখে আসে।
‘ হ্যা। সবাই চলে আসছে। একটা মহিলাও আসেনাই। সব ব্যাটা মানুষ। ‘
মেজো কাকী লাবিবার মাথায় ঘোমটা টেনে দেয়। তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে,
‘ চুপচাপ বসে থাকো। আমি বা ছোট এসে নিয়ে যাবে। রান্নাঘরে প্রচুর কাজ এখনো পড়ে আছে। আমি গেলাম। ‘
উর্মিলা ফোন হাতে এগিয়ে আসে।
‘ আয় দোস্ত সেলফি নেই। তোকে একদম ব্ল্যাক ডাইমন্ড লাগছে। আজকে ঐ সাদা বান্দর টার কি অবস্থা হবে সেটাই ভাবছি আমি। ‘
ফটাফট কয়েকটা সেলফি তুলে নেয়। লাবিবা নিরুত্তর। ভালো লাগছে না এসব। কেমন জানি অস্থির লাগছে। লাবিবার ডাক আসে। ছোট কাকী এসে তাড়া দেয়। শাড়িটা আরেকটু ঠিক করে কপাল অব্দি ঘোমটা টেনে লাবিবার কাঁধে হাত দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়। এতো পর পর পা ফেলতে লাবিবার বেশ অসুবিধা।একেতো পড়েছে শাড়ি। তার উপর প্রতিবন্ধী টাইপ হাটা। বিরক্তি ঠেলে আসে ভেতর থেকে।
‘ কাকী। আমি একাই হাটি। কি বাচ্চাদের মতো হাঁটি হাঁটি পা পা করছেন?’
‘ এভাবেই হাঁটতে হয়। নয়তো উনারা ভাববে মেয়ের পা বেশী চলে। ‘
‘ তাহলে আমি কি তাঁদের সামনে সারাজীবন এভাবেই হাটবো?উনারা কি আগে কখনো আমাকে দেখেননি? যদি নাও দেখে থাকে নাটক কেনো করবো? আমার যে হাত পা মুখ বেশী চলে এটা লুকিয়ে যাবো?’
‘ ত্যাড়ামি করিস কেনো?এটা নিয়ম রে মা।মাথা নিচু করে রাখ। খবরদার মাথা উঁচু করবিনা ।’
‘ আচ্ছা করবোনা।চোখ ও কি নিচু করে রাখবো?’
কাকী চোখ রাঙায়। লাবিবা মাথা নিচু করে নেয়।
ড্রয়িং রুমে বিশাল আলোচনা হচ্ছে। এরিমাঝে লাবিবাকে নিয়ে হাজির হয়। আলোচনা থেমে দৃষ্টিবদ্ধ হয় লাবিবার দিকে। ইসমাইল উঠে লাবিবাকে হাত ধরে এনে বসায় নিজের পাশে। মাথা নিচু করে থাকায় লাবিবার দৃষ্টি পড়ে ফ্লোরের উপর ঠিক তার সামনের সোফায় বসা গোড়ালীর উপর প্যান্ট উঠানো লম্বা ফর্সা মাঝ বরাবর কালো লোমযুক্ত পুরুষালী পায়ের দিকে। চট করে লাবিবার চোখ উঠে যায় উপরের দিকে। দৃষ্টি আটকায় উরুর উপর সোজাসুজি রাখা পুরুষালী হাতের দিকে। কব্জির উপর রিচ ওয়াচের কাটা ঠিক দুইটার ঘরে। প্লাটিনামের উপর গ্ৰীন স্টোন টা আঙুলের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে। সপ্ন গুলো আজকাল বার বার ফিরে ফিরে আসছে। মন মস্তিষ্ক সে দিকেই টানছে। সাইড ইফেক্ট কি পড়েনি?অবশ্যই পড়েছে। দৃষ্টিগুলো আজকাল একজন ব্যক্তির উপরেই চরম বেহায়া হয়ে উঠেছে ।

চলবে ___

#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো

(৮)
অপ্রত্যাশিত কিছু হুট করে পেয়ে গেলে একটু চমকে যাওয়াটা স্বাভাবিক। তানভীর খান কে প্রথমে লাবিবা অপ্রত্যাশিত ভেবেই চমকালো। পরক্ষনেই মনে পড়লো আজ সে যে কাজের জন্য এখানে উপস্থিত হয়েছে তানভীর খান হচ্ছে সেই মাধ্যম। দৃষ্টি তার নড়বড়ে। সরাসরি তাকানোর সাহস হয়ে উঠেনি। চোখ দুটো এখনো উরুর উপর রাখা লম্বা আঙুলের হাতকে ছাড়িয়ে যায়নি। বরং দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। লাবিবাকে কেউ কখনো কোন ছেলের দিকে অন্য নজরে তাকাতে দেখেনি। শত চার্মিং বয় ও যদি একবার চোখে পড়ে ফের ঘুরে দ্বিতীয় বার তাকে কখনোই দেখাবেনা। অতসব চার্মিং,হ্যান্ডসাম, বডি ওয়ালাকে লাবিবা ভয় পায়। আকর্ষন খুবই খারাপ জিনিস। বিরাট ভাবে জেঁকে বসে। ধীরে ধীরে অতলে টেনে নেয়। সমাজ ধর্মে কলুষিত করে। এতো সাবধানতা সত্ত্বেও সে একজন যুবতী। বিপরীত লিঙ্গের দিকে তার কিছু কিছু দূর্বলতা আছে। সেই দূর্বলতাকে এড়িয়ে গেলো লাবিবা। চোখ দুটো তার এই মুহূর্তে বন্ধ। নিজেকে বকে বকে দমাতে ব্যস্ত। তার এই রুপ দেখার পর আশেপাশে কি হচ্ছে সে জানতেও পারলো না ।

উপস্থিত মহলে মুরুব্বি , তানভীর ব্যতীত দুজন অবিবাহিত যুবক। একজন ফাহাদ আরেকজন ফাহাদের চাচাতো ভাই। মুরুব্বিরা মাশাআল্লাহ বলে আলাপে মগ্ন হতেই ধ্যান ভাঙে তানভীরের। চোখ সরে যায় লাবিবার থেকে। এতোক্ষন কোথায় ছিলো ভেবেই ক্রোধে ফেটে যায়। পরক্ষনেই আবার লাবিবাকে দেখেই শরীরের রক্ত হীম হয়ে আসে। তানভীর উঠে দাঁড়ায়। হুংকার ছেড়ে লাবিবাকে বলতে ইচ্ছে করে,
‘ এই মেয়ে এতোটা নির্লজ্জের মতো এসেছো কেনো? তোমার শাড়ি পড়া একদমই উচিত হয়নি। যাও চেঞ্জ করে আপাদমস্তক ঢেকে আসো।’
কিন্তু কিছুই মুখ থেকে বের করতে পারলো না। জাভেদ তানভীরকে ডাকলো।
‘ ভাগিনা! কোনো সমস্যা?’
তানভীর ডানে বায়ে মাথা নাড়ালো।
‘ না মামা।’
পরমুহূর্তেই আবার লাবিবার দিকে দৃষ্টি মেললো। মেয়েটা এসে দাঁড়িয়েছে। ঠিক ঐ মুহুর্তে ই তাকে দেখে তানভীরের মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে। লজ্জায় নুইয়ে পড়েছে। বারবার মাথা থেকে ঘোমটা পড়ে যাচ্ছে। সে ভয়ে হাত উঁচিয়ে কপালের দিকে ঘোমটাটা টেনে দিচ্ছে। ঠিক তখন তখনি উম্মোচিত হচ্ছে পেটের কিছু অংশ। কালো শাড়িতে সৌন্দর্য যেনো দ্বিগুন ফুটে উঠেছে। কালো কাপড়ের উপর সাদা কোমল চামড়া উকি ঝুঁকি দিচ্ছে। এই দৃশ্য ফাহাদের দৃষ্টি এড়ালেও ফাহাদের কাজিনের এড়ায় না। ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে সে। ফাহাদ ও কম যায়না। যদিও লাল পড়তে বলেছিলো সে তবে কালোতে যে এতোটা সুন্দর লাগবে সে না দেখলে বিশ্বাস ই করতো না। লাবিবার রুপে সকলে মুগ্ধ হলেও তানভীর বিন্দু মাত্র হলোনা। মেজাজ তার প্রথমেই চটে গেছে। এরপর লাবিবার দিকে ভুল করেও চোখ রাখলো না। সুন্দরী মেয়েদের সুন্দর দেখাবেই। এতে এতো বেহায়া হবার প্রয়োজন নেই। কিন্তু যার প্রয়োজন সে ঠিকই বেহায়া হয়ে উঠেছে। লাবিবার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে। প্রথমে গলা খাঁকারি দিলো। কাজ হলোনা। পা নাড়ালো। কাজ হলোনা। উপায় না পেয়ে উর্মিলার দিকে চোখ রাখলো। উর্মিলা ফাহাদের দৃষ্টিতে পড়ে মুচকি হাসলো। ফাহাদ ইশারা করলো। তখন উর্মিলা লাবিবাকে ঝাঁকি দিলো। লাবিবার দৃষ্টিচ্ছেদ হলো। মুখ ঘুরিয়ে উর্মিলার দিকে তাকাতেই উর্মিলা ফাহাদের দিকে ইশারা করলো। লাবিবা কোন আগ্ৰহ দেখালোনা। মাথা নিচু করতেই তার দুর্বলতা তাকে আবার বেহায়া বানালো। ফাহাদ ইশারা করলো আবার। উর্মিলাকে বুঝালো লাবিবার সাথে কথা বলতে চায়। উর্মিলা কাকীকে ইশারা করলো। কাকী একটু অপেক্ষা করতে বললো। আলোচনা বাড়তেই লাগলো। তানভীরের ফোনটা হুট করেই বেজে উঠলো। আলোচনা থেমে বেরিয়ে পকেটে হাত ঢুকিয়ে ফোন হাতে নিলো। সেই ফাঁকে একবার সামনে দিক তাকাতেই দৃষ্টি আটকালো। লাবিবার ডাগর ডাগর চোখদুটো কে অনুসরণ করে নিজের গোড়ালীতে আটকালো। ফোন বেজে কেটে গেলো। তানভীর তাতে মন দিলোনা। বরং মিনিট দুয়েক লাবিবার পানে দৃষ্টি রেখে ব্যপারটা বুঝার চেষ্টা করলো। দুর্বলতা! উইকনেস! এ দৃষ্টি ভয়াবহ। তানভীর একটু নড়ে চড়ে উঠলো। ফের ফোন বাজতেই তানভীর দ্রুত উঠে গেলো। এতো দ্রুত জায়গা ত্যাগ করলো যে লাবিবা ধ্যানচ্যুত হলো। সামান্য ভড়কেও গেলো। দৃষ্টি উঠালো। নিবদ্ধ হলো তানভীরের মুখপানে। এতোক্ষণে তানভীর সিউর হলো। ফোন কানে চেপে পকেটে হাত ঢুকিয়ে ড্রয়িংরুম ছাড়লো।

প্রস্তাবটা লাবিবার কাকীই রাখলো । ভাইজান, লাবিবা ফাহাদ দুজন একটু নিজেদের মধ্যে কথা বলুক। সকলেই সম্মতি রাখলো। লাবিবার উঠতে ইচ্ছা হলোনা। উর্মিলা ধাক্কিয়েই উঠিয়ে নিলো। নিজের রুমের দিকে যেতে নিলে লাবিবা আপত্তি জানালো।
‘ রুমের অবস্থা খারাপ। পুরোটাই অগোছালো। সেখানে ফাহাদকে নিয়ে যাওয়া যাবে না। ‘
‘ কোথায় যাবি তাহলে? ছাদে?’
‘ না। আমার পছন্দের জায়গায় ঐ ফাকাদ কাকাদ কে নিবো না।’
‘ এতো মান করে লাভ নেই। সেই মানুষ টাই দেখবি একদিন তোর পছন্দের হয়ে উঠবে। ‘
উর্মিলা এদিক ওদিক তাকালো। ফাহাদের চোখে চোখ পড়তে আবার একটু হাসলো। লাবিবার হাত ধরে টান দিলো।
‘ চল বাইরে বারান্দায় গিয়ে বসবি। সেখানে চেয়ার পাতাই আছে। ‘

তানভীর কথা শেষ করে বাসায় প্রবেশ করতেই লাবিবা ফাহাদ কে নিরিবিলিতে পাশাপাশি বসে থাকতে দেখে দাঁড়ালো। তাঁদের দুজনকে পাস করেই ভেতরে ঢুকতে হবে। তানভীর যাবে কি যাবে না দু মনা করলো। যেতে চেয়েও পা এগোলো না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। দেয়ালের এপাশ ওপাশ বিধায় লাবিবা ফাহাদের গল্পের সম্পূনাংশ কানে এলো।

ফাহাদ একটু বেশীই এক্সাইটেড। লাবিবার হাত ধরতে চাইলো। হাত এগুতেই লাবিবা সোজা হয়ে বসলো। ফাহাদ হাত গুটিয়ে দাত বের করে হাসলো। মোহিত গলায় বললো,
‘ প্রথমে লাল পড়োনি জন্য রাগ করেছিলাম। কিন্তু তোমাকে দেখে রাগ পালিয়ে গেলো। খুব ই সুন্দর লাগছে। কারো নজর না লাগুক। ‘
‘ থ্যাংকিউ। ‘
‘ তোমার বান্ধুবীটা অনেক ভালো। ইশারায় বেশ পটু। কারো সাথে কি কোন চক্কর চলছে নাকি তার?’
‘ চক্কর চললেই যে ইশারায় পটু হবে এটা কে বললো?’
‘ ওহ। তার মানে বলতে চাইছো সিঙ্গেল!’
‘ হ্যা। কেনো পছন্দ হয়েছে?’
‘ তাতো অবশ্যই। তুমি না থাকলে তার দিকেই ঝুকতাম। কিন্তু এখন আর যাচ্ছিনা। ‘
লাবিবা মৃদু হাসলো। ফাহাদ বললো,
‘ আমি কিন্তু ফ্রী মাইন্ডে কথা বলি। তুমি কিছু মাইন্ড করোনা। তোমার বান্ধবী যথেষ্ট সুন্দরী। তার দিকে আমাদের মতো কম বয়সী যুবকরা নজর দিবে নাতো কে দিবে? তবে আমি কিন্তু দিচ্ছি না। কারণ আমার নজর তোমাতেই আবদ্ধ হয়ে গেছে। ‘
ফাহাদের কথাতে লাবিবার মনে বিষাদ ছুঁয়ে গেলো। বুঝার পর থেকে যে ভয়টা এতো দিন পেয়ে এসেছিলো সে ভয়টা সত্যি হতে চলেছে। অথচ লাবিবা সবসময় আল্লাহর কাছে চাইতো এমন যেনো কখনোই না হয়। ভাবতে ভাবতে আনমনেই বলে উঠলো।
‘ ব্যক্তিগতভাবে আমি কম বয়সী যুবকদের জীবনসঙ্গী হিসেবে পছন্দ করিনা । কম বয়সী যুবকদের থাকে দ্বিধাবোধ, গুড থেকে বেস্ট খোঁজার তাড়না। হৃদয় ভাঙার অভ্যাস। তারা অধিকাংশই থাকে কনফিউজড।
আমার চাই একজন আপাদমস্তক পুরুষ। সত্যিকারের সুপুরুষ। তারা ডালে ডালে ঘুরে না। অবলম্বন খুঁজে নেয়। শেষ বয়স অব্দি বাঁচার অবলম্বন। ‘

(চলবে।)