ভালোবাসি তারে পর্ব-২৫

0
5412

ভালোবাসি তারে

২৫.
নিঝুমের একটু দূরত্বে চুপ করে বসে আছে ঝুম। নিঝুম যেতে দিচ্ছে না তাকে। যেতে চাইলে ধমক শুনতে হচ্ছে। ঝুমের বুক কাঁপছে এবার। হাতগুলো একটু বেশিই কাঁপছে না? নিজেকে নিজে প্রশ্ন করল ঝুম। হাতের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে নিলো। হুম! হাত জোড়া একটু বেশিই কাঁপছে। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে ঝুম ধীর গলায় বলল,
— “ডাক্তার? আমি যাই, প্লীজ? আপনার ফুফি বা অন্যকেউ আমাকে এখানে দেখলে খারাপ ভাববেন।”

নিঝুম নিরুত্তর। সে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে ঝুমের মুখ পানে। ঝুমের অস্বস্তি হচ্ছে। ইচ্ছে করছে দৌঁড়ে পালিয়ে যেতে। অথচ নিঝুমের ভালো লাগছে ঝুমকে দেখতে। ঘোর লেগে যাচ্ছে। মেয়েটা এত সুন্দর কেন? গুলুমুলু গালদুটো লজ্জায় রক্তিম রঙ ধারণ করলে টেনে দিতে ইচ্ছে হয়। আচ্ছা, ঝুমের চুল বাঁধা কেন? নিঝুমের ভ্রু কুঁচকে যায়। চুলের খোঁপা একটানে খুলে ফেলে সে। সঙ্গে সঙ্গে কোমড় অব্দি চুলগুলো সারা পিঠে ছঁড়িয়ে পড়ে। আচমকা এমন হওয়ায় ঝুম চমকে যায়। বড় বড় চোখে নিঝুমের দিকে তাকায়। থমথমে গলায় বলে,
— “কি হয়েছে আপনার? চুল খুলে দিয়েছেন কেন?”
নিঝুমের নির্লিপ্ত ভাব,
— “আমার ইচ্ছে।”
ঝুম অবাক হয়। একটু থেমে নিঝুম আবার বলে,
— “তোমাকে খোলা চুলে ভালো লাগে ঝুম।”

ঝুম হা হয়ে যায় এবার। নিঝুমের কি হয়েছে? অচেনা লাগছে তাকে। পরক্ষণেই চোখ সরিয়ে ফেলে ঝুম। অস্বস্তিতে এদিক-ওদিক তাকানো শুরু করে। নিঝুম কোমল কণ্ঠে ডাকে,
— “ঝুম?”

ঝুম আড়চোখে তাকায় নিঝুমের দিকে। রোদের আলো সরাসরি পড়ছে নিঝুমের সর্বত্র মুখে। কি অসম্ভব সুন্দর লাগছে দেখতে! হঠাৎ টেবিলে থাকা লাল রঙের টিউব থেকে কিছুটা রঙ নিয়ে ঝুমের বাম গালে লাগিয়ে দেয় নিঝুম। ঝুম ভড়কে যায়। দ্রুত সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে। নিঝুম হেসে ফেলে। সেও উঠে দাঁড়ায়। জিজ্ঞেস করে,
— “ভয় পেয়েছো?”

ঝুম কিছু বলে না। তার রাগ লাগছে। অথচ প্রকাশ করতে পারছে না। কিছু বলতেও পারছে না! এ রাগ দেখাতে না পারায় ঝুম হতাশ। হতাশ হয়ে দক্ষিণ দিকের জানালাটার দিকে চেয়ে রয় ঝুম। নিঝুম এবার টিস্যু এগিয়ে দিয়ে ধীর গলায় বলল,
— “ঝুমময় পিচ্চি? রাগ করেছো ডাক্তারের উপর?”

ঝুম প্রথমেই কিছু বলে না। টিস্যুটি নিয়ে নেয় তৎক্ষণাৎ। গাল মুছতে মুছতে অভিমান নিয়ে বলে,
— “চোখ বন্ধ করুন ডাক্তার।”
— “কি?”
ঝুম আবারো বলল,
— “চোখ বন্ধ করুন।”

নিঝুমের ভ্রু কুঁচকে গেল। তবে প্রশ্ন করল না সে। ভ্রু কুঁচকানো অবস্থায়ই চোখ বন্ধ করে ফেলল। এবার যেন নিঝুমকে আরো সুন্দর লাগছে। ঝুমের ইচ্ছে করছে নিঝুমের নাকটা একটু টেনে ধরতে। পরক্ষণেই চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলে সে। মনে মনে আওড়ায়,
— “পাগলামী বন্ধ কর ঝুম। বেশি বেশি হচ্ছে এসব। নিঝুম তোর জন্য একটা বিরাট বড় সর্বনাশ। সেখানে চোখ দেওয়া বারণ। দিলেই সর্বনাশ হয়ে যাবে যে!”
অথচ ঝুম পারছে না, না তাকিয়ে থাকতে। অজান্তেই নিজেকে ঠেলে দিচ্ছে সর্বনাশের দিকে।

— “আর কতক্ষণ চোখ বন্ধ করিয়ে রাখবে ঝুম?”

নিঝুমের গম্ভীর গলা শুনে ঝুম বাস্তবে ফিরে। কাঁপা কাঁপা হাতে টেবিলের লাল রঙ হাতে নিয়ে নিঝুমের একটু কাছাকাছি এগোয় সে। ধীর গলায় বলে,
— “সরি ডাক্তার!”
বলা মাত্রই নিঝুমের ডান গালে লাল রঙ ছুঁইয়ে দিয়ে দৌড়ে চলে যায় ঝুম।

______________________________

সোফার এক কোণে প্রচন্ড অস্বস্তি নিয়ে বসে আছে ঝুম। মনোয়ারা শেখ বারবার তার দিকে ক্ষীপ্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করছেন। ঝুম বুঝতে পারছে না, তিনি কেন ঝুমকে এত অপছন্দ করেন? ঝুম তো তার কোনো ক্ষতি করে নি। দীর্ঘশ্বাস ফেলল ঝুম। মিসেস সানজিদা তার পাশে বসে শপিংব্যাগ গুলো এক এক করে দেখছেন। নিধাকে পড়ানো শেষে ঝুমকে যেতে দেন নি তিনি। বরং নিজের পাশে বসিয়ে শপিং করা জিনিসগুলো তাকেও দেখাচ্ছেন।

সোফায় গোল হয়ে বসে সবাই যার যার পছন্দের জামা নিচ্ছে। এসবের মাঝে নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে ঝুমের। চারপাশে তাকিয়ে শুধু নিঝুমকে খুঁজছে সে। একটু আগেও তো নিঝুম এখানে ছিল। এখনই আবার কোথায় চলে গেল? পাশে বসে থাকা নিধাকে ঝুম ফিসফিসিয়ে বলল,
— “নিধা? তোমার ভাইয়া কোথায় দেখেছো?”

নিধা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানায়। ঝুমের ফিসফিস করে বলে,
— “বাগানের দিকে গেছে ম্যাম।”
— “ওখানে কেন গিয়েছে?”
— “ভাইয়ুর বাগানে পানি দিতে অনেক ভালো লাগে। তাই!”

ঝুম পাল্টা কিছু বলবে তার আগেই মনোয়ারা শেখের কর্কশ কণ্ঠ শোনা গেল। তিনি মুখ বিকৃতি করে বললেন,
— “এই মেয়ে! তোমার নাম যেন কি?”

সবার সামনে এভাবে ডাকায় ঝুমের একটু খারাপ লাগলো। উত্তর দিতে সময় নিলো সে। কাঁপা গলায় বলল,
— “জ-জ্বী, মালিহা তা.. তাবাস্সুম ঝুম।”

মনোয়ারা শেখ ভ্রু কুঁচকে বললেন,
— “তুমি তোতলা নাকি? ঠিক করে কথা বলতে পারো না?”
ঝুমের লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে। মহিলা এত অপমান করছে কেন তাকে? কান্না পাচ্ছে ঝুমের। কষ্ট হচ্ছে।

স্নিগ্ধ বিরক্তি নিয়ে মনোয়ারা শেখকে বলল,
— “সমস্যা কি মা? ওর সাথে এমন বিহেভ করছ কেন?”
— “চুপ থাকো তুমি। তোমার সাথে কথা বলছি না আমি।”

স্নিগ্ধ রেগে গেল। তৎক্ষণাৎ উঠে চলে গেল সেখান থেকে। ঝুমের মনে হচ্ছে সে এখুনি কেঁদে দেবে। পরিস্থিতি অস্বাভাবিক দেখে মিসেস সানজিদা দ্রুত বলে উঠলেন,
— “ঝুম? দেখ, তোর জন্য অনেক সুন্দর একটা শাড়ি কিনে এনেছি আমি। সুন্দর হয়েছে না?”

ঝুম শাড়িটির দিকে তাকালো। সবুজ পাড়ের হলুদ শাড়ি। দেখবে বেশ সুন্দর। ঝুমের ভালো লাগলো শাড়িটা। মুখ ফুটে ‘সুন্দর’ বলবে তখনই মনোয়ারা শেখ আবারো বলে উঠলেন,
— “পরের মেয়ের জন্য এর দরদ উতলে পড়ছে কেন তোর সানজিদা? ও কে যে ওকে শাড়ি দিতে হবে?”
কথা সত্য হলেও ঝুম সহ্য করতে পারছে না। টুপ করে এক ফোটা জল ঝুমের গাল বেয়ে গড়িয়ে পরল। ঝুম আর বসে রইল না সেখানে। দ্রুত বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।

উঠানের সরু রাস্তাটায় মাথা নত করে দ্রুত পদে হাঁটছে ঝুম। বারবার গাল বেয়ে পড়া পানিগুলো ডান হাত দিয়ে মুছে ফেলছে। কিছুতেই কান্না আটকাতে পারছে না সে। কুড়ি বছরের জীবনে ঝুম কখনো এতটা অপমান হয় নি। কখনো না!

হঠাৎ কারো বুকের সঙ্গে ধাক্কা খায় ঝুম। মাথা তুলে তাকাতেই দেখে নিঝুম। সে বেশ শান্ত চাহনিতে দেখছে ঝুমকে। তার দৃষ্টি ঝুমের লাল হয়ে যাওয়া চোখ, গাল আর নাকে বিচরণ করছে। শান্ত গলায় নিঝুম প্রশ্ন করে,
— “কাঁদছো কেন ঝুম?”

ঝুম জবাব দেয় না। পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নেয়। নিঝুম আটকে ফেলে। ঝুমের হাত ধরতেই ঝুম যেন ভেতর থেকে ভেঙ্গে পড়ে। কিছুক্ষণ আগের ঘটনা চোখের সামনে ভেসে উঠে তার। শব্দ করে কেঁদে দেয় সে। নিঝুম স্থির হয়ে ঝুমের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। পরপরই ঝুমকে আবদ্ধ করে নেয় নিজের আলিঙ্গনে। ঝুমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,
— “কি হয়েছে ঝুম? আমাকে বলো। কেউ কিছু বলেছে?”
ঝুম নিশ্চুপ। নিঝুমের বুকের সঙ্গে একদম এঁটে রয়েছে সে। নিঝুমও কিছু বলছে না। পরম যত্নে আগলে রেখেছে ঝুমকে। প্রায় অনেক্ষণ পর নাক টেনে,টেনে ভাঙ্গা গলায় ঝুম বলে উঠে,
— “আমার খুব কান্না পাচ্ছে ডাক্তার। আটকাতে পারছি না। আমাকে কান্না আটকানোর একটা ঔষুধ দিন না প্লীজ।”

এহেন কথায় নিঝুমের হাসি পায় প্রচুর। শব্দ করে হেসে দেয় সে। ঝুম আবারো নাক টেনে অভিমান নিয়ে বলল,
— “আপনি অনেক খারাপ ডাক্তার। আমার কান্না দেখে কিভাবে হাসছেন?”
নিঝুম হাসতে হাসতে বলে,
— “আচ্ছা, আর হাসবো না।”
— “কিন্তু আপনি হাসছেন!”
নিঝুম নিঃশব্দে হাসে এবার। আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করে,
— “কেউ কি তোমাকে কিছু বলেছে ঝুম বৃষ্টি?”
ঝুম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
— “উহু!”

_________________

চলবে…
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা