ভালোবাসি তারে
২৯.
ঘুম থেকে উঠতে বেলা বারোটা বেজে গেল ঝুমের। দূর্বল শরীর নিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে আয়নার সামনে দাঁড়ালো সে। ক্ষণিকের জন্য নিজেকে দেখে নিজেই ভড়কে গেল। এ কি হাল তার চেহারার? চোখ ফুলে লাল হয়ে গেছে। টমেটো লাগছে দেখতে। মুখটাও কেমন ফ্যাকাসে হয়ে আছে। এ সবই কাল রাতে কান্না করার ফলে হয়েছে।
কাল রাতে আলম খানকে আবারো বোঝানোর চেষ্টা করেছিল ঝুম। বার বার বুঝিয়ে বলছিল, সে এ বিয়ে করতে চায় না। কিন্তু কেউ শোনে নি তার কথা। কেউ না! বরং হেলা করে দেখছিল সবাই। উল্টো ঝুমকে বিয়ের জন্য আরো চাপ দিচ্ছি। মিসেস শ্রেয়া তো গালাগাল করছিলেন। রাগে, দুঃখে সারা রাত্রি শুধু কেঁদেছে ঝুম। এক বিন্দুও ঘুমায় নি। ফলসরুপ এ অবস্থা তার। ঝুম দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আরেক দন্ড আয়নায় দেখে নিলো নিজেকে। মনে মনে আওড়ালো, ‘আমার কি সত্যি অন্য কারো সঙ্গে বিয়ে হয়ে যাবে? আমার সুন্দর স্বপ্নটা কি সত্যি দুঃস্বপ্ন হয়ে ভেঙে যাবে? আমি কি নিঝুমের হবো না কখনো?’
নিমিষেই জল জমে গেল ঝুমের চোখে। তবে জল গাল গড়িয়ে পড়ার আগেই হাত দিয়ে ঘঁষে মুছে ফেলল ঝুম। ঘন ঘন নিশ্বাস নিলো এবং ফেলল। শক্ত হওয়ার চেষ্টা করছে সে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর ঠিকই ভেঙ্গে পরছে। দূর্বল চোখ জোড়া বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে নোনাজল। উহু! নিঝুমের ভাষায়, চোখের মুক্তাগুলো অপচয় হচ্ছে মাত্র!
৪
ঝুমের চোখ,মুখের বাজে অবস্থা দেখেও মিসেস শ্রেয়া কিছু বললেন না। মনে মনে তিনিও চান নি ঝুমের বিয়েটা এত তাড়াতাড়ি হোক। কিন্তু এছাড়া তার কিই-বা করার আছে? আর সাত-আট মাস পর আলম খান চাকরী থেকে রিটায়ার হয়ে যাবেন। এমনিতেই তাদের আর্থিক সমস্যা। পরে হয়তো সসম্মানে ঝুমকে বিয়ে দিতে পারবেন না আলম খান। তারউপর ছেলেরও অতশত চাহিদা নেই। মাত্র একটা মোটরসাইকেলের বিনিময়ে ঝুমকে তুলে নিবে তারা। এমন ছেলে হাত ছাড়া করা যায় নাকি? সব কিছু বিবেচনা করে মিসেস শ্রেয়া চুপ করে আছেন। বিয়ের জন্য সবচেয়ে বেশি তাড়া উনারই যেন।
ঝুম বিরক্ত মুখে শাড়ি পড়ে বসে আছে পাত্র পক্ষের সামনে। অথচ কেউ তার বিরক্তির আড়ালের কষ্টটা দেখতে পারছে না। চূর্ণ-বিচূর্ণ মনের ক্ষতটাও অদৃশ্য সবার কাছে। ঝুম বারবার আমল খানের দিকে তাকাচ্ছে। এই বুঝি আলম খান বলবেন,
— “আমার মেয়ের বিয়ে আমরা এখন দেবো না। আপনারা আসতে পারেন।”
কিন্তু আফসোস! এমন কিছুই ঘটছে না। আলম খান হাসি মুখে আপ্যায়ন করছেন সবার। পাত্রের মা অনবরত প্রশ্ন করে চলেছে ঝুমকে। ঝুম ভাঙ্গা গলায় উত্তর দিচ্ছে সবকিছুর। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করেই উল্টাপাল্টা উত্তর দিচ্ছে। সেক্ষেত্রে মিসেস শ্রেয়ার চোখ রাঙানো থেকেও রেহায় পায় নি সে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হওয়ার পর ঝুমকে পাত্রর সঙ্গে পাঠানো হয় তার রুমে। ঝুম ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও পাত্র থেকে যথেষ্ট দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে আছে।
পাত্রের নাম রূপক। ঝুমের একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে সে। ঝুমকে দেখে বার বার মুচকি মুচকি হাসছে। ঝুম বুঝতে পারছে না এখানে হাসার কি আছে? বিরক্ত লাগছে তার। বিরক্তি নিয়ে বলেই ফেলল ঝুম,
— “সমস্যা কি? এভাবে হাসছেন কেন?”
রুপক ছেলেটা তবুও হাসছে। আশ্চর্য! পাগলের মতো হাসছে কেন? ঝুম ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল ছেলেটার দিকে। এক-দুই সেকেন্ড চুপ থেকে রুপক মুচকি হেসে বলল,
— “তুমি অনেক সুন্দর।”
ঝুম হকচকিয়ে গেল। ঝুমের মতে ঝুমকে ভূতের চেয়ে কম লাগছে না। চোখ-মুখ ফুলে বিশ্রী একটা অবস্থা। তবুও ছেলেটার কাছে সুন্দর লাগছে কিভাবে? ঝুমের আজব লাগলো ব্যাপারটা। রুপক আবার বলে উঠল,
— “আচ্ছা, তোমার কি আমাকে পছন্দ হয়েছে?”
ঝুম এক ঝলক দেখে নিল রুপক নামক ছেলেটাকে। দেখতে মোটামোটি সুদর্শন সে। অধিকাংশ মেয়েই হয়তো প্রথম দেখায় বিয়েতে রাজী হয়ে যেত, কিন্তু ঝুমের মোটেও ভালো লাগে নি তাকে। বরং একরাশ বিরক্তি আর তিক্ততা কাজ করছে সর্বত্র জুড়ে। ঝুম কথা বাড়ালো না আর। কাঠকাঠ গলায় সরাসরি বলে উঠল,
— “দেখুন। আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি। ত-তাই আপনি বিয়েটা ভেঙ্গে দিন।”
প্রায় অনেক্ষণ প্রতিউত্তর এলো না। নিশ্চুপ সামনের জন। ঝুম মাথা নত করে ছিল। কোনো সারাশব্দ না পেয়ে চোখ তুলে তাকালো। রুপক তখনো হাসছিল। ঝুমের রাগ লাগল। বলল,
— “হাসছেন কেন? আমি কি কৌতুক শুনিয়েছি আপনাকে?”
আস্তে ধীরে হেসে জবাব দিলো ছেলেটা,
— “হ্যাঁ। অনেকটা তেমনই। তা ছেলেটা কি তোমাকে ভালোবাসে?”
ঝুম তাৎক্ষণিক ভাবে জবাব দিতে পারলো না। নিঝুম তো তাকে কখনো বলে নি, সে তাকে ভালোবাসে। তবে আকারে ইঙ্গিতে বোঝানোর চেষ্টা করেছে বহুবার। সেটা ভেবে ঝুম চট করে বলে উঠল,
— “ভালোবাসেন। উনি আমাকে অনেক ভালোবাসেন।”
ছেলেটা তার অসহ্য হাসি আবারো হাসলো। এক কদম এগিয়ে এলো ঝুমের দিকে। তড়িৎ গতিতে ঝুম দু’কদম পিছিয়ে গেল। মৃদু চেঁচাল,
— “দূরে থাকুন। এগোচ্ছেন কেন?”
রুপক বাঁকা হেসে বলল,
— “আমি তিন বছর এব্রডে ছিলাম। তোমার মতো অনেক মেয়েকেই ভালোবেসেছি। তারাও বাসত! ইট’স নট আ বিগ ডিল। কিন্তু শেষে তো আমরা আলাদা হয়েছি তাই না? তোমরাও হবে। এখানে বিয়েতে না করার কি আছে? তাছাড়া তোমাকে আমার অনেক পছন্দ।”
রাগের মাত্রা যেন বেড়ে গেল ঝুমের। রাগে রীতিমতো হাত পা কাঁপছে। কাঁপা কাঁপা গলায় প্রবল ক্ষোপ নিয়ে ঝুম বলে উঠল,
— “আপনি একটা চরিত্রহীন। বাজে লোক! আপনার সাহস কি করে হয় আমার ভালোবাসাকে আপনার থার্ডক্লাস ভালোবাসার সঙ্গে তুলনা করে অপবিত্র করার? আর ওটা আপনার ভালোবাসা না। ক্ষণিকের বাজে মোহ!”
তবুও বেহায়ার মতো হাসছে রুপক। হাসি যেন ঠোঁট থেকে সরছেই না। রুপক আবারো এগোতে লাগল ঝুমের দিকে। ঝুম ভয়ে সিটিয়ে গেল। দেওয়ালের সঙ্গে লেগে দাঁড়ালো একদম। রুপক সামান্য দূরত্বে দাঁড়ালো ঝুমের সামনা সামনি। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বাঁকা হেসে বলল,
— “বিয়ের পর দেখবো তোমার এই তেজ কোথায় যায়। আসি সুইটহার্ট!”
বলেই চলে গেল রুপক। ঝুম স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল কিছুক্ষণ। পরক্ষণেই মেঝেতে বসে পড়ল। অনুভূতি শূণ্য হয়ে তাকিয়ে রইল সামনের দিকে। চোখ দিয়ে অনর্গল পানি পরছে তার। কয়েক সেকেন্ড পরই ঝুম কান্নায় ভেঙ্গে পরল। হাঁটুতে মুখ গুঁজল সে।
অনেক বাবা-মায়েরা আছেন ছেলের ভেতরের দিক বিবেচনা না করে, বাইরের দিক দেখেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেন। ছেলের টাকা-পয়সা আছে, ভালো দেখতে, ভালো ব্যবহার! আর কি লাগে? ভাবেন তাদের মেয়ে ভালো থাকবে। সুখে থাকবে! অথচ এটা ভাবেন না, তাদের মেয়েটা আসলে কি চায়। ছেলেটা আসলেই কেমন! তাদের একটু গাফলতির জন্য মেয়েটার সারাটা জীবন নষ্ট হয়ে যায়। নিজের স্বপ্নের পাশাপাশি আত্মাটাও যে মিলিয়ে যায়। একদম কোনো বিভীষিকা স্বপ্নের মতো!
____________________
রাত ১টা বেজে ১২মিনিট। নিস্তব্ধ রাতের মতো নিশ্চুপ ভাবে রুমের এককোণে বসে আছে ঝুম। কান্নার পানিগুলো শুকিয়ে গালে দাগ বসে গেছে। দৃষ্টি তার জানালা গলিয়ে দূর আকাশের টিমটিম করতে থাকা তারাগুলোর দিকে। ঝুম তাকিয়ে আছে তো তাকিয়েই আছে সেদিকে। খুব কমই চোখের পলক ফেলছে সে। এখন আর কান্না আসছে না তার। সবকিছু এলোমেলো লাগছে। নিজের অস্তিত্বটাই হারিয়ে ফেলছে যেন!
খানিকবাদ পর ফোনের সুরেলা রিংটোন প্রবল শব্দ করে বেজে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে ঝুম কেঁপে উঠে সম্বিৎ ফিরে পেল। নিস্তেজ প্রায় শরীরটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে। বিছানায় গিয়ে বসল। কাঠের টেবিলটার এককোণে ফোনটা বাজছে। স্ক্রিনে গুটিগুটি অক্ষরে নিঝুমের নাম ঝাপসা ভাবে দেখতে পারছে ঝুম। প্রবল অভিমানে ঝুম একবার ভাবলো কল ধরবে না। পর মুহুর্তেই হুরহুর করে ফোনটা নিয়ে কল রিসিভ করে ফেলল সে। ওপাশ থেকে নিঝুম শান্ত গলায় ডেকে উঠল,
— “ঝুম?”
ঝুম উত্তর দিতে পারলো না। নিঃশব্দে কেঁদে উঠল। নিঝুম আবার বলল,
— “কথা বলবে না পিচ্চি?”
সঙ্গে সঙ্গে তীব্র অভিমান নিয়ে কান্না ভেঁজা, ভাঙ্গা কণ্ঠে ঝুম বলে উঠল,
— “আপনি এত বাজে কেন ডাক্তার? আমার.. আমার কথা কি আপনার একটুও মনে পরে না? এত্তক্ষণে আমাকে কল করার সময় হলো আপনার?”
একটু থেমে আবার বলে,
— “ডাক্তার? আমি বিয়েটা করব না। আপনি প্লীজ কিছু করুন। জানেন? ছেলেটা খুব বাজে। আমার ঘৃণা লাগে ছেলেটাকে দেখলে। অসহ্য অনুভূতি হয়।”
অনেকটা সময় নিয়ে কথাগুলো বলে ঝুম। ওপাশ থেকে নিঝুমের দীর্ঘনিশ্বাসের শব্দ শুনতে পায়।
কয়েক সেকেন্ড পর আদুরে গলায় নিঝুম বলল,
— “কান্না বন্ধ করো ঝুম। তুমি যা চাও তাই হবে। এখন ঘুমাও। রাত হচ্ছে।”
ঝুম নাকচ করে বলল,
— “আমার মন ভালো নেই ডাক্তার। ঘুম আসবে না। আপনি আমাকে মন ভালো করার একটা ঔষুধ দিন তো। আমি সেটা খেয়ে মন ভালো করতে চাই।”
নিঝুম মলিন হেসে বলল,
— “তুমি দিন দিন চালাক হচ্ছো ঝুম। তোমাকে ঘুমাতে বলছি আর তুমি না ঘুমানোর উপায় খুঁজছো। কেন?”
ঝুম নাক টেনে বলল,
— “আমি ঘুমাবো না। কথা বলব।”
— “আচ্ছা, কি কথা বলবে?”
— “আপনি আমাকে সারাদিন ফোন দেন নি কেন? আমি অপেক্ষায় ছিলাম।”
নিঝুম তপ্ত নিশ্বাস ফেলে বলল,
— “ব্যস্ত ছিলাম ঝুম।”
ঝুমের মনে আবারো অভিমান জমলো। সে বলল,
— “তাই বলে একটাবার ফোন দিতে পারলেন না? এক মিনিটের জন্যও না?”
নিঝুম উত্তর দিলো না। অস্পষ্ট ভাবে বলল,
— “সত্যিই সময় পাই নি ঝুম। কাজটা জরুরি ছিল। তোমার আমার জন্য ভীষণ জরুরি ছিল।”
__________________
চলবে…
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
Ishanur Tasmia