#ভিনদেশি_তারা
#পর্ব-১২
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
৩৪.
‘ হ্যালো জান? কেমন আছো জান?’
‘ আপনি আবার ফোন করেছেন?’
‘ হুম জান।’
‘ কেন করেছেন?’
‘ তোমার সাথে কথা বলতে জান!’
আমি রেগে বললাম, ‘আপনি বারবার “জান জান” বলছেন কেন আজব!’
‘ ভালো লাগছে জান।’
‘ আপনি ফোন রাখুন তো। যত্তসব।’
‘ ফোন রাখতে তো দিইনি। তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে জান।’
‘ এই আপনি জান বলা বন্ধ করুন, হুম?’
নিঝুম হু হা করে হেসে বললো, ‘ঠিক আছে। তবে সারপ্রাইজটা বলি?’
‘ কিসের সারপ্রাইজ? তাড়াতাড়ি বলে ফোন রাখুন তো।’
‘ তুমি আবার মরে যাবে নাতো?’
আমি রেগে বললাম, ‘মরে যাবো মানে?’
‘ মানে সারপ্রাইজ শুনে তুমি যদি হার্টফেল করো তাহলে আমিতো বিয়ের আগেই বিধবা হয়ে যাবো।’
আমি তাচ্ছিল্যের সুরে বললাম, ‘ সেকথা পরে। এই জীবনে বেঁচে থাকতে আমি আপনাকে বিয়ে করবোনা। গট ইট? তাই আমার পিছু ঘুরা বন্ধ করেন আর এসব গুন্ডামি ছেড়ে ভালো হয়ে যান।’
নিঝুম গা জ্বালানো হাসি দিয়ে বললো, ‘ আমাকে করবেনা তো কাকে করবে? ওয়েট..ওয়েট… তুমি আবার ওখানের কোনো সাদা বাঁদরের প্রেমেট্রেমে পড়লা নাকি?’
‘ আপনাকে বলবো কেন? সেটা একান্তই আমার ব্যাপার।’
‘ তাই নাকি? তুমি আমার উড বি ওয়াইফ, তাই সবকিছু জানার অধিকার আমার আছে।’
‘ হাসালেন আমায়। আপনাকে বিয়ে করছেই কে আর আপনার কাছে আমার হাতই তুলে দিবে কে? আমি তো ইন্তেকাল করলেও করবোনা আর আমার ফ্যামিলিও আপনার মতো গুন্ডার কাছে বিয়ে দেবেনা। তাই আকাশকুসুম কল্পনা না করে বাস্তবে ফিরে আসুন।’
নিঝুম আমার সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। অতঃপর বললেন, ‘সারপ্রাইজ বলি?’
‘ জ্বি। বলে উদ্ধার করেন!’
‘ আমার না চাকরি হয়েছে।’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘চাকরি মানে? কিসের চাকরি?’
‘ একটা স্কুলে। বেশ ভালো বেতন।’
‘ তো আমি কি করবো?’
‘ তুমি চমকালে না?’
‘ না। কারণ আমি জানি আপনি মিথ্যাবাদী!’
‘ ওকে ইন্টারনেটে সার্চ করে দেখো। ওখানে আমার ছবিটবি, বায়ো পাবে। আমি এখন গুন্ডামি ছেড়ে ভালো হয়ে গিয়েছি। বুঝলে? আর তাঁর ক্রেডিটটা শুধু তোমার বাবার !’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘ কিসের ক্রেডিট?’
‘ কারণ তোমাকে না পেয়ে আমি প্রায় পাগলই হয়ে গিয়েছিলাম। তোমার সাহস, সৌন্দর্য, স্বপ্ন সবকিছু আমার মনের মধ্যে গেঁথে যায়। বুঝলাম যে, তোমাকে ছেড়ে আমি বেঁচে থাকতে পারবোনা। তাই পাগলের মতো একবার তোমার বাসায় হামলা চালাতে গেলে তোমার আব্বু আমাকে যাচ্ছেতাই অপমান করে তাড়িয়ে দেয় এবং শর্ত দেয়, আমি যদি ভালো হয়ে উঠতে পারি, তোমার যোগ্য হতে পারি তাহলে নিদ্বিধায় তোমাকে আমার হাতে তুলে দেবে। তাই ক্রেডিট তোমার বাবার। বুঝলে?’
আমি চুপ। যেন কান দিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছে, হাত-পা গরম হয়ে গিয়েছে। নিঝুম আবারও বললো, ‘ অনেকদিন আগেই আমি এসব ছেড়েছি এবং তোমার সাথে ক’দিন আগে যোগাযোগ করেছি। আমি কিন্তু সব ছেড়ে এখন চাকরি করি আর এলাকায় গরিব মানুষদের সাহায্য করি। সবাই আমার জন্য দোয়া করে, ভালোবাসে। বিশ্বাস করো, আমি আগের থেকে অনেক ভালো আছি। তোমাকে না পেলে আমি আর বাঁচবোই না চিত্রা।’
‘ আর কিছু?’
‘ হুম।’
‘ কি?’
‘ তোমার কাছে যাওয়ার জন্য আবেদন করেছিলাম। খুশির খবর, আমার ভিসা হয়ে গিয়েছে। সারপ্রাইজটা কেমন?’
‘ হোয়াটটট?’
‘ ইয়েস জান। কয়েকমাসের মধ্যেই আমি আসছি। সো বি রেডি।’
আমি হতভম্ব এবং রাগী গলায় বললাম, ‘ কিসব আবোলতাবোল বকছেন আপনি? মাথা খারাপ আপনার? এসব পাগলামি বন্ধ করুন আর আমাকে শান্তিতে বাঁচতে দিন। আমি আপনাকে ভালোবাসি না, সো আপনার পথ দেখুন।’
‘ এসব বললে হবেনা। আমি সব ঠিকঠাক করেছি এবার আর পালাতে পারবেনা। নইলে সব তছনছ করে দিবো। মাইন্ড ইট।’
নিঝুমের ভয়ানক কথাগুলো শুনে আমার মাথা হ্যাং হয়ে গেলো। রাগে গা কাঁপতে লাগলো। ফোন কেটে দিয়ে বাসায় ফোন করলাম এবং আব্বুর কথা শুনে আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। নিঝুম যা যা বলেছে সব নাকি ঠিক। রাগের মাথায় আব্বুও নিঝুমকে কথা দিয়ে ফেলেছিলো। আর এলাকায় নিঝুমকে নিয়ে এখন নাকি হৈ হৈ রব, এককথায় নোবেল প্রাইজ দেওয়া বাকি নিঝুমকে।
ফোন রেখে আমি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম।
৩৫.
মন বেশ খারাপ। নিঝুম যদি সত্যিই এখানে আসে তাহলে আমার কি হবে? আমিতো কোনোদিনও ওনাকে মানতে পারবোনা। মুখচোখ কালো করে বসে রইলাম। মারোলা এসে বললো, ‘হানি? মন খারাপ?’
‘ হুম।’
মারোলা উদ্ধিগ্ন হয়ে বললো, ‘কি হয়েছে?’
‘ মারো! নিঝুম ফোন করেছিলো।’
মারোলা নিঝুমের সব ঘটনা জানে, এটাও জানে ওর জন্যই আমি পালিয়ে এসেছি। ভয়ার্ত গলায় বললো, ‘ কেন ফোন করেছে?’
‘ নিঝুম সব গুন্ডামী ছেড়ে নাকি ভালো হয়ে গিয়েছে।’
মারোলা বললো, ‘ ওয়াও, গ্রেট!’
‘ মারো!’
‘ হোয়াট?’
‘ নিঝুম এখানে আসছে!’
মারোলা অবাক হয়ে কিছুক্ষণ ‘থ’ মেরে বসে রইলো। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, ‘রিয়েলি?’
‘ হুম। আমার জন্য আসছে, কিন্তু আমি ওকে চাইনা মারো।’
‘ তুমি ওকে ভালোবাসোনা?’
‘ না মারো। কখনো পারবোনা।’
ছিঁচকাদুনের মতো কাঁদতে লাগলাম মারোলাকে জড়িয়ে ধরে। ও মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। জিজ্ঞেস করলো, ‘কেন? অন্য কাউকে লাভ করো?’
আমি মাথা নাড়িয়ে ‘হুম’ বলতেই ওর চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে গেলো। আমার মাথা উঠিয়ে বললো, ‘আই কান্ট বিলিভ। কে সে?’
‘ তোমরা তাকে চেনো।’
‘ প্লিজ বলো।’
‘ গেস করো।’
মারোলা কিছুক্ষণ ভাবলো। কিন্তু ভাবতে পারলোনা কে সে। মুখটা পানসে করে বললো, ‘ আমাদের মাঝের কেউ?’
‘ হুম।’
‘ নাম কি?’
‘ বলতে পারবোনা কোনোদিন। যদি ভাগ্যে থাকে তাহলে ঠিক জানতে পারবে। শুধু আমিই তাকে পছন্দ করি, সে নয়।’
‘ দুঃখজনক। তাহলে নিঝুমম্মের কি হবে?’
‘ জানিনা, সে উচ্ছন্নে যাক। আমি তাকে মানবোনা।’
মারোলা হেসে বললো, ‘ দেখা যাক। আমিই পটিয়ে ফেলবো হানি। তোমার পিছু আর নেবেনা।’
মারোলার কথা শুনে হেসে দিলাম। ও বললো, ‘ আমার আবার মাফিয়াদের খুব পছন্দ। বাট ওয়াইফকে টর্চার না করলেই হয় আর খুব খুব ভালোবাসলেই হবে!’
আমি বললাম, ‘ ভালো তো! ওই নিঝুইম্মা আজ থেকে তোমার, ওকে?’
মারোলা বললো, ‘ টেনশান নিও না হানি। যার ভালোবাসা কখনো ফুরোয় না, ক্লান্তি আসে না, তাঁকেই আমাদের ভালোবাসা উচিৎ। জীবনে অনেকেই আসবে। আবার, প্রয়োজন ফুরালে ছেড়ে চলে যাবে। হতাশ না হয়ে তাদেরকে চলে যেতে দাও। শুধু রিয়েল লাভটাকে আঁকড়ে রাখো।’
৩৬.
বিকেলের দিকে কাজে গেলাম হেঁটে হেঁটে।
আমার পার্পেল রঙের জামাটা চকচক করছে। বিকেলের সোনা রঙা রোদ্দুর গাছগাছালির উপর আলো ফেলছে। দূর পাহাড়ের চূড়ার দিকটা কেমন সোনালী হয়ে আছে। বন্য বাতাস নিয়ে আসছে ফুলগন্ধি হাওয়া,দুপুরের রোদে সবকিছু লাগছে কেমন উদাস উদাস। লাইব্রেরিতে ঢুকতে যাবো তখনই কোথা থেকে ক্লেভের হামলা। এসে বললো, ‘ হেই চিট…. এখানে কি করছো?’
আমি না তাকিয়েই বললাম, ‘কাজ করতে এসেছি!’
ক্লেভ ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘ এখানে কিসের কাজ?’
‘ সহকারী লাইব্রেরিয়ান। আই মিন এখানে বইটই গুছিয়ে রাখা, হিসাব রাখা এগুলো করি। কিছু ডলার উঠে এখান থেকে, হাত খরচের টাকাটা হয়ে যায়!’
ক্লেভ মুখটা কালো করে বললো, ‘এতো কষ্টের কাজ কেন করো? আমি তোমাকে এসব করতে দেবোনা।’
‘ সিরিয়াসলি? এটা কষ্টের কাজ নয়। আর কাজটা আমার ভালো লাগে, তাই করি। আর তুমি আমাকে কাজ করতে দিবেনা কেন?’
‘ তোমাকে এসব করতে দেখলে আমার খারাপ লাগবে।’
‘ তাহলে দেখোনা। চোখ বন্ধ করে থাকো।’
‘ এরকম করার কোনো মানে হয়? তোমাকে আমি ডলার দিবো, তাও এটা ছাড়ো।’
আমি রেগে বললাম, ‘তোমার ডলার আমি নেবো কেন? আমি তোমার কে হই?’
ক্লেভ বললো, ‘ তুমি আমার ল..!’
থেমে গেলো। আমি বললাম, ‘তুমি যাও তো ক্লেভ।’
‘ স্যরি।’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কিসের স্যরি?’
‘ সেদিন রেস্তোরাঁতে ডোনা তোমার সাথে মিসবিহেভ করেছিলো, সেজন্য।’
‘ এটাই বলতে এসেছো?’
‘ হুম। বাট এই কাজটা ছাড়ো, ধুলোবালিতে থাকলে তোমার হাঁচি-কাশি হবে।’
ততক্ষণে আমরা লাইব্রেরিতে ঢুকে গিয়েছি। আমি ক্লেভকে বোঝাচ্ছি আমার এই কাজটা দরকার। কিন্তু এই উগান্ডার অধিবাসী বুঝতেই চাইছেনা। ওর এক কথা, আমার হাঁচি-কাশি হবে। আমাদের দুজনকে এভাবে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখে সিনিয়র লাইব্রেরিয়ান হ্যাবলা চেহারার আর্থার ক্লেভকে জিজ্ঞেস করলো,’ ও কি তোমার গার্লফ্রেন্ড?
আমি চোখ বড়বড় করে তাকালাম ক্লেভের দিকে। ক্লেভ তাড়াতাড়ি বললো, ‘না না।’
‘ তাহলে তোমরা একসাথে কেন?’
‘ আমরা দুজন বন্ধু।’
‘ বাট তোমার সাথে চিতলা’কে অনেক মানিয়েছে ক্লেভ।’
ক্লেভ আর কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে চলে আসলো আমাকে নিয়ে। আমি বললাম, ‘আর্থার এসব বললো কেন?’
ক্লেভ অসহায় চোখে তাকালো। ‘ আমি জানিনা চিট!’
‘ সব জানো। তুমি ইচ্ছে করেই এমনভাবে আমার সাথে ভেতরে এলে যাতে করে আমাকে তোমার গার্লফ্রেন্ড মনে হয়। সব বুঝি আমি।’
‘ বেশি বোঝো, তাইনা?’
‘ অভিয়েসলি!’
‘ এসবই বুঝবে। উল্টোপাল্টা কথা বুঝো আর আমাকে বুঝোনা।’
আমি সরু চোখে ওর দিকে তাকালাম। ‘ মানে? আমি কি বুঝিনা?’
ক্লেভ ঢোক গিললো। কাতলা মাছের মতো মুখটা করে বললো, ‘ কিছুনা।’
‘ তুমি কি যাবে এখান থেকে? আমার অনেক কাজ আছে যা তোমার কারণে হচ্ছেনা। তুমি প্রতিনিয়ত আমাকে ডিস্টার্ব করছো।’
‘ আরেকটু থাকিনা।’
‘ আর এক মুহূর্তও না। যাও এখান থেকে, এটা আমার কাজের জায়গা।’
ক্লেভ মনমরা গলায় বললো, ‘ওকে ওকে স্যরি। এতো রেগে যাচ্ছো কেন?’
‘ গো টু হেল।’
‘ ওকে।’
ক্লেভ চলে গেলো। এই ছেলের কাছ থেকে আমি যত দূরে থাকতে চাই সে ততোই আমার কাছে আসবে। আরও মায়ায় জড়িয়ে যাবে। সে কি বুঝবেনা আমাকে কখনো? শুধু কি ডোনাকেই ভালোবাসবে? আমাকে নয়? হিংসে হচ্ছে।
চলবে….ইনশাআল্লাহ! ভুল ত্রুটি মাফ করবেন।