ভিনদেশি তারা পর্ব-১৫

0
2481

#ভিনদেশি_তারা
#পর্ব-১৫
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া

৪৩.
আমরা সবাই ঘুরে তাকিয়ে দেখি নিঝুম। গায়ে শীতের পোশাক। রাগে চেহারা দপদপ করছে। মনে হচ্ছে উল্কাবর্ষণ নেমেছে ওনার চেহারায়। অতিরিক্ত রাগে বেচারা ইংরেজি ভুলে বাংলায় গালাগাল দিতে লাগলো। মারোলা তার ক্রাশবয়কে দেখে ‘হা’ করে তাকিয়ে আছে। কিভাবে যে ‘হা’ করে থাকে আমি ভেবে কুল পাইনা। ক্লেভ বোকার মতো মাথা চুলকে নিঝুমের কথা বোঝার চেষ্টা করছে। কিন্তু কিছু না বুঝতে পেরে আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। মারোলা আর আমার চোখাচোখি হতেই নিজেকে সামলে নিলাম। এদিকে নিঝুম বড়বড় পা ফেলে ক্লেভের কাছে এসে ওর কলার চেপে ধরলো।

আকস্মিক আক্রমণে ক্লেভ কিছুই বুঝতে পারলো না। তার উপর ও নিঝুমকে চেনেনা, বাংলা ভাষাও জানেনা। নিঝুম অশ্রাব্য ভাষায় বললো, ‘তোর সাহস কম না, তুই চিত্রার পিছু লেগে থাকিস।’

ক্লেভ ভ্রু কুঁচকে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলো, ‘হোয়াট আ’র ইউ সেইং?’

নিঝুম বললো, ‘বুঝস না হারামজাদা? মেয়ে দেখলেই তোদের মাথা ঠিক থাকেনা, তাইনা?’

ক্লেভ আমার দিকে তাকালো। অসহায় গলায় বললো, ‘আই ডু নট আন্ডারস্ট্যান্ড হোয়াট দ্যা ম্যান সেইং চিট!’

নিঝুম ক্লেভকে ধাক্কা মেরে টেবিলের উপর ফেলে দিলো। ফলস্বরূপ গরম কফিটা ক্লেভের হাতে পড়ে গেলো। মারোলা ক্লেভকে ধরে উঠালো। কাউন্টার থেকে দৌড়ে বরফ নিয়ে এলাম আমি। মারোলা ক্লেভের হাত ঠান্ডা পানিতে ডুবিয়ে দিলো। জায়গাটা লাল হয়ে গিয়েছে। ক্লেভ বললো, ‘লোকটা কি পাগল? এরকম করছে কেন?’

আমি ওকে শান্ত হতে বলে নিঝুমের দিকে এগিয়ে গেলাম। রাগে ফুঁসছে নিঝুম। রাগী গলায় বললাম, ‘আপনি ওকে মারলেন কেন?’

‘ একশোবার মারবো।’

‘ সেই সাহস আপনাকে কে দিয়েছে?’

‘ আমার কারো পার্মিশনের প্রয়োজন নেই।’

‘ কিন্তু আপনার কাউকে মারার অধিকারও নেই।’

‘ আমি এসবের তোয়াক্কা করিনা। গট ইট?’

‘ করবেন কেন? কুকুর কুকুরই থাকে, কুকুর কখনো মানুষ হতে পারেনা।’

‘ বেশি বলছো তুমি!’

‘ আপনার চেহারাটাই মানুষের মতো, ভেতরটা কুকুরের স্বভাব থেকেও জঘন্য। অবশ্য কুকুর কখনো বেইমানি করেনা।’

নিঝুম ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘বেইমানি? মানে?’

আমি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললাম, ‘আপনি না ভালো হয়ে গেছেন, এই তার নমুনা? এসব মিথ্যা কথা বলে আপনি মানুষের সাথে বেইমানি করেননি? চোখের সামনেই আপনার আসল রুপ দেখতে পাচ্ছি।’

‘ তুমিই বারবার আমাকে রাগিয়ে দিচ্ছো। আসার পর থেকে এই ছেলেকে আমি তোমাদের সাথে দেখতে পাচ্ছি। এতোটা হেসে তো আমার সাথে কখনো কথা বলোনি।’

‘ ভালো লোকের সাথে ভালো ব্যবহার। কথায় আছে, খারাপের সাথে খারাপই হয়; ভালোর সাথে ভালো। আপনি এমন কোনো মহান কাজ করেননি যার জন্য আপনার সাথে হেসে কথা বলবো। ভালো সাজার নাটকটাও টিকিয়ে রাখতে পারলেন না, হাস্যকর!’

নিঝুম বললো, ‘আমি সত্যিই ভালো হয়ে গেছি।’

‘ তার নমুনা এই? ভালো মানুষ কখনো অন্যকে আঘাত করতে পারেনা। আর আপনি যদি আমাকে সত্যিই ভালোবেসে থাকেন; যদি পেতে চাইতেন তাহলে আমার জন্য অপেক্ষা করতেন। আপনার ভালোবাসার উপর বিশ্বাস রাখতেন। কিন্তু তা তো না, শুধু শুধু একজনের উপর চড়াও হয়ে আসল চেহারা দেখিয়ে দিলেন!’

‘ তুমি কিন্তু এবার আমার সাথে বেইমানি করছো।’

‘ আমি? আপনার সাথে? কেমন বেইমানি?’

‘ তোমার জন্য সব ছেড়েছুড়ে এলাম আর তুমিই এখন আমাকে কথা শোনাচ্ছো?’

‘ গুন্ডামী ছেড়ে ভালো হয়েছেন ঠিক আছে। কিন্তু আমিতো প্রথমেই আপনাকে বলে দিয়েছি আপনাকে আমি ভালোবাসি না, আপনার প্রতি আমার কোনো অনুভূতি নেই,কখনো আপনাকে বিয়ে করবোনা। আর না আপনার সাথে আমার এমন সম্পর্ক আছে, না আপনাকে আমি আশা দিয়ে রেখেছি। আপনি স্বেচ্ছায় আমার পিছু ঘুরছেন আর আমাকেই বেইমান বলছেন। হাস্যকর!’

‘ চিত্রা…?’

‘ ডোন্ট টক মাই নেইম ইন ইউর মাউথ। লেট মি বি লাইক মাইসেলফ!’

‘ আমি সারাক্ষণ তোমার জন্য উতলা হয়ে আছি আর তুমি এই প্রতিদান দিচ্ছো?’

‘ আমি কি বলেছি স্পাইগিরি করতে? অন্য কোথাও এসব আদিখ্যেতা দেখান। বিরক্তিকর!’

৪৪.
আমার কাছ থেকে এসব শুনে নিঝুম প্রচন্ড রেগে গেলো। মারোলা আর ক্লেভ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলো। দুজনের কেউই বুঝতে পারছেনা আমাদের কথোপকথন, বোকার মতো তাকিয়েই আছে। রাগের মাথায় নিঝুম আমাকে ধাক্কা মারলো, আমি টাল সামলাতে না পেরে টেবিলে বারি খেয়ে পড়ে গেলাম। টেবিলটা ছিলো কাচের, ফলে কাচ ভেঙে আমার হাত কেটে গেলো এবং ভাঙা জায়গায় মাথা লাগায় খানিকটা ফেটেও গেলো। আমি চিৎকার করে উঠলাম। রক্ত চুইয়ে চুইয়ে পড়তে লাগলো। নিঝুম তো ধরলোই না উপরন্তু বললো, ‘আমি নিজের জিনিস না পেলে কেড়ে নিতে জানি।’

ক্লেভ আর মারোলা দৌড়ে এসে আমাকে ধরলো। আমি ঘৃণায় নিঝুমের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। মারোলা টিস্যু দিয়ে কাটা জায়গার রক্ত মুছতে লাগলো। অন্যপাশে যে দুটো ছেলেমেয়ে বসেছিলো তারা ভয়ে বাইরে চলে গেলো। কফিশপের মালিক জিনা ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে এলো। ক্লেভ ড্রেসিং করে দিলো। তারপর প্রচন্ড রেগে জিজ্ঞেস করলো, ‘হু ইজ হি চিট?’

আমি চুপ করে চোখের পানি ফেলছি। নিঝুম ক্লেভকে বললো, ‘ তোকে বলবে কেন? কে তুই হারামজাদা?’

ক্লেভ উঠলো। রাগে ওর মুখ থমথম করছে। হারামজাদা যে একটা গালি ক্লেভ এটা এতক্ষণে বুঝে গেলো। নিঝুমকে বললো, ‘ হু আর ইউ হা.রাল..জাদা?’

কান্নার মাঝেও আমি একটু হেসে দিলাম। নিঝুম বোকার মতো তাকিয়ে আছে। এদিকে পেট ফেটে আমার হাসি আসছে। বেচারা ক্লেভ রাগের মাথায় হারামজাদা শব্দটার রফাদফা করে দিলো। ক্লেভ এদিকে পাত্তা না দিয়ে নিঝুমকে বললো, ‘Your courage is no less bastard.’

‘ কেন? তুই কি করবি? মারবি আমায়?’

‘ বেশি বাড়াবাড়ি করছো তুমি। ভালোয় ভালোয় চলে যাও, রাগিও না আমায়।’

‘ আমি তোকে রাগাচ্ছিনা, তুই রাগাচ্ছিস আমায়। তুই আমার চিত্রার পেছনে ঘুরে বেড়াস কেন?’

‘ আমি কারো পিছনে ঘুরে বেড়াইনা। চিট আমার ফ্রেন্ড, আমি আমার ফ্রেন্ডের সাথে ঘুরি। তাতে হস্তক্ষেপ করার অধিকার কারো নেই!’

‘ চিত্রা আমাকে ভালোবাসি, তুই ওর থেকে দূরে থাক!’

ক্লেভ শুনে মুখটা কালো করে ফেললো। তারপর বললো, ‘কেউ কারো ভালোবাসার মানুষের সাথে এরকম করতে পারে নাকি? এটাকে ভালোবাসা বলে না, ইট’স কলড মেইডনেস!’

‘ তোর শেখাতে হবেনা’ বলে ক্লেভকে একটা ঘুসি মারলো নিঝুম।

এবার ক্লেভও রাগলো। বললো, ‘এতক্ষণ ভালো করে কথা বলায় তোমার সাহস বেড়ে গেছে তাইনা? বারবার বলেছি আমায় রাগিও না, তাও কথা শুনোনি। এবার ফল ভোগ করো।’

বলেই নিঝুমের মুখে একটা ঘুসি মারলো। নিঝুমও পাল্টা ওর পেটে লাথি দিতে এলে ক্লেভ সরে যায়। আর নিঝুম আছাড় খেয়ে ফ্লোরে পড়ে যায়। উঠে আবার ক্লেভের দিকে এগিয়ে গেলে ক্লেভ ওর মুখে গ্লাসের পানি ছুঁড়ে মারে। তারপর ক্লেভ ওকে ধাক্কা মারে, এতে ও গিয়ে পড়ে কাউন্টারের উপর। নিঝুম ওখান থেকে সরে একটা চেয়ার হাতে তুলে এগিয়ে আসে ক্লেভের দিকে। ভাবলেশহীন চেহারায় ক্লেভ কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকে। যেইনা চেয়ারটা ওর ওপর ফেলতে যাবে তখুনি ক্লেভ নিঝুমের হাত ধরে ফেলে। কেউওই কারো থেকে কম যায়না। আমি আর মারোলা বিদেশের মাটিতে নিখুঁত বাংলা সিনেমার শুটিং দেখছি।

নিঝুমের হাত থেকে চেয়ার নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয় ক্লেভ। তারপর ওর গাল চেপে ধরে বলে, ‘হার..লজাদা! তুই আমাকে মেরেছিস কষ্ট হয়নি একটুও। কিন্তু চিটের গায়ে হাত তুলে বুঝিয়ে দিয়েছিস তুই ওকে ভালোবাসিস না, তুই ওর যোগ্যই নস। আর কোনো যোগ্যতাবিহীন লোককে চিট ডিজার্ভ করে না। সো ইউ গেট আউট ইফ হিয়ার!’

নিঝুম রক্তবর্ণ চোখ করে ক্লেভের দিকে তাকালো। বললো, ‘ ও তো আমারই থাকবে। জাস্ট ওয়েট এন্ড সি!’

‘ ডোন্ট লেট মি সি ইউ এরাউন্ড আস, ডাফার!’

‘ তোকে আমি দেখে নিবো।’

‘ টেক আ’ লুক নাও।’

নিঝুম রাগে ফুঁসছে। ক্লেভ ধাক্কা মেরে ওকে কফিশপ থেকে বের করে দিলো। রেস্তোরাঁর মালিক জিনা বললো, ‘ ওকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া উচিৎ ছিলো।’

ক্লেভ বিরক্ত নিয়ে বললো, ‘ দরকার নেই।’

তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ওই বাস্টার্ডটাকেই কি তুমি পছন্দ করো?’

‘ না। ওনি করে!’

‘ মানে এই মেন্টাল পেশেন্ট তোমাকে পছন্দ করে, তুমি না?’

‘ না ক্লেভ! ওর সাথে আমার বিয়ের কথা হচ্ছিলো। পরে জানতে পারি ওনি একজন মাফিয়া। বিয়ে ভেঙ্গে আমি এখানে চলে আসি। কিন্তু সে এখনো আমার পিছু ছাড়েনি। সব খারাপ কাজ ছেড়ে এখানে এসে পড়েছে আমাকে ফিরিয়ে নিতে। কিন্তু আমি যাবোনা, আমি ওনাকে ভালোবাসিও না!’

‘কি ব্যাপার চিট? তোমাকে দেখেই মানুষ প্রেমে পড়ে যায় কেন? এর রহস্য কি?’

আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললাম, ‘ছাড়ো তো।’

‘ বাই দ্যা ওয়ে! তুমি ঠিক আছোতো?’

‘ আমি ঠিক আছি। তোমার কোথাও লাগেনি তো।’

‘ লেগেছে হয়তো কোথাও, বুঝতে পারছি না।’ আনমনে বললো ক্লেভ!

‘ স্যরি আমি!’

‘ আমাকে রাগিও না চিট। অন্য কারো দোষের জন্য তুমি কেন নিজেকে ছোট করবে? আমি এসব পছন্দ করিনা।’

আমি আর কিছু বললাম না। কোমড়ভাঙা নিঝুম কোথায় গেলো সেটা জানার প্রচুর ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু ওনার কথা ভেবে সময় নষ্ট না করাই শ্রেয়। খারাপ কাজ ছেড়ে দিলেও ভেতরের মানুষটার রাগ আগের মতোই আছে। যেটাই সবচেয়ে ক্ষতিকর।

এদিকে মারোলা’র মন খারাপ। ওর ক্রাশবয় যে এরকম কান্ড ঘটাতে পারে সেটা ওর ধারণার বাইরে। আহা! ওর কতই না শখ ছিলো একটা মাফিয়াকে বিয়ে করবে, সে আশায় গুঁড়ে বালি ঢেলে দিলো নিঝুম। নিঝুমের রাগ দেখেই আপাতত মারোলা ভয়ে কাঁপা-কাঁপি অবস্থা। আগ বাড়িয়ে নিঝুমকে “ভালোবাসি” বলতে গেলে নিজেই ইন্তেকাল করবে। তাছাড়া নিঝুম তো আমাকে পছন্দ করে। জানিনা বেচারি মারোলা’র কপালে কি আছে! দুদিনেই মনে মনে একটা রংমহল তৈরি করে ফেলেছিলো মারোলা। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ওর সেই রংমহল ভেঙে গেছে। যাইহোক, স্নো-ফল হচ্ছে দেখে এতো রাতে ক্লেভ আমাদের বাড়ি নামিয়ে দিয়ে গেলো। গাড়িতে বসে গুনগুন করে গাইলাম।

“কতবারও ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া,তোমারই চরণে দিবো হৃদয় ও খুলিয়া!
চরণে ধরিয়া কহিব প্রকাশি
গোপনে তোমারে সখা কত ভালোবাসি!
ভেবেছিনু… তুমি স্বর্গেরও দেবতা
কেমনে তোমারে কবো প্রণয়েরও কথা!”

৪৫.
সেদিনের পর প্রায় একসপ্তাহ পার হয়ে গিয়েছে। নিঝুমকে একদিনও দেখিনি। ফিরে গেলো নাকি কে জানে? যাইহোক, আজ ভার্সিটি যেতে হবে।ভার্সিটিতে আমার সাবজেক্ট মলিকুলার বায়োলজি। প্রাণ রসায়ণের সবচেয়ে আধুনিক একটি শাখা মলিকুলার বায়োলজি! এ বিষয়ে পড়তে হলে হতে হবে চিন্তাবিদ, কঠোর পরিশ্রমী। পাশাপাশি ঝানু হতে হবে জীববিজ্ঞান, জৈব রসায়ন এবং প্রোগ্রমিংয়ে। চিন্তা করাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কারণ এখানে এমন কিছু করা সম্ভব যা কেউ ভাবতেও পারে না। আজগুবি চিন্তা করতে জানতে হবে। খুব মন দিয়ে প্রফেসর রিচার্ডের ক্লাস করছি। নাকের ডগায় চশমা ঝুলিয়ে রাখাটা ওনার অভ্যাস। কপালে সর্বদাই ভাঁজ থাকে, চুলটুল মিলিয়ে মাঝে মাঝে দেখে মনে হয় ওনি বুঝি আইনস্টাইন। শিক্ষার্থীরা আড়ালে অবশ্য ওনাকে আইনস্টাইনই বলে। গমগমে গলায় ওনি আমাদের পড়াচ্ছেন। কেউ একটু অমনোযোগী হলেই ধমকি দিচ্ছেন। আমার মনে হচ্ছে আমি বুঝি বাংলাদেশের কোনো স্কুলের স্যারের কাছে পড়তে এসেছি। যাইহোক, প্রফেসর রিচার্ড একপর্যায়ে বলতে লাগলেন, ‘যেখানে জীবনকে সংজ্ঞায়িত করা হয় অণু-পরমাণু পর্যায়ে, একে বলা হয় “The Molecular Logic Of Life”। বুঝলে গাইজ?’

সবাই সমস্বরে বললো, ‘ইয়েস প্রফেসর!’

‘ A-T-C-G এই মাত্র চারটি হরফে লেখা এ বিষয়কে বলা হয় Language of GOD. শিওর গাইজ?’

‘ ইয়েস প্রফেসর!’

বারবার ” ইয়েস প্রফেসর” বলায় ওনি খুব রেগে গেলেন। ওনি আসলে খুব অদ্ভুত। কখন হাসেন কখন রাগেন নিজেও বোধহয় বুঝেন না। শেষ সারির দিক থেকে জনসনকে দাঁড় করিয়ে বললেন, ‘ কিছু বলো মলিকুলার বায়োলজি নিয়ে এন্ড সবাই চুপ থাকো!’

জনসন ক্লাসের সবচেয়ে ভালো স্টুডেন্ট। তাঁর কথা বলার ভঙ্গি সর্বদাই হাসিখুশি, প্রাণোচ্ছল। খুব সুন্দর করে সে বলতে লাগলো, ‘মলিকুলার বায়োলজি মূলত ট্রান্সজেনিক উদ্ভিদ ও প্রাণী সৃষ্টিতে কাজ করে। এর একটি শাখা জেনেটিক্স, জীববিজ্ঞানের এ শাখাটিতেই নিজের ইচ্ছামত ডিজাইন করে একটি প্রাণী সৃষ্টি করা যায়, ডিজাইন করা যায় নিজের পছন্দের ই.কোলাই যে কিনা নিজের কথামত উঠবে বসবে। সম্পর্কটা রাজা-প্রজার মতোন বা আপনার আর আমাদের মতো। আই মিন আপনি যেভাবে একক্লাস স্টুডেন্টদের সামলাচ্ছেন, তেমন! তাই না প্রফেসর?’

জনসনের আন্সারে খুশি হলেন প্রফেসর রিচার্ড। খুশিতে গদগদ হয়ে বললেন, ‘ভালো বলেছো। কিন্তু চিন্তা করে দেখ, ব্যাপারটা একজন আবিষ্কারকের জন্য কতটা রোমাঞ্চকর ব্যাপার!’

সবাই সমস্বরে বললো, ‘ইয়েস প্রফেসর।’

‘ তোমরা কি জানো? বর্তমানে একবিংশ শতাব্দীকে নিঃসন্দেহে বলা হচ্ছে The Century of Biological Science. এর কারণ 1972 সালে পল বার্গের রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ টেকনোলজি বা মলিকুলার ডকিং এর আবিষ্কার।’

রবার্ট ফাজলামো করে জিজ্ঞেস করলো, ‘প্রফেসর! আপনি কিন্তু অনেক গবেষণা-আবিষ্কার করলেন। মানে আপনি তো নোবেল পাওয়ার যোগ্য। তাহলে নোবেল কমিটি কেন আপনার মতো সুদক্ষ একজন বিজ্ঞানীকে নোবেল দিচ্ছেনা? এটা কি আপনার ব্যর্থতা নাকি ওদের? আপনার মনে হচ্ছেনা ওরা আপনাকে যোগ্য সম্মানটা দিচ্ছেন না? এ বিষয়ে আপনার অভিব্যক্তি কি?’

প্রশ্ন শুনে প্রফেসর হাসলেন। চেহারায় একটা আলাদা গাম্ভীর্য এনে বলতে লাগলেন, ‘ একজন মলিকুলার বায়োলজিস্ট একাধারে একজন মাইক্রোবায়োলজিস্ট! তাছাড়া নেচার ম্যাগাজিনের কভারের প্রতিদিনিই জায়গা করে নিচ্ছে বাঘা বাঘা দেশগুলোর মলিকুলার বায়োলজিস্টরা। কয়েক বছর আগে চিকিৎসা বিজ্ঞানে যিনি নোবেল পেলেন তিনি একজন মলিকুলার বায়োলজিস্ট। তোমরা জানো? আমি ওনাকে আমার প্রাইজটা গিফট হিসেবে দিয়ে দিয়েছি? নাম হলো ওনার, কিন্তু আসল কৃতিত্ব আমার। আসলে আমি চাইনা কিছু আবিষ্কার করে জনসম্মুখের সামনে আসতে। আমার কাছে গবেষণাটাই আসল, প্রাইজটা নয়। সুতরাং ব্যর্থতা আমার বা নোবেল কমিটি ; কারোর নয়!’

প্রফেসর কিছুক্ষণ নিজের গুণগান গেয়ে চলে গেলেন। ক্লাসে হাসির রোল পড়ে গেলো। কারণ সবাই জানে প্রফেসরের মাথায় কতোটা ঘাপলা আছে। নিজেকে নিয়ে তাঁর আকাশচুম্বী ভাবনা। যাইহোক, ক্লাস শেষে আমরা বেরিয়ে এলাম। কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে মারোলা বাড়ি চলে এলো আর আমি লাইব্রেরিতে কাজ করতে। সেখানে কর্মরত অবস্থায় হুট করে কে যেন আমার কোমড় জড়িয়ে ধরলো। আমি ভয় পেয়ে তাকিয়ে দেখি নিঝুম! আমি আশ্চর্য তাঁর সাহস দেখে। এদিকটায় কেউ নেই, কিন্তু ওপাশে সবাই বই পড়ছে। আমি রেগে বললাম, ‘কি হচ্ছেটা কি? ছাড়ুন আমায়।’

‘ ছাড়ার জন্য ধরিনি। নিয়ে যেতে এসেছি!’

‘ ক কোথায় নিয়ে যাবেন আপনি আমায়? আমি কোথাও যাবোনা।’

‘ তোমার মতামত কে জানতে চেয়েছে?’

‘ কালকের পরেও আপনার শিক্ষা হয়নি, তাইনা?’

‘ খুব ভালো লেগেছিলো, তাইনা? যখন ওই সাদা চামড়ার ক্লেভ আমায় পিটিয়েছিলো?’

‘ শুধু শুধু ক্লেভ কাউকে হার্ট করে না। আপনি ভুল করেছেন তাই ও রুড বিহেভ করেছে। তাছাড়া শুরুটা আপনিই করেছিলেন।’

‘ তোর কি লাগে ওই ছেলে? তোর কিছু লাগে? এত গা জ্বলে কেন ওই ছেলেকে মারলে, বকলে?’

‘ ও আমার বন্ধু!’

‘ বন্ধুর জন্য এতো পিরিতি? বাহ! তা আর কি কি করলো তোর ওই বন্ধু?’

আমি ঘৃণায় দৃষ্টি নামিয়ে নিলাম। ‘সবাইকে আপনার মতো সস্তা ভাববেন না। ক্লেভের সাথে আপনার তুলনা কখনো করবেন না।’

‘ একশোবার করবো। তোর ওই বন্ধুর কি হাল করি দেখিস।’

‘ মানে?’

নিঝুম শয়তানী হাসি দিয়ে বিশ্রিভাবে হেসে বললো, ‘ওয়েট এন্ড সি!’

এমন সময় আর্থার নিঝুমকে অসভ্যতামি করতে দেখে ফেললেন। চিৎকার করে গার্ডদের ডেকে আনলেন এবং নিঝুমকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলেন। আমার মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। শূন্য মস্তিষ্কে ভাবনা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি। স্যার আর্থার পানির বোতল এগিয়ে দিলে আমি ঢকঢক করে পুরো বোতলের পানি গিলে নিলাম।

চলবে…ইনশাআল্লাহ! ভুল ত্রুটি মাফ করবেন।
আপনাদের মতামত আশা করছি! তথ্যসূত্র কালেক্টেড!