ভিনদেশি তারা পর্ব-২৬

0
1735

#ভিনদেশি_তারা
#পর্ব-২৬
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া

৭৯.
আমি চোখ পাকিয়ে তাকালাম। আমাকে আরশোলা বানিয়ে দিলো? আবার দাঁত বের করে কেমন হাসছে দেখো! গরম কফিতে চুমুক দিতে লাগলো। নিঝুম একপাশে বসেছে, বাড়ির মুরুব্বিদের সাথে নাস্তা করছে। খাওয়ার মাঝখানে হঠাৎ দূর্লভ বড় চাচ্চুকে বললো, ‘জানো! দা-ভাইকে ককরোচ কামড় দিয়েছে।’

‘ তাই নাকি?’

‘ হুম। দেখো ঠোঁটে দাগ পড়ে গেছে।’

চাচ্চু বিচলিত হয়ে বলল, ‘ কই দেখিতো।’

ক্লেভ মুখ ঘুরিয়ে দেখালো। একটা হাসি দিয়ে বললো, ‘টেমন কিছু না। ককরোচটা বড় ছিলো, তাই এমন।’

চাচ্চু কিছু বললেন না। বোধহয় বুঝে গেছেন। ছিঃ! মুখ দেখানোর উপায় রইলোনা। সরাসরি না বললেও ওর কান্ডকীর্তি দেখে একটা বাচ্চাও বুঝতে পারবে কী হয়েছে।

আব্বু বললো, ‘ খাবার পছন্দ হয়েছে তো বাবাজি?’

‘ অফকোর্স। ভেরি টেস্টি, আই মিন হালুয়াটা।’

‘ খাও খাও। না খেয়ে শরীরের কী অবস্থা করেছো।’

‘ অ্যামি ফিট আছি আব্বাজান।’

আব্বু বিগলিত গলায় বললো, ‘বেশ বেশ। কত ভালো ছেলে দেখেছো। ভালোবেসে আব্বাজান বলে ডাকছে।’

দাদু বললো, ‘দেখতে হবেনা কার নাতজামাই?’

‘ হুম।’

ক্লেভ বললো, ‘চাচাজান!’

চাচ্চু অবাক হয়ে বললো, ‘আমাকে বলছো বাবা?’

‘ জি চাচাজান।’

‘ বাহ। কী ভালো দেখো তো। চাচাজান বলে ডাকছে, মনটা জুড়িয়ে গেলো।’

‘ চাচাজান অ্যাপনি দেখতে কিন্তু স্মার্ট।’

চাচ্চু লজ্জ্বা পেয়ে বললো, ‘তাই নাকি?’

‘ হুম।’

‘ তুমিও খুব সুন্দর, স্মার্ট।’

‘ অ্যামার মনে হয় নিজ্ঝুম ও কুব স্মার্ট।’

নিঝুম স্যান্ডউইচ রেখে তাকালো। হেসে বললো, ‘তাই নাকি? মজা পেলাম।’

‘ অভিয়েসলি।’

‘ তুমিও।’

‘ টোমার বাচ্চা কোথায়?’

‘ মায়ের কাছে হবে!’

‘ মারো কী ব্রেকফাস্ট করেনি?’

‘ করেছে। জেনিফার নাশতা নিয়ে গিয়েছে।’

‘ ওখে।’

‘ তো আহনাফবাবু কবে ফিরছেন?’

‘ শিওর নই। চিট জানাবে, ওর টো অফিস আছে।’

‘ আমরা কিন্তু গতসপ্তাহ রওয়ানা দেবো।’

‘ সব্বাই?’

‘ হুম।’

‘ ওখে। গ্র‍্যানিকে নিয়ে যেও।’

‘ ঠিক আছে।’

আব্বু ছলছল চোখে তাকালো। বললো, ‘এতো তাড়াতাড়ি চলে যাবে?’

নিঝুম আলগা হাসলো। বললো, ‘জি আঙ্কেল। আপনাদের সাথে অনেক বাজে বিহেভ করেছিলাম। আই এক্সট্রেমলি স্যরি।’

‘ ক্ষমা চাওয়ার দরকার নেই। নিজের ভুল বুঝতে পেরেছো এটাই বেশি। তুমিও তো সবার জন্য কত করলে। আমার ছেলেই তুমি।’

‘ ধন্যবাদ আঙ্কেল।’

৮০.
খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষ করে ঘরে এসে বসলাম। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। ক্লেভের দাদী ওনি ঘুমাচ্ছেন এ ঘরে। মহিলা ভিড়ভাট্টা সহ্য করতে পারেন না। আমি ঘরটা গুছিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসে আছি। একটু পর মিশু আপু এলো। বলল, ‘কি রে চিত্রানি! কী করস?’

‘ কিছুনা।’

‘ সারারাত আদর খাইছো এখন তো আর কাজ নেই, তাইনা।’

‘ আপ্পু।’

‘ কী?’

‘ কীসব বলো?’

‘ চোখ পাকায়া তাকাস কেন?’

‘ উল্টাপাল্টা কিছু বলবা না।’

‘ কইলে কী প্রবলেম?’

‘ আহ, চুপ করো।’

‘ ওকে!’

‘ কিছু বলতে এসেছো?’

‘ হুম।’

‘ কী?’

মিশু আপু হাত বাড়িয়ে দিলো আমার সামনে। বুঝতে পারলাম টাকা চাচ্ছে। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘টাকা নাই।’

‘ তোর কাছে কে চেয়েছে? চাইসি তোর বরের কাছে!’

‘ তো ওর কাছে যা!’

‘ তুই নিয়ে যা।’

‘ পারবোনা।’

‘ ওকে আমিই যাচ্ছি।’

বলেই চলে গেলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার এলো। ততক্ষণে ক্লেভের দাদীর ঘুম ভেঙে গেছে এবং ওনি আম্মুর ঘরে আড্ডায় বসেছেন। মিশু আপু বললো, ‘ তোর জামাইরে খুঁজেই পাইনা। কই সে?’

‘ জানিনা।’

এমন সময় কাঁধে দূর্জয়কে নিয়ে ঘরে ঢুকলো ক্লেভ। বাঁদরের মতো গলায় ঝুলে আছে। মিশু আপুকে দেখে হেসে বললো, ‘হাই মিসু আপা।’

‘ হাই ভাইয়া।’

‘ একানে কী করো?’
‘ আপনার সাথে কথা ছিলো।’

‘ কীসের কতা?’

‘ বিয়ে করেছেন, শালিদের টাকা দিতে হয় জানেন না?’

মিশু আপু যেন খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছে এমন একটা ভাব করে ক্লেভ বললো, ‘ইয়েস ইয়েস। অ্যামার মনে আছে। ট্যাকা আছে অ্যামার ওয়ালেটে।’

‘ তাহলে দিন!’

ক্লেভ দূর্লভকে ঘাড় থেকে নামিয়ে ওয়ালেট বের করলো। নতুন কচকচে এক হাজার টাকার দশটা নোট বের করে মিশু আপুর হাতে দিলো। আমি হতভম্ব। মিশু আপু পারেনা ওর সামনে আকাশে উড়াল দিতে। সব টাকা ও একাই আত্মসাৎ করবে এমন একটা ইশারাও করলো। ক্লেভ জিজ্ঞেস করলো, ‘আরো লাগবে মিসু আপা? কম হয়েছে? অ্যামি দিচ্চি।’

মিশু আপু বললো, ‘নাহ,লাগবেনা।’

টাকা নিয়ে মনের আনন্দে চলে গেলো। আমি বললাম, ‘টাকা কে দিলো তোমাকে?’

‘ ডাডু!’

‘ দাদু টাকা কই পেলো?’

‘ ব্যাংক থেকে এক্সচেঞ্জ করে এনেছে। অ্যামার টাকাই।’

৮১.
বিকেলবেলা বাইরে বেরুলাম। ঘন্টু মিয়া বাসার সামনে ঝালমুড়ি বিক্রি করছে। ক্লেভ আমাকে কিনে দিলো। ঘন্টু মিয়ার সাথে ওর ছোটখাটো বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছে, ঘন্টু মিয়া টাকা নিতে চাইলো না। ক্লেভ জোর করে পকেটে টাকা ঢুকিয়ে দিলো। পাশের বাসার আন্টিরা বারান্দা দিয়ে হা করে তাকিয়ে রইলো। উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখছে। কয়েকজনকে দেখে মনে হলো ক্লেভের সাথে আমাকে দেখে হিংসায় জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে। আমি তাড়াতাড়ি ওকে নিয়ে বাড়ি চলে আসলাম।

জানালা দিয়ে বয়ে আসছে বর্ষার উত্তাল বাতাস।জোৎস্না ছড়িয়ে পড়ছিলো অন্ধকার ঘরের বিছানায়, আমি অন্ধকারে বসে বাইরে তাকিয়ে ছিলাম।প্রকৃতির এই রুপ দেখে শুধু একটা কথাই মনে হচ্ছে
“আজ জোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে
বসন্তের এই মাতাল সমীরণে!”

ক্লেভ এতোক্ষণ সবার সাথে গল্প করছিলো। ঘরে এসে আমাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,

‘ টোমি সেসময় অ্যামাকে নিয়ে এলে কেন?’

‘ তোমাকে সবাই চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছিলো।’

‘ হোয়াটটট?’

‘ আই মিন তোমার দিকে সবাই হা করে তাকিয়ে ছিলো।’

ও দুষ্টুমি করে বললো, ‘সো হোয়াট?’

আমি রেগে বললাম, ‘তাকাবে কেন তোমার দিকে? তুমি শুধু আমার হাজব্যান্ড, আমি শুধু তোমার দিকে তাকাবো। আর কেউনা।’

‘ টাই নাকি?’

‘ হুম।’

‘ টোমি অ্যামায় অনেক বালোবাসো, টাই না।’

‘ হুম।’

‘ অ্যামি যদি মরে যাই, টাহলেও এমন বালোবাসবে?’

আমি ওর মুখ চেপে ধরলাম। কান্না এসে গেলো আমায়। ওকে জড়িয়ে ধরে কান্নাভেজা গলায় বললাম, ‘এগুলো বলবেনা প্লিজ। তোমাকে ছাড়া আমি কীভাবে থাকবো? এসব বলবেনা!’

‘ ওখে! টার বদলে অ্যামার গিফট চাই!’

আমি ওর বুকে মুখ লুকিয়ে আছি৷ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললাম, ‘কী গিফট?’

‘ অ্যামার প্রিন্সেস চাই। একদম সিনডারেলা টাইপ!’

আমি লজ্জ্বা পেয়ে বললাম, ‘তুমি কাল রাত থেকে এই কথাটা কয়বার বলেছো হিসেব আছে?’

‘ ন্যাহ। আরও হাজারবার বলটে চাই অ্যামার একটা ছোট্ট একটা প্রিন্সেস চাই। লিপ’টা হবে টোমার মতো, চোখগুলো হবে অ্যামার মতো। বলো দিবে কিনা?’

‘ আমি কী জানি? এমন গিফট তো আল্লাহতায়ালা দিবে!’

‘ অ্যামি তো গডের কাছে নামাজ পড়ে এটাই প্রে করেছি।’

‘ এই টপিক বাদ দাও।’

‘ লজ্জ্বা পাচ্ছো। হা হা!’

‘ হাসবেনা একদম।’

‘ হাসবো।’

ক্লেভ হু হা করে হাসতে লাগলো। তারপর থেমে বললো, ‘চিট..! টোমি এমন একটা ককরোচ যাকে সারাদিন বুকের মধ্যে আগলে রাখতে ইচ্চা করে।’

চলবে….ইনশাআল্লাহ! ভুল ত্রুটি মাফ করবেন।