#ভিনদেশি_তারা
#পর্ব-২৭
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
৮২.
এক সপ্তাহ অনেক হাসি-আনন্দে কাটানো হলো। মারোলা’র ছেলেকে নিয়ে রীতিমতো হইচই। সে বেচারা এই বয়সেই বুঝিয়ে দিচ্ছে বড় হয়ে কেমন হবে। সেদিন ক্লেভের কোলে আসতেই বড় একটা হাসি দিলো, কিউট হাসি। সেই হাসি দেখে রাতের বেলা ক্লেভ আমাকে বললো, ‘চিট! ওর হাসি দেখেছো? কত কিউট!’
‘ হুম দেখেছি। তোমার মতো পাগল দেখে ওর হাসি এসে গেছে।’
ক্লেভ আমার কোমড় জড়িয়ে ধরে বললো, ‘তো শুনি, আমি কী পাগলামো করলাম।’
‘ যে ছেলে সব ত্যাগ করে আমার জন্য এতদূর থেকে ছুটে আসতে পারে, সে অবশ্যই পাগলের কাতারে পরে।’
‘ আমার চিট কী জানেনা আমি ওর জন্য সব করতে পারি।’
আমি হেসে বললাম, ‘চিট জানেনা।’
‘ চিটের জানা উচিৎ ওর বর ওকে কত লাভ করে।’
‘ কতোটা ভালোবাসে?’
‘ একটা আকাশে যত তারা আছে, ততটাই ভালোবাসে।’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘তারার সাথে তুলনা কেন?’
‘ বিকজ তারা যেমন গুনে শেষ করা যায়না, আমার ভালোবাসাও কেউ পরিমাপ করে বের করতে পারবেনা।’
‘ ওহহ!’
‘ আচ্ছা চিট, তোমার নামের মিনিং কী?’
‘ চিত্রা একটা নক্ষত্রের নাম।’
‘ ওয়াও! রিয়েলি?’
‘ হুম।’
‘ চিট!’
‘ বলো।’
‘ আমরা ভার্জিনিয়াতে ফিরে গেলে তোমার কী সবাইকে ছেড়ে থাকতে কষ্ট হবে?’
‘ একটু তো হবেই।’
‘ ট্যাহলে অ্যামরা ব্যাঙলাদেসে থেকে যাই?’
আমি বললাম, ‘ন্যাহ!’
‘ হোয়াটট?’
‘ কারণ মেয়েরা তাঁর নিজের বাড়ি, আই মিন বরেরবাড়ি থাকে। আর আমার বরের বাড়ি যেহেতু আটলান্টিকের ওপারে, তাই আমি ওখানেই থাকবো।’
‘ বাট টোমি চ্যাকরি করো এখানে !’
‘ ছেড়ে দেবো। লেটার অফিসে জমা দিয়েছি।’
‘ টোমার কশশট হবে ন্যাহ?’
‘ না। কারণ তুমিও আমার জন্য অনেক ত্যাগ করেছ, আর আমি তোমার জন্য চাকরি ছাড়তে পারবোনা?’
‘ টোমিও কী আমাকে অনেক বালোবাসো?’
‘ কোনো সন্দেহ আছে?’
‘ নো।’
‘ তাহলে চুপচাপ গিয়ে ঘুমাও। কাল মারোলারা চলে যাবে।’
‘ হুম।’
‘ ঘুমাও।’
‘ ঘুমাব না।’
‘ কেন?’
‘ টোমি অ্যামাকে আডর দ্যাও গালে।’
‘ আর খাইয়া কাজ নাই!’
‘ প্লিজ চিট বেবি।’
‘ এই এসব কী বলো? আমি কী দু বছরের বাচ্চা নাকি?’
‘ অভয়েসলি বেবি।’
‘ একদম বেবি বলবেনা।’
‘ ট্যাহলে গালে কিসি দ্যাও।’
‘ দেবোনা!’
‘ টুমি না একটা…!’
আমি চোখ পাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমি কী?’
‘ টোমি একটা ব্লা ব্লা ব্লা।’
বলেই আমার কপালে চুমু খেয়ে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লো। আমি হাসলাম। পাগল নাকি লোকটা! ওর বুকে মাথা রাখলেই অদ্ভুত শান্তি পাই। জানালা দিয়ে আকাশ আর জ্বলজ্বল করতে থাকা তারাদের দেখতে লাগলাম। আমার মনের চিলেকোঠায় জমে থাকা এক আকাশ সমান লুকানো গল্পগুলো কী কখনো ওকে বলতে পারবো? ওর মতো কখনো অতোটা ভালোবাসতে পারবো! ওর ভালোবাসার মর্যাদা দেওয়ার ক্ষমতা কী আমার আছে? ভালোবাসার শক্তিই সবচেয়ে বেশি। ভাবতে ভাবতে অতঃপর পাড়ি জমালাম ঘুমন্তপুরীতে, এক স্বপ্নের দেশে।
‘আমার ভিনদেশি তারা
একা রাতেরই আকাশে
তুমি বাজালে একতারা
আমার চিলেকোঠার পাশে।
ঠিক সন্ধ্যে নামার মুখে
তোমার নাম ধরে কেও ডাকে,
মুখ লুকিয়ে কার বুকে
তোমার গল্প বলো কাকে?’
__সংগৃহীত
৮৩.
পরদিন সকালে উঠে নামাজ পড়ে ছাদে গিয়ে হাওয়া খেয়ে এলাম। বিশুদ্ধ বাতাসে মনটাও পবিত্রতায় ছেয়ে যায়। ক্লেভ ঘরে ঘুমুচ্ছে। আমি নিচে নেমে হাতে হাতে আম্মুদের নাস্তা বানানোয় সাহায্য করলাম। মিসেস এডওয়ার্ড চেয়ারে বসে দাদুর সাথে গল্প করছেন।
সব কাজ শেষ হওয়ার পর ওনাকে খেতে দেওয়া হলো। ওনি শুধু নরম খাবারই খেতে পারেন, সেইমতো ব্যবস্থা করা হয়েছে। খাবার খেতে খেতে দাদী ইংরেজি ভাষায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুই কখন ফিরবি?’
‘ কয়েকটা দিন লাগবে।’
‘ তাড়াতাড়ি চলে আসিস বাচ্চাটা, আমি অপেক্ষায় থাকবো।’
‘ আচ্ছা।’
‘ তুই কী ওই বাড়িতে থাকতে পারবি? নাকি অন্য কোনো ব্যবস্থা করবো?’
‘ আমার ওটাতেই ভালো লাগবে।’
‘ খুশি হলাম। জানিস, ওই বাড়িটা আমার খুব প্রিয়, ওখানেই এডে’র ছোটবেলা কেটেছে। রাত জেগে ওকে রুপকথার গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়েছি। যখন ওর মম-ড্যাডের ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছে, তখন ও আমার কাছে ছিলো। ওরা ওকে হোমে পাঠিয়ে দিতে চেয়েছিলো, কিন্তু আমি দিইনি। নাতি হলেও ছেলের মতো বড় করেছি। আমার সবকিছু ওর নামে করে দিয়েছি। ওই বাড়িটা আর পেছনের জঙ্গলটা আমি তোর নামে করে দিয়েছি। যদি ভালো লাগে, বাড়িটা রেখে দিস।’
‘ তোমার বাড়ি তোমার থাকবে। আমি এসব নিয়ে কী করবো?’
‘ সেটা তুই ঠিক কর। আমার আর কদিন। তুই সব আগলিয়ে রাখিস।’
আমি দাদীকে জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘তোমার আয়ু আরো আশি বছর বাড়ুক, তুমি আমাদের সাথেই থাকবে।’
দাদী আমার গালে চুমু খেলেন। বললেন, ‘কুইন! তুই নাকি আমাকে প্রথম দেখে ভয় পেয়েছিলি?’
‘ একটু!’
‘ আমি কিন্তু ভয়ংকর নই, একদম ভয় পাবিনা।’
‘ এখন আর পাইওনা। জানি তুমি খুব মিষ্টি।’
‘ তোর হাতটা দে!’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কেন?’
‘ গিফট!’
আমি হাত বাড়িয়ে দিতেই দাদী তাঁর জামার পকেট থেকে একটা সাদা রঙের বক্স বের করলেন। বক্স খুলে একটা আংটি আমার আঙ্গুলে পড়িয়ে দিলেন। চকচকে হীরের আংটি, নিশ্চয়ই খুব দামী। নিঁখুত কারুকাজ করা পাথরের উপর। আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, ‘এতো দামী আংটি!’
‘ ওটা তোকে সেদিন দিতে চেয়েছিলাম, যেদিন আহনাফ তোকে প্রপোজ করেছিলো। কিন্তু ও ভুল করে বাড়িতে নাকি ফেলে যায়। পরদিন দিতে গিয়ে দেখে তুই কোথাও নেই, চলে এসেছিস!’
আমার মনে পড়লো ক্লেভ বলেছিলো তাঁর দাদী আমাকে গিফট দিতে চায়। তাহলে এটাই ছিলো সেই গিফট! ওহ মাই গড!
‘ এটা কোথা থেকে নিয়েছো?’
‘ এটা আমার এনিভার্সারিতে এডের দাদা আমাকে গিফট দিয়েছিলো। আমি তোকে দিলাম, যত্ন করে রাখবি। আমি যখন থাকবোনা, তখন এটা দেখিস।’
আমি আংটির দিকে তাকালাম। কারুকাজের ভেতর ছোট্ট একটা তারা জ্বলজ্বল করছে। মাঝে মাঝে রং পাল্টে যাচ্ছে। ভীষণ সুন্দর দেখতে।
‘ তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।’
‘ স্বাগতম কুইন।’
দাদী আমাকে “চিত্রা বা চিট” বলে ডাকতে পারেনা। তাই সবসময় “কুইন” বলেই ডাকে। তখন নিজেকে নিজের সত্যিই রাণী মনে হয়।
৮৪.
বিকেলের দিকে রবার্ট, প্যাটিসন, আলিয়া, জেনিফার, দাদী, নিঝুম-মারোলা আর প্রিয় আর্ফ গোছগাছ সেরে তৈরি হয়ে নিলো। ওদের এয়ারপোর্টে ছেড়ে আসতে বাসার সবাই এসেছে। আমাদেরকে বিদায় দিয়ে ওরা ভেতরে চলে গেলো। কাচের দরজা দিয়ে যতটুকু দেখা যায় সেই পর্যন্ত তাকিয়ে রইলাম। সবাই হাত নাড়িয়ে বাই জানালো।
আসার পথে সবাই বাড়ির গাড়ি করে এলেও ক্লেভ বায়না করলো আমাকে নিয়ে ঘুরতে যাবে। অগত্যা ওকে নিয়ে ঘুরতে বেরুলাম। যানজটের শহর ঢাকা আজ বেশ চুপচাপ।
‘ চিট!’
‘ বলো।’
‘ আসো হাঁটি!’
‘ এতোক্ষণ ধরে তো হাঁটছিই, আমি আর পারবোনা।’
‘ কষ্ট হচ্ছে?’
‘ তো হবেনা? একঘন্টা যাবৎ হাঁটছিই।’
‘ ট্যাহলে আমার কোলে আসো।’
‘ ফাজলামো পাইসো তুমি!’
‘ অ্যামার বউ অ্যামার কোলে উঠবে তাতে কার কী?’
‘ ওফফ, চুপ করো!’
‘ টুমি আসলেই নজ্জ্বাবতী।’
‘ আসো রিকশা নিই।’
একটু এগোতেই রাস্তার মোড়ে একটা রিকশা দেখতে পেলাম। চৌদ্দ-পনেরো বছরের একটা ছেলে সেই রিকশার চালক। আমি যখন রিকশা ঠিক করে ক্লেভকে নিয়ে ওঠতে যাবো, তখন ও রেগে আমার দিকে তাকালো। বললো, ‘রিয়েলি? আমরা এই বাচ্চার উপর চেপে শহর ঘুরবো?’
‘ বাচ্চার উপর কোথায়? আমরা তো রিকশায় বসবো, ও শুধু চালাবে।’
‘ চিট! এটা কিন্তু অন্যায়। ওদের এখন এসব করার বয়স না। পড়ালেখা করার বয়স।’
‘ জানি আমি। কিন্তু পেটের দায়ে ওরা এসব করতে বাধ্য হয়।’
‘ থার্ড ওয়ার্ল্ড কান্ট্রির এই প্রবলেম গুলো দেখলে আমার মাথা গরম হয়ে যায়। দেখো আমার রক্ত টগবগ করে ফুটছে।’
আমি ওর দিকে তাকিয়ে দেখি সত্যিই ওর চোখমুখ লাল বর্ণ ধারণ করেছে। আমি তাড়াতাড়ি বললাম, ‘ওকে ওকে। আমরা ওর গাড়ি করে যাবোনা, হেঁটেই যাবো।’
ক্লেভ ফুটপাতে বসে পড়লো। শরীর পুরো লাল, অতিরিক্ত রাগলে ওর এমন হয়। আমি রিকশাওয়ালা ছেলেটাকে দিয়ে দোকান থেকে পানির বোতল আনালাম। ওর মাথায় পানি ঢাললাম। বললো, ‘টুমি কীভাবে ওর রিসকাতে উঠতে বললে? টোমার কী ওকে দেখে কশশট হচ্চে ন্যা?’
আমি কী উত্তর দেবো ভেবে পাচ্ছিনা। ছেলেটা ‘হা’ হয়ে তাকিয়ে আছে। ওর চোখেমুখে উৎসাহ খেলা করছে। একটা বিদেশি কেমন অদ্ভুতভাবে বাংলা বলছে, দেখে ওর চোখ ছানাবড়া। তাও আবার ওকে নিয়েই কথা হচ্ছে। আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘আফা, এইডা কেডা?’
আমি মুচকি হেসে বললাম, ‘তোমার দুলাভাই।’
‘ হাচা কইতাছেন?’
‘ হুম।’
‘ ওনি আফনেরে বিয়া করছে?’
‘ বিয়ে না করলে তোমার দুলাভাই হলো কীভাবে?’
ছেলেটা অবাক হয়ে বললো, ‘ ও আল্লাহ! আফা, ভাই দি কত ফরসা। মাশাল্লাহ, মাশাল্লাহ!’
আমি হেসে ফেললাম।
‘ আফা ভাইয়ের নাম কী?’
‘ এডওয়ার্ড এলক্লেভ!’
ও ছোট ছোট চোখ করে বললো, ‘নামটা খ্রীষ্টিয়ান লাগে কেন? ভাই কী খ্রীষ্টিয়ান?’
‘ ছিলো। এখন মুসলমান হয়ে গিয়েছে, নাম মোহাম্মদ আহনাফ!’
ছেলেটা আরও একদফা অবাক হলো। খুশিতে গদগদ হয়ে বললো, ‘ও আল্লাহ! ভাই তো পুরাই জোস। আল্লাহ হেদায়েত করছে। আপনের অনেক ভালা অইবো আফা! কী সুন্দর দেখতে ওনি, আপনেও সুন্দর!’
আমি বললাম, ‘তুমিও!’
ও জিজ্ঞেস করলো, ‘আফা, ভাই বাংলা কইতে পারে?’
‘ একটু আধটু।’
‘ তাইলে চলেন আমার রিকশা কইরা আফনেরারে শহর ঘুরাইয়া দেখায়।’
আমি হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, ‘ও রিকশায় উঠতে চাচ্ছেনা।’
আমাদের কথোপকথন ক্লেভ শুনলো না। সে ফুটপাতে বসে আছে। আমি এগিয়ে গেলাম। ছেলেটাও এলো আমার সাথে। আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘শুনছো?’
ও মুখ তুলে চাইলো। বললো, ‘কী?’
আমাকে কিছু বলতে না দিয়ে ছেলেটা বললো, ‘ভাই চলেন আমার রিকশা কইরা আপনেরারে ঘুরাইয়া আনি।’
ক্লেভ হেসে বললো, ‘টুমি চাও টোমার রিসকায় অ্যামরা ওঠি?’
‘ জে ভাই।’
ক্লেভ পকেট থেকে আবারও এক হাজার টাকার কয়েকটা নোট ছেলেটার পকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে বললো, ‘চলো। আর ট্যাকাটা দিয়ে স্কুলে এডমিট হতে পারবে, অনেককিছু খেতে পারবে। অ্যাজকের পরে আর কখনো রিসকা চালাবেনা। নিজে অনেক বড় হও আর অনেকের আইডল হও, ট্যাটেই টোমার ব্যাঙলাদেসের ডেভেলপ হবে। যা রিসকা চালিয়ে কখনো করতে পারবেনা, ওখে?’
ছেলেটা অবাক হয়ে মাথা নাড়ালো। জানালো আজকের পরে আর কখনো রিকশা চালাবেনা। পড়াশোনা করবে। ক্লেভ খুব খুশি হলো। চোখেমুখে খুশির ঝিলিক।
তারপর ক্লেভ ওঠে দাঁড়ালো। আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। আমি অবাক হলাম, একটু আগেই না রেগেমেগে আগুন হয়ে ছিলো। এখন আবার কী হলো! অদ্ভুত!
৮৫.
রিকশাতে আমি উঠে বসলাম। ক্লেভ উঠলো না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী?’
ছেলেটা বললো, ‘ভাই আফনে উঠেন। আমি চালাই।’
ও হেসে বললো, ‘টুমি চিটের পাশে বসো, অ্যামি চালাচ্ছি!’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘মানে?’
‘ অ্যামি রিসকা চালাবো।’
‘ পাগল হলা তুমি?’
‘ ন্যাহ। টুমি স্টপ হও।’
‘ তোমাকে দেখলে মানুষ কী ভাববে?’
‘ আই ডোন্ট কেয়ার। যারা ছোট্ট বাচ্চাদের দিয়ে এমন কাজ করায়, টারা কী ভাবলো অ্যামি কেয়ার করিনা।’
আমি আর কিছু বললাম না! ছেলেটা বিস্মিত চোখে চেয়ে রইলো। এমন অবাক হয়তো অনেক দিন হয়না। ক্লেভ রিকশায় উঠতে বললে ও যন্ত্রের মতো আমার পাশে উঠে বসলো। আমি আতঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিন্তু তুমি তো রিকশা চালাতে পারোনা।’
‘ পারবো। সাইকেল চালানোর অভ্যাস আছে অ্যামার।’
‘ সাইকেল আর রিকশা কী এক?’
‘ টুমি চুপ করে বসে থাকো।’
আমি আর কিছু বললাম না। ক্লেভ কিছুক্ষণ ট্রাই করলো, কীভাবে শুরু করবে। আস্তে না জোরে চালাবে! মানে একপ্রকার রিহার্সেল করতে করতে ওর কপাল ঘেমে গেলো। আমার ওড়না দিয়ে মুখটা মুছে গালে ফট করে একটা চুমু খেলো। হেসে বললো, ‘লেটস গো গাইজ।’
রিকশাওয়ালা ছেলেটা হতভম্ব হয়ে বসে আছে। বিনা টিকেটে সে হলিউড মুভি দেখছে। তারপর বললো, ‘ভাই খুউব ভালা। চলেন ভাই, সাবধানে চালাইয়া নেন। না পারলে আমারে কইয়েন, সাহাইয্য করমু নে।’
‘ ওকে।’
আমি বললাম, ‘আস্তেধীরে চালাবে!’
‘ ওকে চিট বেবি।’
ক্লেভ দোয়া পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে রিকশার প্যাডেল ঘুরাতে লাগলো। ওর চালানোর ভঙ্গি দেখে আমরা দুজন অট্টহাসিতে ফেটে পড়লাম। ক্লেভ ধমক দিয়ে বললো, ‘রিসকা চালানোর সময় কথা বলবেনা।’
‘ কিন্তু আমরা যাচ্ছিটা কোথায়?’
‘ জ্যানিনা! যতটুকু যেতে পারি অতটুকুই যাবো।’
‘ ওকে।’
ততক্ষণে আঁধার নেমে এসেছে অলিতে-গলিতে! সোডিয়াম আলো রাস্তার বাঁকেবাঁকে ঝিলিক কাটছে। বর্ষার ঠান্ডা বাতাস আমার ফতুয়া গলে শরীর কাঁপিয়ে দিচ্ছে। এমন একটা বিদেশি লোক তাঁর বউ আর রিকশাওয়ালা ছেলে নিয়ে রিকশা চালাচ্ছে দেখে আশেপাশের লোকজন ‘হা’ হয়ে আছে। সবাই যেন চিড়িয়াখানায় অদ্ভুত প্রাণী দেখতে এসেছে। আমার রাগ হলো। ওরা আমার চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছেনা তো? তাহলে নিশ্চয়ই ক্লেভের পেটেব্যথা করবে।
কিন্তু ভালোও লাগছে। এসব মিষ্টিমধুর মুহূর্ত এই জীবনে আর কখনো আসবে কিনা সন্দেহ। এই রাতের ঢাকা শহরে রিকশাচালক সেজে ক্লেভকে যে অদ্ভুত রুপবান লাগছে সে কী জানে? ভার্জিনিয়াতে এই দিনটা কখনো ফিরে পাবোনা। আবার কখন দেশে আসতে পারবো তাঁর ও ঠিক নেই। আমাদের উচিৎ জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত দারুণভাবে উপভোগ করা। কারণ আর কখনো এই দিনটা ফিরে আসবেনা, স্মৃতির পাতায় আজীবন রঙিন হয়ে থাকা এসব মুহূর্ত সারা জনমভর আমাদের আনন্দ দেবে। মুহূর্তটাকে আমি ক্যামেরাতে বন্দি করে নিলাম। আমার জীবনের দ্বিতীয় সেরা মুহূর্ত। প্রথমটা ছিলো শ্যানানডোয়ায়, যেদিন ক্লেভ আমাকে প্রপোজ করেছিলো। জীবন ক্ষণে ক্ষণে মানুষকে সেরা সেরা কিছু মুহূর্ত উপহার পাঠায়, যেগুলো কখনো ভোলার নয়।
চলবে….. ইনশাআল্লাহ! ভুল ত্রুটি মাফ করবেন।