ভুলিনি তোমায় পর্ব-২৮

0
3237

#ভুলিনি_তোমায়?
#Nishat_Tasnim_Nishi
#পর্ব :২৮

.
উনার কথা শুনে আমি কোনো রিয়েক্ট করলাম না,,চুপচাপ নিচে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই উনি পিছন থেকে আমার হাত ধরে ফেললেন।আমি ঘাড় ঘুরিয়ে হাতের দিকে গাঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। উনি আমার হাত টা ছাড়ছেন না দেখে আমি হাত ঝাড়ি মেরে ছাড়িয়ে নিতে চাইলাম।তখনই উনি আমার হাতসহ আমাকে টান দিলেন,আমি টাল সামলাতে না পেরে উনার বুকে গিয়ে পড়লাম।উনি একহাত দিয়ে আমাকে উনার সাথে চেপে ধরে অন্যহাত দিয়ে মাথার কাঠি টান মেরে খুলে দিলেন,,সাথে সাথে একরাশি ঘনকালো চুল আমার পিট ছাড়িয়ে কোমর অবধি ঠেকলো।

আমি উনার বুক থেকে মাথা তুলে উনার চোখের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকালাম,,উনি ঠোঁট কামড়ে দুষ্টু হাসলেন। এক হাত দিয়ে আমার মুখের উপর পড়া চুলগুলো সরিয়ে কানের পাশে গুজে দিলেন,, মিষ্টি হেসে আমার কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে বললেন,,”রাগ করেছে?অবশ্য রাগ করাটা স্বাভাবিক। আমি কিন্তুু তোমার রাগ ভাঙ্গাতেই এত কিছু করেছি অথচ দেখো উল্টো তুমি আরো রেগে গিয়েছো। তবে,আজ আমি অনেক হ্যাপি,,আমি জেনে গিয়েছি তোমার মনে আমাকে নিয়ে কী চলছে। জানো কতটা খুশি হয়েছিলাম যখন জেনেছি যে আমার জন্য তুমি কিছু ফিল করো। আমার অনেক কিছুই জানার ছিলো তাই এমন টা করেছি। তোমার কিছু জিনিস দেখে আমি সত্যি মুগ্ধ হয়েছি ,প্রথমত তুমি নিজেকে স্ট্রং রেখেছো,দ্বিতীয়ত আমার প্রতি তোমার ফিলিংসগুলো বলেছো,তৃতীয়ত কোনো ভুল পদক্ষেপ নেও নি। আমার এত ভালো লেগেছে যে কী বলবো।আমি সত্যিই তোমার প্রেমে পড়ে গিয়েছি। আমি কখন ভাবি নি আমার জন্য তোমার ফিলিংস জন্মাবে।”

উনার চোখে মুখে অন্যরকম খুশির ঝিলিক দেখতে পেলাম। উনার চোখের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,,”আর আপনার ফিলিংস?”

উনি কিছুটা চমকে গেলেন। মুচকি হেসে আমার নাকের সাথে নাক ঘষে বললেন,,”শুনতে চাও আমার ফিলিংস?”

আমি মাথা নাড়ালাম।

–“তোমাকে প্রথম দিন দেখেই আমার অন্যরকম অনুভূতি হয়েছিলো,সেটা কিন্তুু আমি তোমাকে বলেছিলাম। তখন অবশ্য ভালোবাসতাম না তবে বিয়ের পর থেকে অন্যরকম টান হতো। আমি তেমন গুরুত্ব দিতাম না,ধীরে ধীরে তোমার গভীর প্রেমে পড়ে যাই যা আমি টেরও পাই নি।”

এটুকু বলে উনি থামলেন।আমি আগের মতো উনার দিকে তাকিয়ে আছি, মনের মধ্যে কেমন সুপ্ত অনুভূতি নাড়া দিচ্ছে।

–“জন্ম,মৃত্যু,বিয়ে এ তিনটি সৃষ্টিকর্তার হাতে।উনিই তোমার সাথে আমার মিল রেখেছেন বলেই তুমি আমার হয়েছো।তোমার অতীত নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যাথা নেই,আর না তোমার ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে।তুমি যেমন আমার তোমাকে তেমনই পছন্দ।আমি চাই তোমার বর্তমান,ভবিষ্যৎ সবকিছু জুড়ে যেনো আমি থাকি। আমি তোমাকে পছন্দ করি,ইনফেক্ট ভালোবাসি। আমি তোমাকে বলবো না যে আমি তোমাকে ভালোবাসি কারন আমি চাই তুমি যেনো বুঝো আমি তোমাকে ভালোবাসি।অনেক তো সময় দিয়েছি,এ কয়টা দিন কী যথেষ্ট ছিলো না আমার ভালোবাসা বুঝার জন্য?”

আমি তাচ্ছিল্যেরর সুরে বললাম,,
—“আপনি এখন আমাকে ভালোবাসেন পরেও যে ভালোবাসবেন এর কী গ্যারান্টি আছে?হতেও তো পারে আমি আপনার মোহো,,.!! ”

আমার কথা শেষ হতেই উনি এক ঝটকায় আমাকে সরিয়ে দিলেন।উল্টো দিকে ফিরে জোরে জোরে নিশ্বাস নিলেন,বুঝতে পারলাম উনি রেগে গিয়েছেন।আজব,এখানে রাগের কী আছে?

উনি আমার দিকে ফিরে চোখমুখ শক্ত করে হাত নাড়িয়ে বলতে লাগলেন,,
–“দেখো,আমি তোমাকে ভালেবাসি।তুমি একদম তোমার এক্সের সাথে আমাকে মিলাতে যেও না,সবাই যদি এক হতো তাহলে তো হতোই!তোমাদের প্রবলেম কী জানো?যে তোমাদের সত্যিকার অর্থে ভালোবাসে তোমরা তাদের ভালোবাসো না।অথচ যারা তোমাদের সাথে মিথ্যা অভিনয় করে তাদের ঠিকই ভালোবাসো।”

উনার কথা শুনে আমার চোখ দুটো ভরে উঠলো।উনি আমার চোখের দিকে খেয়াল করতেই চুপ করে গেলেন।
এহসান চাপা সুরে বলে উঠলেন,,
–“আই এম সরি,আসলে তুমি ওই কথা বলায় রেগে গিয়েছিলাম।”

মুহূর্তেই পরিবেশ নিস্তব্ধতায় ঢেকে যায়। আমি পিছনের ওয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে বসে পরলাম,সাথে সাথে আমার গাল বেয়ে একফোটা অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়লো।
আচমকা উনিও আমার সামনে হাটু গেড়ে বসে পড়লেন।আমার বাম হাত টেনে উনার হাতের মুঠোয় পুরে নিয়ে বলতে লাগলেন,,”আমি জানি না আমার কী বলা উচিত!আমি যখনই তোমাকে আমার মনের কথা বুঝাতে চাই তখনই গন্ডগোল বাঁধিয়ে ফেলি।তোমাকে খুশি করতে গিয়ে উল্টো কাঁদিয়ে দেই।আমি যেনো কেমন হয়ে গিয়েছি,,তোমাকে ভালোবাসার পর থেকে ধৈর্য্য জিনিস টা একদম হারিয়ে ফেলেছি,ইস্পেশালী তোমার ক্ষেত্রে!তুমি তো আমাকে বুঝো তাই না,তুমি জানো আমি কখনও তোমাকে হার্ট করে কিছু বলতে চাইবো না।আমি জানি না কেনো বলে ফেলেছি।আমি একদম ডেস্পারেট হয়ে গিয়েছি তোমার জন্য।দেখো কত সুন্দর করে আয়োজন করেছি শুধুমাত্র তোমাকে খুশি করার জন্য।এ কয়েকটা দিন তো তুমি প্রচুর চাপের মধ্যে ছিলে তাই আমি ভাবলাম তোমার রিফ্রেশমেন্টের দরকার।এজন্যই এসবের ব্যবস্থা করেছি।”

আমি শুধু পাথরের মতো উনার কথাগুলো শুনতে লাগলাম,কোনো কথা বললাম না।কারন আমার প্রচন্ড খারাপ লেগেছে, উনি কীভাবে আমাকে কথাগুলো বলতে পারলেন?

উনি আমাকে নানাভাবে সরি বলতেছেন,আমাকে কত কিছু বলে হাসানোর চেষ্টা করতেছেন।কিন্তু আমি কোনো রিয়েক্ট করলাম না। কিছুক্ষন চুপ থেকে উনি আমার হাত ধরে টেনে বললো,”চলো!”
আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই উনি আমার কথার জবাব দিলেন না।আমাকে টেনে নিয়ে ছাদের কার্নিসে এসে দাড় করালেন।উনি একটু জোরে হেটে টেবিলের পাশে গিয়ে কিছু একটা নিয়ে আবারো দৌড়ে আমার কাছে আসলেন। উনার হাতের জিনিসটার ভিতরে লাইটার দিয়ে আগুন জ্বালালেন।আমার দিকে ওটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন ছেড়ে দিতে, আমি উনার কথামতো করতে লাগলাম।কাজ টা করতেই আমি চমকে গেলাম,কী সুন্দর ওটা আকাশে উড়তে লাগলো।সবচেয়ে বেশি সুন্দর লাগছিলো যখন ওটার ভেতরের আগুন গুলোকে আলোর মতো দেখা যাচ্ছিলো।আমি অনেক আগ্রহ নিয়ে সবকিছু দেখতে লাগলাম।

উনি আমার পিছনে এসে দাড়ালেন,আমার দুইপাশে দুইহাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। সাথে সাথে আমি কেঁপে উঠলাম।

–“জানো,ওটা কী ছিলো?”

আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম,,”না”

উনি আমার কাধে মুখ রেখে বললেন,,”ওটার নাম ফানুস।সুন্দর না?”

আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম,,”হ্যা।”

–“ভালো লেগেছে?”

আমি আবারো মাথা নাড়িয়ে বললাম,,”হ্যা।”

এরপর অনেক্ষণ আমাদের মধ্যে কথা হয় নি।চুপচাপ দুজনই এভাবে দাড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ পর উনি আমাকে ছেড়ে দিলেন,সাথে সাথে আমি জোরে জোরে নিশ্বাস নিলাম।এতক্ষণ যেনো দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। উনি আমার হাত ধরে আমাকে টেবিলের সামনে নিয়ে একটা চেয়ার বের করে বসিয়ে দিলেন।তারপর খাবারের ঢাকনা উঠালেন।খাবারের ঘ্রান পুরো টেবিলে মৌ মৌ করতে লাগলো। সারাদিন ক্ষুদার্থ থাকায় আমার পেটের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো।তবুও আমি চুপচাপ বসে রইলাম।উনাকে কীভাবে বলবো যে ক্ষিদে পেয়েছে,ছিঃ কি লজ্জা! উনি নানান কথা বলতেছেন আর আমি খাবারের দিকে তাকিয়ে রইলাম,কথা বলতে বলতে হঠাৎ আমার দিকে উনার চোখ পড়লো।উনি বিষয়টা বুঝতেই চুপ করে গেলেন।উনি নিজে খাবার মেখে আমার মুখের সামনে খাবার ধরলেন।যেহেতু আগে থেকেই ক্ষুধা পেয়েছিলো তাই আমি কোনো অভিনয় না করে চুপচাপ খেয়ে নিলাম। অনেক তৃপ্তির সাথেই সবটুকু খাবার খেয়ে শেষ করলাম।রান্নাটা যে অসম্ভব ভালো ছিলো তা আমার খাওয়ার ধরন দেখেই বুঝা যাচ্ছিলো,কারন আমি চেটেপুটে খেয়েছিলাম।খাওয়া শেষে উনি আমাকে বললেন,,”আমাকে খেতে বললে না?” আমি লজ্জা পেয়ে মুখ নামিয়ে নিলাম,তা দেখে উনি ঠোঁট চেপে হাসলেন।তখন চাঁদের আলোয় উনার মুখটার দিকে তাকাতেই আমি থমকে গেলাম,কয়েক মুহূর্ত বেহায়ার মতো তাকিয়ে ছিলাম,উনি একটু খুক খুক করে কাশতেই আমি আবারো ভীষণ লজ্জা পেয়ে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলাম।প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত আমরা ছাদে ছিলাম।ততক্ষণে আমি অনেকটা স্বাভাবিকও হয়ে গিয়েছিলাম।
___________________

এই অবেলায় ফোঁটা কাশফুল, নিয়তির মত নির্ভুল
যেন আহত কোন যোদ্ধার বুকে বেঁচে থাকা এক মেঘফুল
যদি ঘরে ফেরা পাখি নিশ্চুপ, হৃদয়ে ঢেউ ভাঙে চুপচুপ
যদি জাহাজের নাগরিক ঢেউ…
অপরাধ মেনে নিয়ে কেউ কেউ….
যদি শোঁকগাথা হাতে বহুদূর যাও,
একদিন ঠিকই এনে দেব হাসিমুখ….
রোদ্দুর…
একসাথে হেঁটে হেঁটে যেতে চাই বহুদূর…
বুকের ভেতর ডানা ঝাপটায় পাখি, বেপরোয়া ভাংচুর…
– শিরোনামহীন
.
এক কাপ চা নিয়ে বারান্দায় দাড়িয়ে নিচের ব্যস্ত শহরের দিকে তাকিয়ে আছি আমি।ভেজা চুল নিঃসৃত টুপ টুপ পানি আধভেজা করে ফেলছে আমার পিঠের অর্ধাংশ।সময়গুলো যে কীভাবে কেটে যায় টেরও পাওয়া যায় না।আমাদের দিনগুলো অনেক সুখে-শান্তিতেই কাটছে।
আমি এখন উনার সাথে একদম স্বাভাবিক,সাধারন স্বামী-স্ত্রী দের মতোই আমাদের সংসার চলছে।আমাকে হাসি-খুশি দেখে আমার ফুফি অনেক খুশি,ফুফি প্রায়ৌ নানান জিনিস রেঁধে নিয়ে আসেন আমাদের জন্য। আমার জীবন নিয়ে এখন আর তেমন অভিযোগ করি না,নিজেকে এখন অনেক ভাগ্যবতী মনে হয়।মাঝে মাঝে অতীতের পিছুটান নিয়ে খুব আফসোস করি।তখন আমার উনি খুব ভালো করেই আমার মন খারাপের কারনগুলো বুঝে যায়,নানান কৌশলে আমাকে আবার হাসিয়ে স্বাভাবিক করে ফেলেন। উনার অদ্ভুদ কর্মকান্ড গুলো আনমনে ভেবে মুচকি মুচকি হাসছিলাম আর চায়ে চুমুক দিচ্ছিলাম।তখনই পিছন থেকে আওয়াজ আসলো,,”না,ঠিক আছে।তাহলে এভাবেই তাহলে জ্বর বাঁধিয়ে দুদিন পর পর বিছানায় পড়ে থাকো।” এ কথা বলে উনি আমাকে এক ধমক দিলেন। তারপর টাওয়াল নিয়ে আমার চুলের পানি মুছতে লাগলেন।আমি মুচকি হেসে চায়ের দিকে মনোযোগ দিলাম,,এ কয়েকটা দিনে উনি আমাকে ছোট ছোট জিনিসগুলো নিয়ে উনার বকাবকি শুনতে শুনতে অভ্যস্ত। উনি আমাকে হাসতে দেখে বললেন,,”একদম হাসবে না,কোনো কিছুতেই সিরিয়াসনেস নাই,ইডিয়েট..!!” আমি হাসি বন্ধ করে বললাম,,”আচ্ছা হাসবো না।” উনি ধ্যাত বলে চলে গেলেন।আর আমি ফিক করে হেসে দিলাম।
.
“কি হয়েছে,আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেনো?”

উনি কিছু না বলে সোজা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন।উনাকে কাঁদতে দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম,কখনো মানুষটাকে কাঁদতে দেখি নি হঠাৎ কী হলো যে উনি কেঁদে দিলেন। এ ভরদুপুরে উনাকে এমন করতে দেখে আমার বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠলো।কোনো খারাপ কিছু হয় নি তো?

–“আপনি কাঁদছেন কেনো?কী হয়েছে আমাকে বলেন..!!”

উনি ফিকরে কেদে কেদে বলে উঠলেন,,”কিছুক্ষণ আগে বাড়ী থেকে ফোন এসেছে,, বাবা নাকী স্ট্রোক করেছেন।”

উনার কথা শুনে আমি একদম অবাক হয়ে গেলাম।এতদিনে তো আমি একবারও উনার পরিবার সম্পর্কে জানতে চাই নি,এখন যদি কিছু জিজ্ঞাস করি তাহলে নিশ্চয় উনি আরো কষ্ট পাবে।তারউপর উনার বাবার বিষয়,নিশ্চই বাবাকে অনেক ভালোবাসেন না হলে তো আমার সামনে কখনও কান্না করতেন না। আমি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম।

এরপর উনি চোখ-মুখ মুছে নিজে নিজে বললেন,,” আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে।বাবা নাকি আমাকে দেখতে চায়।”

এ বলে উনি উঠে গেলেন, দু-চারটা জামা-কাপড় ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলেন।

–“কী হলো,তুমি বসে আছো কেনো?তুমি যাবে না?”

উনার কথা শুনে আমার হাত-পা কাপতে লাগলো।উনার দেশের বাড়ীও তো আমার দেশের বাড়ীতে। আমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে লাগলো।
.
.
.
চলবে?