ভুলিনি তোমায় পর্ব-৩৩

0
3506

#ভুলিনি_তোমায়?
#Nishat_Tasnim_Nishi
#পর্ব :৩৩

কয়েক সেকেন্ড থম মেরে দৌড়াদৌড়ি করে ওড়না টা খুজতে লাগলাম।আসলে বই পড়ার সময় ওড়না টা খুলে রেখেছিলাম।বারবার সমস্যা হচ্ছিলো তো তাই। কিন্তুু এখন এই মরার ওড়না কই গিয়েছে।চুলগুলো বড় হওয়ায় পুরো শরীর ঢেকে আছে। খোজাখুজি করতে করতে হটাৎ দেখলাম ওড়না টা টেবিলের নিচে পড়ে আছে,আমি দ্রুত ওড়না টা নিয়ে ভালো মতো গায়ে জড়িয়ে নিলাম।

আমি একটু রাগী সুরে সৌরভকে উদ্দেশ্য করে বললাম,,”কারো রুমে ঢুকার পূর্বে পারমিশন নিয়ে ঢুকতে হয়।এটলিস্ট এটুকু ম্যানার্স থাকা উচিত।”

–“আমি তো নক করেই এসেছি।”

আমি থতমত খেয়ে বললাম,,”তাই বলে এভাবে আসবেন?আপনি তো বলতে পারতেন ভাবী আমি সৌরভ, আমি কী আসতে পারি?তা না করে চোরের মতো প্রবেশ করেছেন।”

সৌরভের মুখ টা রাগে লাল হয়ে উঠলো।ও চোখ বন্ধ করে কয়েক সেকেন্ড নিশ্বাস ফেলে বললো,,”বারবার আপনি বলাটা বন্ধ করো।আর ভাবী মানে?কিসের ভাবী, আমি মানি না।”

আমি ভ্রু কুচকে বললাম,,”তো?আপনি মানলেও কী না মানলেও কী?”

সৌরভ রেগে আমার বাহু চেপে ধরলো,থমথম গলায় বলে উঠলো,”আমার কী মানে?তুমি বুঝো না আমি তোমায় ভালোবাসি।”

সৌরভের কথা আর ব্যবহার দেখে আমি থম মেরে গেলাম।কী বললো সৌরভ? সৌরভ কেমন অসহায়ের মতো আমার দিকে তাকিয়ে আছে,তা দেখে আমি শব্দ করে হাসতে লাগলাম।সৌরভের হাত দুটো এক ঝটকায় সরিয়ে পেট চেপে হাসতে লাগলাম।কী বলে সৌরভ,ও আমায় ভালোবাসে।হাসতে হাসতে চোখের কোনে পানি জমা হয়ে উঠলো।মূলত সৌরভকে উপহাস করতেছি। সৌরভ একদম অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে,ও অবাকের রেশ নিয়ে বললো,,”কী নিয়ে হাসছো?আমি তো হাসির কিছু দেখছি না।”

আমি হাসতে হাসতে কোনোরকম আটকে আটকে বললাম,,”কী বলেন,হাসবো না?আপনার জোকস টা বেস্ট লেগেছে।”

সৌরভ প্রচন্ড অবাক হয়ে বললো,,”আমি জোকস কখন বললাম?”

–“আরে একটু আগে বললেন না আপনি আমায় ভালোবাসেন।সেটাই তো জোকস ছিলো।”

আমার কথা শুনে সৌরভ মাথাটা নিচু করে ফেললো,ও কোনো রিয়েক্ট করলো না।হয়তো বুঝেছে যে আমি তো ঠিকই বলছি।কিন্তুু আমি চেয়েছি ও বিষয় নিয়ে আরো বলুক,যাতে আমি আমার মনের কথাগুলো শুনাতে পারি।

সৌরভ একটু নরম হয়ে বললো,,”নায়লা,শুনো..!!”

–“হ্যা বলেন,,আমি শুনতেছি।আরো বাকি আছে নাকি?”

–“এভাবে বলছো কেনো?”

–“আশ্চর্য! তো কীভাবে বলবো?”

সৌরভ উপরের দিকে তাকিয়ে একটা নিশ্বাস ছাড়লো।
সৌরভ কেমন অস্থির হয়ে বিনীতভাবে বললো,,
–“আমি কিছু কথা বলতে এসেছি,কষ্ট করে একটু মন দিয়ে শুনবে?বেশি সময় নিবো না।”

আমি কিছু একটা ভাবলাম,হয়তো সিরিয়াস কিছু হবে।আমি মাথা হেলিয়ে বললাম,,
–“আচ্ছা।ওখানে বসুন।যা বলার দ্রুত বলুন।”

সৌরভ মুখ টা ভার করে চেয়ার টা টেনে আমার থেকে নিরাপদ দূরত্ব রেখে বসলো।আমি টেবিলের সাথে হেলান দিয়ে দাড়ালাম,ওর সাথে বসা বিষয় টা খারাপ দেখাচ্ছে না।তারউপর গ্রামের মানুষ একটা দেখলে দুইটা বানায়।

সৌরভ একটু নড়ে চড়ে বললো,,”কী পড়তেছিলে?”

সৌরভের কথা শুনে আমার কপাল কুচকে এলো।বুঝলাম কী দিয়ে কতা শুরু করবে সেটা বুঝতেছে না। আমি মৃদু হাসলাম,হাসিমুখেই বললাম,,”তেমন কোনো বই না, জাফর ইকবাল স্যারের বই পড়ছিলাম।আপনি বলুন কী বলতে চান।”

সৌরভ আবারো উশখুশ করতে লাগলো।এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলো।

সৌরভকে দেখে বুঝলাম ওর কথায় জড়তা কাজ করছে।তাই আমি নিজ থেকেই স্বাভাবিকভাবে বললাম,,,

–“হঠাৎ ভালোবাসি কেনো বললেন?না মানে, অন্যরকম জোকস ও বলা যেতো এটাই কেনো বললেন?”

সৌরভ অসহায় হয়ে বললো,,
–“আমি জোকস বলি নি।আমি সত্যি বলেছি।”

সৌরভের কথা শুনে আমি কপাল কুচকে তাকালাম,ওর ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত একবার চোখ বুলালাম।আমি সৌরভের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে বললাম,,” আপনার মাথা ঠিক আছে তো?”

সৌরভ মাথা নিচু করে বললো,,”না, নেই। আমি জানি আমি যা বলছি তা কোনো সুস্থ মানুষ বলবে না।”

আমি খুব স্বাভাবিকভাবে শান্তস্বরে বললাম,,
–“তাহলে কেনো বলছেন?আর হঠাৎ এমনটা কেনো মনে হলো?”

–“আমি বলছি কারন আমার বলার যথেষ্ট কারন আছে।আমি শান্তিতে খেতে পারি না,ঘুমাতে পারি না।সবসময় কেমন অচেনা কষ্ট অনুভব করি,বারবার এমন মনে হয় সেদিন যদি নিজের ফিলিংস সম্পর্কে বুঝতাম তাহলে তুমি হয়তো আমার সাথে থাকতে।আজ তো তোমার আমার পাশে থাকার কথা ছিল তাই না?”

–“তো নেই কার কারনে?নিশ্চই আমার কারনে নয়।”

–“আমারর কারনে,আমি সেদিন যদি ওসব না বলতাম তাহলে তো তুমি আমার সাথে থাকতে তাই না?

–“আচ্ছা, এখন এটা বলেন হঠাৎ এমন কেনো মনে হলো? মুমুকে কি ছেড়ে দিয়েছেন নাকি ও ছেড়ে দিয়েছে?”

–“নায়লা!”

–“এভাবে রিয়েক্ট করছেন কেনো?আজগুবি কিছু বলি নাই।”

সৌরভ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে ধীর কন্ঠে বললো,,
—“মুমুর সাথে আমার কোনো সম্পর্ক ছিলো না। সেদিন তুমি চলে যাওয়ার পর মুমু আর আমার সাথে কোনো কথা বলে নি,কয়েক মাস আগে ওর কাজিনের সাথে ওর বিয়ে হয়ে যায়। আমার প্রথম কয়েকদিন খারাপ লেগেছিলো,আমি ভেবেছিলাম তোমার কারনে ও আমার সাথে কথা বলে নি।এ নিয়ে তোমার উপর অনেক জিদ ছিলো।পরে শুনলাম ওর কাজিনের সাথে নাকি আগে থেকেই বিয়ে ঠিক ছিলো। ”

–“হ্যা,তারপর।আমি শুনছি তো,বলেন,থেমে গেলেন কেনো?”

–“তুমি চলে যাওয়ার পর আমি আর তোমার খবর নেই নি।কারন মুমুর ব্যাপার টা নিয়ে তোমার উপর রাগ ছিলো। আমি ভেবেছিলাম, মুমু আমার ভালোবাসা কিন্তুু আমি ভুল ছিলাম।মুমু শুধু মোহ ছিলো,তুমি ছিলে ভালোবাসা। আর আমি মোহ আর ভালোবাসা টা গুলিয়ে ফেলেছিলাম।তুমি ছিলে আমার আসল ভালোবাসা সেটা গত কয়েকদিনে খুব ভালো করে বুঝেছি। তুমি জানো, তোমাকে যখন ভাইয়ার সাথে দেখি তখন আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়।আমার সব ভেঙ্গে ফেলতে ইচ্ছে কে।নিজেকে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করে কারন আমার ভুলের কারনেই তো তুমি আমার কাছে নেই।বারবার শুধু ভাবি কেনো সেদিন আমি ওমন করেছিলাম।আমি, ‘তুমি’ শূন্যতায় ভুগতেছি।কয়েকদিন থেকে আমার সব কিছু থেকে রুচি চলে গিয়েছে,না পারছি শান্তিতে খেতে আর না ঘুমাতে।মনে হয় আর বেশি দিন বাঁচবো না।আমাকে মাফ করে দেও।”

কথাগুলো বলার সময় বারবার সৌরভের গলা ধরে আসছিলো। ওর দিকে তাকাতেই দেখলাম ওর চোখের কোন দিয়ে অশ্রুকনা গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে।

–“গুড।আপনার বলা মনে হয় শেষ তাহলে আপনি এবার যেতে পারেন।”

–“আমাকে একটা সুযোগ দেওয়া যায় না?মানুষ মাত্রই তো ভুল,আমি না হয় একটা ভুল করেই ফেলেছি।”

–“আপনি যা বলছেন ভেবে বলছেন তো?আমি বিবাহিত সেটা জানেন তো?”

–“হ্যা,আমি জানি।বাবা বলেছেন তোমার আর ভাইয়ার বিয়ে টা একটা এক্সিডেন্ট ছিলো,তোমার ফুফাতো ভাইয়ের সাথে বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো কিন্তু ও পালিয়ে যাওয়ার কারনে তোমার সাথে বিয়ে হয়ে যায়।যেহেতু ভাইয়া চাপে পড়ে বিয়ে করেছে,সেহেতু তোমাদের সম্পর্কটা দায়িত্বের।আর আমি জানি তোমাদের মধ্যের ওসব শুধু আমাকে দেখানোর জন্য করেছিলে তাই না?”

এতক্ষণ সৌরভের কথাগুলো দাত চেপে হজম করছিলাম,যথাসম্ভব শান্তভাবে জবাব দিচ্ছিলাম।কারন ওর সাথে তর্ক বা উচ্চস্বরে কথা বলতে চাচ্ছিলাম না। এবার আমি রেগে গিয়ে দাত চেপে বললাম,,”আমি উল্টা-পাল্টা কিছু করার আগে এখান থেকে চলে যান।এতক্ষন আপনার কথার জবাব দিচ্ছি না বলে, আপনি যা ইচ্ছা তাই বলতে পারেন না।আপনি জানেন কি হ্যা,বলেন?যখন আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছেন তখন আমার সাথে কী কী হয়েছে জানেন?শুধু মাত্র আপনার জন্য আমার বাবা আমার সাথে নেই?”

–“কাকার কী হয়েছে?আর কাকাই বা কই?”

–“ওহ,,তাহলে বাবা কই আপনি সেটাও জানেন না?ভালো।”

–“আমি আসলে সত্যি জানি না।বলো না কই?”

আমি সৌরভের দিকে তাচ্ছিল্যের হাসি দিলাম। খুব হাসি পাচ্ছি,সাথে কান্নাও আসছে।কী করবো নিয়তি বলে কথা। আমি চাই সৌরভ আজ সব জানুক,ও বুঝক ও ছেড়ে দেওয়ার পর আমার সাথে কী কী হয়েছে।আমি নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলে এক এক করে ওকে সব বললাম। প্রত্যেক টা ককথা ববলার সসময় আআমার চোখে পানি ছিলো, শেষে এহসানের সাথের কথাগুলো বলার সময় আমার মুখের কোনো এক চিলতি হাসি ফুটে ওঠেছিলো। আমি চোখ মুখ মুছে সৌরভকে বললাম,,”আর কিছু বলার আছে?”

সৌরভ কান্নাজড়িত কন্ঠে বললো,,”আই এম সরি।আমি সত্যি জানতাম না এতকিছু হয়ে গিয়েছে।আমি কোনোদিন ভাবি নি যে এতকিছু হবে?জানলে কখন তোমাকে ছেড়ে দিতাম না। আমি ভেবেছিলাম ভাইয়া হয়তো তোমাকে ভালোবাসে না, আর তুমিও আমাকে দেখানোর জন্য এমন করছো।তাই আমি তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নতুন করে সব শুরু করতে চেয়েছিলাম।”

আমি কিছু বললাম না।ও অনেক কথাই বলতেছে, কথাগুলো কান পযন্ত পৌঁছালেও মষ্তিষ্ক পযন্ত পৌঁছাচ্ছে না। এখন আমার খুব কান্না পাচ্ছে, জানি না কেনো।তবে সৌরভের সামনে কাঁদতে চাইছি না, আমি চাই না ও আমাকে কাঁদতে দেখুক।আমি সোজাসুজি বললাম,,আমাকে একটু একা থাকতে দিন প্লিজ।”সৌরভ মাথা নেড়ে উঠে দরজা টেনে চলে গেলো।আমি চুপচাপ ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে রইলাম,চোখ দিয়ে বৃষ্টির মতো পানি গাল বেয়ে পড়ছে। জানি না কেনো কাঁদছি,তবে আজ খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে।
________________________________

ভোরের আলো চোখে পড়তেই ঘুম টা ভেঙ্গে যায়।চোখ বন্ধ রেখেই হালকা নড়ে-চড়ে উঠালাম। বুঝতে পারলাম কারো বাহু-বন্ধনে আটকে আছ,চোখ না খুলেই বুঝলাম যে কে।আমি আরো উনার গা ঘেষতে লাগলাম।

—“কী সমস্যা এত নড়াচড়া কেনো করছো?”

—“আপনি জেগে গেছেন?”

–” না,ঘুমিয়ে আছি।”

–“এখনও রেগে আছেন?”

–“না,তো..!!রাগ করবো কেনো?”

–“সরি বলেছি তো।আমি সত্যি ইচ্ছে করে ফ্লোরে ঘুমায় নি। আমি নিজেও জানি না কখন ঘুমিয়ে ছিলাম।”

আসলে বিকালের দিকে কাঁদতে কাঁদতে নিচেই ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম।রাতে যখন উনি এসেছিলেন তখন আমাকে নিচে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে,আর কি?সাহেবের মাথা গরম হয়ে যায়।আমাকে টেনে তুলে বিছানায় নিয়ে যায়,আর পুরো রাত বকতে থাকে।আমি আর উনাকে সৌরভের ব্যাপারে কিছু বলি নি,এমনিতেই উনি রেগে ছিলেন,তারউপর এসব বললে তো আরো রেগে যাবে তাই বলি নি।
আমার ভাবনার মাঝেই উনি বললেন,,
–“না এসব জানবে কী করে?আজকে যে তোমার রেজাল্ট দিবে সেটা জানো?”

রেজাল্টের কথা শুনে আমি চমকে উঠলাম,আমি তো ভুলেই গিয়েছি।

—“সত্যি?”

উনি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাতেই আমি বললাম,,”ওহ,আচ্ছা।পাশ করলেই চলবে।” উনি চোখ বড় করে তাকাতেই আমি হেসে দিলাম।উনি বিরক্তি নিয়ে আমার হাত সরিয়ে ওপর দিকে পাশ করে শুয়ে পড়লেন।আমিও পিছন থেকে উনাকে জড়িয়ে ধরলাম। কিছুক্ষন পর আমি উনার পিঠে আকিবুকি করতে করতে বললাম,,”কালকে সৌরভ এসেছিলো।”

উনি স্বাভাবিকভাবেই বললো,,”কী বলেছে?”

–“ও বলেছে ও নাকি আমায় ভালোবাসে।”

–“তো তুমি কী বলেছো?”

আমি ঠোঁট কামড়ে হাসি আটকে বললাম,,”আমি বলেছি আমিও ভালোবাসি।”

উনি স্বাভাবিকভাবেই বললেন,,”ভালো তো।তারপর?”

আমি অবাক হয়ে বললাম,,”ভালো মানে?আপনার খারাপ লাগে নি?”

–“কেনো,খারাপ কেনো লাগবে?আমি তোমাকে ভালো করেই চিনি। কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যা সেটা ভালোই বুঝি।এখন বলো কী হয়েছে যে কাল কাঁদতে কাঁদতে একদম ফ্লোরেই ঘুমিয়ে গিয়েছো।”
.
.
.
চলবে?