ভুলে যেতে ভালোবাসিনি
পর্ব-১৪(পাওনাদার পার্ট?)
রোকসানা আক্তার
নাতাশা কারণ ছাড়া মানুষকে কখনোই কল করেনা।প্রয়োজন হয় দু-তিনটে কথা সেরে বিদেয় নেয়।বলতে গেলে অনেকটা চাপা মেয়ে নাতাশা।আর নীর তা ভালো করেই জানে।যদিও নাতাশার সাথে তার তেমন মেশা হয়নি, তবুও নীর নাতাশাকে দূর থেকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে।নীর বিবিএ ছাড়াও,মনোবিজ্ঞান নিয়ে সামান্য ঘাটাঘাটি করেছে।তাই মানুষের মনোজগৎ সম্পর্কে তার মোটামুটি ধারণা আছে।
নীরের ভাবনায় আসছে না সে এখন নাতাশাকে কি ভেবে কি বলবে।কিছুক্ষণ পর্যন্ত ফোনের দু’পাশে নিরবতা বিরাজ করে।না নীর শব্দ তুলছে,না নাতাশা!
একটা মুহূর্তে নিরবতার ছেদ ঘটে ফোনের ওপাশ থেকে গম্ভীর কন্ঠস্বর ভেসে আসে নাতাশার।নাতাশা নীরকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,
-যদি সময় হয় তাহলে আমি একটা বিষয়ে কথা বলতে চাচ্ছি!
নীর থমথমে গলায় বলে,
-হু,বলতে পারো।আই হ্যাভ এনাফ টাইম।
-সেদিন রাতে ডিভোর্স ব্যাপারে কথা হয়েছিল।আর, ডিভোর্স সিদ্ধান্তে আমার কোনো দ্বিমত ছিলনা।আমি মেনে নিয়েছি।আপনি হয়তো তা ভালো করেই জানেন।
আর এতদিনের সয়ে যাওয়া ধৈর্য্যের জেদের অবসান ঘটবে।আই হোপ ইউ ক্যান আন্ডার্সটেন্ড দ্যাট।
তাই আমি চাই না কাউকে কষ্ট দিতে,কারো সামনে অসহ্যকর প্রাণী হয়ে বেঁচে থাকতে।ডিভোর্স নিয়ে কথা বলবো বলবো বলে আমার সময় হয়ে উঠেনি।
আসলে,সময়ের অপ্রতুলতা,ফ্যামিলি প্রবলেম এন্ড আদার্স নিয়ে ব্যস্ত সময় কেটেছে।তাই আজ তার ফয়সালার জন্যেই কল দেওয়া।আমি কী বলতে চাচ্ছি আপনি আমার কথা কি বুঝতেছেন?হ্যালো? হ্যালো?
নীর ফোনটা কানের পাশ থেকে সরিয়ে নেয়।আজ অনেক কিছুই নাতাশাকে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, পারছে না।বুক ফাটে, মুখ ফাটে না।দু’কান গরমে লাল হয়ে যায় নীরের।
নাতাশা ওপাশ থেকে হ্যালো হ্যালো শব্দের আওয়াজ তুলতে থাকে।সবকিছু যেন নীরের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।মুখের ভঙ্গিমা ঠিক করে দু’ঠোঁট সামান্য ফাঁক করে।আর ছোট কন্ঠ বলে ফেলে,
-তোমার যা ভালো মনে হয়!
নাতাশা চোখদুটো সরু করে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি মুখে এঁটে।প্রয়োজনে তুমি অনেক দূরে পালিয়ে যাও এবং সবার আড়ালে লুকিয়ে থাকো তবুও কিছু অমানুষের কাছে ধার ঘেঁষবে না।
যে পশুত্ব বিবেক মাথায় বয়ে বেড়ায়,তার হৃদয়ে একবিন্দু মায়ার কণা সৃষ্টি হওয়া অবিশ্বাস্য!
মুহূর্তে নাতাশা ধ্যান থেকে বেরিয়ে আসে।মোবাইলটা বালিশের পাশে রেখে মনে মনে বলে,
-হু,আমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি এটাই ঠিক।কেউ আমার চোখের সামনে চট করে আঙ্গুল তুলে ভুল দেখালেও আমিই ঠিক এবং আমিই সত্য!!
নাতাশার ভাবনা গুলো কিছু মুহূর্ত ভালো,আবার কিছু মুহূর্তে এসে খারাপ হয়ে যায়।সে নিজের মনকে স্থির রাখতে পারছে না।মুখে না বললেও হৃদয় যে নীরের জন্যে একটুখানি হলেও কাঁদে তা নাতাশা বুঝতে পারছে।তবুও,এ থেকে এড়িয়ে চলাই ভালো।কারণ,যে পথ তার জন্যে বিপদ,সেখানের সবকিছুই সঙ্কুলান!
নীর অস্থির মন নিয়ে চেয়ারে মাথা হেলে দেয়ালের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।মন তার আজ অনেক কিছু বলতে চাচ্ছে,শুনতে চাচ্ছে,বুঝতে চাচ্ছে তবে বোঝার মত মানুষটি নেই।পৃথিবী বড়ই নিষ্ঠুর।যখন মানুষটি বুঝে তখন অন্য মানুষটি বুঝে না, আর যখন অন্য মানুষটি বুঝে ততক্ষণে ওই মানুষটি সকল মায়ার বাধন ছিঁড়ে অনেক দূরে চলো যায়।এটাই হলো ভালোবাসার এক নির্মম পরিহাস।
নীর ধ্যানভাঙ্গে কারো কথার আওয়াজে।সামনে তাকিয়ে দেখে অয়ন যে নীরের অনেল পুরনো বন্ধু।নীর ঠিকঠাক হয়ে বসে।আর টানটান কন্ঠস্বরে বলে,
-অয়ন তুই?হঠাৎ আমার অফিসে?
– এখান দিয়ে কাকার দোকানে যাচ্ছিলাম ভাবলাম তোর সাথে একটু দেখা করেই যাই।
-আচ্ছা, আচ্ছা সমস্যা নাই। বস এখানে।
অয়ন সিটে বসে পড়ে।চোখ রাঙ্গিয়ে নীরকে বলে,
-কি নীর তোর বোধহয় মন খারাপ?ভাবীর সাথে ঝগড়া টগড়া হলো নাকি?
-আমি যে বিয়ে করেছি তুই জানিস?
-একটা থাপ্পড় দিই আগে তোকে?
-ক্যান?
-এইযে আমাদের না জানিয়ে বিয়ে করে ফেললি।আর শালা তুই ত চোর একটা।ভাগ্য ভালো ওদিন কি মনে করে আন্টির মোবাইলে কল দিই,দ্যান আন্টির থেকে জানতে পারলাম তুই ম্যারিড!হায় রে পোড়া কপাল!না তোর বিয়ের দাওয়াত ভাগ্যে জুটলো,না আনন্দ।ইস,কত আশা ছিল আমিই একমাএ ব্যক্তি যে কি না তোর বউকে নিয়ে তোর সাথে ভাগ বসাবো।আর শালা…
নীর ফিকে হেসে দেয়।অয়ন তামশার আরো আসর বসাতে থাকে।
-বায় দ্য ওয়ে,ভাবীটা কেমন রে?সুন্দর তো, হুম?
-জানি না।
-কেন জানিস না!ভাবীকে তোর থেকে কেড়ে নিব বলে?ভাবিস না তা।কারণ,মানুষ সব সহ্য করতে পারে,তবে তার বউয়ের ভাগ মোটেও না।
-বাব্বাহ,অভিজ্ঞতা ভালোই ত বটে তোর।তুই-ই প্রশ্ন করিস,আবার তুই-ই উওর করিস।
-হিহিহিহিহি।যাই বলিস না কেন ভাবীকে দেখতে আমার খুব ইচ্ছে হয়েছে।
নীর চুপ হয়ে যায়।নীরের চুপ থাকা দেখে অয়ন নীরের মন খারাপ বুঝতে পারে।চেয়ার ছেড়ে দাড়িয়ে নীরের কাঁধে উবু হয়ে হাত বাড়ায়।মুখে মলীনতা ভাব এনে বলে,
-এই নীর,তোর কিছু হয়েছে?প্লিজজ আমায় বল।আমার মন বলছে নিশ্চয়ই তোর কিছু হয়েছে।কেননা,অন্যান্য দিন থেকে আজ তোকে আলাদা দেখাচ্ছে।একদম আলাদা! আর হাসিখুশি মানুষের মুখে ফুলো ভাবটা বেমানান। প্লিজজ খুলে বল!
নীর অয়নের কথা শুনে খানিক ভরসা পায়।কারণ,মানসিক ব্যথাগুলো হৃদয়ে চেপে রাখা যায় না।নাহলে দগ্ধ হওয়া হৃদয়টা পুড়ে ছাই হয়ে যায়।নীর জোরে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে।ব্যর্থমুখে অয়নের দিকে তাকায়।অয়ন নীরের বামকাঁধ আরো জোরে চেপে ধরে ভরসার হাত বাড়ায়।এই ভরসার হাতটি বলে–
কষ্ট পাস না,খুলে বল আমায়।
আমি আছি ত তোর সাথে, এইযে সবসময়।
তারপর নীর অয়নকে সবটা খুলে বলে।
এদিক দিয়ে,রুব্বান বার বার নাতাশার রুমে এসে উঁকি দিয়ে যায়।নাতাশা বিছানা ছেড়ে উঠছে না।সেই যে দুপুরের দিকে নিজ ঘরে ঢুকে পড়েছে, এখনো বেরুবার জো নাই।নাতাশার মা-বাবা,নিদ এবং নিতু এসেও ঘরে ঘুরে যায়।তবুও নাতাশা বিছানার উপর শরীরটা ছড়িয়ে শুয়ে আছে।
রুব্বান একগাদা বিরক্তি নিয়ে সামনের বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। নাতাশার মাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-খালা?এই নাতুটার হইলো ডা কি?ওরেহ আমি এত্তবার ডাকলাম,ওতো আধমরার মত হুইয়া রইছে।শরীল-টরীল খারাপ নাকি খালা?
-বুঝতেছি না রুব্বান।ডাক্তার আনার জন্যে তোর খালুকে পাঠাইছি।দেখি ডাক্তার এসে কি বলে।
-হ খালা ওইডাই।
সন্ধের নাতাশার বাবা ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরে। ডাক্তার নাতাশার টেম্পারেচার, প্রেশার মাপেন।সবকিছুই স্বাভাবিক আছে।তবে,এত রোগা রোগা দেখাচ্ছে কেন ডাক্তার তার কূল খুঁজে পাচ্ছেন না।অতঃপর ডাক্তার নাতাশাকে স্যাম্পেথিক কিছু ওষুধ দিয়ে যায়, যাতে মাথাঘুরা কমে এবং পর্যাপ্ত ঘুম হয়।
ডাক্তার চলে যাওয়ার পর রুব্বান নাতাশার হাত চেপে পাশে বসে।খরখর গলায় বলে,
-এই নাতু?হটাৎ-এ তোর হইলো ডা কিরে?তুই এত অসুস্থ হইয়া গেলি ক্যান।
নাতাশার দৃষ্টি নিচের বিছানার চাদরের দিকে।রুব্বানের কথায় কোনো রকম জবাব তুলছে না।নাতাশার মা রুব্বানকে ডেকে অন্যঘরে নিয়ে যান।
-ক্যান ডাকলা খালা?
নাতাশার মা রুব্বানের কানের কাছে মাথা গুঁজে ফিসফিস করে বলেন,
-এই রুবু?নাতাশাকে আবার বাতাস ভর করলো নাতো?
-কই থাইকা করবো খালা?
-ও কাইল ওসমান গণির দোকানে গিয়েছিল। আর তুই ত জানিস-ই ওসমান গণির দোকানে যাওয়ার পথে মস্ত বড় একটা কড়াই গাছ পড়ে।লোকমুখে শোনা ওইটাতে নাকি সাত মাথাওয়ালা ভূত থাকে। নাকি ওই ভূতটাই আমার মেয়ের শরীরের উপর ভর করছে।
এ বলে নাতাশার মা আঁচলে মুখ গুঁজে কেঁদে দেন।
-আরেহ খালা কাইন্দেন না।এহন কাইন্দা কোনো লাভ নাই।দেরী কইরা ফালাইলে আমগো নাতুর উপর ওই সাত টাক্কু আরো ভর দিয়া বসবো।পরে নাতুরে বাছান যাইবো নাএহন যেইডা করলে এই বালা দূর করন যাইবো, ওইডা করন লাগবো।বেশি দেরী করন যাইবো না.।
নাতাশার মা তড়িঘড়ি চোখমুছে বলেন,
-হ্যাঁ,হ্যাঁ তুই ঠিক বললি।আচ্ছা,আমি তোর খালুরে দরবেশ কালা মিয়ার কাছে পাঠাই পানিপড়ার জন্যে।উনার পানি পড়া অনেক ওস্তাদি। একবার গাঁয়ে ছিটালেই ওই ভূত দৌড়ে পালাবে।
-আচ্ছা খালা,আচ্ছা। তাড়াতাড়ি খালুরে পাঠান।
নাতাশার মা কাপড়ের আঁচল মাথায় টেনে নাতাশার বাবার ঘরের দিকে যায়।
চলবে…….
(বায় দ্য ওয়ে,বর্তমানে ভূত-প্রেতে বিশ্বাস এখনো অনেক মানুষ।তারা প্রাচীন রীতিতে এখনো স্বাভাবিক রোগকে অস্বাভাবিক দেখলে অলৌকিকে টেনে আনেন।)