#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা
৪
🌸
“না না। পায়ে হাত দিবেন না।”
ওর বাধা পেয়ে জায়িন শান্ত অথচ শাসন মাখানো দৃষ্টিতে তাকাল। লোকটা তার থেকে কত বড়। উনি পায়ে হাত দিলে মীরার পাপ হবে। তার থেকে বড় কথা অস্বস্তি লাগবে। মুবিন বলল,
“পায়ে হাত না দিলে চিকিৎসা কীভাবে করবে মীরা? ব্লিডিং অফ করতে হবে না? ভাইয়াকে দেখতে দাও।”
মীরা আর আপত্তি জানাতে পারল না। জায়িন দক্ষ হাতে ফার্স্টএইড বক্স থেকে জিনিসপত্র বের করে তুলো নিয়ে রক্ত মুছে জায়গাটা পরিষ্কার করে দিচ্ছে। মীরা একটু একটু ব্যথা পেলেও দাঁত কিড়মিড় করে সহ্য করে নিল। কিন্তু কী একটা মলম লাগাতেই অস্যহ রকম জ্বলে উঠল। মীরা অস্ফুটস্বরে ব্যথিত শব্দ করে উঠল। জায়িন মলম লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে মুবিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“পানি নিয়ে আয়।”
মুবিন বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল,
“হাত ধুবে?”
জায়িন কঠিন চোখে তাকিয়ে বলল,
“গ্লাস দিয়ে পানি আন।”
মুবিন পানি নিয়ে এলে জায়িন মীরার সাথে একটা ট্যাবলেট ধরিয়ে দিয়ে খেতে বলল। মীরা ভেবে পেল না কিসের ঔষধ এটা। উনি কি পুরোপুরি ডাক্তার? ভুলভাল ঔষধ খেয়ে মরতে চায় না সে। জায়িন হয়তো মীরার মনের কথা বুঝেছে। সে বলল,
“পেইন কিলার। ব্যথা কমে যাবে।”
মীরা নিঃশব্দে পেইন কিলার খেয়ে নিল। জায়িন ঘরে চলে গেছে। মুবিন এসে মীরার পাশে বসল। এতক্ষণেও আন্টির দেখা না পেয়ে মীরা জিজ্ঞেস করল,
“আন্টি কোথায় মুবিন ভাই?”
“মা আজ সকালেই খালামুনির বাসায় গেছে। রাতে চলে আসবে মনে হয়।”
“ওহ।”
“তুমি কি এখন পড়বে?”
“পড়তেই তো এসেছিলাম।”
“আচ্ছা তাহলে অল্প পড়ে যাও। ব্যথা নিয়ে পড়ায় মনোযোগ বসবে না। কিন্তু সামনে পরীক্ষা। আজ বরং এখানেই পড়ি আমরা কেমন?”
“হুম।”
মীরা ব্যাগ খুলে বইপত্র বের করল। পড়ার ফাঁকেও তার চোখ অনেক বারই জায়িনের রুমের দিকে চলে গেছে। লোকটা যে সেই কখন রুমে ঢুকেছে। একবার বাইরে আসবে তো দূর একটু শব্দও পাওয়া যাচ্ছে না। যেন বাসায় তৃতীয় কোন ব্যক্তি নেই। এমন নিঃশব্দে কীভাবে থাকে মানুষ? মীরা বাড়িতে থাকলে হৈচৈ করে বাড়ি মাথায় তুলে রাখে। পড়ার ফাঁকে মীরা জিজ্ঞেস করল,
“মুবিন ভাই, উনি কিসের ডাক্তার?”
মুবিন বই থেকে চোখ তুলে হেসে বলল,
“এখনও ডাক্তার হয়নি। পড়ছে। আরও এক বছর লাগবে।”
“ওহ।” মীরা মনে মনে ভাবল ডাক্তার না হয়েই এত ভালো চিকিৎসা করেছে। ডাক্তারি ডিগ্রী নিয়ে বেরুলে একটা রোগীকেও অসুস্থ থাকতে দিবে না।
মীরার পড়া শেষ। আজ অল্পই পড়েছে। পায়ের ব্যথা টের পাওয়া যাচ্ছে না তবুও মুবিন বলল,
“তুমি একা যেতে পারবে না। আমি বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসি।”
মীরা আর না করলো না। মুবিন ভাইয়ের উপর তার দুর্বলতা আছে। মানুষটাকে দেখলেই কেমন ভালোলাগা কাজ করে।
“তুমি বসো। আমি রুম থেকে বাইকের চাবি নিয়ে আসি।”
মুবিন মীরাকে নিয়ে বেরুবার আগে ভাইকে ডেকে বলল,
“ভাইয়া আমি মীরাকে পৌঁছে দিয়ে আসি। তুমি দরজা লাগিয়ে নিও।”
সিঁড়ি ভেঙে নামবার সময় মুবিন মীরার হাত ধরে নামতে সাহায্য করলো। মুবিন ভাই জাস্ট তার হাতটা ধরেছে। এতেই মীরার মনের বাগানে লাল নীল প্রজাপতিরা পাখা ঝাপটিয়ে উড়াউড়ি করতে শুরু করে দিল। ওরা গেটের কাছে এসে দেখল আগে থেকেই একটা রিকশা দাঁড়িয়ে আছে। মুবিন দারোয়ান চাচাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন,
“জায়িন বাবাই তো বললো মীরা বাড়ি যাবার সময় যেন রিকশা ডেকে দিই। পায়ে ব্যথা নিয়া ও তো হাঁটতে পারব না।”
রিকশা অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এখন তাড়িয়েও দেওয়া যাবে না। মুবিন মীরাকে বলল,
“তুমি রিকশায় উঠে যাও। আমি নাহয় বাইকে পেছনে আসছি।”
মীরা কতকিছু ভেবে বসেছিল। বাইকে মুবিন ভাইয়ের পেছনে বসে যাবে। আহা, তার সব স্বপ্নে ওই লোকটায় এক বালতি ঠান্ডা পানি ফেলে দিল। কে বলেছিল উনাকে মীরার জন্য এতো চিন্তা করতে? মীরা রিকশায় উঠে পড়ল। মুবিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনাকে কষ্ট করে আসতে হবে না ভাইয়া। রিকশা তো আমাদের গেটের সামনেই যাবে।”
“তুমি যেতে পারবে?”
“হুম।”
“শিওর?”
“হ্যাঁ।”
রিকশায় বসেও মীরা ওই লোকটার উদ্দেশ্যে কতক্ষণ গালাগালি করতে লাগল। এমন একটা রাক্ষস বড় ভাই থাকলে মুবিন ভাইয়ের এই জন্মে প্রেম করা হয়েছে! মীরা বাড়ির সামনে নেমে ভাড়া দিতে চাইলে রিকশা ওয়ালা বলল ভাড়া নাকি দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কে দিয়েছে জিজ্ঞেস করতে লোকটা জায়িনের কথা বলল। মীরার রাগ হলো। একদিনে এত সাহায্য নেওয়া যাচ্ছে না। লোকটা তার রিকশা ভাড়া দিতে গেল কোন দুঃখে?
“টাকা বেশি হয়েছে। সমস্যা নেই। আপনার দাবি আমি রাখব না। সব দাবি চুকিয়ে দেব।”
খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে মীরা সদরদরজায় পা রাখতেই রুমশি ছুটে এসে মীরার উপর আক্রমণ চালালো। মীরা প্রাইভেট পড়ে আসার সময় প্রতিদিন রুশমির জন্য চকলেট নিয়ে আসে। আজও চকলেটের লোভে রুমশি আপুকে জড়িয়ে ধরল। ওরা চলে এসেছে মীরা জানত না। প্রাইভেটে যাওয়ার আগেও দেখে গেছে এখনও আসেনি।
রুমশি তোতলা তোতলা কন্ঠে বলল,
“আপু আমাল চকলেত। চকলেত এনেচ?”
মীরা ঝুঁকে রুমশিকে কোলে নিয়ে গালে চুমু খেয়ে বলল,
“তোরা চলে এসেছিস এটা তো আমি জানতাম না বোনু। সরি।”
রুশমি মন খারাপ করে বলল,
“চকলেত আনোনি?”
“কাল এনে দিব প্রমিজ।”
রুমশিকে কোলে নিয়ে হাঁটতে গিয়ে পায়ের ব্যথাটা টের পেলো। মীরা পায়ে ব্যথা পেয়েছে এই কথাটা সন্ধ্যায় জানাজানি হলো। পুরো দুইটা দিন পর আজ তার রুমে আড্ডা বসেছে। আবির ভাই এত এত খাবার নিয়ে এসেছে। আজ লেট নাইট মুভি দেখা হবে। আবির ভাই ভুল করে মীরার পায়ের উপর বসে পড়েছিল। মীরা ব্যথার ককিয়ে উঠলে আবির ভাই দেখতে পেল। সাথে সাথে চিৎকার চেঁচামেচি করে সবাইকে জানিয়ে দিল। ছোট চাচী, বড় মা এসে মীরাকে বকাবকি করে গেল। কেন ওদের জানাল না। মীরা শত বলেও কাউকে বোঝাতে পারল না।
“আমার কিছু হয়নি। সত্যি বলছি। এখন আর ব্যথা নেই।”
আবির জায়িনকে চেনে। ওরা এক সাথেই পড়েছে। এখনও বন্ধু। আবির গর্ব করে বলল,
“আমার বন্ধু চিকিৎসা করেছে ব্যথা থাকবে কীভাবে বল। দেখতে হবে না বন্ধুটা কার।”
তনি মুখ ভেঙচি দিয়ে বলেছে,
“এত বন্ধুর প্রশংসা করতে হবে না। নিজে তো ডাক্তার হতে পারলে না।”
“সবাই ডাক্তার হলে আর্মি কে হবে বল? তোর বাপের তো আবার আর্মি ছেলে পছন্দ।”
মীরা সব জেনেও কিছুই না জানার ভান করে ওদের সামনে গাধা সেজে রইল। আড়ালে মুখ টিপে হাসল। ওহ তাহলে এই ব্যাপার! চাচ্চু আর্মি ছেলে পছন্দ করে বলেই আবির ভাই তার বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে আর্মি হতে চাচ্ছে! আহা হা, কী ভালোবাসা দেখেছ! প্রেমিকার জন্য সব করতে রাজি। মাহি গাধীকে কালই এই কথাটা জানাতে হবে। আজ আর পড়া হলো না। সবাই ইভান ভাইয়ের অপেক্ষায় ছিল। ইভান ভাই বাড়ি ফিরেই মুভি ছেড়ে বসল। আজকে হরর মুভি দেখবে সবাই। মীরা শুরুর দিকে ভয় পেয়ে পেয়ে একটু দেখলেও যখন ভূতটা সামনে এলো তখন আর চোখ খোলা রাখতে পারল না। রুমশি ভয়ে কাঁদতে লাগলে ওকে চাচীর কাছে দিয়ে আসা হলো। মীরা তনি আপুকে খামচে ধরে কতক্ষণ পর্দার দিকে তাকিয়ে মুভি চলাকালীনই ঘুমিয়ে পড়ল। মুভি শেষ করে ওরা কখন ওর রুম থেকে গেল বলতেই পারল না।
🌸
মাহিমা মীরাকে নিতে এসে শুনলো মীরা পায়ে ব্যথা পেয়েছে। সে বিরক্তি নিয়ে মীরার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ল্যাংড়া লুলার মতো যেখানে সেখানে পড়ে যাস কেন? আমার মামারা যে এত খাওয়ায় ওসব যায় কই শুনি?”
পরীক্ষার জন্য মাহিমা এতদিন তাদের বাড়ি আসেনি। তার একটা রোগ আছে। মামার বাড়ি এলে আর যেতে মন চায় না। তাই পরীক্ষা শেষ করে একেবারে চলে আসবে। দুই মামীই মাহিমাকে পছন্দ করে। সে মীরার উদ্দেশ্যে বকবক করেই যাচ্ছে। বড় মামী এসে বলল,
“কইতরি এতদিন কই ছিল? মামা মামীদের ভুলে গিয়েছিল নাকি?”
“ইচ্ছে করে ভুলিনি গো মামী। পরীক্ষা ভুলিয়ে দিয়েছে।”
“বাবাহ! মেয়ে পড়ায় ভীষণ মনোযোগ দিয়েছে বোঝা যাচ্ছে।”
“ভালো রেজাল্ট দিয়ে তোমাদের মুখ উজ্জ্বল করতে হবে তো। আজকাল ফেয়ার এন্ড লাভলী ব্যবহার করে মুখ উজ্জ্বল হয় না।”
মাহিমার কথা শুনে মীরা খিলখিলিয়ে হাসতে লাগল। বড় মামী খাবার নিয়ে এসেছে। মাহিমা তাড়াতাড়ি করে বাড়ি থেকে খেয়ে এসেছে। কিন্তু মামী এখন তাকে না খাইয়ে ছাড়বে না। এটাও খুব ভালো করে জানে। মাহিমা, মীরা একসাথে খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। গেটের সামনে থেকে রিকশায় উঠে মাহিমা জিজ্ঞেস করল,
“ব্যথা পেয়েছিস কীভাবে?”
“প্রাইভেট পড়তে গিয়ে। শোন না। তুই কি একটা কথা জানিস?”
“কোন কথাটা বল তো?”
“আবির ভাইয়া চাচ্চুকে খুশি করতে আর্মি জব নিতে চাচ্ছে।”
“এটা আর নতুন কি? হবু শ্বশুরের পেয়ারের জামাই বাবাজী।”
ওরা রিকশা দিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তার পাশের একটা দোকানে মুবিন ভাইকে দেখতে পেল। মুবিন ভাইও মনে হয় ওদেরকে দেখেছে। মাহিমা মুবিন ভাইকে দেখে সন্দেহের চোখে মীরার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“মুবিন ভাই আর তোর মধ্যে কি কিছু চলছে মীরা?”
চলবে_
#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা
৫
🌸
মাহিমার কথা শুনে মীরা বিষম খেয়ে উঠল। সে মুবিন ভাইকে মনে মনে পছন্দ করে। কিন্তু এই পছন্দ এতটা গুরুতর না। মীরা রাগ দেখিয়ে বলল,
“মাহি! বাজে কথা বলবি না।”
“বাজে কথা কি? আমরা কোচিং-এ যাবার সময় প্রায়ই মুবিন ভাইকে এদিকে দেখা যায়। হ্যাঁ মানলাম উনার বাড়িও এই এলাকাতেই। একদিন দুদিন দেখা হতেই পারে। তাই বলে এভাবে প্রতিদিন তো আর কো ইন্সিডেন্স মানা যায় না। আমার মনে হয় উনি ইচ্ছে করে আমরা কোচিংয়ে যাবার সময় এখানে বসে থাকেন।”
“কিন্তু উনি যে আমার জন্যই বসে থাকেন এটা তোকে কে বলেছে?”
“এই সহজ কথাটা বলতে হবে কেন? তুই উনার কাছে প্রাইভেট পড়িস। উনি তোকে চেনে। তোর জন্য বসে না থেকে কি তাহলে আমার জন্য বসে থাকবে?”
“হু। কিন্তু মুবিন ভাই আমাকে কোনদিন ইশারা ইঙ্গিতেও এমন কিছু বোঝাননি। উনি অনেক ভালো।”
“তোর চোখে পৃথিবীর সবাই ভালো বোন। আসলে তুই-ই যে ভীষণ ভালো। তাই কাউকে খারাপ মনে হয় না।”
কোচিং শেষে ফেরার সময় মীরা মাহিমাকে চেপে ধরল,
“চল না হসপিটালে গিয়ে ওজনটা মাপিয়ে আসি।”
মাহিমা বিরক্ত হয়ে বলল,
“হঠাৎ তোর ওজন মাপানোর কিড়া মাথায় নাচছে কেন?”
“নাইনে উঠে মেপেছিলাম। এখন কত হবো জানি না তো।”
“জেনে কি করবি? কার কোলে উঠবি?”
কোলে উঠবি কথা শুনেই মীরার ওই ঘটনা মনে পড়ে গেল। সে জায়িন ভাইয়ের কোলে উঠেছে চিন্তা করেই কান, গাল গরম হয়ে উঠল।
“দূর বাজে বকিস কেন?”
“ওজন মাপতে হবে না৷ আমি তোকে দেখেই ওজন বলে দিচ্ছি। কম করে হলেও পঞ্চাশ কেজি হবি।”
মীরা প্রতিবাদ করে বলে উঠল,
“এত বেশি! জীবনেও না। আমাকে কি তোর কুমড়োপটাশ মনে হয়। ত্রিশ, পয়ত্রিশ হবো।”
“তাহলে তো জানিসই কত হবি। আর ওজন মাপতে হবে না বোন।”
মাহিমা বাড়ি চলে যেতে চাইলে মীরা জোর করে মাহিমাকে ওদের বাড়িতে নিয়ে এসেছে। মাহিমারও আসার ইচ্ছে ছিল। শুধু পরীক্ষাটা জীবনের সুখ শান্তি কেড়ে নিয়েছে। দুপুরে খেয়েদেয়ে দুই বোন একসাথে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। মাহিমা জিজ্ঞেস করল,
“ধর মুবিন ভাই তোকে পছন্দ করেছে। তুই কি তখন রাজি হবি?”
“না। এটা কি আমার প্রেম করার বয়স? বাবা, চাচ্চুরা জানতে পারলে অনেক কষ্ট পাবে।”
“তাহলে কি করবি? উনাকে ফিরিয়ে দিবি?”
“আমার জন্য অপেক্ষা করতে বলব। ভার্সিটিতে ওঠার পর প্রেম করব। তখন আমরা প্রেমের মানেটাও ঠিকঠাক বুঝতে পারব।”
“তুই মহান বোন! ধরবিও না। পুরোপুরি ছেড়েও দিবি না। ঝুলিয়ে রাখবি।”
“আমি কি উনাকে জোর করব। তার বুঝে না হলে অন্য মেয়েদের সাথে প্রেম করুক। আমার কোন আপত্তি নেই। তাকে না পেলে আমি মরে যাব এমন কোন ব্যাপারই না।”
রুশমি এসে কোলে ওঠার জন্য বিরক্ত করলে মাহিমা এক ধমক দিল। মীরা মাহিমাকে ধমক দিলে সে বলল,
” আজকালকার বাচ্চা গুলা এত বেয়াদব হয়েছে কেন? খালি কোলে উঠতে চায়। ওই তোর বাপে আমারে খাওয়ায়? তোরে কেন কোলে নিমু আমি?”
মীরা ওর কথা শুনে হাসতে লাগলে মাহিমা মাথায় চাটি মারল। মীরা রুশমিকে কোলে নিলে রুশমি তোতলা কন্ঠে বলল,
“মাহি আপু পতা(পঁচা)। আলি আলি(আড়ি)।”
দুপুরটা ঘুমিয়ে কেটে বিকেলে মীরার সাথেই বেরিয়ে পড়ল মাহিমা। রাতে ভাইয়া এলে ওর সাথেও যাওয়া যেত। কিন্তু তখন আর রাতে পড়া হতো না। হাঁটতে হাঁটতে মীরা বলল,
“পরীক্ষার পর কোথায় ঘুরতে যাবি ঠিক করেছিস?”
“প্রথমে খালামুনির ওখানে যাব। পুরো সিলেট ঘুরে তারপর ফিরব। পরেও হাতে অনেক সময় থাকবে। তখন ভেবে দেখব আর কোথায় যাওয়া যায়।”
“আমি যেভাবেই হোক এবার কক্সবাজার যাবোই যাব। জীবনে যাইনি।”
“আমিও না।”
বলেই দু’জন একসাথে হাসতে লাগল। কত প্ল্যান করে রেখেছে ওরা। পরীক্ষার পর কতকিছু করবে। দু’জন এক কলেজে এডমিশন নিবে। একই ভার্সিটিতে পড়বে। এমনকি এক বাড়ির দুই ছেলেকে বিয়ে করে সারাজীবন একসাথে থেকে যাবে এটাও ভেবে রেখেছে।
“মুবিন ভাইয়ের না একটা বড় ভাই আছে।”
মীরা রাস্তার পাশে সুন্দর একটা বাড়ির ফুল গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে হাঁটছিল। মাহিমার কথা কানে যেতে মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“ওই বদমেজাজি কাউয়ার সাথে নিরীহ কইতরির কিছুই হবে না।”
“দূর এজন্য জিজ্ঞেস করছি না। মুবিন ভাইকে তো দেখেছি। কিন্তু উনার বড় ভাইকে কোনদিন দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।”
“আমিও প্রথম দিন দেখে চিনতে পারিনি। উনি তো বাড়িতে থাকেন না। বেশি সময় ঢাকা থাকেন।
“পরেও আমরা এক এলাকার তো। এলাকার একটা ছেলেকে চিনি না এটা কেমন কথা?”
“আমরা ডিম থেকে ফুটে বের হওয়ার আগে উনি এলাকা ছেড়েছেন। কীভাবে চিনব বল তো?”
“আচ্ছা বাদ দে। উনারে চিনে আমাদের কাজ নেই।”
মীরা মুবিন ভাইয়ের কাছে পড়া শেষ করে আন্টির কাছে জানতে পারল জায়িন ভাই কাল চলে গেছে। উনাকে রিকশা ভাড়ার টাকাটা দেওয়া হয়নি। আর একটা ধন্যবাদ বলাও বাকি ছিল। আচ্ছা পরের বার বাড়ি এলে টাকা ধন্যবাদ দু’টোই একসাথে দেওয়া যাবে।
🌸
পরীক্ষার দিনগুলো মীরা নিজের ঘর ছাড়া বারান্দায়ও আসেনি। পুরোটা সময় টেবিলে বসে ছিল। আর নয়তো ঘুমিয়েছে। ভাইবোনদের আড্ডা বিহীন সেই কষ্টের দিনগুলো পার হয়েছে। এবার সে মুক্ত পাখি। আর কোন বাধা নেই। যতক্ষণ খুশি ঘুমোতে পারবে। যেখানে খুশি যেতে পারবে। শেষ পরীক্ষার দিনই মাহিমা ব্যাগপত্র গুছিয়ে মামার বাড়ি চলে এসেছে। মীরা মাহিমা দু’জন ইভান ভাইয়ের ঘরে গিয়ে লাউড স্পিকারে মিউজিক চালিয়ে বেডের উপর উঠে লাফাচ্ছে। যতক্ষণ পা ব্যথা না হয়েছে ততক্ষণ নেচেছে। ক্লান্ত হয়ে ধপাস করে শুয়ে পড়ে মীরা বলল,
“বড় ফুপুর বাসায় আমাদের কে দিয়ে আসবে? ছোট চাচ্চুকে বলব?”
“তোদের বাড়িতে আমাকে বেড়াতে দিবি না? অন্তত এক সপ্তাহ এখানে থাকি।”
“থাক তুই। তোকে না করেছে কেউ?”
“তুই তো খালামনির বাসায় যাওয়ার কথা বলছিস। যাব রে যাব। একটু সবুর কর।”
🌸
দুই দিন বাড়িতে ঘুমানোর পর তিন দিনের মাথায় নিজেরাই বিরক্ত হয়ে উঠল। আগে ভেবেছিল পরীক্ষার পর ঘুমিয়ে দিন পার করবে। এখন মনে হচ্ছে বাড়িতে কিছুতেই সময় কাটছে না। ছোট চাচ্চুকে ধরে অনেক রিকোয়েস্ট করে রাজি করিয়েছে ওদের ট্রেনে সিলেট নিয়ে যেতে হবে। কারণ এর আগে কেউই ট্রেনে উঠেনি। ছোট চাচ্চু রাজিও হয়েছিল। কিন্তু বাঁধ সাধলো তাদের বান্ধবী রিমু। রিমুর জন্মদিন। অনেক বড় করে পার্টি করবে। বান্ধবী কেউ একজনও না গেলে কেক কাটবে না। এ কি মুসিবত। রিমু কলে প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলেছে,
“স্কুল জীবন শেষ করে এখন কি ফ্রেন্ডশিপ ভুলে যাবি? বলেছিলি সারাজীবন ফ্রেন্ড থাকবি। এখন তো এক সপ্তাহও যায়নি ভুলে গেছিস আমাকে।”
ওর কান্নাকাটি দেখে মাহিমা মীরা ঠিক করল আচ্ছা সিলেট তাহলে দুইটা দিন পরেই যাই।
সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে দুই বান্দরকে শান্ত থাকতে দেখে ইভান জিজ্ঞেস করল,
“কি গো বইনেরা, আমনেরা সিলেট যাইবেন না?”
দু’জনই একসাথে নাবোধক মাথা নাড়ল। ইভান অবাক হওয়ার ভান করে মুখে হাত দিয়ে বলল,
“কেন গো?”
মীরা টোস্টে কামড় দিতে দিতে বলল,
“আমাদের ফ্রেন্ডের জন্মদিন ইভান ভাই। জন্মদিন খেয়ে পড়ে যাব।”
ইভান হাসতে হাসতে বলল,
“জন্মদিন খায় কেমনে রে রাক্ষস? বল কেক খেয়ে যাব।”
মাহিমা তার প্লেট থেকে সেদ্ধ ডিমটা টুক করে ইভান ভাইয়ের প্লেটে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
“ছোট মামী দেখার আগে টুপ করে খেয়ে ফেলো না। নইলে ছোট মামী ঠেলেঠুসে আমাকে ডিম খাওয়াবে। ইয়াক।”
আস্ত ডিমটা মুখে পুরে দিয়ে মুখ ভরে চিবোতে চিবোতে ইভান বলল,
” বান্ধবীর জন্মদিনের গিফট কেনা শেষ?”
মীরা জবাব দিল,
“না।”
“কার সাথে যাবি? মন চাইলে আমার সাথে চলতে পারিস। পিচ্চি পিচ্চি বোন বলে শুধু দয়া দেখাচ্ছি।”
“তুমি নিয়ে যাবে!”
মীরা মাহিমা দু’জনই খুশি হয়ে ইভান ভাইকে জড়িয়ে ধরল। মাহিমা বলল,
“ইভান ভাই তুমি জানো তুমি কত ভালো! আমার নিজের ভাইয়ের থেকেও ভালো। আমার ডিম আমি রোজ তোমাকে দিয়ে দিব।”
“তোমার ডিম আমি খামু না আপা। মুরগির ডিম খামু।”
ইভান এদের পাগলামি দেখে হাসছে। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে এসেছে তবুও এদের বাচ্চামি কমলো না।
গিফট কিনতে গিয়ে আরেকটা ঘটনা ঘটলো। অনেকদিন পর মুবিন ভাইয়ের সাথে দেখা হয়ে গেল। মুবিনকে দেখেই মাহিমা মীরাকে কনুই দিয়ে ধাক্কা দিল। মীরা রেগেমেগে তাকাল। ওদের দেখে মুবিন নিজেই এগিয়ে এলো। ইভানকে দেখে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“কেমন আছেন ভাইয়া?”
“আরে মুবিন নাকি! কতদিন পর দেখা। আমাদের ওদিকে যাস না কেন? কী করছিস এখানে?”
“কিছু কেনাকাটা করতে এসেছি।”
“ওহ। মাঝে মধ্যে সময় পেলে আমাদের বাড়িতে যাস। এখন তো আর যাসই না।”
“সময় হয়ে উঠে না ভাইয়া।”
মুবিন মীরার দিকে তাকিয়ে সামান্য হেসে বলল,
“পরীক্ষা কেমন হয়েছে?”
“ভালো।”
“শুধু ভালো? এ প্লাস আসবে তো?”
“ইনশাআল্লাহ ভাইয়া।”
“আম্মু তোমার কথা মনে করে। আমাদের বাড়িতে যেও।”
ইভান আর মুবিন কথা বলতে বলতে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। মাহিমা পেছন থেকে মীরার হাত টেনে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
“আম্মু মনে করে? নাকি দুলাভাই নিজে মিস করে।”
মীরা চোখ মুখ গরম করে মাহিমার দিকে ফিরল। চাপা শাসন করে বলল,
“দুলাভাই কাকে বলছিস? উনার সাথে কি আমার বিয়ে হয়েছে। বেশি পকপক করবি তো উনার সাথে তোর বিয়ে দিয়ে দিব।”
ইভান মুবিনকে জিজ্ঞেস করছে,
“জায়িন কি বাড়ি আসে না?”
চলবে…