মন নিয়ে কাছাকাছি পর্ব-৬+৭

0
471

#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা

🌸

এক দোকানের সামনে বিশাল বড় একটা টেডিবিয়ার দেখে মীরা দাঁড়িয়ে পড়ল। ইভানকে ডেকে জানাল এই দোকানে যাবে। ইভান মুবিনকে বিদায় দিয়ে ওদের সাথে এসে দোকানে ঢুকলো। দু’জনই এই টেডিবিয়ারটা নিবে ইভান এদের ছেলেমানুষী দেখে হাসবে না কাঁদবে ভুলে গেছে। এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে ফেলেছে এমন একটা মেয়েকে তারা জন্মদিনে টেডিবিয়ার গিফট করতে চাচ্ছে। ইভান দুইটাকে ধমকে অন্য কিছু নিতে বলল। মাহিমা বলল,

“টেডিবিয়ার দিলে সমস্যা কি ভাইয়া? রিমুর তো টেডিবিয়ার পছন্দ।”

“সমস্যা কিছু না। লোকে তোদের গাধা বলবে। আর আমাদের বংশকে কিপ্টা বলবে।”

মীরা মনোক্ষুণ্ণ হয়ে বলল,

“গিফট কি দাম দেখে দেয় মানুষ? পছন্দ হওয়াটা বড় কথা।”

“বোনেরা আমার তোদের যা খুশি নে। তবে তাড়াতাড়ি কর।”

মাহিমা মীরা নিজেদের দিকে তাকিয়ে শয়তানি হাসি দিল। ইভান ভাইকে সহজে পাওয়া যায় না। পুরো সপ্তাহ অফিস করে। এক শুক্রবারের দিন একটু বাড়ি থাকে। আজ যখন পেয়েছে তাহলে এত সহজে ছাড়বে না। ইভানের তাড়া থাকলেও বোনদের আবদার মিটাতে হলো। গিফট কিনা শেষে আইসক্রিম খেল। মাহিমা মীরার জোড়াজুড়িতে ওকেও খেতে হলো।

“তোরা কি আমাকে বাচ্চা পেয়েছিস! তোদের সাথে এখন আমার আইসক্রিম খেতে হবে!”

“আইসক্রিম ফ্যাক্টরির মালিক কি আইসক্রিম বানানোর সময় বলে দিয়েছে এটা শুধু বাচ্চারাই খাবে। বড়রা খেলে জরিমানা হবে।”

মীরা কথা শেষ করলে মাহিমা বলল,

“আর আমরা বাচ্চা না। এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে ফেলেছি। কয়দিন পর কলেজে যাব।”

ইভান ওদের কথা শুনে হাসতে হাসতে বলল,

“না তোরা বাচ্চা হতে যাবি কেন? তোরা তো বুড়ি। আমার দাদী নানী।”

🌸

জন্মদিনের পার্টিতে কী পরে যাবে এটা নিয়ে দুপুর থেকে ভাবছে। তবুও এখনও কিছু ঠিক করে উঠতে পারছে না। মীরা আলমারির সব কাপড় নামিয়ে বেডের উপর রেখে বসে আছে। রুশমি কাপড়চোপড় এলোমেলো করছে। ফ্লোরে ফেলছে। মাহিমা গালে হাত দিয়ে বলল,

“কতদিন ধরে শপিং করি না! একটা নতুন কাপড়ও নেই।”

“আমার তো পুরান কাপড়ও নেই।”

তনি রুমে ঢুকে রুমের এই অবস্থা দেখে হতাশ হয়ে কতক্ষণ দুই গাধার দিকে তাকিয়ে রইল। ফ্লোরে পড়ে থাকা কাপড় পা দিয়ে সরিয়ে ভেতরে ঢুকলো।

“তোরা দুই জঙ্গল ঘরটাকে জঙ্গলে পরিণত করেছিস কেন?”

মীরা মাহিমা দু’জনই তনি আপুর দিকে তাকাল। মাহিমা গালে হাত দিয়ে বসে মন খারাপ করা গলায় বলল,

“আমাদের কোন ড্রেস নেই আপু।”

তনি চোখ ঘুরিয়ে পুরো রুমটা দেখে নিল। বিছানা, মেঝেতে কাপড়ের ছড়াছড়ি। তবুও এরা বলছে কাপড় নেই! তনি চোখ বড়ো বড়ো করে বলল,

“এতগুলো তো কাপড় না৷ গাছের ছাল। আদিম যুগের মানুষের মতো তোদের এখন গাছের ছাল পরিয়েই রাখা উচিত। না শোকর বান্দা।”

এদের ঘ্যানঘ্যান শুনে তনি আপু শাড়ি পরার আইডি দিল। শাড়িতে কেউই অভ্যস্ত না। কিন্তু শখও তো কম না। দু’জনই নাচতে নাচতে রাজি হয়ে গেল। কিন্তু সমস্যা একটা। দু’জনের কারোরই শাড়ি নেই। তনি আপু তার নিজের দুইটা শাড়ি দু’জনকে পরিয়ে দিল। মাহিমা আবেগের চোটে বলে উঠল,

“তুমি কত ভালো তনি আপু। তোমাকে বিয়ে দিয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠাব না। সারাজীবন আমাদের কাছেই রেখে দিব।”

মীরা মাহিমাকে চোখ টিপলো। ভুল করে মুখ ফসকে বলে ফেলেছে। কিন্তু তনি কিছু মনে করল না। উল্টো হেসে ওদের সুন্দর করে সাজিয়ে দিল।
সেজেগুজে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেরাই নিজেদেরকে চিনতে পারছে না। মীরা কালো কালারের জর্জেট শাড়ি পরেছে। মাহিমা খয়েরী রঙের। দু’জনকেই অসম্ভব সুন্দর লাগছে। মীরা মাহিমাকে দেখে বলল,

“কইতরি তোরে যে কী সুন্দর লাগছে রে!”

“মীরাবাঈ তোমাকেও হেবি সুন্দর লাগছে।”

মামী, চাচীকে বলে ওরা বেরুবার সময় রুশমি বায়না ধরল সে-ও সাথে যাবে। ওকে কাঁদিয়ে রেখে আসতে হয়েছে। মাহিমা বাইরে বেরিয়ে বলল,

“বাচ্চাগুলা দিনদিন বড় বেয়াদব হচ্ছে। তুই ছোট মানুষ তুই জন্মদিনের পার্টি কী বুঝিস? চুপচাপ মা’র কোলে বসে ফিডার খা। তা না, সে বড় বোনদের সাথে জোড়া ধরে।”

🌸

রিমুদের বাড়ি বেশি দূরে না৷ এক এলাকায় হলেও রিমুদের বাড়ি এলাকার শেষ সীমানায়। সন্ধ্যার পরে ওরা বেরিয়েছে। রাতে কেক কাটা হবে। মীরা রিমুর জন্য সেই টেডিবিয়ারটাই নিয়েছে। এত্ত বড় টেডিবিয়ার কোলে নিয়ে আসার সময় সবাই তাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। মাহিমা রিমুর জন্য স্পেশাল একটা গিফট এনেছে। সে সাবধানে সেই বক্সটা হাতে নিয়ে হাঁটছে। রিমুদের বাড়ির সামনে এসে রিকশা থেকে নেমে মাহিমা ভাড়া নিয়ে ঝগড়া শুরু করে দিল। মীরা বারবার বলেও ওকে পুরো ভাড়াটা দেওয়াতে পারল না। এইটুকু জায়গা আসার জন্য রিকশাওয়ালা একটু বেশিই ভাড়া চাচ্ছে। মাহিমা কিছুতেই ন্যায্য ভাড়ার বেশি এক টাকাও দিবে না। মীরা মেয়েটার উপর বিরক্ত হয়ে ওকে রেখেই রিমুদের বাড়ির ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। সে টেডিবিয়ারটাকে কোলে নিয়ে গেট দিয়ে ঢোকার সময় অন্যমনস্ক হয়ে বারবার পেছনে তাকানোর ফলে একটা লোকের সাথে ধাক্কা খেল। এবং ধাক্কা খেয়েই থেমে থাকল না। হিল জুতো দিয়ে লোকটার পা মাড়িয়ে দিয়ে নিজেও পড়ে যেতে নিল। কিন্তু লোকটা তাকে পড়তে দিল না। শক্ত দু’টো হাত তার কোমর জড়িয়ে ধরল। অপ্রত্যাশিত এই স্পর্শে মীরার গায়ে কাটা দিয়ে উঠল। সে মানুষটাকে গালি দেওয়ার জন্য মুখ খোলার আগে সামনে থেকে টেডিবিয়ার সরিয়ে যাকে দেখল, তাকে দেখে ওভাবেই পাথরের মতো কঠিন হয়ে রয়ে গেল। তার জীবনে যত অঘটন আছে সব কি জায়িন ভাইয়ার সামনেই ঘটতে হয়!
কুকুরের দৌড়ান। পড়ে গিয়ে কোলে ওঠা। এখন ধাক্কা খেয়ে পা মাড়িয়ে দেওয়া। ইশ লজ্জা!
জায়িন শান্ত চোখে মীরার দিকে তাকিয়ে আছে। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে না সে বিরক্ত বা ব্যথা পেয়েছে। এই লোকের সবসময় এতটা স্বাভাবিক থাকাই মীরার কাছে অস্বাভাবিক লাগে। মীরা তাড়াহুড়ো করে জায়িনের থেকে সরে দাঁড়াতে চাইল। এবং তখন আরেকটা অঘটন ঘটলো। মীরার শাড়ি জায়িনের পায়ের নিচে থাকায় মীরা সরতে গেলে তার কুঁচিই খুলে গেল। মীরা আর্তনাদ করে উঠে শাড়ির কুঁচি চেপে ধরল। এবার জায়িনের চেহারায় সামান্য ভাব পরিবর্তন লক্ষ করা গেল। যাক লোকটা পাথর না। রিয়েক্ট করতে জানে। মীরাই তাড়াহুড়ো করে আগে বলে উঠল,

“সরি ভাইয়া। এক্সট্রিমলি সরি। আমি দেখিনি। সত্যি বলছি, একটুও বুঝে পাড়া দিইনি।”

মীরা হয়তো জায়িনের শার্ট খামচে ধরেছিল। তাই কুঁচকে গেছে। জায়িন শার্টের ভাজ ঠিক করতে করতে গম্ভীর গলায় বলল,

“হু।”

তখনই মাহিমা আসে। মীরাকে কারো সাথে কথা বলতে দেখে পেছন থেকেই ডাকে।

“কে রে মীরা? কার সাথে কথা বলছিস?”

মাহিমা ওদের কাছে এসে দাঁড়াল। জায়িনকে দেখে চেনা চেনা মনে হলেও ঠিক মনে করতে পারল না। তবে ছেলেটা যে-ই হোক ভীষণ হ্যান্ডসাম। হিল জুতা পরেও লম্বাতে ওরা কাঁধের সমান হতে পারছে না। মাহিমা চলে আসায় মীরা ফের একবার অপরাধী কন্ঠে বলল,

“সরি ভাইয়া।”

যেতে যেতে কয়েকবার পেছনে ফিরে মাহিমা জায়িনকে দেখতে দেখতে প্রশ্ন করল,

“ছেলেটা কে রে মীরা? আর তুই সরি বলছিলি কেন?”

মীরা তার তৃতীয় তম গাধামির কথা মনে করে ফোঁস করে দম ফেলল। হতাশ গলায় বলল,

“মুবিন ভাইয়ের বড় ভাই।”

মাহিমা অবিশ্বাস্য গলায় প্রায় চেঁচিয়ে বলল,

“ইনি জায়িন ভাই! সেজন্যই তো চেনা চেনা লাগছিল। উনাকে আমি চিনি। ছোট বেলায় কত দেখেছি। ভাইয়ার বন্ধু। কতবার ভাইয়ার সাথে আমাদের বাড়িতে গেছে। ইশরে, দেখলি জায়িন ভাইকে চিনতে পারলাম না। এজন্যই এলাকার ছেলেপিলে গুলোকে এলাকাতেই থেকে যেতে হয়। বাইরে গেলেই অচেনা হয়ে যায়। তা উনাকে সরি বলছিলি কেন?”

“গেট দিয়ে ঢোকার সময় ধাক্কা খেয়ে পা মাড়িয়ে দিয়েছি। দেখ কত উঁচু হিল পরেছি। পা মনে হয় কানা হয়ে গেছে।”

“ইশশ! কী করলি এটা? আহা, অনেক ব্যথা পেয়েছে হয়তো।”

হঠাৎ লোকটার প্রতি মাহিমার এত দরদ দেখে মীরা চোখ মুখ বাঁকিয়ে মাহিমার দিকে দেখল।

“হঠাৎ উনার জন্য তুই এত দরদ দেখাচ্ছিস কেন?”

“ওমা, আমার ভাইয়ের বন্ধু। এলাকার সিনিয়র ভাই। তোর স্যারের বড় ভাই। দরদ দেখব না! কিন্তু উনি এখানে কী করছেন? রিমুর আত্মীয় টাত্মীয় হয় নাকি? উনাকেও দাওয়াত দিয়েছে?”

🌸

রিমুর সাথে দেখা করে ওকে টেডিবিয়ারটা ধরিয়ে দিয়ে মীরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। হাত দু’টোকে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল,

“তোর এই গিফট নিয়ে আসতে আসতে আমার হাত ব্যথা হয়ে গেছে।”

মাহিমাও তার আনা গিফটটা রিমুকে দিয়ে দিল। সাবধানী বাণী আওড়িয়ে বলল,

“খবরদার যদি মানুষের সামনে খুলেছিস! এখন খুলবি না। সবাই চলে গেলে একা রুমে খুলবি।”

রিমু চোখে মুখে সন্দেহ নিয়ে জানতে চাইল,

“কী আছে এর ভেতরে?”

“আছে। অনেক দামী একটা গিফট। এখন খুলে দেখলে আসল মজা পাবি না।”

“রিমু আমার সাথে একটু রুমে আসবি? শাড়ি খুলে গেছে। কুঁচি ঠিক করে দিবি।”

রিমু হাসতে হাসতে বলল,

“তোরা শাড়ি পরতে গেলি কেন? অবশ্য শাড়িতে তোদের অনেক সুন্দর লাগছে। কিন্তু মানুষের সামনে বারবার কুঁচি খুলে গেলে তো ইজ্জতের দফারফা হয়ে যাবে।”

রুম থেকে শাড়ি ঠিক করে ওরা লনে চলে এলো। লনেই পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। অনেক মানুষ এসেছে। মীরা মাহিমা রিমুর কাছে দাঁড়িয়ে আছে। মাহিমার চোখ দূরে দাঁড়ানো জায়িনের উপর পড়তেই সে কৌতূহলে ফেটে পড়ে বলল,

“জায়িন ভাই তোদের কী হয় রিমু? উনিও এসেছেন! তোদের আত্মীয়?”

মাহিমার দেখাদেখি মীরা রিমু দু’জনই জায়িনের দিকে তাকাল। জায়িন কয়েকজন ছেলের সাথে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তার কানে ফোন। ফোনে কারো সাথে কথা বলছে হয়তো। রিমু হেসে বলল,

“জায়িন ভাই আসবে না! তোর জন্মদিনে তোর চাচাতো ভাই না এসে থাকবে?”

মীরা মাহিমা দু’জনই অবিশ্বাস্য চোখে রিমুর দিকে তাকাল। জায়িন ভাই রিমুর চাচাতো ভাই। মাহিমা হতভম্ব গলায় বলল,

“জায়িন ভাই তোর চাচাতো ভাই! আগে তো বললি না।”

“আপন চাচাতো না। আমার আব্বুর চাচাতো ভাইয়ের ছেলে। তবে আপন চাচাতো ভাইয়ের থেকেও বেশি।”

মীরা জায়িনকে দেখছে। নখ উলটে ফেলার ওই ঘটনার পরে জায়িন ভাইয়ের সাথে আর দেখা হয়নি। তিনি চলে গিয়েছিলেন। মীরাও পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। উনি এখনও রিকশা ভাড়ার টাকা আর একটা ধন্যবাদ পাওনা মীরার কাছে।

চলবে…

#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা

🌸

কেক কাটার সময় সবাই একসাথে এসে দাঁড়িয়েছে। রিমু কেক কেটে সবার আগে মীরা মাহিমাকে খাওয়ালো। মীরা মাহিমা কেকের একটু অংশ হাতে নিয়ে রিমুর মুখে মাখাল। তিন বান্ধবীর হাসির শব্দে পরিবেশ মুখরিত হয়ে উঠেছে। মুবিন ভাইকেও পার্টিতে দেখা গেল। সকালে মুবিন ভাইও তাহলে রিমুর জন্যই গিফট কিনছিল। মাহিমা মীরার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে বারবার ওর হাত ধরে টেনে দেখাচ্ছে।

“মীরা দেখ না, জায়িন ভাই কী হ্যান্ডসাম! শহরে থেকে এতটা হ্যান্ডসাম হয়ে এসেছে!”

মীরা তাকাতে গেলে প্রতি বারই জায়িন ভাইয়ের সাথে চোখাচোখি হয়ে যাচ্ছে। ইশ, লোকটা কী ভাববে! রিমু মুখ ধুতে গেছে। মুবিন ওদের কাছে এসে দাঁড়িয়ে স্বভাবসুলভ হেসে জিজ্ঞেস করল,

“কেমন আছো মীরা?”

“ভালো। আপনি কেমন আছেন মুবিন ভাই?”

“ভালো। পরীক্ষা কেমন হয়েছে?”

“ভালো।”

“এ প্লাস আসবে তো?”

মীরা হেসে ফেলে বলল,

“এই কথাটা কিন্তু আজ সকালেও জিজ্ঞেস করেছেন মুবিন ভাই।”

মুবিন লজ্জিত মুখে হাসল। মীরা মাহিমাকে মুবিন ভাইয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল।

“মুবিন ভাই, ও আমার বড় ফুপুর মেয়ে। ওর নাম মাহিমা। আমরা একসাথে পড়ি।”

মুবিন মাহিমার দিকে তাকাল। মাহিমা মুবিনকে চেনে। এক এলাকায় বাড়ি। তাই সে অচেনা বলে ইতস্তত করল না। বা ফর্মালিটি করেও কথা বলল না। মাহিমা বলল,

“আমি আপনাকে চিনি। আপনার ভাইকেও চিনি। জায়িন ভাই আমার ভাইয়ার বন্ধু। আমি ছোট থাকতে ভাইয়ার সাথে আমাদের বাড়িতে যেত। এখন হয়তো উনি আমাদের চিনেন না। আপনি তো এলাকায় থেকেও চেনেন না। উনি না চেনাই স্বাভাবিক।”

মাহিমা এত সহজ ভাবে কথা বলছে দেখে মুবিনও সহজ হলো। ওর একটা কথা শুনে হাসি পেল। ওকে হাসতে দেখে মাহিমা বলল,

“হাসছেন কেন?”

“না, তুমি বললে না তুমি ছোট থাকতে ভাইয়া তোমাদের বাড়িতে যেত। ভাবছি তুমি এখন কতটা বড় হয়েছ।”

মাহিমা লজ্জা পেল। সে কি একটু বেশি কথা বলে ফেলেছে? মুবিনের সাথে মীরাও সহজ ভাবে কথা বলে। কারণ মুবিন ভাই তার ভাইয়ের মতো অমন গম্ভীর বদমেজাজি না। মীরা বলল,

“রিমু আপনার বোন হয় আমরা জানতামই না। আন্টি এলেন না কেন মুবিন ভাই?”

“আম্মুর কোমরের ব্যথাটা বেড়েছে। তাই আসেনি। ভাইয়াও আসতে চাচ্ছিল না। আম্মু জোর করে পাঠালো।”

ওরা তিনজন বেশ অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। কথা বলতে বলতে তিনজনই হাসছে। জায়িন মুবিনকে খুঁজছিল। বলতে, খাওয়াদাওয়া শেষ করে তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফিরতে হবে। মা বাড়িতে একা আছে। কিন্তু মুবিনকে মেয়ে দুইটার সাথে কথা বলতে দেখে এগোলো না। ওখানেই চোখ মুখ কঠিন করে দাঁড়িয়ে রইল। এত সময় ধরে কী কথা বলছে ওদের সাথে! এদিকে আসার নামই নিচ্ছে না। বিরক্তিতে জায়িনের কপালের শিরা দপদপ করতে লাগল। তার ভাইটা যে মেয়েদের সাথে খাতির জমাতে এত পারদর্শী তা তো জানা ছিল না।
পার্টি শেষে মীরা মাহিমা বের হওয়ার সময় গেটে মুবিনকে দেখতে পেল। মাহিমা মীরাকে খোঁচা দিয়ে বলল,

“এখনও যায়নি দেখেছিস। তোর জন্যই দাঁড়িয়ে আছে।”

চাপা গলায় মীরা ওকে শাসালো।

“চুপ কর।”

মুবিনের কাছাকাছি এসে দেখা গেল একটু সামনেই জায়িন দাঁড়িয়ে আছে। ফোন কানে কথা বলছে। মুবিন ওদের দেখে জিজ্ঞেস করল,

“একা যাবে তোমরা?”

মীরা জবাব দিল,

“না। আবির ভাইয়া আমাদের নিতে আসবে।”

“ওহ। আমরাও চলে যেতাম। ভাইয়ার জরুরি কল এসেছে।”

মীরার মন খারাপ হলো। মুবিন ভাই তার জন্য দাঁড়িয়ে আছে না। তার ভাইয়ের জরুরি কলের জন্য দাঁড়িয়ে আছে। জায়িন ফোনে কথা বলা শেষ করে ওদের কাছে এলো। মীরা মাহিমাকে দেখবে আশা করেনি।

“কার সাথে যাবে তোমরা?”

লোকটা গম্ভীর গলায় কার উদ্দেশ্য প্রশ্নটা করেছে দুই বোন বুঝলো না। তাই দু’জনের কেউই উত্তর দিতে পারল না। ওদের এমন বোকার মতো চুপ করে থাকতে দেখে মুবিন পরিস্থিতি সহজ করে দিয়ে বলল,

“তোমার বন্ধু আসবে।”

জায়িন প্রশ্নবিদ্ধ চোখে মুবিনের দিকে দেখলে মুবিন বলল,

“আবির ভাইয়া তোমার বন্ধু না? ওরা আবির ভাইয়ার বোন।”

মীরা মাহিমা দু’জনই জায়িনের এক্সপ্রেশন দেখার জন্য ওর দিকে তাকিয়েছিল। কিন্তু জায়িন তেমন কোন এক্সপ্রেশনই দেখাল না। গম্ভীর গলাটা একটু যেন নরম হলো। দু’জনের দিকে তাকিয়ে বলল,

“তোমরা আবিরের বোন।”

মাহিমা মাথা নাড়ল। সে জানাল,

“আমি ভাইয়ার আপন বোন। ও আমাদের মামাতো বোন।”

“আচ্ছা।”

আবির যতক্ষণ এসে না পৌছুলো মীরা মাহিমাকে রেখে ওরাও গেল না। আবিরের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইল। চারজন মানুষ বোবা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুবিন জায়িনের অসুবিধা না হলেও মীরা মাহিমার পেটের ভেতর বুট বুট করতে লাগল। কথা না বলে এভাবে থাকা যায় নাকি। মীরা বারবার মাহিমাকে খোচাচ্ছে। মাহিমা কানে কানে বলল,

“দু’জনের একটা ফোনও নেই যে ভাইয়াকে কল করে তাড়াতাড়ি আসতে বলব।”

মীরাও নিচু গলায় ফিসফিসিয়ে বলল,

“পরীক্ষা শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষায় ছিলাম। এবার বাড়িতে ফোনের কথা জানাতে হবে।”

“কিন্তু এখন কীভাবে সময় কাটাবো বোন? এই দু’জন অতিমানবের সাথে থাকার চেয়ে ভালো আমাদের জঙ্গলে ফেলে দিয়ে আসুক। জন্তুজানোয়ার নয়তো গাছপালার সাথে বান্ধবী পেতে নিব।”

“আমার তো কথা বলতে না পেরে পেটের ভেতর কেমন লাগছে। মনে হচ্ছে কথাগুলো মুখ দিয়ে বেরুতে না পেরে পেট ফেটে বেরুবার চেষ্টা করছে।”

“আল্লাহর কাছে দোয়া কর ভাইয়া যেন পাঁচ মিনিটের ভেতরে চলে আসে।”

ওরা ভাবছে ওরা কানাকানি করে কথা বলছে। দুই ভাই হয়তো শুনতে পাচ্ছে না। কিন্তু ওদের সব কথাই দুই ভাই শুনেছে। মুবিন চোখ বড় বড় করে মেয়ে দুইটাকে দেখছে। কী সাঙ্ঘাতিক মেয়ে রে বাবা! জায়িন এমন ভাবে ওদের দেখছে যেন ওরা চিরিয়াখানার রাখা আজব উদ্ভট কোন প্রাণী। বোনেদের দোয়ার ফেলে আবির সত্যিই পাঁচ মিনিটের ভেতরে চলে এসেছে। আবিরকে দেখে দুই বোন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। অনেকদিন পর বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে আবিরের খুশি দেখে কে। সে জায়িনের সাথে হাত মিলিয়ে, গলা জড়াজড়ি করে বলল,

“কতদিন পর ডাক্তার সাহেব!”

জায়িন হাসলো। মীরা অবাক হয়ে লোকটার হাসি দেখল। এই লোক হাসতেও জানে! তার সাথে দেখা হওয়ার এতগুলো দিনের মাঝে মীরা আজই প্রথম জায়িনকে হাসতে দেখল। আর এতটা প্রাণখোলা ভাবে কথা বলতে দেখল। মাহিমা মীরাকে চিমটি কেটে বলল,

“জায়িন ভাইয়ার হাসি কী সুন্দর, না?”

মীরাও মাথা নেড়ে সায় দিল।

“হুম।”

জায়িন আবিরের হালচাল জিজ্ঞেস করল,

“তোর কী খবর?”

“খবর ভালোই। কিন্তু আফসোস তোর মতো ডাক্তার হচ্ছি না।”

“আর্মিই বা কম কিসে!”

জায়িন রহস্যময় হাসলো। আবির চোখ বাঁকিয়ে তাকাল। জায়িন পাল্টা হাসলো।

“তুই জানিস কীভাবে?”

“লেকচারার হওয়ার স্বপ্ন বাদ দিয়ে আর্মি যেতে চাচ্ছিস কার জন্য এটাও জানি।”

আবির সত্যিই অবাক হলো। তারপর হেসে বলল,

“তুই আমার খবরও রাখিস তাহলে?”

“এলাকা ছেড়েছি। দেশ ছাড়িনি।”

“বাড়িতে এলেও তো দেখা করিস না শালা।”

“বাড়িতে এলেও খুব কম থাকা হয়। দু-এক দিনের বেশি থাকাই যায় না। সবার খবর কি?”

“একেক জন একেক জায়গায় ছড়িয়ে গেছে। তেমনভাবে কারো সাথেই যোগাযোগ নেই। এবার কতদিন আছিস?”

“আছি কয়দিন।”

“আমাদের বাড়িতে কবে যাবি? নাকি বলবি সময় নেই। বুঝি বুঝি ব্যস্ত মানুষ তুমি।”

“যাব সময় করে।”

অনেকদিন পর দেখা হওয়ায় দুই বন্ধু দুনিয়া ভুলে আলাপে মগ্ন হয়ে গেল। এদিকে দুই বোন যে দাঁড়িয়ে থেকে পা ব্যথা বানিয়ে ফেলছে এটা কেউ খেয়াল করছে না। আবির আরও অনেকটা সময় জায়িনের সাথে কথা বলল। কথা বলার একপর্যায়ে গিয়ে আবির জানতে চাইল,

“গার্লফ্রেন্ড টালফ্রেন্ড বানিয়েছিস? নাকি শালা পড়তে পড়তেই জীবন যৌবন শেষ করে ফেলছিস।”

মীরা মাহিমা দু’জনই এই প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। ছোট ভাইয়ের সামনে এসব কথা ওঠায় জায়িন প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যেতে চাইল। সে সামান্য হেসে বলল,

“কাল দেখা হচ্ছে। সবাইকে জানিয়ে দিস।”

“ঠিক আছে।”

ধ্যাত! আসল কথাটাই জানা হলো না। চালাক বেটা ওদের সামনে বলেনি। মীরা শাড়ির কুঁচি ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলল,

“তোর রাস্তা ক্লিয়ার কি-না বোঝা যাচ্ছে না। লোকটার যদি গার্লফ্রেন্ড থাকে? আচ্ছা তোর কি মনে হয়? এত বড় একটা ছেলের গার্লফ্রেন্ড থাকবে না? তুই তো উনার হাঁটুর বয়সীও হবি না।”

এতক্ষণে আবির বন্ধুর সাথে দুই বোনকে পরিচয় করিয়ে দিল।

“ওদেরকে তো তুই চিনিসই। দুইটাই আমার বোন। একটা মা’র পেটের। আরেকটা মামীর পেটের। মীরা তো মুবিনের কাছেই প্রাইভেট পড়ে। তোদের বাড়িতে দেখিসনি কখনও?”

জায়িন আড়চোখে মীরার দিকে তাকিয়ে একটু সময় নিয়ে হালকা করে জবাব দিল,

“দেখেছি।”

“মুবিন নাকি ভীষণ ভালো পড়ায়। মীরার কাছে ছোট ভাইয়ের অনেক সুনাম শুনেছি। পরীক্ষায় পাস করলে মাহিও পড়তে যাবে।”

জায়িন তার ভাইয়ের দিকে একবার তাকাল। আবির বলে যাচ্ছে,

“মীরা হায়ার ম্যাথে পাস করে গেলে মুবিনকে পুরষ্কার দেব। কী বলিস মীরা? হায়ার ম্যাথকে ও যমের মতো ভয় পেত। মুবিন ভাইয়ের কৃপায় সেই ভয় কিছুটা দূর হয়েছে।

নিজের প্রসংশা শুনে মুবিন খানিকটা লজ্জা পেল। লজ্জায় দৃষ্টি নত হলো। মীরা মনে মনে আবির ভাইয়ের উপর বিরক্ত। আবির ভাই এত কথা বলছে কেন? বন্ধু বলেই কি সব কথা উনাকে বলে দিতে হবে। কথা বলতে বলতে হেঁটে হেঁটে ওরা অনেকটা চলে এসেছে। এখান থেকে ওদের পথ ভিন্ন। যাবার আগেও আবির কয়েকবার মনে করিয়ে দিল,

“কাল কিন্তু দেখা হচ্ছে।”

জায়িন তার ভীষণ দামী হাসিটা আবার হেসে বলল,

“মনে আছে।”

এই হাসির উপর মীরা মাহিমা দু’জনই একটু গলে গেল। বেশি না কিন্তু। যে লোক খুব অল্প হাসে তার হাসি এত সুন্দর হবে কেন? সুন্দর জিনিসের কদরই করতে জানে না।
বাড়ি ফিরে রুমে এসে শাড়ি খুলতে খুলতে মাহিমা বলল,

“মুবিন ভাই কিউট। কিন্তু জায়িন ভাই হ্যান্ডসাম।”

“তোর সাথে ভালো মানাবে। পারলে তাড়াতাড়ি করে পটিয়ে নে।”

চলবে_