মনের পিঞ্জরে পর্ব-৫৩

0
993

#মনের_পিঞ্জরে
#Ariyana_Nur
#Part_53

ঘুমের ঘরে দু’বোনের চেচামেচিতে ঘুম ছুটে গেলো মিসেস খান এর।বাসায় ডাকাত পরার চেচামেচি শুনে মাথায় শাড়ির আচল টেনে রুম থেকে বের হতেই তার চোখ ছানাবানা হয়ে গেলো।কেননা ইশফা আর ইশরা দুজনই একটা টেডিবিয়ারের জন‍্য গলায় পারা দিয়ে ঝগড়া করছে।দুজনই টেডিবিয়ার এর দু’ মাথা ধরে টানাটানি করছে।মিসেস খান ওদের ধমক দিয়ে বলল……..

—রাত বেরাতে কি শুরু করেছো তোমরা?এতো বড় হয়েও বাচ্চাদের মত সামান্য একটা টেডিবিয়ার নিয়ে ঝগড়া কেন করছো?

ইশফা নালিশের শুরে বলল……

—মা এটা আমার পুচকো ইরুকে ছেড়ে দিতে বল।

ইশরা টেডিবিয়ার টা ইশফার হাত থেকে ছাড়িয়ে নিতে চেয়ে চেচিয়ে বলল……

—না মা!এটা আমার পুচকো।ওরটা ও ফেলে দিয়ে এখন আমারটায় ভাগ বসাচ্ছে।

ইশফাঃনা মা ও মিথ‍্যে বলছে।এটা আমার পুচকো।

ইশরাঃতুই মিথ‍্যাবাদী আমি না।এটা আমার পুচকো।

ইশফা টেডিবায়ারটা টান দিয়ে বলল….

—এটা আমার।

ইশরা নিজের দিকে টেডিবিয়ারটা টান দিয়ে বলল…….

—না এটা আমার।

দুবোনের বাচ্চাদের মত ঝগড়া দেখে মিসেস খান ধমক দিয়ে বলল……..

—চুপ একদম চুপ।একটা কথাও বলবে না।ফাজিল মেয়েরা দিনদিন বড় হচ্ছে আর বাদর হচ্ছে।বড় হয়ে গেছে বিয়ে হয়ে গেছে এখনো বাচ্চাদের মত সামান‍্য একটা পুতুল নিয়ে যদি ঝগড়া করতে লোকে শুনে তাহলে কি বলবে?

কথাটা বলে মিসেস খান নিজের রুমের চলে যেতে নিয়ে পুনরায় ফিরে এসে দুজনের হাত থেকে টেডিবিয়ারটা ছিনিয়ে নিয়ে বলল……

—এটাকে এখন আমি চুলোয় দিব।না থাকবে তোদের পুতুল না থাকবে কোন ঝামেলা।

ইশফা,ইশরা চুল টান দিয়ে বলল……

—তোর জন‍্য আজ মা পুচকো কে মারতে চাচ্ছে।

ইশরা,ইশফার চুল টান দিয়ে বলল…….

—আমার জন‍্য না তোর জন‍্য।তুই তো ষাড়ের মত চেচাচ্ছিলি।তোকে আমি……

এই বলেই আবার শুরু হয়ে গেছো দু’জনের মারামারি।মিসেস খান ওদের রাম ধমক দিয়ে বলল…..

—চুপ।আবার শুরু করেছিস?আর একটা কথা বলবি তো দুজনকে এখন বাহিরে নিয়ে রেখে আসবো।সাথে তোদের সব পুতুল চুলায় দিব।

মিসেস খান ওদের বকতে বকতে কিচেনের দিকে পা বাড়ালেই ইশফা,ইশরা দুজন একসাথে ন‍্যাকা কান্না জুড়ে দিয়ে বলল…….

—মা প্লিজ পুচকোকে মেরো না আমরা প্রমিস করছি আর ঝগড়া করবো না।

মিসেস খান ওদের দিকে ঘুড়ে রাগি গলায় বলল……

—ঐ তোদের কান্না বন্ধ কর।তোদের এই কান্নায়ও আজ কিছু হবে না।তোদের জন‍্য আমার সাধের ঘুম নষ্ট হয়েছে।

—মেয়েদের জন‍্য তোমার এক রাতের ঘুম নষ্ট হয়েছে আর তোমাকে বিয়ে করে যে আমার সারা জীবনের ঘুম নষ্ট হয়ে গেছে।

পাশের রুম থেকে বের হয়ে মিঃ খান কথাটা বলল।মিঃ খান এর কথা শুনে মিসেস খান তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলল…..

—তুমি!তুমি কখন এসেছো?এই মাত্র কি বললে?আবার বল তো।

মিঃখানঃযা শুনেছো তাই তো বলেছি।

মিসেস খান চোখ রাঙিয়ে বলল……

—তুমি আমাকে এই কথা বলতে পারলে?

মিঃখানঃপারলাম দেখেই তো বললাম।

মুহূর্তের মধ‍্যে মিসেস খানের চোখ জলে ভরে উঠল।ছলছল চোখে মিঃখান এর দিকে তাকিয়ে থেকে কোন কথা না বলে নিজের রুমের দিকে পা বাড়াতে নিলেই মিঃখান মিসেস খান এর সামনে গিয়ে পথ আটকিয়ে দাড়িয়ে একটা ছোট বক্স বাড়িয়ে দিয়ে বলল…….

—শুভ বিবাহ বার্ষিকী।এই দিনে কান্না করতে করতেই তো আমার ঘরে এসেছিলে।আমি কিন্তু তোমার ঐ কান্নারত চেহারা দেখেই ঘায়েল হয়ে গিয়েছিলাম।তাই তো আজও সেই কান্নারত চেহারা দেখার জন‍্য একটু বৃথা চেষ্টা করলাম।তুমি জানো তোমার ঐ……।

মিঃখান কে আর কিছু বলতে না দিয়ে মিসেস খান তার হাতে চাপড় মেরে নাক টেনে বলল……

—কি শুরু করেছো তুমি।বয়সের সাথে সাথে চোখও কি গেছে নাকি তোমার।মেয়েরা যে সামনে আছে দেখতে পাওনা?

মিঃখান কিছু না বলে হাসতে লাগলো।ইশফা ইশরা সামনে এসে দুজনকে জড়িয়ে ধরে বলল…….

—শুভ বিবাহ বার্ষিকী।

মিসেস খান মুচকি হেসে মেয়েদের জড়িয়ে ধরে বলল…….

—পাগলগুলো।

—উহু উহু এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না মা।আমরাও কিন্তু এখানে আছি।আপনি আমাদের সামনে ওদের একা আদর করছেন এটা ঘোর অন‍্যায়।

কথাটা শুনে মিসেস খান ওদের ছেড়ে ঘুড়ে দাড়াতেই দেখে সান ফুলের তোড়া নিয়ে ইশফাদের রুমের দরজার সামনে দাড়িয়ে রয়েছে।মিসেস খান অবাক হয়ে বলল…….

—বাবা তুমি এখানে?

সান মিস্টি হেসে মিসেস খান এর সামনে এসে ফুলের তোড়া বাড়িয়ে দিয়ে বলল……

—শুভ বিবাহ বার্ষিকী।

মিসেস খান হাসি মুখে ফুলের তোড়াটা নিয়ে বলল……

—তুমি কখন এসেছো?

—মামী শুধু এ আসেনি।আমরাও এসেছি।

একে একে ইশান,তুশি,সিনথিয়া,জিদান বের হয়ে তাদের উইস করল।

মিসেস খান মিঃখান ও জিদানের দিকে দিকে তাকিয়ে বলল……..

—এই আপনাদের জরুরি কাজ।যার জন‍্য আপনারা রাতে বাসায় ফিরতে পারবেন না?

মিঃখান,জিদান কিছু না বলে মুচকি হাসলো।

মিসেস খান মিঃখান কে চোখ রাঙিয়ে ফিসফিস করে বলল…….

—তুমি কি গো হ‍্যা?সবাই যেমন তেমন মেয়েদের জামাই এর সামনে তুমি…..?

মিঃখানঃতাতে কি হয়েছে।মেয়ে আমাদের মেয়ের জামাইও আমাদের।মেয়ের জামাইরাও একটু কিছু শিখুক,জানুক।

মিসেস খান চোখ রাঙাতেই মিঃঅন‍্য দিকে তাকালো।জিদান সেটা দেখে মিটমিট করে হেসে বলল…….

—ছোট মা চাচ্চু আমাদের আইডল।এখানকার সবাই জানি চাচ্চু তোমাকে কত ভালোবাসে।তাই শুধু শুধু চাচ্চুকে আর কিছু বল না।

মিসেস খান জিদান কে হাত দেখিয়ে বলল….

—মাইর লাগাবো তোমায়।এগুলোর সাথে থাকতে থাকতে তুমিও দিন দিন বাদর হয়ে যাচ্ছ।

ইশরা ভেঙচি কেটে বলল…….

—এ আবার সাধু ছিলো কবে।এতো শুরু থেকেই বাদর।শুধু একটু বড়দের সামনে ভালো সাজার নাটক করত।

জিদানঃছোট মা তোমার মেয়েকে কিছু বলবে?দেখো ও আমায় একটু সম্মান দেয় না।

ইশরাঃআপনি কে ভাই?যে আপনাকে সম্মান দিবো?

ইশরার কথা শুনে সবাই মিটমিট করে হাসতে লাগলো।

জিদান ইশরাকে চোখ রাঙাতেই ইশরা ভেঙচি কেটে অন‍্য দিকে তাকিয়ে রইল।

সিনথিয়াঃঝগড়া ঝাটি পরে।তোমরা কি একটা জিনিস লক্ষ করেছো?গত মাসে ইশরা আপুর এনিভার্সিরি ছিলো।তার কিছুদিন পরে আঙ্কেল আন্টির।আবার সামনের মাসে ভাইয়া আর ভাবিরটা আসছে।কিছু দিনের ব‍্যবধানে তিনজনের এনিভার্সিরি একসাথে।ওয়াও তিন তিনটা এনিভার্সিরির পার্টির দাওয়াত একসাথে😍

ইশান তুশির দিকে এক পলক তাকিয়ে মুখে হাসি ঝুলিয়ে বলল……

—চিন্তা করো না আপু আরো একটা দাওয়াত ও পাবে।মামা আমার বিয়ের ডেটটাও এর মধ‍্যেই ঠিক।কথায় আছে না, মামা ভাগনে যেখানে আপদ নাই সেখানে।তাই তো তোমার পিছে পিছে থাকতে চাচ্ছি।

মিঃখান ইশান এর দিকে বড় বড় চোখ করে তাকাতেই ইশান আমতা আমতা করে বলল…..

— না মানে বলছিলাম কি, বিয়ে তো ঠিক হয়েই আছে ডেটটা একটু সামনে নিয়ে আসো তাহলেই তো হয়।

ইশান এর কথা শুনে সবাই মিটমিট করে হাসতে লাগলো।তুশি সবার অগোচরে ইশানকে চোখ রাঙিয়ে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে রইল।

মিঃখান হাসতে হাসতে বলল……

—সিনথিয়া মামুমি যদি তিন তিনতে এনিভার্সিরির দাওয়াত একসাথে পাও তাহলে কেমন হবে?

সিনথিয়াঃতাহলে তো আরো ভালো হবে আঙ্কেল।কিন্তু কিভাবে….?একেক জনের টা তো একেক দিন।

মিঃখানঃআমরা বড়রা একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।সান,জিদান আর ইশান এর বিয়ে একসাথে ধুমধাম করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত।শুধু ওদের মতামত বাকি।কি বল তোমরা আমরা কি কথাবার্তা সামনে বাড়াবো…..?

মিঃখান এর কথা শুনে সবাই চুপ করে দাড়িয়ে রইল।কেউ এদিক ওদিক তাকাচ্ছে তো কেউ মাথা চুলকাচ্ছে।তুশি তো সেই যে মাথা নিচু করেছে আর মাথাই তুলেনি।সিনথিয়া চেচিয়ে বলল……

—ইয়াহু বহুত মজা হবে।তিন তিনতে বিয়ে একসাথে।আমি তো অনেক একসাইটেড।আঙ্কেল নির্রবতাই সম্মতির লক্ষন।দুলহা-দুলহানরা রাজি।ডাকেন আঙ্কেল কাজি।

💦💦💦💦💦💦

ছাদের এক কোনে দাড়িয়ে কথা বলছে সান,ইশফা।ইশফার মুখে যেন হাসির ঝিলিক লেগেই রয়েছে।সান বুকে হাত বেধে রেলিং এর সাথে হেলান দিয়ে ইশফার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে তার বাঘিনীর হাসিখুশি মুখটার দিকে।

—আজ তোমায় খুব খুশি মনে হচ্ছে।

সান এর কথা শুনে ইশফা ঠোটের কোনে হাসির রেখা টেনে বলল…….

—আজ আমি খুব খুব খুশি।কতদিন পর আজ সবাই একসাথে খুশির কিছুটা সময় কাটালাম।এতোদিন পর সবাইকে প্রান খুলে হাসতে দেখে কি যে খুশি লাগছে আপনাকে বলে বোঝাতে পারবো না।পরিবারের সাথে হাসিখুশির কিছুটা সময় কাটানো যে কতটা আনন্দের সেটা বলে বোঝানো সম্ভব না।

—বাবা,মাকে খুব ভালোবাসে তাই না।

ইশফা মুচকি হেসে বলল……

—খুব।জানেন আব্বু এখনো ইচ্ছে করে মা কে এটা সেটা বলে রাগিয়ে দেয়।আবার সরি টরি বলে মা এর রাগ ভাঙায়।যতক্ষন তারা একসাথে থাকে ততক্ষন তাদের ছোট ছোট খুনসুটি চলতেই থাকে। তাদের তো আমরা দু’বোন মিলে স্পেশাল নাম দিয়েছি টম এন্ড জেরি।

ইশফা রেলিং এর উপর হাত রেখে বলল…..

—আমার বাবার অতো টাকা নেই।তার পরেও সে টাকার পিছে কখনো ছুটেনি।সব সময় আমাদের সময় দিয়েছে।কখনো কোন সময় আমি দেখিনি বাবা মাকে অবহেলা করেছে।মা কেও দেখেছি সব সময় সব পরিস্থিতিতে বাবার পাশে থাকতে।আমার বাবা আমাদের দামি দামি সব কিছু দিতে না পারলেও মন-প্রান ভরে ভালোবাসা দিয়েছে।আর সেটাই আমাদের কাছে বেষ্ট পাওয়া।টাকা-পয়সা তো আসবে যাবে কিন্তু বাবা,মায়ের ভালোবাসা?সেটা কয়জন সন্তান এর ভাগ‍্যে জুটে।আপনার কাছে একটাই অনুরোধ কখনো টাকার পিছে ছুটতে গিয়ে আমাকে অবহেলা করবেন না।দামি খাবার,দামি কাপড় আমার না হলেও চলবে কিন্তু আপনার অবহেলা সেটা সহ‍্য হবে না।যেমন আছেন সব সময় এমনি থাকবেন প্লিজ।আমার ভদ্র,রাগি সূর্য হয়ে।

সান,ইশফার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল……

—তুমি যদি সব সময় আমার বাঘিনী হয়ে থাকো তাহলে আমিও তোমার সূর্য হয়ে থাকবো।কি থাকবে তো?

ইশফা,সান এর হাতে হাত রেখে মুচকি হেসে বলল…….

—ইনশাআল্লাহ।

সান মুচকি হেসে ইশফার হাতের উপর নিজের হাত রেখে বলল…….

—ইনশাআল্লাহ।আমি চেষ্টা কবরো যেন এমনই থাকি।আমার বাঘিনীর সূর্য হয়ে।

—আচ্ছা আপনি আমাকে বাঘিনী কেন বলেন?আমাকে আপনি কিভাবে চিনেন সেটা কিন্তু এখনো বললেন না।

—তা তোমার না জানলেও চলবে।এটা সিকরেট থাক।যখন বুড়ো বয়সে নানি,নাতনীদের নিয়ে গল্প করবো তখন তাদের সাথে তোমাকেও বলল।

ইশফা,সান এর দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে বলল……

—তার মানে আপনি বলবেন না।

—বলবোনা কখন বললাম?বলবো তো সময় হলে?

—আপনার আর বলতে হবে না।

ইশফা রাগ দেখিয়ে চলে যেতে নিলেই সান ইশফার হাত ধরে মিটমিট করে হেসে বলল…….

—রাগিনী আমার,বাঘিনী আমার
রাগলে মানায় ভালো।
রাগের চেয়ে হাসলে তাকে
মানায় আরো ভালো।

#চলবে,

(বানান ভূলগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।রি-চেইক করা হয়নি।ধন‍্যবাদ)