#মনের_মতো_তুই
#পর্বঃ১১(শেষ_পর্ব)
#লেখিকাঃদিশা মনি
আজ আদিত্য ও আমার বিয়ের দিন।সকাল থেকেই বাড়িতে আনন্দের পরিবেশ।তৃপ্তি,লিলি,রিয়া সবাই এসেছে।
আমিও সবার সাথে আনন্দেই আছি।বিয়ে যে একটা মেয়ের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ দিন সেটা একটা মেয়ে খুব ভালোভাবেই জানে।
আজ আমার বিয়ে ভাবতেও ভালো লাগছে।তার উপর যদি মনের মানুষের সাথে বিয়ে হয় তাহলে তো আর কথাই নেই।
লিলি আমার হাতে মেহেদী পড়িয়ে দিতে দিতে বলছে,
‘আগামী জীবনের জন্য শুভকামনা দোস্ত।তোর আগামীর জীবন সুখের হোক।’
আমি লিলির কানে কানে ফিসফিস করে বলি,
‘তোর আর হিমেলের সম্পর্ক কতদূর এগোলো?’
আমার কথাটা শুনে লিলি কিঞ্চিৎ লজ্জা পেয়ে যায়।এক মাস আগে থেকে হিমেল লিলির পিছু পিছু ঘুরছে।প্রথমদিকে তো লিলি হিমেলকে একদম পাত্তা দেয়নি।কিন্তু এখন বোধহয় সে হিমেলকে পছন্দ করতে শুরু করেছে।
তৃপ্তি আমাদের মাঝে এসে বলে,
‘আচ্ছা হিয়া তোর ঐ ডাক্তার বন্ধুটা আজ আসবে তো?’
‘কে ধ্রুব? ও আসবে কিনা শিওর না।’
কথাটা শুনে তৃপ্তির হাসিমুখ নিমেষেই গোমড়া হয়ে যায়।
২১.
রাতে ধ্রুব এসে আমাদের সবাইকে চমকে দেয়।ধ্রুবকে আসতে দেখে তৃপ্তি খুবই খুশি হয়।আর হবে নাই বা কেন? ও যে এখন ধ্রুবকে ভালোবাসতে শুরু করেছে।
হিমেলও এসেছে ওর সাথে।তাই লিলিও খুশি হয়।
অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হতে থাকে।আদিত্য চলে আসে।
কাজী সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু করেন।সবকিছু ঠিকঠাক ছিল কিন্তু যখনই আমায় কবুল বলতে বলা হয় আমার উপর দিয়ে শিহরণ বয়ে যায়।
কোনরকমে তিন বার কবুল বলি।কাজি সাহেবের মুখে বিয়ে হয়ে যাওয়ার কথা শুনেই মনে অজানা ভালোলাগা শুরু হয়।
বিয়ের পরের মুহুর্তটা বুঝি একটা মেয়ের জন্য সবথেকে কঠিন সময়।চেনা স্থান,চেনা মানুষদের ছেড়ে যেতে হবে ভাবলেই কেমন জানি লাগছে।
আমি যাওয়ার সময় আম্মুকে আঁকড়ে ধরে কাদতে থাকি।এই মানুষটা ছোট থেকে সবসময় আমার পাশে থেকেছে।আমার সব আবদার পূরণ করেছে।আমার জীবনে আম্মুর ভূমিকা যে কতটা অপরিসীম তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়।
আম্মু যাওয়ার সময় আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
‘তোর আগামীর জীবন সুখের হোক।’
আমি এবার আব্বুর সামনে গিয়ে দাড়াই।আব্বু এতক্ষণ বেশ গম্ভীর ছিলেন।আমি সামনে যেতেই তার সব গাম্ভীর্য চলে যায়।আমাকে জড়িয়ে হুহু করে কাদতে থাকে আব্বু।আব্বুকে এভাবে কাদতে আমি ভীষণ অবাক হয়।
ছোটবেলা থেকে আব্বু আমায় একটু বেশি শাসনে রাখত।আমি বড্ড অবাধ্য ছিলাম তো তাই।সেই তুলনায় রিয়া আব্বুর অনেক প্রিয় মেয়ে ছিল।কিন্তু রিয়ার বিদায়ের সময়ও আম্মু এভাবে কাদেনি যেভাবে আজ কাদছে।আমিও আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না।আমার কান্নার গতি যেন আরো বেড়ে যায়।
আব্বু-আম্মুকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি।ভাবতেই খারাপ লাগছে।কিন্তু এটাই তো প্রত্যেক মেয়ের জীবনের সত্য।আমিও তার বাইরে নই।সবাইকে বিদায় জানিয়ে অশ্রুভারাক্রান্ত চোখে বিদায় নিলাম।
গাড়িতে করে যাওয়ার সময়ও সমানে কাদতে থাকি আমি।আমাকে এভাবে কাদতে দেখে আদিত্য আমায় নিজের বুকে জড়িয়ে বলে,
‘এভাবে কেদোনা হিয়া।তুমি কাদলে যে আমারও অনেক কষ্ট হয়।আমি কথা দিচ্ছি তোমাকে কখনো কষ্ট দেবনা।একটু হাসো দয়া করে।তোমার হাসিমুখটা যে আমি দেখতে চাই।’
আদিত্যর কথাটা শুনে নিজের অজান্তেই হেসে ফেলি।
জানিনা আগামী জীবন কেমন হবে কিন্তু আমার আগামী জীবনে সবার কাছে দোয়া চাই।
মনের মানুষের সাথে সারাজীবন একসাথে থাকার মজাই আলাদা।
বাড়িতে পৌছানোর পর দেখি আমার শাশুড়ী,তৃষা সবাই আছে।তারা আমার খুব যত্ন নেয়।তৃষা আপু নিজের হাতে আমায় খাইয়ে দেয়।
বাসর! একটা মেয়ের জন্য সবচেয়ে আনন্দের আবার ভয়েরও রাত।বাসর ঘরে চুপিসারে বসে ছিলাম আমি।অপেক্ষায় আছি কখন আদিত্য আসবে।
আমার ভাবনার মধ্যেই আদিত্য চলে আসে বাসর ঘরে।কখন আসে সেটা আমিও বুঝতে পারিনি।নিঃশব্দে এসে আমায় ভয় পাইয়ে দেয়।
আমি তো খুবই রেগে যাই।বাসর রাতে কি কেউ এভাবে ভয় দেখায়? ছেলেটার উপর রাগ আরো বেড়ে গেল।
রাগ করে শোফায় গিয়ে শুয়ে পড়ি।আদিত্য আমার রাগ ভাঙানোর অনেক চেষ্টা করে কিন্তু আমিও এত সহজে গলবার পাত্রী নয়।চুপ করে শুয়ে রইলাম।একপর্যায়ে আদিত্য আমায় কোলে তুলে নিল।আমি বলি,
‘কি করছ ছাড়ো আমায়?’
আদিত্য আমায় চোখ রাঙিয়ে বলে,
‘আগে রোম্যান্স করব তারপর তোমার কথা শুনব।’
আমাকে সুন্দর করে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ঠোটে আলতো করে ছুয়ে দেয় আদিত্য।তারপর ধীরে ধীরে আমার আরো কাছে আসে।সারা রাত এভাবেই চলে যায়।
সকালে ঘুম থেকে উঠে আমি আদিত্যকে ডেকে তুলি।তারপর ফ্রেশ হয়ে বাইরে আসি।শুরু হয় আমার নতুন জীবন।
২২.
সময় তার আপন গতিতে চলতে থাকে।আজ আমাদের বিয়ের ১ বছর পূর্ণ হলো।আমাদের এনিভার্সারী খুব ধুমধাম ভাবে পালিত হয়।
আহসান-রিয়া,হিমেল-লিলি,ধ্রুব-তৃপ্তি ওরা সবাই আসে।দুই মাস আগেই হিমেল আর তৃপ্তির বিয়ে হয়েছে।ধ্রুব লিলিও অনেকদিন থেকে প্রেম করছে।ধ্রুব শুধু অপেক্ষায় আছে ডাক্তার হওয়ার।এর পরেই সে তৃপ্তিকে বিয়ে করে নেবে।
আমাদের এনিভার্সারী উপলক্ষে কেক আনা হয়।আমরা কেক কে’টে সেটা পালন করি।আজকের এই আনন্দের দিনে চারিদিকে যেন খুশির বন্যা বয়ে যাচ্ছে।
এভাবে আরো দুবছর চলে যায়।বর্তমানে আমি তৃপ্তি আর ধ্রুবর বিয়েতে এসেছি।কিন্তু একা আসিনি।আমার সাথে আদিত্য আছে।আর আমার কোলে রয়েছে আহির।আমার আর আদিত্যর ছেলে।আমাদের ভালোবাসার প্রতীক।
ধ্রুব-তৃপ্তির বিয়েও হয়ে যায়।আমরা সবাই আমাদের মনের মানুষটাকে নিয়ে এভাবে সুখের ঘর বাধি।জীবনে দুঃখ কষ্ট লেগেই থাকে।কিন্তু মনের মানুষটার সঙ্গ পেলে সব দুঃখ কষ্ট দূর হয়ে যায়।
আমার আজও মনে পড়ে আমার আর আদিত্যর প্রথম দেখা।আমাদের সুন্দরভাবে কা*টানো জীবন।ভালোবাসার চিরটা কাল।কতোটা সুখকর ছিল সেই জীবন।দীর্ঘ ৩০ বছর সুখে সংসার করছি আমরা।এখনো আমরা বেশ ভালোই আছি।আমাদের ছেলেটাও বড় হয়েছে।একমাত্র ছেলে আমাদের।ছেলেটার বিয়ে হয়েছে।ওর দুটো যমজ মেয়েও হয়েছে।মেয়ে দুটো আমাদের চোখে হারায়।আমরাও আমাদের নাতি নাতনিকে নিয়ে সুখে আছি।
জীবন সবদিক দিয়েই আমাকে সুখী করেছে।আজ জীবনে কোন না পাওয়া নেই।এখন মৃত্যু হলেও ভালো লাগবে।জীবনে এখনো আমার কাছে সবথেকে সেরা প্রাপ্তি হলো আদিত্য।ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে মনের মানুষকে নিয়ে এটা আমার সুখের জীবন।
এরমধ্যে এক শুক্রবার আমরা তিন বান্ধবী আবার এক হই।হ্যা আমি,লিলি,তৃপ্তি সবাই এক হই।সবাই নিজেদের সংসার নিয়ে ব্যস্ত।কিন্তু তবুও আমাদের বন্ধুত্বে কোন ছেদ পড়েনি।আজও আমরা মাসের একটা নির্দিষ্ট দিনে সবাই একত্রিত হয়েছে সুখ দুঃখের গল্প করি।আমি বরাবরই সংসারী মানুষ।তবে লিলি আর তৃপ্তি জব করতো।লিলি একটি বেসরকারি অফিসে জব করতো আর তৃপ্তিও একটি কলেজের প্রফেসর।কিন্তু এখনো সবাই ঠিক আগের মতোই আছে।
লিলি-তৃপ্তি এরা আজও আগের মতো খুনশুটিতে ব্যস্ত।আর আমিও ওদের সামলাতে ব্যস্ত।
আমরা সবাই আজ প্রকৃত সুখী।আর এই সুখের কারণ মনের মানুষকে কাছে পাওয়া।
The End
>>>গল্পটা এভাবে শেষ হওয়ায় হয়তো অনেকে অবাক হয়েছেন।আমিও চাইছিলাম একটু বড় করে শেষ করতে।কিন্তু গল্পটা আমি যেভাবে ভেবে রেখেছিলাম তাতে আর বাড়ালে হ্যাপি এন্ডিং দিতে পারতাম না।তাই এভাবে শেষ করলাম।নতুন গল্প নিয়ে ফিরব ইনশাআল্লাহ।