মনোহারিণী পর্ব-১৮+১৯

0
297

#মনোহারিণী
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৮.
মিনহা আপুর থেকে সম্পূর্ণ ঘটনার বিবরণ শুনে আমি পাথুরে মূর্তি বনে গেলাম। তার ভাষ্যমতে গতকাল রাতে আমি ছাদ থেকে চলে আসার কিছুক্ষণ পরেই তাজ ভাই শ্রেয়ান ভাইয়াকে নিয়ে এসেছিলেন। তারা বাজারে গিয়েছিলেন কী সব কেনাকাটা করতে। এসেই না কি তাজ ভাই মেহেদি উৎসব বেশ জমিয়ে তুলেছিলেন নাচ-গানের আসর বসিয়ে। অথচ সে নিজেই সেই আসরে ছিলেন না। কী এক কাজের কথা বলে আসর বসিয়ে কিছু সময়ের জন্য কে’টে পড়েছিলেন। ফিরেছিলেন মেহেদি উৎসব শেষ হওয়ার কিছু আগে। সবার মেহেদি দেওয়া সম্পন্ন হওয়ার পর তাজ ভাই সবাইকে একসাথে ডেকে আড্ডা বসিয়েছিলেন। আড্ডার বিষয় ছিল শুধুমাত্র ডেয়ার খেলা। ট্রুথ সম্পূর্ণ বাতিল। সবাইকে বাধ্য করেছিল খেলায় অংশগ্রহণ করতে। উলটা-পালটা ডেয়ারে আড্ডা বেশ জমে উঠেছিল। যখন আফরা আপুর পালা এসেছিল, তখন তাজ ভাই না কি তার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন ওটা নিয়ে আফরা আপুর বাবার হাতে দিতে। এরূপ ডেয়ারে সবাই অবাক হয়েছিল। আফরা আপু কিছুতেই রাজি ছিল না। খেলা রেখে উঠে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু নিয়ম ভঙ্গ করা চলবে না বলে সবাই মিলে তাকে বাধ্য করেছিল ডেয়ার পূর্ণ করতে। শেষমেষ আফরা আপু মানতে বাধ্য হয়েছিল। তাজ ভাইয়ের দেওয়া কাগজটাই নিয়ে দিয়েছিল তার বাবার হাতে। ওই কাগজটাই হলো সব ভেজালের মূল। যাতে লেখা ছিল,

বাবা,
তোমাকে একটা কথা বলব-বলব করেও কিছুতেই বলতে পারছি না। কীভাবে বলব তা-ই মাথায় আসে না। লজ্জা লাগে; তবু আজ লিখে দিলাম। প্লিজ তুমি কিছু মনে কোরো না। আসলে আমি তোমাদের মিথ্যে বলেছিলাম। তোমার পছন্দ করা ছেলেকে আমার পছন্দ হয়নি, এ কথা বলেছিলাম মনের আশঙ্কা থেকে। সত্যি বলতে, বিয়ে, সংসার নিয়ে সবসময় আমার মনে একটা আশঙ্কা চলে। সেই কারণেই বিয়েতে রাজি হওয়া নিয়ে আমি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। এবার আমি অনেক ভেবেছি। তারপর ঠিক করেছি সাহস জুগিয়ে আশঙ্কা কা’টিয়ে আমি তোমাদের কথার মান রাখব। তোমার পছন্দের ছেলেকেই আমি বিয়ে করব। আমার আর কোনো আপত্তি নেই। আরেকটা কথা, দয়া করে তুমি এসব নিয়ে আমাকে আর কোনো প্রশ্ন কোরো না। তাতে কিন্তু আমি লজ্জায় ম’রে যাব। তুমি বরং আজই ওনাদের জানিয়ে দাও যে, বিয়েটা হবে। আর রাজ ভাইয়ের বিয়ের পরপরই বিয়ের তারিখ ঠিক করো। আবার বলছি, আমায় একদম লজ্জায় ফেলবে না।
ইতি
তোমার আদুরে কন্যা
আফরা

চিঠিটা পাওয়ার সাথে-সাথেই ফুপা পাত্রপক্ষের সঙ্গে কথা বলে বিয়ে কনফার্ম করে ফেলেছিলেন। তারপর সবাইকে জানিয়েছিলেন। খবর শুনে সবাই বিস্মিত হলেও, আফরা আপুর অবস্থা ছিল ম’রি-ম’রি। চিঠির ভেতরের খবর জেনে সে ম’রা কান্না জুড়ে বসেছিল। অথচ ততক্ষণে তার বাবা কয়েক কেজি মিষ্টি এনে বাসাসুদ্ধ সবাইকে মিষ্টিমুখ করিয়ে ফেলেছিলেন। এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল যে, আফরা আপু ডেয়ারের কথাটাও মুখে আনতে পারেনি। কারণ পাত্র বাতিল করতে-করতে সে ফুপাকে রীতিমতো ঘোলাপানি খাইয়ে ছেড়েছে। এই পাত্রপক্ষ আজকাল থেকে ঘুরছে না, বহুদিন হলো। তাই তো তার বাবা-মা বিয়ে কনফার্ম করে এত বেশি খুশি হয়েছিল। এরপরও যদি সে একবার মুখ খুলে বলত সে আসলে বিয়ে করতে চায় না, তাহলে নিশ্চিত তাকে ঘরছাড়া করত। বিয়ে নিয়ে কম জ্বালায়নি সে। আর এবার তো বিয়ে কনফার্ম হওয়ার পরও ভেঙে ফেলা মানেই ফুপার সম্মান নষ্ট। সবদিক ভেবে আফরা আপু কেবল যন্ত্রণা চেপে কাঁদা ছাড়া কিছুই করতে পারেনি।‌ অথচ খেলায় অংশগ্রহণ করা জনগণ ছাড়া বাসার ছোটো থেকে বড়ো সবাই এক কথায় ভেবে নিয়েছিল বিয়ে ঠিক হয়েছে বলে দুঃখ-কষ্টে আফরা আপু ওভাবে কাঁদছিল। কাগজটা আফরা আপু তার বাবার থেকে নিয়ে পড়েছিল। তারপর বড়োদের চোখের আড়ালে তাজ ভাইয়ের সাথেও ঝামেলা করেছিল। তার থেকে আবার কাগজটা জুম্মান ভাইয়া নিয়ে পুরো গ্যাংকে শুনিয়েছিল। তারপর আর ফেরত দেয়নি। তার বদৌলতে আমিও পড়তে পারলাম। তার পর থেকেই মাথার ভেতর হাজার-হাজার প্রশ্ন মাথার ভেতর গুবরে
পোকার মতো কামড়ে চলেছে। তার ওপর আবার জুম্মান ভাইয়া বলে বসলেন,
“কেন জানি মনে হচ্ছে ছয় বছর আগের চির স্মরণীয় ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। ইন্টারেস্টিং রিভেঞ্জ!”
রিভেঞ্জ, হ্যাঁ। এ ছাড়া এই অদ্ভুত কাণ্ডের অন্য কোনো অর্থ তো দাঁড়ায় না। যেদিক থেকেই ভাবনা শুরু হোক, শেষ প্রান্তে গিয়ে সেই রিভেঞ্জেই ঠেকে যায়। সকালে যখন থেকে আফরা আপুর বিয়ে ফিক্সড হওয়ার কাহিনি জানলাম, তখন থেকেই মাথা হ্যাং হয়ে বসে আছে। কেবলমাত্র রিভেঞ্জ শব্দটা ছাড়া কিছুই মাথায় আসছে না। মস্তিষ্কটা চক্রাকারে ঘুরতে-ঘুরতে আবার ঠিক কোন দিকে গিয়ে থামে, ধারণা একদমই নেই। আজ রাজ ভাইয়ের গায়ে হলুদ। বাসায় আত্মীয়-স্বজনের সংখ্যা বাড়ছে। এদিকে আমার শরীরের তাপমাত্রা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এই বাড়ছে, তো এই কমছে। সকালে নাস্তার টেবিলে তাজ ভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছিল। চোখাচোখি হওয়া তো দূর, আমার অস্তিত্ব নাই করে একবার চোখ তুলেও তাকায়নি।‌ এমনকি সারাদিনে যতবারই আমার সামনে পড়েছে, রীতিমতো এড়িয়ে গেছে। তা-ও আবার ইচ্ছে করেই। আমিও বিশেষ তোয়াক্কা করিনি। থাকুক যে যার মতো করে। কারো কোনো বাজে কথা শোনার ইচ্ছে আর আমার নেই। সন্ধ্যায় আব্বু এল। তাকে পেয়ে যেন আমি অসুখ ভুলে গেলাম। আমার জ্বরের অবস্থা দেখে আব্বুর মন খারাপ হলো। বুকে জড়িয়ে বসে রইল। এতেই আমার সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। আজ আমিরা আপুদের সাথে শাড়ি পরতেও রাজি হলাম। শরীর কিছুটা ভালো লাগছে। আম্মি আমায় একটা হলুদ শাড়ি দিয়েছে অনুষ্ঠানে পরার জন্য। দেখে মনে হলো নতুন শাড়ি, এখনও ভাঁজ খোলো হয়নি। সেটা পরার পর আমিরা আপু আর মিনহা আপু আমাকে ধরে-বেঁধে হালকা মেকআপ করে দিলো। কোনো বাঁধাই তারা শুনতে রাজি নয়। অথচ তাদের মেকআপ করা আর শেষ হচ্ছে না। চুলগুলো আঁচড়ে আমি আমিরা আপুদের বাসা থেকে বেরিয়ে এলাম। করিডোরেই তাজ ভাই, শ্রেয়ান ভাইয়া আর আদনান ভাইয়া দাঁড়িয়ে ছিল। না চাইতেও দৃষ্টিটা প্রথমে ওনার ওপরেই পড়ল। উনিও হয়তো বেখেয়ালে তাকালেন। চোখাচোখি হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন। শ্রেয়ান ভাইয়া আমাকে বললেন,
“তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে ইলোমিলো। শাড়িটায় দারুণ মানিয়েছে। কার পছন্দ?”
আমি মৃদু হেসে উত্তর দিলাম,
“আম্মির।”
“ওহ্। আচ্ছা যাও।”
আমি ধীর পায়ে বাসায় ঢোকার সময় দরজায় পা রেখেই আদনান ভাইয়ার বিস্মিত কন্ঠস্বর শুনলাম।
“এই তাজ, এই শাড়িটা না তুই ফুপির জন্য কিনেছিলি? ফুপি তো নিজে না পরে ওকে পরতে দিয়ে দিলো।”
কয়েক মুহূর্তের জন্য আমার পা থেমে গেলেও, ফিরে তাকালাম না। কথাটার প্রত্যুত্তর না শুনেই দ্রুত পা চালিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। সায়মা আপু আমাকে দেখে হাসিমুখে বলল,
“কী সুন্দর লাগছে রে তোকে! কারো নজর না লেগে যায় আজ।”
আমি হেসে বললাম,
“তোমার জামাই বাবুর নজর না পড়লেই হলো।”
“আমার সতীন হওয়ার শখ জেগেছে?”
“হলে মন্দ হয় না। এই অছিলায় তোমার সাথে চুলাচুলি করব।”
সায়মা আপু হুঁ-হা করে হেসে বলল,
“পেটে-পেটে এসব বুদ্ধি নিয়ে ঘোরো?”
পাশ দিয়ে সৌরভ ভাইয়া যাওয়ার সময় পা থামিয়ে ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকালেন। ঈষৎ বিরক্তি নিয়ে বলল,
“আপু, ওই আমিরা আর মিনহা মহিলা দুটো আপনাকে মেকআপ করিয়েছে, না?”
আমি হতাশ ভঙ্গিতে বললাম,
“হ্যাঁ।”
“জানতাম, কারো ন্যচারাল লুক ওই আটা-ময়দাদের সহ্য হয় না।”
সায়মা আপু সৌরভ ভাইয়াকে বলল,
“কেন? ওকে তো ভালো লাগছে। তুই সর এখান থেকে। মেয়েদের মেকআপ নিয়ে গবেষণা করতে এসেছে।”
“তুমি তো সমর্থন করবাই। বিয়ের আগে আব্বুর টাকায় ময়দা ঘঁষেছ, বিয়ের পর এখন ভাইয়ার টাকায় ঘঁষ। তার চেয়ে বরং ভাইয়াকে বলো বাসার সামনে একটা ময়দার দোকান খুলে বসতে।”
সায়মা আপু ধমকে উঠল,
“সৌরভ, যেতে বলেছি। কানের নিচে একটা মা’রব কিন্তু। পাকামি করতে ডেকেছি তোকে?”
আমাদের কথার মাঝে আমিরা আপুকে দেখা গেল। যেখানে তাকে আজ সবচেয়ে গর্জিয়াস লুকে আশা করেছিলাম, সেখানে সে সাজ তো দূর, শাড়িও পরেনি। দিনের বেলা যেমন দেখেছিলাম, তেমনই আছে। এসেই সরাসরি আমাকে বলল,
“তোর সাথে একটু কথা আছে। আয় তো।”
আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে সে একপ্রকার টেনেটুনে আমাকে বেলকনিতে নিয়ে গেল। সে মুখ খোলার আগেই আমি আন্দাজ করে ফেললাম ঠিক কোন ধরণের কথা বলতে চলেছে সে। অতঃপর আমার ধারণার ষোলো কলা পূর্ণ করে সে চাপা স্বরে বক্তব্য শুরু করল,
“খুব খুশি হয়েছিস, না? আমাকে সরাতে পেরে একেবারে জ্বরটর ভুলে শাড়ি-মেকআপ দিয়ে সেলিব্রেট করছিস? আমি কিছু বুঝিনি ভেবেছিস? সব বুঝতে পেরেছি। তাজ ভাইকে দিয়ে পুরোনো প্রতিশোধ নিয়েছিস তুই?”
আমি বিরক্তিতে ঠোঁট ফাঁক করে নিঃশ্বাস ছাড়লাম।
বললাম,
“তুমি ওসব নিয়ে পড়ে থাকলেও, আমার এসব নিয়ে পড়ে থাকার অভ্যাস নেই। আজকের দিনেও ঝগড়া কোরো না প্লিজ।”
আফরা আপু তেলেবেগুনে জ্ব’লে উঠল,
“তুই মিথ্যে বললেই আমি বিশ্বাস করব? মিথ্যুক। এত বছর ধরে তাজ ভাই তোকে দুচোখে সহ্য করতে পারেনি। এখন তাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে সেই পুরোনো কথা বিশ্বাস করিয়ে আমাকে তার চোখে খারাপ বানিয়েছিস। তারপর বুদ্ধি খাটিয়ে তাকে দিয়ে আমার বিয়ের ব্যবস্থাও করে ফেলেছিস। ভেবেছিস একদিকে তোর বাঁধাও থাকবে না, আরেকদিকে প্রতিশোধও নেওয়া হলো। ওপরে বোকা-সোকা সেজে পেটে ভালোই কুবুদ্ধি রাখিস। তোকে চেনা হয়ে গেছে আমার।”
“তুমি তা ভাবার ভাবতে পারো আপু। কিন্তু আমি এসব কিছুই করিনি। এমনকি আমি এসব জানতামও না। সকালে ঘুম থেকে উঠে জুম্মান ভাইয়ার থেকে জেনেছি। আর সবার মতো আমি নিজেও অবাক হয়েছি। কারণ তাজ ভাই এমন কিছু করবে তা আমি ভাবতেও পারিনি।”
“সাধু সাজছিস? সাধু সেজেই তো পটিয়েছিস তাজ ভাইকে। নইলে যে তাজ ভাই সুইডেন চষে বেড়িয়েও একটা প্রেম অবধি করল না, সে কি না তোর কথায় পটে যায়! তোর মতো মেয়েরা থাকেই এসব ধান্দায়। কীভাবে টাকা-পয়সা ওয়ালা ছেলে হাত করবে, আর আজীবন পায়ের ওপর পা তুলে বসে আরামসে জীবন-যাপন করবে। এত লোভী কীভাবে হলি রে তুই?”
আফরা আপু ভয়ঙ্কর রেগে গেছে। তার তীরের মতো বাক্য শুনে আমার মাথায়ও রাগ চড়ে বসেছে। আমি চাপা স্বরে শক্ত গলায় বললাম,
“চিৎকার করবে না আপু। তাজ ভাইয়ের পেছনে আমি ঘুরিনি, ঘুরেছ তুমি। ভুলে গেছ?”
“সেটাই তো তোর সহ্য হয়নি। আমি তাজ ভাইয়ের মতো ওমন একজন পারফেক্ট ছেলেকে পছন্দ করি, তা দেখে হিং’সায় জ্ব’লেছিস। সেজন্যই তো বুদ্ধি খাটিয়ে এই বাসায় উঠেছিস, যাতে তাকে তুড়ি মে’রে হাত করে ফেলতে পারিস। এই এসব তোর বাপ-মা শিখিয়ে দিয়েছিল না কি রে? প্ল্যান করে মেয়ের ভবিষ্যত উজ্জ্বল করার জন্য এত নিচে নেমেছে? মামার বন্ধু সেজে নিজের স্বার্থসিদ্ধির ব্যবস্থা করছে? এত টাকার লোভ তোদের? ছিঃ!”
আমি চেষ্টা করেও চোখের পানি আটকাতে পারলাম না। এ আমার বিখ্যাত দোষ। কারো কটুক্তি সহ্য হয় না। আর তা যদি হয় মিথ্যে অপবাদ, তাহলে তো তা সহ্য সীমার বাইরে। তবু ছলছল চোখে আমি প্রতিবাদ করলাম,
“খবরদার আপু, আমার আব্বু-আম্মুকে নিয়ে একটাও বাজে কথা বলবে না। সোজা গিয়ে ফুপাকে জানাব আমি। তোমার এই বিশ্রী মানসিকতা সম্পর্কে সবাইকে জানাব। তুমি নিজেই তো সবার সামনে সাধু সেজে থাকো, আর এই মুহূর্তের রূপটাই হলো তোমার আসল রূপ। আমাকে বাজে কথা শোনানোর আগে নিজের মনটাকে ঠিক করো। আমার তো এখন মনে হচ্ছে তাজ ভাই তোমার মতো মেয়েকে নিজের থেকে দূরে সরাতেই এই কাজটা করেছে। উনি ভালো করেই জানেন, কে কত সাধু।”
আফরা আপু নিজের খারাপ মানসিকতার ঊর্ধ্বে উঠে এমনসব কথা বলল যে, আমি কোনোমতে তার সঙ্গ ছেড়ে রুমে চলে এসেছি। কারণ তার সাথে তাল মেলানো আমার কর্ম নয়। কিন্তু অবাধ্য চোখের জল বাঁধা মানল না। ঘৃণায় ঝরঝর করে ঝড়ে চলল। ওয়াশরুমে ঢুকে নিঃশব্দে কাঁদলাম। এত জঘন্য কথা আমি কেবল আফরা আপুর মুখেই শুনেছি। এর আগে কোনোদিন অন্য কোনো ব্যক্তি আমায় নিয়ে জঘন্য মন্তব্য করেছে বলে আমার মনে পড়ে না। সবাই এসব হজম করতে পারে না, তন্মধ্যে আমিও। ওয়াশরুমের দরজার বাইরে থেকে সায়মা আপুর ডাক শুনে দ্রুত মুখে পানির ঝাপটা দিলাম। ছাদে যাওয়ার জন্য তাড়া দিচ্ছে সে। সবাই না কি চলে যাচ্ছে। এদিকে আমি কান্না লুকাতে গিয়ে আমার মেকআপের বারোটা বাজিয়ে বসে আছি। বিরক্তি নিয়ে ঘষেমেজে মুখ থেকে মেকআপ নামক প্যারা ধুয়েমুছে সাফ করে ফেললাম। নিজেকে সামলে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে সায়মা আপুকে পেলাম না। কিন্তু ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়াতেই দুটো জিনিস পেলাম। একটি অতি পরিচিত চিরকুট, আরেকটি বেলী ফুলের বড়ো মালা। মালাটা হাতে তুলতেই নাকে সুঘ্রাণ ধাক্কা খেল। নাকের কাছে নিয়ে কিছু মুহূর্ত প্রাণভরে ঘ্রাণ নিলাম। তাজা ফুলের মালা। তারপর চিরকুট খুললাম।

মনোহারিণী,
আমার শুভ্রতা জড়ানো নিষ্পাপ কামিনি। শুভ্রপ্রেমীর বেলী ফুলের এক টুকরো শুভ্রতা আমার ব্যক্তিগত ফুলের জন্য। এ জীবন, আজীবন আমার বক্ষ জুড়ে ফুলের মতো ফুটে থাকুক সে। এক শুভ্রপ্রেমীর নিজস্ব পৃথিবীর সমস্ত শুভ্রতা তার নামে লিখে দেওয়া হলো। তবু সে একটুখানি হাসুক সূর্যমুখীর ন্যায়, শুভ্রতা ছড়াক বেলীর। কেউ একজন সেই আকাঙ্ক্ষিত শুভ্রতামাখা হাসির অপেক্ষায়। ওহ্ হ্যাঁ, ওই বেলীর চাহিদা কেবল মনোহারিণীর ঘনকালো কেশ।
ইতি
কোনো এক শুভ্রপ্রেমী

চিরকুটটা পরপর তিনবার পড়লাম। মালাটা দুহাতে তুলে বারংবার ঘ্রাণ নিলাম। কিন্তু কেশে আর ছোঁয়ানো হলো না। গলায় কান্নারা দলা পাকাতে লাগল। বহুকষ্টে সেই কান্নাটুকু গিলে আমি হাতের মালাটা মুচড়াতে গিয়েও মুচড়ালাম না। দ্রুত নিজের ব্যাগের ভেতর ঢুকিয়ে ফেললাম। তারপর বড়ো করে শ্বাস নিয়ে খোলা চুলগুলো বেঁধে বেরিয়ে পড়লাম। এখন কেবল শাড়ি ব্যতীত বাড়তি সাজ নেই বললেই চলে। কানের দুল দুটোও খুলে ফেলেছিলাম। তবে আগের থেকে এখনই বেশ হালকা লাগছে। আমার অবস্থা দেখে সবার চোয়াল ঝুলে পড়ার জোগাড়। সবার একই প্রশ্ন, আমি সাজ উঠালাম কেন। আমিরা আপু রীতিমতো রেগে গেছে। আমি তাদের কোনোমতে বিশ্বাস করালাম, অস্বস্তি হচ্ছিল বলে সাজ উঠিয়ে ফেলেছি। কথাটা তারা বিশ্বাস করল শুধুমাত্র আমি অসুস্থ বলেই। আমিও সুযোগটা কাজে লাগিয়েছি। ছাদে যাওয়ার পরও ছোটো-বড়ো সবার একই প্রশ্নের উত্তর দিতে হলো। সবাই দুঃখ প্রকাশ করলেও, সৌরভ ভাইয়া হাসিমুখে বলে উঠল,
“আমি জানতাম আপনি ওসব ছাইপাশ উঠিয়ে ফেলবেন। একদম ভালো করেছেন। ওই ময়দাওয়ালীদের দলে নাম না লেখানোই শ্রেয়।”
আমি উত্তর দিলাম,
“আপনি কি জানেন না বলুন তো? সবই তো দেখছি জানেন।”
হলুদের অনুষ্ঠান জমজমাট হয়ে উঠেছে। রাজ ভাই বেজায় খুশি। তার মুখের মিষ্টি হাসিটাই যেন সবার আনন্দ দ্বিগুণ বাড়িয়ে তুলেছে। কিন্তু আমার জন্য সমস্যা হচ্ছে সাউন্ড বক্সের তীব্র শব্দ। প্রত্যেকটা শব্দ যেন ধুপ-ধাপ করে মাথায় আঘা’ত হানে। স্টেজের সামনেই ক্যামেরা হাতে দেখা যাচ্ছে তাজ ভাইকে। স্টেজের প্রত্যেকটা মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দী করতে ভীষণ ব্যস্ত সে। মাঝে-মাঝে আবার চারপাশেও ক্যামেরা তাক করছে। এগিয়ে এসে নূর আঙ্কেল আর আব্বুর ছবিও তুলেছে। আব্বুর পাশে কোনো হাতি, না ঘোড়া বসে আছে, সেদিকে যেন ভ্রুক্ষেপই নেই। পুরোটা অনুষ্ঠান আমি কা’টিয়ে দিলাম আব্বুর পাশে বসে। এদিকে একেকজন হলুদ নিয়ে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিয়েছে। কে কাকে মাখাতে পারে। আব্বু আমার শরীরের অবস্থা বিবেচনা করে কাউকে হলুদ লাগাতে দিলো না। আমিও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। এসব একদমই ভালো লাগে না। রাত-বিরেতে আবার হলুদ ঘষেমেজে উঠাতে হত। আমার স্বস্তির নিঃশ্বাসটা বুঝি আমার একার কানে পৌছাল না। যার কর্ণগোচর হলো, তার বুঝি সহ্যও হলো না। সবার হৈ হুল্লোড়ের মাঝেই আমি টের পেলাম পেছন থেকে কেউ বাঁধা চুলগুলো থেকে কাটার খুলে নিয়েছে। চকিতে পেছন ফিরে তাকালেও, ভীড়ের মাঝে সঠিক মানুষটির সন্ধান পেলাম না। তবে খোলা চুলগুলো মুঠোয় নিয়ে বাঁধতে গিয়ে স্পষ্ট টের পেলাম ঘাড়ে ভেজা বস্তুর অস্তিত্ব। দ্রুত চোখের সামনে হাত মেলে ধরতেই কাঁচা হলুদ বাটার গন্ধ নাকে লাগল। পুনরায় ঘাড়ে হাত বুলালাম। একটুখানি হলুদ, সম্ভবত দুই আঙুলে ছোঁয়ানো। ভারী নিঃশ্বাস ফেলে আমি মুঠোয় ধরা চুলগুলো আবার পিঠে মেলে দিলাম। অতঃপর স্টেজের দিকে মনোনিবেশ করতে গিয়ে স্পষ্ট দৃষ্টিগোচর হলো, দেহ-মনে প্রিয় শুভ্রতা জড়ানো মানুষটির শুভ্র দুই গালে টকটকে হলুদের ছোঁয়া দিলো আমিরা আপুর দুটি উচ্ছল হাত।

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

#মনোহারিণী
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৯.
জ্বরের সঙ্গে আমার এক আত্মিক সম্পর্ক আছে। সেই ছোটোবেলা থেকে প্রত্যেক পরীক্ষা আসার আগমুহূর্তে আমার জ্বর হয়। যেকোনো বিশেষ দিন এলেই বিনা নিমন্ত্রণে জ্বর মশাই এসে উপস্থিত হয়। জ্বরের একটা ভালো দিক হচ্ছে, আম্মুর ভালোবাসার মাত্রা বেড়ে যায়। যেমন, সাধারণত দু-এক বেলা ভাত খাইয়ে দেয়, অথচ জ্বর হলে প্রতিবেলা খাইয়ে দেয়। বলতেও হয় না। কিন্তু এবার তো আম্মু নেই। আম্মি শত ব্যস্ততার মাঝেও যতটুকু সম্ভব করে চলেছে। তবে আজ আব্বু থাকায় সে একটু স্বস্তি পেয়েছে। গতকাল রাতেও আব্বু আমার কারণে ঘুমাতেও পারেনি। আজও সকাল থেকে পাশ থেকে নড়ার নাম নিচ্ছে না। এদিকে আমার ভাল্লুক জ্বর আবার বেড়েছে। ওদিকে রাজ ভাইয়ের বিয়ের আনন্দোৎসব চলছে। যে যার মতো রেডি হচ্ছে কমিউনিটি সেন্টারে যাওয়ার জন্য। এই অসুস্থ শরীরে রেডি হওয়া তো দূর, বাসা থেকে বেরোতেও শরীর সায় দিচ্ছে না। এরমধ্যে সায়মা আপু এসে আমার হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বলল রেডি হতে। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
“এটা কিসের?”
আপু বলল,
“খুলে দেখ।”
প্যাকেট খুলে পেলাম একটা লাল শাড়ি। অবাক হলাম।
“শাড়ি! এটা পড়বে তুমি?”
সায়মা আপু বুঝি ঈষৎ বিরক্ত হলো। আমার ওপর, না আমার কথার ওপর?
“চশমা লাগিয়ে কানা হওয়া থেকে বেঁচেছিস জানতাম। তাই বলে যে আজকাল চোখে কোনোকিছুই দেখতে পাস না, তা তো জানতাম না।”
“অ্যাঁ!”
“হ্যাঁ, আমাকে দেখে তোর কেন মনে হচ্ছে আমি আবার রেডি হব? কষ্ট করে একবার রেডি হইনি?”
খেয়াল করে দেখলাম সায়মা আপু শাড়ি-টারি পড়ে একদম রেডি। নিজের উদাসীন মনটার ওপর ভীষণ বিরক্ত হলাম।
“আমি রেডি হয়েই তোর কাছে এসেছি। জানতাম এখনও বসে আছিস। নে, চটপট রেডি হ। আয়, আমি দ্রুত শাড়ি পরিয়ে দিই।”
আমি শাড়িটার দিকে আপত্তিকর চাহনিতে তাকিয়ে রইলাম। এই অসুস্থ শরীরে শাড়ি পরার মতো মানসিকতা নেই। তার ওপর আবার টকটকে লাল শাড়ি! আপু তাড়া দিলো,
“তোর লাল পেটিকোট আছে না? বের কর তাড়াতাড়ি। সবাই রওয়ানা হতে চলেছে। আমরা পড়ব সবার শেষে।”
আমি কাঁচুমাচু মুখে বললাম,
“শাড়ি পরে থাকতে পারব না আপু। শরীরের যেই অবস্থা!”
“সবাই পরেছে, তুই পরবি না মানে কী? শরীর ঠিক হয়ে যাবে। তুই কি দৌড়ঝাঁপ করবি? গিয়ে চুপচাপ বসে থাকবি, আমরা তো আছিই। না করিস না প্লিজ।”
“তুমি বুঝতে পারছ না, আমার একটুও ইচ্ছে করছে না শাড়ি পরতে। শেষে দেখবে মাথা ঘুরে-টুরে পড়ে থাকব।”
সায়মা আপু নাছোড়বান্দা, সে শাড়ি পরাবেই। আমিও সমানে আপত্তি জানিয়ে জামাও বের করে ফেলেছি। এরমধ্যে আম্মি এসে বলল তারা চলে যাচ্ছে। আমরা যেন জুম্মান ভাইয়ার সাথে আসি। যাওয়ার সময় শাড়ি দেখে প্রশ্ন করল,
“শাড়ি কার?”
সায়মা আপু উত্তর দিলো,
“আমি এনেছি ইলোর জন্য। সুন্দর না?”
“হ্যাঁ, কবে এনেছিস?”
“এনেছিলাম শপিংয়ে যাওয়ার দিনই, আজ বের করলাম।”
“ওহ্ আচ্ছা, কিন্তু ও শাড়ি পরবে না বলছে। সেজন্যই তো আমিও জোর করিনি। অসুস্থ শরীর, পরতে না চাইলে জোর করার দরকার নেই। ও যাতে আরাম বোধ করবে, তা-ই পড়ুক।”
আম্মি চলে যাওয়ার পর আমি সায়মা আপুকে বললাম,
“আপু, আমি কিন্তু বাচ্চা না। শাড়িটা যে তুমি কিনোনি, তা বুঝতে আমার এক সেকেন্ডও সময় লাগেনি।‌ আর না তুমি আমার হাতে মেহেদি পরিয়েছিলে। সবাইকে বুঝাচ্ছ তুমি পরিয়েছ, আমি কিন্তু ওসব বুঝিনি। আজকাল আমার বিপক্ষে চলে যাচ্ছ।”
আপু অবাক হয়ে বলল,
“এই, আমি কি রাজনীতি করছি? পক্ষ-বিপক্ষ আবার কী? তুই বাচ্চা না তা আমিও জানি। এখন তোকে কিচ্ছু বুঝতেও হবে না। পাকামি রেখে পেটিকোট নিয়ে আয়, আর ওই জামা রাখ।”
আমি সে কথা কানে তুললাম না। জামা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢোকার আগে শুধু বললাম,
“শাড়িওয়ালাকে বলে দিয়ো, অতিরিক্ত ভাবওয়ালা মানুষের এসব ঢং মানায় না। ভাবে ভাটা পড়ে যাবে।”
জুম্মান ভাইয়া, সায়মা আপু, আমিরা আপু আর মিনহা আপু আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। ফলস্বরূপ সবার শেষে কমিউনিটি সেন্টারে পৌঁছালাম আমরা। তখন চারদিকে এলোপাথাড়ি ফটোশুট চলছে। থামাথামির বালাই নেই কারো। অসুস্থতায় বিরক্তি নামক শব্দটা ধরা দেয় খুব সহজেই। বিরক্তি না আসার মতো বিষয়েও বিরক্তি এসে যায়। আমিও কিঞ্চিত বিরক্ত হলাম। যেচে কারো সাথে কথা বাড়ালাম না। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে দু-এক লাইনে উত্তর দিলাম। অবাধ্য চোখ জোড়া চারদিকে সন্ধান চালিয়ে আজকের সবচেয়ে বিরক্তিকর দৃশ্যে আটকাল। মহাশয় তার প্রাণপ্রিয় বান্ধবী জেসিকা আনামের সাথে সেলফিতে মগ্ন। মুখে সেকি বিশ্ব জয়ের হাসি! যেন বহু বছরের সাধনার পর কোনো প্রকৃত সুন্দরীর সাথে বহুল আকাঙ্ক্ষিত সেলফি তুলতে সক্ষম হয়েছে। চারপাশের সুন্দরী মেয়েদের নজর কাড়ার ধান্দাও হতে পারে। একে বিশ্বাস নেই। লোকটার স্বভাবে বিশাল আকারের দোষ আছে। দু-একটা ছ্যাঁ’কা খেলে উচিত শিক্ষা হত। ছ্যাঁ’কা একেবারে উত্তম মেডিসিনের কাজ করত। এমতাবস্থায় ছ্যাঁ’কাটা আসলে দিবে কে, তা নিয়ে ভয়া’বহ চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমার বিরক্তির আ’গুনে ঘি ঢালতে কুলসুম আপার আগমনই যথেষ্ট ছিল। এসেই বক্তৃতা শুরু করলেন,
“দেখছেন আফা? সবাই কত আনন্দ করতাছে, আর আপনে চুপচাপ বইয়া দেখতাছেন। এরেই কয় নিয়তি। আপনের লাইগা আমার যে কী কষ্ট লাগতাছে! অসুখটা আর সময় পাইল না।”
আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে পুনরায় বলে চলল,
“আমি না একটা জিনিস বহুদিন ধইরা খেয়াল করতাছি। প্রথমে আপনে ছোডো ভাইজানের থিকা দূরে থাকার কত চেষ্টা করতেন। অথচ অহন যেই সময়ই আপনেগরে দেখি, সেই সময়েই দেখি দুইজন আঠার মতো চিপকায় আছেন।”
আমি কপাল কুঁচকে তাকাতেই কুলসুম আপা দাঁতে জিব কে’টে সংশোধন করল,
“কিছু মনে নিয়েন না আফা। আমি কইতে চাইছিলাম, দুইজনরে সবসময় একসাথেই দেখি। আর ছোডো ভাইজান যে আপনেরে অনেক ভালো জানে, তা-ও কিন্তু আমি বুইঝা গেছি। খালি-খালি আপনে ওনারে ডরাইতেন। কিন্তু আফা, দুইদিন ধইরা আপনেরা দুইজন দূরে-দূরে থাকতাছেন, আবার কথাও কইতাছেন না ক্যান? আপনেগো কি ঝগড়া হইছে? কিন্তু আমি তো জানি আপনে কারো সাথে ঝগড়া করেন না। আর আমার বিশ্বাস, আপনের মতো মাইয়া কোনো দোষও করতে পারে না। তাইলে কি ছোডো ভাইজান দোষ করছে? ও আফা, কন না বুঝাইয়া।”
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে রইলাম। এ সার্ভেন্ট, না কি সিসি ক্যামেরা? কাজের ফাঁকে এতকিছু খেয়াল করে কীভাবে? মনে তো হচ্ছে এতদিন ধরে সে নিজের কাজ রেখে ডিটেকটিভের ওপর ডিটেকটিভিটি চালিয়েছে। কী সাংঘা’তিক মহিলা! তবে আমার বিরাট ভক্ত হিসেবে যে সে আপাতত আমাকে নির্দোষ, আর তাজ ভাইকে দোষী সাব্যস্ত করে নিজেই ভয়া’নক বিশৃঙ্খলায় পড়ে গেছেন, তা তার চুপসানো মুখ আর কুঁচকানো কপাল দেখেই বুঝা যাচ্ছে। নিজের বিরক্তি দমাতে আর কুলসুম আপার মুখ বন্ধ করতেই আমি প্রসঙ্গ পালটে ফেললাম। কৌতুহল নিয়ে জানতে চাইলাম,
“আপনার ছেলেকে আনেননি, কুলসুম আপা?”
কুলসুম আপা দারুণ খুশি হলেন। দু পাটি দাঁত বের করে হেসে মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন,
“হ, আনছি তো। অর বাপেও আইছে। পোলায় কান্দে দেইখা অর বাপের কোলে দিয়া দিছি। আমার পোলাডা হইছে বাপের মতোই হাঁড়ে ব’জ্জাত, বুঝলেন? অর বাপে আমার মগজ ভাইজ্জা ফালায়, আর অয় ভাজে কলিজা। দুইজনে মিল্যা আমার জীবনডারে ভাজা-ভাজা কইরা দিছে। আমি দেইখা তবু সংসার করতাছি। অন্য মহিলা হইলে কবে সংসারের পা’ছায় লা’ত্থি মা’ইরা বিদায় হইত।”
আমার বিরক্তি কমার বদলে আরও একগুণ বাড়ল। কুলসুম আপার এই সংসার জীবনের চরম দুঃখের বিখ্যাত গল্প শুনতে-শুনতে পুরোনো হয়ে মরিচা ধরার জোগাড়; তবু তার এই গল্পের শেষ নেই। সুযোগ পেলেই সে দুঃখের ঝুলি খুলে বসে আর কান ঝালাপালা করে ফেলে। কুলসুম আপার গল্প জমে ওঠার আগেই আমি দ্রুত বাঁধা দিলাম।
“আমার ভালো লাগছে না কুলসুম আপা। আপনি কি আমায় এক গ্লাস ঠান্ডা জুস এনে দিতে পারবেন?”
সে বকবক থামিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠল। কপালে হাত দিয়ে বলল,
“আবার জ্বর উঠছেনি আফা? বড়ো আফারে ডাকমু?”
“না, আমি ঠিক আছি। শুধু এক গ্লাস জুস এনে দিন।”
“আইচ্ছা।”
আপা বিদায় হওয়ায় হাঁফ ছাড়লাম। তার বকবক শুনে না আবার মাথা ধরে যায়। কিন্তু না, শান্তি মিলল না। কোত্থেকে উড়ে এসে আলগোছে পাশের চেয়ারে বসলেন সম্মানিত ডিটেকটিভ সাহেব। আমি ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বসে রইলাম। উনি সরাসরি তাকালেন না। নীরবে হাত উঁচিয়ে কপালে ঠেকালেন। তাপমাত্রা বুঝে নিয়ে আবার নামিয়ে নিলেন। এর পরের কাজটা করলেন আরও শান্তভাবে। আমার কোলের ওপর থেকে ডান হাতটা তুলে নিজের কোলে নিলেন।আমি নীরব চোখে চাইলাম দুটো শক্তপোক্ত হাতের মুঠোয় বন্দী আমার অবলা হাতটার পানে। দেখলাম শক্তপোক্ত হাত দুটির একটি নিজের রক্তলাল পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা বেলি ফুলের ছোটো মালা বের করে আমার হাতে প্যাঁচিয়ে দিলো। অনুভূতিটুকু সূক্ষ্ম অভিমানে বুঝি গ্রাস হলো। আগ বাড়িয়ে মুখ ফুটে কথা বেরুল না। কেবল মন আওড়াল, সে কেন বলার চেষ্টা করছে না।‌ রাগ থেকে ছোটো একটা কথাই তো বলেছিলাম, তার জন্য এমন কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেছে? মুখে তো একবার জিজ্ঞেসও করতে পারত, শরীর কেমন আছে। পেছনে যত্ন দেখিয়ে মনে রাগ পুষে রাখবে কেন? সে স্বাভাবিক হলে আমি কি মুখ ভার করে থাকতাম? একটামাত্র কথা বললে কি উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে যেতাম? চেষ্টাটুকু তো করল না। পৃথিবীর সমস্ত রাগ, অভিমান বুঝি শুধু তার মধ্যেই আছে? এই যে হাতে এত যত্ন নিয়ে মালা পরাল, আমি কি বাঁধা দিয়েছি? মুখ না খুলে বোবার মতো হাতের দিকে তাকিয়ে থাকার কোনো মানে হয়? হাতের রূপ বেড়েছে, না বেলি ফুলের মালার প্রেমে-ট্রেমে পড়ে গেছে? কখন না আবার কেউ এ বিরল দৃশ্য দেখে চেঁচিয়ে অজ্ঞান-টজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকে। সতর্ক দৃষ্টি চারদিকে ঘুরাতে গিয়ে সর্বপ্রথম আমার দৃষ্টিগোচর হলো আফরা আপু। তার পাশাপাশি হাঁটছে তার হাস্যোজ্জল হবু বর। তাদেরকে বিয়েতে নিমন্ত্রণ করেছেন নূর আঙ্কেল। এদিকে আফরা আপুর চোখে-মুখে রাজ্যের বিরক্তি। নিজের হবু বরকে না পারছে সাদরে গ্রহণ করতে, না পারছে এড়িয়ে চলতে। আমি আলগোছে নিজের হাতটা সরানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না। হাতের বাঁধন শক্ত হলো। আফরা আপু এদিকেই আসছে। আমি বিরক্ত হলাম। একটু জোর খাটানোর প্রয়োজন বোধ করলাম। কিন্তু তাতেও লাভ হলো না। হাত ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করে বিরক্ত চোখ তুলে তাকালাম। ওমা! মহাশয় সূক্ষ্ম চোখে আফরা আপু আর তার হবু বরকে দেখছে। বাড়তি বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে এল। এভাবে দেখার কী আছে? এমন তো নয় যে প্রথম দেখছে। কষ্ট লাগছে বুঝি? কই? এদিকে তো একবারও চোখ ঘুরল না। আমাকে অবাক করে দিয়ে আফরা আপু আমাদের কাছে থামল না। পাশ দিয়ে চলে গেল। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে লাগলাম আফরা আপু কোন দিকে যাচ্ছে। এদিকে উনি আমার হাতের মুঠোয় একটা বস্তু গুঁজে দিয়ে হাত ছেড়ে উঠে হনহনিয়ে চলে গেলেন। তবু একবার তাকালেন না, আশ্চর্য! গুমোট মুখে মুঠোর চিরকুট খুললাম।
“প্রখর আত্মসম্মানের অধিকারী দুজন মানুষের মধ্যকার অভিমান বড়ো ভয়া’নক হয়। না যায় বলা, না যায় সওয়া। কেউ-কেউ তো অপর মানুষটার মনের খোঁজটাও নেয় না। তারা কী ভাবে? অপর মানুষটা বেশ আছে? দিব্যি হেসে-খেলে দিন পার করছে? আরামসে ঘুমিয়ে রাত ভোর করছে? আদৌ কি তা হয়? অভিমানে বুঝি মনের খোঁজ নেওয়া-ও বারণ?”
এতক্ষণে কুলসুম আপারও আসার সময় হলো। সে এসেই জুসের গ্লাস বাড়িয়ে ধরে ছোটোখাটো কৈফিয়ত দিয়ে বসলেন।
“কিছু মনে কইরেন না আফা। আমার ব’জ্জাত পোলাডায় কাইন্দা ভাসাইয়া ফালাইতাছিল। অরে ঠান্ডা করতে গিয়া আপনের ঠান্ডা জুস গরম হইয়া গেছিল। অহন আবার ঠান্ডাডা নিয়া আইছি। লন, লন, তাড়াতাড়ি খাইয়া লন।”
চিরকুটটা হাতের মুঠোয় মুচড়ে ধরে আমি গভীর শ্বাস নিলাম। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে মৃদু স্বরে বললাম,
“আপনি খেয়ে নিন। আমার আর ইচ্ছে করছে না।”
“ক্যান? আবার কী হইল আপনের? হাছা কইরা কন তো আফা, আপনের শইল আবার খারাপ লাগেনি।”
“না।”
ছোট্ট উত্তরটা দিয়ে আমি সেখান থেকে প্রস্থান করলাম। জমজমাট অনুষ্ঠানের পুরো আয়োজন আমায় বিন্দুমাত্র ছুঁতে পারল না। খাবারটাও খুব একটা মুখে রোচল না। সবাই বরাবরের মতোই ভেবে নিল শরীর খারাপের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া। ইতোমধ্যে আফরা আপুর আরও এক ধাপ ক্রো’ধের মুখোমুখিও হতে হয়েছে আমায়। পূর্বের ন্যায় নিজের নোংরা মানসিকতা আর লাগামহীন কটূক্তি ঝাড়তে সে আজকের পরিবেশটাও বিবেচনা করেনি। তখনকার মুঠোবন্দী হাতের দৃশ্যটুকু মোটেও তার শকুন দৃষ্টি এড়াতে পারেনি। যা নয় তা বলে আমায় এটাই বুঝানোর চেষ্টা করেছে যে, আমি লোভ থেকে তাজ ভাইয়ের পেছনে পড়ে আছি। এমনকি সে আমার চরিত্রের দিকে আঙুল তুলতেও ভুলেনি। কমিউনিটি সেন্টার ভর্তি লোকজনের সামনে নিজের সম্মানটা হারানোর ভয়ে আজ আর জোর গলায় প্রতিবাদ করা হয়নি। তার মতো হওয়া সম্ভব ছিল না। চাপা স্বরে থামানোর শত চেষ্টাটা করেও ব্যর্থ হয়েছি। কিন্তু আত্মসম্মানে লাগা আঘা’তটা আজ আর সয়ে নিতে পারলাম না। শেষমেষ ঠিক করে নিলাম তাজ ভাইয়ের সাথে এ বিষয়ে কথা বলব। অনেক হয়েছে, এবার এর একটা বিহিত অবশ্যই জরুরি। নইলে এই আফরা মেয়েটার বাড়াবাড়ি সহ্যের সীমা অতিক্রম করেও থামার নাম নিবে না। আজ ওনাকে এর সমাধান দিতেই হবে। আমি কেন ওনার জন্য এসব ভোগ করব? কিন্তু ওনাকে একা পাওয়া গেল না। অনুষ্ঠানের পুরোটা সময় পুরোদস্তুর ব্যস্ত ছিলেন। কয়েকবার চারপাশে ঘুরঘুর করেও ফিরে আসতে হয়েছে, তবু উনি মুখ খোলেননি। জানতে চাননি কিছু বলার আছে কি না। মাইন্ড রিডিংয়ের কী হলো? ভাবলাম বাসায় ফিরে কথা বলব। অনুষ্ঠানের পাট চুকিয়ে সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরলাম ঠিকই, কিন্তু ওনাকে আর পেলাম না। বাসা থেকেই নিরুদ্দেশ সে। খুঁজেও দেখা মিলল না, আর না ফোনে পাওয়া গেল। ওদিকে আব্বু বাড়ি ফেরার তাড়ায় আছে। সবাই তাকে অনেক অনুরোধ করেছিল বউ-ভাতের পর যাওয়ার জন্য। কিন্তু সে থাকতে পারবে না। কী এক জরুরি কাজ আছে তার। হুট করে আমি বায়না ধরে বসলাম আব্বুর সাথে বাড়ি যাওয়ার। আমার কথা শুনে সবাই অবাক হলো। এক কথায় না-বোধক উত্তর দিয়ে দিলো। কিন্তু আমি রীতিমতো অনুরোধ করলাম। আম্মিকে বুঝালাম আমার আম্মুর কাছে না যাওয়া পর্যন্ত আমি সুস্থ হব না। তার কাছে গেলেই আমি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠব। তারপর রাজ ভাইয়ের বউ নিয়ে গ্রামে গেলে তাদের সাথে আবার ফিরে আসব। নূর আঙ্কেল বললেন আমি যেন আর পাঁচটা দিন অপেক্ষা করে রাজ ভাইয়াদের সাথেই যাই। কিন্তু আমি নিজের কথায় অটল থাকলাম। শেষমেষ আব্বু আমার হয়ে সবাইকে বুঝাল, এই অসুস্থতা নিয়ে আমি যখন কোনো অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারছি না, তখন আম্মুর কাছ থেকে ঘুরে আসাই ভালো হবে। তার কথায় নূর আঙ্কেল আর আম্মি মিনমিনে গলায় রাজি হলেন। রাজ ভাইয়াকে বুঝাতেও কষ্ট হলো। কিন্তু আজ আর এখানে থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার মধ্যে নেই। এখানে থাকা মানেই নিজের সম্মান ন’ষ্ট করা। আফরা আপু বিদায় না হতে আমি কোনোভাবেই এ মুখো হব না। হলেও আর এখানে থাকব না। প্রয়োজনে হলে উঠব, কিংবা ভাড়া বাসায়। পরবর্তীতে যে আবার কখনও আমায় এমন বাজে পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে না, তার তো মোটেও নিশ্চয়তা নেই। এতটা নির্লজ্জ তো আমি হতে পারব না। থাক যে যার রাগ, অভিমান, প্রখর আত্মসম্মান পুষে। যে প্রয়োজনের সময় খোঁজ নেওয়ার বদলে নিজেই নিখোঁজ হয়, তাকে আর খোঁজার মানে হয় না। এরপর না হয় সে-ও বুঝুক, তার আত্মসম্মানের কাছে কেউ হেরে বসে থাকবে না। তার অভাবেও কেউ ম’রে যাবে না। অভিমানটা তবে ভয়া’নকই হোক।

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।🖤

(রি-চেইক দিতে পারিনি।)