মনোহারিণী পর্ব-১৬+১৭

0
244

#মনোহারিণী
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৬.
আধ খাওয়া খাবার কেড়ে নেওয়া মানুষগুলো যতই আমাদের প্রিয় বা অপ্রিয় হোক না কেন। এদের ওপর প্রকাশিত বা অপ্রকাশিত রাগ বা অভিমানটা সবারই জাগে। যৎসামান্য হলেও জাগে। এর অবশ্য যথেষ্ট কারণ আছে। একটা খাবার খাওয়ার সময় তার স্বাদের ওপর আস্তে-আস্তে আমাদের মনোযোগ চলে যায়। স্বাদটা ভালো হলে ওটা শেষ করা অবধি ওই মনোযোগটা সবাই ধরে রাখতে চায়। কিন্তু মাঝপথে যদি সেই মুখের খাবারটাই কেড়ে নেওয়া হয়, তবে রাগ বা অভিমান অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমি উক্ত ঘটনার এক নিয়মিত ভুক্তভোগী। রোজ আমাকে এই অসহ্যকর ঘটনার শি’কার হতে হয়। যার ফলে রাগ, অভিমান আজকাল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সকালে ফ্রেশ হয়ে সর্বপ্রথম চা খাওয়াটা আমার জন্য অতীব জরুরী। নচেৎ মাথাব্যথা আঠার মতো লেগে থাকে। তারমধ্যে আজ ঘুম থেকে উঠেই মাথাসহ চোখ ব্যথা শুরু হয়েছে। চোখ জোড়া হালকা জ্বলছেও। ভেতরের অস্বাভাবিক অস্বস্তিতে মনে হচ্ছে জ্বর আসবে-আসবে করছে। এখনও সবাই ঘুম থেকে ওঠেনি। রান্নাঘরে আম্মি, ফুপি নাসিমা কাকি আর কুলসুম আপা সকালের নাস্তা বানাতে ব্যস্ত। ড্রয়িংরুমের এক সোফায় সৌরভ ভাইয়া উপুড় হয়ে পড়ে ঘুমাচ্ছেন, আরেক সোফায় আদনান ভাইয়া। জুম্মান ভাইয়া সিঙ্গেল সোফায় বসে-বসে ঝিমাচ্ছেন। তিনজন বোধ হয় গতকাল রাতে আড্ডা দিতে-দিতে এই অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়েছিল। চা নিয়ে আমি ডাইনিং টেবিলে একটা চেয়ার টেনে বসলাম। মনে-মনে বারবার আল্লাহর নাম জপ করলাম, বেশি জ্বর যেন না আসে। রাজ ভাইয়ের বিয়ের আর মাত্র তিন দিন বাকি। আজ সবাই মিলে শপিংয়ে যাবে।
জ্বর বাঁধিয়ে বিছানায় পড়ে থাকলে আমি নিশ্চিত সবকিছু থেকে বাতিল হব। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে গতকাল রাতের কথা ভাবতে লাগলাম। গতরাতে আফরা আপু দারুণ জ্বালিয়েছিল আমায়। আফরা আপু আর আনহা আপু আমার সাথে ঘুমিয়েছিল। আনহা আপু শোয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। অথচ আফরা আপু না নিজে ঘুমিয়েছে, না আমায় ঘুমাতে দিয়েছে। খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে আমাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করে রীতিমতো জেরা করেছে, আর তার সবটাই তাজ ভাই বিষয়ক। সেই চিরকুটের কথা তাজ ভাই ভুলে গেছে কি না, সুইডেন থেকে ফেরার পর সেই বিষয়ে আমায় কিছু বলেছে কি না, এত বছর আমার সাথে যোগাযোগ না রেখেও এখন এত সহজভাবে কথা বলে কীভাবে, পূর্বের রাগ কমে গেছে কি না, কীভাবে কমেছে, আমি কীভাবে তার সাথে এত সহজভাবে কথা বলছি, আরও কত কী! আমি এসব প্রশ্নের উত্তর ঠিকমতো দিতে পারিনি। কারণ পূর্বের সেই ঘটনার বিষয়ে তাজ ভাইয়ের মনে ঠিক কী চলছে, সেসব আমি নিজেই এখনও জানতে পারিনি। তবে ওনার ইঙ্গিতপূর্ণ কথায় এটুকু বুঝতে পেরেছি যে, ওই চিরকুট বিষয়ক দোষটা যে আফরা আপুর ছিল, তা উনি বিশ্বাস করেছেন। কিন্তু মুখে কেন প্রকাশ করছেন না বা বিশ্বাস করার আগে ওনার মনে কী ছিল, সেসব বিষয়ে সত্যিই আমার কোনো ধারণা নেই। আফরা আপু হয়তো আশা করেছিল তাজ ভাই আজও আমার প্রতি পুরোনো রাগ পুষে রেখেছেন। কিন্তু নিজের ভাবনার ভুল প্রমাণ সে কোনোভাবেই মানতে পারছে না। তার কথাবার্তায় এটাও স্পষ্ট ছিল যে, তাজ ভাই আর আমার সঠিক সম্পর্ক নিয়ে সে যথেষ্ট সন্দিহান। আকারে-ইঙ্গিতে আমার মাথায় এটাও বারবার ঢোকানোর চেষ্টা করছিল, তাজ ভাইয়ের প্রতি তার দূর্বলতা ঠিক কতটুকু। তাই তো এত জেরা। গতকাল রাতে আফরা আপুর ওপর মনে-মনে প্রচণ্ড রাগ উঠলেও, তা প্রকাশ করতে পারিনি। বিয়ের কটা দিনই তো থাকবে, এরমধ্যে কোনো ঝামেলা হোক, তা আমি চাই না। নিজে সব ঝামেলা পাকিয়ে উলটো আমাকেই জেরা করেছে। ওদিকে তাজ ভাই নিজেই যে তাকে বারবার এড়িয়ে চলে, সেসব তার মগজে ঢোকে না। বে’য়াদব মহিলা। তার এই আজাইরা বকবক শুনে রাত পৌনে তিনটার দিকে আমাকে ঘুমাতে হয়েছিল। গতকালের ঘটনার বদৌলতে এখন আমি এটুকু নিশ্চিত যে, আফরা আপু এখন ফেভিকল আঠার মতো আমার পেছনেই লেগে থাকবে। ওই মহিলার জ্বালাতন কোনোমতেই সহ্য হয় না আমার। আজ রক্ষা পাব কীভাবে? তাজ ভাই বাসায় থাকলে আফরা আপু তার সামনে এসব বিষয়ে কথা বলতে সাহস পায় না। কিন্তু তাজ ভাই তো একটু পরেই নিজের কাজের পেছনে দৌড় লাগাবে। সারাদিনে ওই মেয়ে আমায় পাগল বানিয়ে নিশ্চিত পাগলা গারদে পাঠিয়ে ছাড়বে। আজকের পরিস্থিতির কথা ভাবতেই আমার মাথা ঘুরে উঠল। এই মেয়ের এত প্যারা সইব কীভাবে আমি? ভাবনার মাঝে টেবিল থেকে চায়ের কাপটা উঠাতে হাত বাড়াতেই অবাক হলাম। মুহূর্তে চিন্তার জাল ছিঁড়ে গেল। টেবিলে চায়ের কাপটা নেই। এই তো কিছুক্ষণ আগেই আমি তিন-চারটা চুমুক দিয়ে সামনেই কাপটা রাখলাম। এরমধ্যে আমার চোখের সামনে থেকে কাপ উধাও! চকিতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই পেছনে সেই রোজকার ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে পেলাম। তাজ ভাই ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে ভীষণ আয়েশ করে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন। কিন্তু আমার সামনে থেকে যে কাপটা সরাল, আমি টের পেলাম না কেন? ভাবনায় এতটাই ডুবে ছিলাম! ধুর! বসা থেকে দাঁড়াতেই মাথাটা ভীষণভাবে ঘুরে উঠল। এই মাথার যন্ত্রণা থেকে একটু হলেও বাঁচা জরুরী। এমন একটা সময়ে তাজ ভাইয়ের কাণ্ডের ওপর আজ একটু বেশিই বিরক্ত হলাম। আওয়াজ যেন রান্নাঘর অবধি না যায়, এটা ভেবে চাপা স্বরে বিরক্তি ঝাড়লাম,
“আমার চা নিলেন কেন? খা’টাশের মতো আরেকজনের এঁটো চা নির্দিধায় খাওয়া শুরু করেন। নিজে চেয়ে খেতে পারেন না? সবসময় আমারটার ওপরেই নজর থাকে?”
উনি আমার কটাক্ষ গায়ে মাখলেন না। নিজেও চাপা স্বরে বললেন,
“তুই এই এক ভুল রোজ-রোজ করিস কেন রে বলদ? কাপের কোথাও তোর নাম লেখা আছে? জিজ্ঞেস করলে তো আর খুঁজে পাস না। কবে যে কিছু শিখবি। আফসোস! আমার মতো ব্রিলিয়ান্ট ছেলের আশেপাশে থেকেও আজ পর্যন্ত কচুর মাথাও শিখতে পারলি না। তোর উচিত কচু গাছের মাথায় ডিরেক্ট ঝুলে পড়া।”
“আপনার বাজে কথা আপাতত বন্ধ রাখুন, তাজ ভাই। ভালো লাগে না। আমার মাথাব্যথা করছে বলে চা-টা খাচ্ছিলাম। না জেনে সবসময় উদ্ভট আচরণ করে বসেন।”
খিটখিটে মেজাজে আমি চলে যাওয়া ধরতেই উনি হাত টেনে আবার মুখোমুখি দাঁড় করালেন। কপালে ভাঁজ ফেলে সূক্ষ্ম চোখে আমার মুখটা নিরীক্ষণ করলেন। চায়ের কাপ টেবিলে রেখে কপালে হাত ছুঁয়ে দিলেন। ঈষৎ চিন্তিত, কিন্তু মুখে বললেন,
“জ্বর বাঁধিয়ে বসে আছিস? জ্বর তো কম, মাথাব্যথা বেশি? চোখ তো লাল হয়ে আছে।”
আমি হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে স্বাভাবিক গলায় উত্তর দিলাম,
“জ্বরের থেকে মাথাব্যথা বেশি।”
“জ্বর কখন এসেছে?”
“রাতে।”
“আম্মিকে বলেছিস?”
আমি ডানে-বায়ে মাথা দোলালাম। উনি চোয়াল শক্ত করে বললেন,
“শরীরে জ্বর নিয়ে রিল্যাক্সে বসে আছেন মহারানি ভিক্টোরিয়া। বিছানায় পড়ার পর জানানোর ইচ্ছে ছিল? দুদিন বাদে তোর বাপ এসে দেখবে তার মেয়ে জ্বরে ভুগছে। বদনামটা কার হবে, শুনি? আমাদের। চা’পড়ে দু পাটি দাঁত ফেললে তুই সোজা পথে হাঁটবি, মাথামোটা।”
আমি গাল ফুলিয়ে চাইলাম। অসুস্থতার কথা শুনে কোথায় একটু ব্যস্ততা দেখাবে, তা না। উনি রাগ ঝাড়ছেন। শক্ত মুঠো থেকে হাত ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা চালিয়ে বললাম,
“হালকা জ্বর, নাপা খেলেই কমে যাবে। আপনাকে মাথা ঘামাতে হবে না।”
উনি শুনেও শুনলেন না। উলটো আমাকে টেনে-হিঁচড়ে ওনার রুমে নিয়ে গেলেন। আমার কোনো বাঁধাই কাজে এল না। রুমে এসে বিছানায় বসিয়ে কড়া গলায় বললেন,
“এক পা-ও নড়বি না এখান থেকে। আমি এক্ষুনি যাব আর আসব। এসে যেন এখানেই দেখি।”
“কেন? কোথায় যাচ্ছেন আপনি?”
আমার প্রশ্নের জবাব তো দূর, প্রশ্নটা বোধ হয় সম্পূর্ণ শুনলেনও না। হনহনিয়ে দরজা ভেজিয়ে রেখে চলে গেলেন। আমি মাথাটা জোরে ঝাঁকুনি দিলাম। মাথাব্যথা কমার বদলে তরতর করে বেড়ে চলেছে। এই ব্যথার সাথেই হয়তো জ্বর বেড়ে যাবে। শেষ আমার আনন্দ। সমস্ত আনন্দের মাথায় বাড়ি। এবার আমি শুধু ভিখারির মতো বসে-বসে সবার হৈ-হুল্লোড় দেখব। বালিশের সাথে হেলান দিয়ে বসে মনে-মনে আফসোসের জাল বুনছিলাম। জাল কে’টে রুমে এল তাজ ভাই আর আম্মি। আম্মির হাতে খাবার। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে আমার কপালে হাত রেখে বলল,
“হঠাৎ জ্বর বাঁধালে কী করে, আম্মু? আমায় বলোনি কেন?”
আমি বললাম,
“বেশি না, আম্মি। ব্যস্ত হয়ো না। মাথাটা বেশি ব্যথা করছে।”
“কম থেকেই বাড়বে। খাবারটা খাও, নাপা খেলে যদি না সারে তাহলে ডক্টরের কাছে নিয়ে যাব।”
খাবার দেখে মুখটা বিস্বাদে ভরে গেল। অনিচ্ছুক চাহনিতে তাকিয়ে বললাম,
“এখন খেতে ইচ্ছে করছে না। পরে খাব।”
পাশ থেকে তাজ ভাই বিদ্রুপ করে বললেন,
“পরে খেতে-খেতে এই জ্বর তোকে গিলে খাবে। খাবার আর খাওয়া হবে না। চুপচাপ খেয়ে নে।”
আম্মি পাশে বসে সস্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“এখন খেলেই ভালো হবে। কষ্ট করে একটু খাও। নিজের হাতে খেতে পারবে? আমি হাতের কাজ ফেলে রেখে এসেছি।”
আমার আগে তাজ ভাই উত্তর দিলেন,
“পারবে, পারবে। তুমি কাজে যাও।”
আম্মি সম্মতি জানিয়ে চলে গেল। তাজ ভাই গলা উঁচিয়ে হাঁক ছাড়লেন,
“আমার খাবারটা দিয়ো। বেরোতে হবে।”
আমি চোখ-মুখ কুঁচকে খাবারের দিকে অনিচ্ছা ভরা চোখে তাকিয়ে ছিলাম। উনি এগিয়ে এসে সামনে বসে বললেন,
“খাবারের মধ্যে পৃথিবীর নবম আশ্চর্য লুকানো আছে? এভাবে কী দেখছিস?”
“মুখে স্বাদ নেই। পরে খেয়ে নিব।”
উনি শুনলেন না। রুটি ছিঁড়ে মুখের কাছে ধরলেন। আমি অসহায় মুখে বললাম,
“ভালো লাগছে না। বলছি তো পরে খাব।”
“হা কর। উলটা-পালটা কথা বললে কানের দুই ইঞ্চি নিচে লাগাব। জ্বর বাপ, বাপ করে পালাবে।”
আমার কোনো অনিচ্ছাই ওনার কাছে গুরুত্ব পেল না। ধমকা-ধমকি করে ঠেসে-ঠেসে মুখে খাবার পুরলেন। মুখে স্বাদ না থাকায় খাবার বিরক্ত লাগলেও, এই মুহূর্তটায় কিছু একটা ছিল। কিছু সময়ের জন্য মনে হলো এমন হাজারো মুহূর্তগুলো থেমে থাকুক, আটকা পড়ুক দৈব কোনো ফ্রেমে। পৃথিবীর সমস্ত বদ নজরকে টেক্কা দিয়ে আমার মাথার ওপর এক তাজের ছায়া থাকুক আজ, কাল, চিরকাল। হৃদয় নিংড়ানো অনুভূতিগুলোতে ছেদ পড়ল অভক্তিতে। অর্ধেকটা খাবার খাওয়ার পর আমার মুখ বাঁধ সাধল। উনিও আর জোর করলেন না। একটা নাপা হাতে ধরিয়ে দিলেন। আমি চুপচাপ তা গলধঃকরন করলাম। রাজ ভাইয়ের কথা মনে পড়ায় প্রশ্ন করলাম,
“রাজ ভাই কোথায়?”
“আব্বুর সাথে বাজারে গেছে। চা খাবি?”
“না, আর ইচ্ছে করছে না।”
“তাহলে চুপচাপ শুয়ে থাক।”
আমি দ্বিমত করলাম না। না শুলে এই ভয়ানক মাথাব্যথা থেকে রেহাই পাব না। আমি শুয়ে পড়তেই উনি দরজা ভেজিয়ে খেতে চলে গেলেন। আমি চুপচাপ বিছানায় পড়ে রইলাম। এই বিছানায় এর আগে শোয়ার ভাগ্য হয়নি। আজ প্রথম হয়েছে। কেউ একজন যেন মিশে আছে এখানে। একটা পরিচিত সুগন্ধ, একটা পরিচিত অনুভূতি। খাবার টেবিলের গল্প, আড্ডার গুনগুন শব্দ আমার কানে এল। নূর আঙ্কেল আসার পর এই আড্ডার রেশ বেশ বেড়েছে।‌ তাজ ভাই খাওয়া-দাওয়া শেষে রুমে ফিরে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আমি তো ভাবলাম এতক্ষণে মহারানি ঘুমে বেহুঁশ।”
ওনাকে পোশাক বের করতে দেখে বুঝলাম এখনই বেরোবেন। প্রশ্ন করলাম,
“অফিসে যাবেন, না কি কোনো ইনভেস্টিগেশনে?”
“আগে অফিসে যাব, ওখান থেকে ইনভেস্টিগেশনে। অফিসে বেশিক্ষণ থাকা হবে না। প্রচুর কাজ।”
উত্তর দিয়েই উনি সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লেন। বেরোলেন ফর্মাল গেটআপে। ব্লাক জিন্স আর ডার্ক ব্লু শার্ট ইন করে পরেছেন। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে সোজা ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুলে ব্রাশ চালাতে ব্যস্ত হলেন। আমি তখন কাত হয়ে শুয়ে আয়নার প্রতিবিম্বে শান্ত দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছি। ওনার চোখে ধরা পড়ে গেলাম খুব সহজেই। উনি আয়নার ভিতরে আমার প্রতিবিম্বের দিকে একবার তাকিয়ে সহাস্যে কৌতুক করলেন,
“বয়ফ্রেন্ডকে ধোঁকা দিয়ে আমার প্রেমে পড়ার মতলব করছিস না কি? বদ নজর দিয়ে লাভ নেই। আমি পিওর সিঙ্গেল। তোদের মেয়ে জাতির আজাইরা প্যারা নেওয়ার মতো ভুল আমি করব না। করার হলে সুইডিশ সুন্দরীদের থেকেই একটা বেছে নিতাম। আমি আবার সুবুদ্ধিসম্পন্ন সচেতন সুপুরুষ। জেনেশুনে বি’ষ পান করি না।”
আমি কপাল কুঁচকে ঠোঁটের ফাঁকে হতাশ নিঃশ্বাস ছাড়লাম। লোকটা জীবনেও শুধরাবে না। সবসময় অপ্রয়োজনীয় কথা বলে, আবার নিজেকে সুবুদ্ধিসম্পন্ন সচেতন সুপুরুষ বলেও দাবি করে। অসম্ভব মানুষ। ওনার কথার প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারলাম না আমি। কারণ আমার মাথায় তখন আফরা আপুর চিন্তা। একটা প্রশ্ন গলায় এসেও আটকে আছে।‌ করব, না কি করব না, এই নিয়ে দ্বিধায় পড়েছি। শেষে একটু নড়েচড়ে শুয়ে শান্ত গলায় প্রশ্ন ছুঁড়লাম,
“একদিন না গেলে কি সমস্যা হবে?”
উনি হাতঘড়ি পারছিলেন।‌ আমার প্রশ্নে থেমে গেলেন। আয়নার ভেতরে তির্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে।‌ হয়তো আমার এমন উদ্ভট প্রশ্নে অবাক হয়েছেন। আমি অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে চোখ সরাতেই উনি আয়নার সামনে থেকে সরে এলেন। বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আমার মাথায় এক হাত রাখতেই আমি ফিরে তাকালাম। উনি তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে কিঞ্চিত নরম সুরে প্রশ্ন করলেন,
“কী হয়েছে?”
কোমল কন্ঠে আমি কেমন এলোমেলো হয়ে পড়লাম। দ্রুত ডানে-বায়ে মাথা দুলিয়ে বললাম,
“কিছু না। এমনি জানতে চেয়েছি।”
“আফরা কিছু বলেছে?”
আমি খানিক চমকাল। পুনরায় না-সূচক মাথা দুলিয়ে বললাম,
“কিছু হয়নি বললাম তো। যান আপনি।”
উনি দমে গেলেন না। দৃঢ় কন্ঠে বললেন,
“আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া এত সহজ না, এতদিনে এটা তোমার বুঝার কথা। ফটাফট বলে ফেলো আফরা কী বলেছে। দুই মিনিট সময় দিলাম।”
ওনার কথার সুরে আমি বাক্য হারিয়ে ফেললাম। হুটহাট এই ‘তুমি’ সম্বোধনটা প্রতিবারই আমাকে চমকে দেয়। বক্ষপঞ্জরের ভেতরের বেপরোয়া যন্ত্রটা বড়ো অ’সভ্য আচরণ করে ওঠে। নিজেকে সামলে কোনোরকমে অজুহাত তুললাম,
“মাথাব্যথা করছে, ঘুমাব আমি। আপনি যাচ্ছেন না কেন?”
উনি কা’টকা’ট কন্ঠে উচ্চারণ করলেন,
“দুই মিনিট দিয়েছি।”
আমার কন্ঠনালি কিঞ্চিত কেঁপে উঠল। ওই শক্তপোক্ত মুখ, আর ধারাল অ’স্ত্রের ন্যায় দৃষ্টির সামনে কথা আড়াল করার ক্ষমতা আমি রাখি না। অসহায় মুখে মিনমিনে কন্ঠে গতরাতে আফরা আপুর বলা সমস্ত কথা গড়গড় করে উগড়ে দিলাম।‌ এক লাইনও বাদ পড়ল না তার মধ্য থেকে। উনি খুব মনোযোগ দিয়ে সবটা শুনলেন। কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ ছাড়া ওনার মুখে তেমন বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া আমার চোখে পড়েনি। এই মানুষটার মুখ দেখে মন পড়ার মতো বিশাল ক্ষমতা বোধ হয় আম্মি ছাড়া কারোরই নেই। অথচ উনি আমার চোখে চোখ রেখে কত সহজেই মনের কোণে লুকানো অবস্থাও বুঝে ফেলেন। আফরা আপুর সমস্ত কথা বলার পর সুযোগ বুঝে আমি নিজের মনের প্রশ্নটাও ব্যক্ত করে বসলাম।
“ছয় বছর আগের ওই বিষয়টা নিয়ে আপনার মনে ঠিক কী আছে বলুন তো? আমার কাছে আপনার সব কথাবার্তা কেমন ধোঁয়াশা লাগে। মুখে এখনও আমাকে দোষারোপ করেন, আর আচরণে তার উলটোটা।”
উনি এ প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। সব গুছিয়ে নিয়ে বেরোনোর সময় শুধু মাথায় হাত বুলিয়ে বলে গেলেন,
“ঘুমা, এই রুম থেকে বেরোনোর দরকার নেই। জ্বর বাড়লে বা খারাপ লাগলে আম্মিকে জানাবি। পাকামো করে বাইরে ঘুরঘুর করবি না। আমি আম্মিকে বলে যাব। আমিরাদেরও বলে যাব, ওরা এসে সময় দিবে। তাড়াতাড়ি ফিরে আসব আমি। এসে যদি শুনি লাফালাফি করেছিস, বুড়িগঙ্গায় ডু’বিয়ে মা’রব।”
সব কথার শেষে একটা বাজে কথা থাকবেই। নইলে যেন তার খাবার হজম হয় না। মিষ্টি কথার মাঝে শান্ত স্বরের হু’মকি, বাহ্! উপায়ান্তর না পেয়ে আমি ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। একটানা কতক্ষণ ঘুমিয়েছি খেয়াল নেই। যখন ঘুম ভাঙল, তখন চোখ মেলেই আপদ সামনে পেলাম। সঙ্গে আমিরা আপু, মিনহা আপু, আনহা আপু, জুম্মান ভাইয়া আর সৌরভ ভাইয়া। মাথাব্যথা একটু কম অনুভব করলাম। আফরা আপু বিছানায় পা তুলে পদ্মাসনের ন্যায় বসে ফোন ঘাঁটছিল। আমি উঠে বসতেই মুখটা একটু গম্ভীর হয়ে গেল। হাসিহীন মুখে বলল,
“এই শুনি বছরের পর বছর কথা হয় না, আবার এখন ডিরেক্ট বিছানা দখল করে শুয়ে আছিস? আমার জানামতে তাজ ভাই তোকে একদমই সহ্য করতে পারে না। এখন তো আমার মনে হচ্ছে তুই নিজেই ওনার পেছনে পড়েছিস।”
আমি ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম,
“আপু প্লিজ। আমার শরীর খুব খারাপ, এখন আপাতত এসব বাজে কথা বোলো না। শুনতে খারাপ লাগে। আমি কোনোকালেই ওনার পেছনে পড়িনি। তুমি তা ওনাকে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবে। অযথা আমাকে এসব বলা বন্ধ করো। আর এই বিছানায় আমি নিজের ইচ্ছায় ঘুমাইনি। অন্য কোনো রুম ফাঁকা ছিল না বলে উনি নিজেই এখানে ঘুমাতে বলে গেছেন।”
আমার উত্তরে সে সন্তুষ্ট হলো না। হয়তো আরও অনেক কটু কথা শোনানোর অভিপ্রায় নিয়ে এসেছিল। পাশ থেকে আমিরা আপুরা বাঁধা দেওয়ায় সে মুখটা বাংলার পাঁচ করে গটগট করে হেঁটে চলে গেল। সৌরভ ভাইয়া হাঁফ ছেড়ে বললেন,
“উফ্, বাঁচা গেছে। এই মহিলা সামনে থাকলে আমার শ্বাসকষ্ট হয়। খালি ছেলেদের পেছনে ঘুরঘুর।”
আমিরা আপু বলল,
“আচ্ছা? আমিও তো তাজ ভাইয়ের ওপর ফিদা। কিন্তু ওর মতো তো এভাবে পেছনে পড়ে থাকি না। আড়ালে আবডালে প্রেমে পড়ি। ও এসে হতে তাজ ভাইয়ের পেছনে পড়ে আছে। ওর মতিগতি আমার একদমই সুবিধার ঠেকছে না।”
আমি ক্লান্ত ভঙ্গিতে বললাম,
“সুবিধার হলে তো সুবিধার ঠেকবে। এসে হতে আমাকে কথা শুনিয়ে চলেছে।”
আনহা আপু প্রশ্ন করল,
“তাজ ভাইকে নিয়ে?”
আমি হ্যাঁ-সূচক মাথা ঝাঁকালাম। জুম্মান ভাইয়া রাগত স্বরে বললেন,
“এই আদিম যুগের কাহিনি নিয়ে এখনও পড়ে আছে কেন? আজব! মানুষের মন কি সবসময় একরকম থাকে? তাজ ভাই আগে একটা মিথ্যের জন্য রেগে ছিল বলে যে এখনও রেগে থাকবে, এমন কোনো কথা আছে? হয়তো সে চিন্তা করেছে, ছোটো একটা মেয়ের ওপর এভাবে রেগে থাকা ঠিক না। সবচেয়ে বড়ো কথা, ওই গণ্ডগোলটা তো আফরা আপুই বাঁধিয়েছিল। এখন তাজ ভাই যে ইলোর ওপর থেকে রাগ উঠিয়ে নিয়েছে, এটা তার সহ্য হচ্ছে না।”
মিনহা আপু চোয়াল শক্ত করে বলল,
“বদ মহিলা।‌ কী দরকার ছিল ওমন ঝামেলা বাঁধানোর? ইলো তখন নাইনে পড়া ছোট্ট একটা মেয়ে। এমন তো নয় যে তার মতো ইলোও তখন তাজ ভাইয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিল। শুধু-শুধু ওর সাথে এমন শত্রুতা করার কোনো প্রয়োজন ছিল? ভেজাল ছাড়া বাঁচতেই পারে না।”
সৌরভ ভাইয়া বলল,
“এদিকে তোমরা বকবকানির ঠেলায় রোগীর খবর নিতেই ভুলে বসে আছো। খবরটা কি রাতে নিবে?”
এবার সবাই নড়েচড়ে বসল। আমার শরীরের অবস্থা জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠল। তাপমাত্রা একটু বেড়েছে জেনেই সবার মাথায় হাত পড়ল। হা-হুতাশ শুরু করল, সন্ধ্যায় সবার সাথে শপিংয়ে কী করে যাব আমি। অবশ্য এই নিয়ে আমার নিজেরও চিন্তা হচ্ছে। হয়তো আমার যাওয়াই হবে না। সবাই শপিংয়ে যাবে, আর আমি বাসায় কম্বল মুড়ি দিয়ে নাক ডেকে ঘুমাব। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে যখন জ্বর বেড়ে চলল, তখন আম্মি অনেকক্ষণ অবধি জলপট্টি দিয়ে দিলো, মাথায় পানি দিলো। কিছুতেই কোনো কাজ হলো না। শেষে রাজ ভাই আমায় টেনেহিঁচড়ে ডক্টরের কাছে নিয়ে গেল। তখন বিকেল চারটা। ডক্টর পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে একগাদা ঔষধ ধরিয়ে দিলেন। সেগুলো নিয়ে বাসায় ফিরে এসেই নাকমুখ খিঁচে একটার পর একটা ঔষধ গলধঃকরন করতে হলো। তারপর আবার ঘুম। মাগরিবের সময় ঘুম থেকে উঠে দেখলাম সবাই শপিংয়ে যাওয়ার জন্য রেডি হতে তাড়া দেখাচ্ছে। আমি কোনোমতে নামাজ আদায় করে ঠাঁয় বসে রইলাম। ঔষধ খেয়ে ঘুম দেওয়ায় একটু হালকা বোধ হচ্ছে। কিন্তু মাথাটা এখনও ভার হয়ে আছে। এই অবস্থায় বাইরে গেলে মাথা ঘুরে-টুরে পড়ার সম্ভাবনা শতভাগ। তারপর আমার জন্য সবার আনন্দ মাটি হবে। অগত্যা এই অসুস্থ শরীর নিয়ে বাইরে যাওয়ার ইচ্ছেটা মাটিচাপা দিতে হলো। যে-ই আমাকে সাধল, তাকেই অনিচ্ছা প্রকাশ করলাম। সবাই রেডি হচ্ছে, অথচ তাজ ভাইয়ের খবর নেই। উনি কি ফিরেননি এখনও? সকালে তো ঠিকই বলে গিয়েছিলেন তাড়াতাড়ি ফিরবেন। আফরা আপু আর আনহা আপু রেডি হতে-হতে গল্প করছে। আমি আলগোছে বিছানা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। চারদিকে আকাঙ্ক্ষিত মুখের খোঁজ চালালাম। কোথাও না পেয়ে কিছু না ভেবেই ওনার রুমের দরজা ঠেলে উঁকি দিলাম। সঙ্গে-সঙ্গেই একটা শীতল কন্ঠস্বর এতক্ষণের বিচলিত মনকে ঝুপ করে শান্ত করে দিলো।
“একটা অবিবাহিত ভদ্র ছেলের রুমে এভাবে উঁকি-ঝুঁকি দেওয়া ভালো লক্ষণ নয়। এমন বদ অভ্যাসের কারণে দেখা যাবে আমার বাসর রাতে রুমের দরজার সামনে পাহারাদার রাখতে হবে।‌ কে কখন পুরোনো অভ্যাসবশত উঁকি দিয়ে আমার বউয়ের মান সম্মানের বারোটা বাজায়, তার তো গ্যারান্টি নেই।”
কথাগুলো বলতে-বলতে উনি এগিয়ে এলেন। ফাঁকা দরজাটা আরেকটু ফাঁক করে আমার হাত টেনে ভেতরে ঢুকালেন। ড্রেসআপ দেখে বুঝলাম শপিংয়ে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিলেন। উনি আমায় বিছানায় বসিয়ে বললেন,
“জ্বর তো আরও বাড়িয়ে বসে আছেন। বিয়ের প্রোগ্রামে কী অবস্থা হবে ভেবে দেখেছেন? বিছানায় শুয়ে, বসে এনজয় করতে হবে।”
আমি মিনমিনে গলায় বললাম,
“বেশি না তো, কমে যাবে।”
“হ্যাঁ, কমে যাবে। তুই তো জ্বরের বাপ-মা। যেতে বললেই বাধ্য মেয়ের মতো চলে যাবে। আমি এখন ফিরিনি। মাগরিবের আগে ফিরেছি। জ্বরের অবস্থা দেখেছি। ভাইয়া ডক্টরের কাছে নেওয়ার আগেই আম্মি জানিয়েছিল আমায়। শুনলাম দুপুরে ঠিকমতো খাসনি?”
“খেয়েছি তো।”
“জানা আছে আমার। মাথাব্যথার কী অবস্থা?”
“একটু কম, কিন্তু পুরোপুরি কমেনি। ভার হয়ে আছে।”
“যাবি? এত হাঁটাহাঁটি করলে তো পরে অজ্ঞান অবস্থায় বাসায় আনতে হবে।”
আমি অসহায় দৃষ্টিতে তাকালাম। সবার সাথে যাওয়ার ইচ্ছে আমার আছে, কিন্তু শরীরের কথাও তো ভাবতে বাধ্য হচ্ছি। তাজ ভাই মৃদু হাসলেন। চুলে আলতো টান মে’রে বললেন,
“যেতে চাইলেও এখন নিব না। আগে সুস্থতা, তারপর সব। এতগুলো মানুষের শপিংয়ে অনেক সময় লাগবে। তার ওপর এতগুলো মহিলা নিয়ে যাচ্ছি। এদের তো আবার এক মিনিটের জায়গায় এক ঘন্টা লেগে যায়। কত রাত হয় তার ঠিক নেই। এই অবস্থায় এত দৌড়াদৌড়ি কূলাবে না।”
আমি ঠোঁট উলটে বললাম,
“কী আর করা? কপাল খারাপ।”
“উঁহু, যা হবার ভালোর জন্যই হয়। হয়তো বাইরে যাওয়াটা ঠিক হবে না, তাই বাঁধা পড়েছে। বাসায় খারাপ লাগবে না। সায়মা আপুরা আসছে। আটটার মধ্যেই চলে আসবে।”
আমি লাফিয়ে উঠে বললাম,
“সায়মা আপু আসছে? কই? আমি তো কিছু শুনলাম না।”
“সবাই জানে না। আম্মিকে ফোন করেছিল। আম্মি শুধু আমাকে আর আব্বুকে জানিয়েছে। আসার পর তো সবাই দেখবেই।”
“সৌরভ ভাইয়াও জানে না?”
“না,” হাসিমুখে উত্তর দিলেন উনি।
এতক্ষণ আমার মনটা একটু খারাপ হলেও, খবরটা শুনে তার চেয়ে বেশি আনন্দ লাগছে। তাজ ভাইয়ের কাজিন মহলের মধ্যে সায়মা আপু আমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। তার সাথে আমার সম্পর্কটা সমবয়সী বান্ধবীর মতো।‌ অনেক মাস বাদে দুজনের দেখা হলে নাওয়া-খাওয়া ভুলে আমরা দিন-রাত গল্প নিয়েই পড়ে থাকি। এত মাসের জমানো সব কথায় জমজমাট আড্ডা বসাই। সায়মা আপু সদা হাসিখুশি মিষ্টি একটা মেয়ে। তার হাসি মুখটা দেখলে ভালোবাসাটা আপনা-আপনি এসে যায়। আমার ধারণা সায়মা আপু আম্মির মতো হয়েছে। আম্মির স্বভাবের শতভাগ তার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়। মায়ের মতো না হয়ে, খালামনির মতো হয়েছে। কথাটা বললেই সে হেসে উত্তর দেয়, কথায়ই তো আছে মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি। দলবেঁধে সবাই শপিংয়ে বেরোনোর সময় আবার আমার মুখটা ভার হলো। এই দলের মধ্যে আমি থাকব না, মানা যায়? সৌরভ ভাইয়া যাওয়ার সময় দুঃখ প্রকাশ করে বললেন,
“আপনার জন্য খারাপ লাগছে, আপু। এই অসুখটা আপনার না হয়ে, আফরা আপুর হলে ভালো হত। মহিলা সঠিক সময়ে উচিত শিক্ষা পেত। যাইহোক, মন খারাপ করবেন না। আপনার জন্য ফুসকা নিয়ে আসব।”
আমি মেকি হাসলাম। সে যে কত ফুসকা আনবে, জানা আছে আমার। ফোনের ভেতর ডুব দিতেই ফুসকার ফ-ও মনে থাকবে না। সায়মা আপুরা আসা অবধি প্রচণ্ড খারাপ লাগা নিয়ে বিছানায় পড়ে রইলাম। তারা এল সাড়ে আটটার দিকে। সৌরভ ভাইয়ার বড়ো দুই ভাই-বোন অনিক ভাইয়া, সায়মা আপু, সায়মা আপুর হাসবেন্ড আর আন্টি-আঙ্কেল এসেছেন। সায়মা আপুকে পেয়েই সব খারাপ লাগা কর্পূরের মতো উবে গেল। আমার জ্বর শুনে তারা বেশ আফসোস করল। অনিক ভাইয়া এসেই বাইরে ছুটেছেন। সবার সাথে শপিংয়ের শেষ পর্বে যোগ দিতে চায় সে। সায়মা আপুর পরিবারের সাথে আমার সময়গুলো বেশ ভালোই কে’টে গেল। জ্বরের মাত্রা বাড়ছে টের পেয়েও হাসি, আড্ডায় সময় কা’টালাম। সবাই ফেরা অবধি অপেক্ষা করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু শরীরে কূলাল না। শপিংয়ে না গিয়ে কী যে ভালো করেছি, তা হারে-হারে টের পেলাম। গেলে এতক্ষণে আমায় নিয়ে হসপিটালে দৌড়াতে হত। আম্মি খাবারের জন্য জোরাজুরি করল। শেষে সায়মা আপু জোর করে একটু খাবার খেতে বাধ্য করল। ঔষধ খাওয়ার জন্য ওইটুকু খেতেই হয়েছে। জ্বরের খবর শুনে সকাল থেকে এই পর্যন্ত হাজারবার ফোন করেছে আব্বু-আম্মু। একবার আমাকে, তো আরেকবার আম্মিকে। মেয়ের অসুস্থতায় তাদের দুশ্চিন্তা এমন যে, পারলে এক্ষুনি এসে নিয়ে যেত। দূরে থেকে এই কষ্টটা আমিও বেশ গভীরভাবে অনুভব করি। এই অসুস্থতার সময়গুলোতে অন্তত ‘আম্মু’ নামক মানুষটাকে বড্ড বেশি প্রয়োজন। আম্মি কখনও আমায় আম্মুর থেকে কম ভালোবাসে না। সবসময় চেষ্টা করে আম্মুর অভাব পূরণ করতে। হাজার হলেও ওই মানুষটা আমার জন্মদাত্রী। আমার কাছে সে সবসময় আমার পৃথিবীর সমস্ত ভালোবাসার উর্ধ্বে ছিল, আছে এবং থাকবে। ক্লান্ত চোখ দুটোতে নিদ্রা ভর করল রাত এগারোটা বাজতেই। অথচ সবাই কত রাতে ফেরে তার ঠিক নেই। ঘুমানোর আগ মুহূর্তেও আমার মনে এক সূক্ষ্ম অভিমান নাড়া দিলো। এতটা সময় কে’টে গেল। অথচ একবার তো ফোন করে ওদিকের খবরটুকু জানাল না। জ্বরের অবস্থাও জানতে চাইল না। কত আনন্দের সময় কা’টাচ্ছে, হুঁহ্! আমার অনুপস্থিতিতে কি কারোর কিচ্ছু যায় আসে না?‌

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।🖤

#মনোহারিণী
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৭.
নতুন দিন, নতুন প্রভাত, নতুন সূর্য। প্রকৃতির রোজকার রুটিনের কোনো হেরফের নেই। নিয়মের শিকলে আবদ্ধ সে। যেকোনো পরিস্থিতিতে এই নিয়মের এদিক-সেদিক মোটেও হবে না। দীর্ঘ রজনী পেরিয়ে নতুন দিন আসবে, এটা যেমন সত্য, তেমনি সত্য গভীর নিদ্রা শেষে আমরা নতুন দিনে জেগে উঠব। সে যখনই হোক। খুব ভোরে কিংবা সকাল বারোটায়, যেকোনো এক সময় উঠতেই হয়। একেক মানুষের জেগে ওঠার রুটিন একেক রকম। আমার জেগে ওঠার রুটিন দুটো। একই প্রভাতে দু-দুবার জেগে উঠি আমি। প্রথমত ফজরের সময় হলে, দ্বিতীয়ত নামাযের পর আরও এক শান্তির ঘুম দিয়ে। কিন্তু আজ আর দ্বিতীয়বার ঘুমানোই হলো না। শরীরের অবস্থার উন্নতি নেই। জ্বর একবার কমে তো আবার বেড়ে যায়। অস্বস্তিতে বিছানায় আর যেতে ইচ্ছে করল না। ধীর পায়ে একবার ড্রয়িংরুমে উঁকি মে’রে এলাম। ম’রার মতো ঘুমাচ্ছে একেকজন। আম্মি আর নাসিমা কাকিকে শুধু রুমের বাইরে দেখলাম কাজে হাত লাগাচ্ছে। নূর আঙ্কেলও মসজিদ থেকে ফেরেননি। আম্মি আমার জ্বরের অবস্থা জেনে হায়, হায় করে উঠল। তাড়া দিয়ে বলল তাদের রুমে গিয়ে শুয়ে থাকতে। সবেমাত্র চায়ের পানি চুলায় বসিয়েছে সে। আমি তার কথা শুনলাম না। গিয়ে দাঁড়ালাম ডাইনিং রুমের লাগোয়া বেলকনিতে। সকালের শিথিল কোলাহল আর লালচে আকাশে মনোযোগ দিলাম। আজ রাজ ভাইয়ের মেহেদি উৎসব। সবাই কত আনন্দ করবে, মেহেদি পরবে। আর আমি? অসুস্থ শরীরের অস্বস্তিতে হয়তো উৎসবের আনন্দ থেকেই বাদ পড়ে যাব। সন্ধ্যার আগে জ্বরটা কমে গেলে ভালো হত। মিনিট পাঁচেক পর পাশে মানব অস্তিত্ব টের পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। পাঞ্জাবি পরিহিত যুবকের স্নিগ্ধতায় মাখামাখি মুখটা থেকে সহসা চোখ ফেরাতে পারলাম না। রেলিংয়ে হেলান দিয়ে খানিক কাত হয়ে এদিকে মুখ করেই দাঁড়িয়ে আছে সে। আমার চোখে চোখ পড়তেই খুবই শান্ত ভঙ্গিমায় ঠোঁটের কোণ ঈষৎ প্রসারিত করে হাসল। বিনিময়ে আমিও এক মলিন হাসি ফেরত দিলাম। ওই শান্তশিষ্ট, অতিশয় ঠান্ডা, সুগভীর দৃষ্টির কাছে এবারেও হার মানতে হলো। দৃষ্টি এলোমেলো হয়ে পড়ল। দৃষ্টিসহ অসুস্থতার ছোঁয়া লাগা মনটাকেও সম্পূর্ণ এলোমেলো করে সে দূরের লালচে আকাশে দৃষ্টি রেখে ঠোঁট নেড়ে আপন মনে কয়েকটা লাইন আওড়াল। নজরুলগীতি ‘তুমি আমার সকাল বেলার সুর’ এর কয়েকটা লাইন।

তুমি আমার সকাল বেলার সুর
হৃদয় অলস-উদাস-করা অশ্রু-ভারাতুর।
ভোরের তারার মতো তোমার সজল চাওয়ায়
ভালোবাসার চেয়ে সে যে কান্না পাওয়ায়,
রাত্রি শেষের চাঁদ তুমি গো
বিদায় বিধুর।

অতিশয় শান্ত, কোমল সে সুমিষ্ট সুর। মনে নিদারুণ অভিলাষ জাগল এই মুহূর্তটাকে ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখার। এজন্যই বলি একটা দৈব শক্তির বড্ড বেশি প্রয়োজন আমার। এই যে এক দারুণ হাসির টুকরো আমার সকালটাকে এক ঝলকে এত মিষ্টি করে দিলো, শরীরের অসুখ ভুলিয়ে দিলো, এমন সুন্দর মুহূর্ত এক অজানা ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখলে মন্দ হত না। যখন ইচ্ছে, তখনই চোখে চোখ রেখে দেখতে পারতাম এই প্রাণবন্ত হাসিটা। কপালে চার আঙুলের ছোঁয়ায় খানিক চমকে উঠলাম। উনি কপালে ভাঁজ টেনে চিন্তিত কন্ঠে আওড়ালেন,
“আবার বেড়েছে।”
পাশের চেয়ারে বসার নির্দেশ দেওয়ার সাথে-সাথে আমি বসে পড়লাম। কথা বলতে গিয়েও মুখ বন্ধ রাখলাম। গতকাল রাতের কথা ভুলিনি আমি। কত রাত করে এসেছিল কে জানে? উনি আমাকে বসিয়ে রেখে চলে গেলেন। বেলকনি থেকে উঁকি দিয়ে দেখলাম রান্নাঘরে ঢুকছেন। তারপর বেরিয়ে এলেন দুই কাপ চা হাতে। দেখেই আমি সোজা হয়ে বসে পড়লাম। বাইরে দৃষ্টি ফিরিয়ে মুখ বাঁকালাম। এত চিন্তা গতকাল কোথায় ছিল? একটা কাপ আমার হাতে দিয়ে অন্যটা নিয়ে উনি রেলিংয়ে হেলান দিয়ে এদিকে মুখ করে দাঁড়ালেন। আমি চুপচাপ চায়ের কাপে চুমুক দিতে লাগলাম। অথচ মহাশয় নিজের চা হাতে ধরে ঠান্ডা করার পাঁয়তারা করছেন। নিজের চা রেখে আমার চা খাওয়া দেখছে। যেন আমি চা না, চাইনিজ খাচ্ছি।
“ফোন কোথায় তোর?”
এবার আমিও মুখ খুললাম। তবে ওনার মতোই শান্ত স্বরে ছোটো জবাব দিলাম,
“ফোনের জায়গাতেই আছে।”
“রাতে কখন ঘুমিয়েছিলি?”
“এগারোটায়।”
তারপর কিছুক্ষণ চুপ রইলেন। চায়ের কাপে প্রথম চুমুকটা দিয়ে পুনরায় ছোটো করে বললেন,
“চেক করিস গিয়ে।”
আমি চোখ তুলে তাকালাম। ফোন চেক করতে বলল কেন? ঘুমিয়ে পড়ার পর ফোন করেছিল না কি? ইচ্ছে করল এক্ষুনি গিয়ে ফোন চেক করি। কিন্তু নড়লাম না। এবার নিজেও প্রশ্ন করলাম,
“কখন ফিরেছিলেন?”
“সাড়ে বারোটায়।”
“ওহ্।”
মিনিট খানেক পরেই আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। তখনও চা শেষ হয়নি। উনি চটজলদি প্রশ্ন করলেন,
“উঠছিস কেন?”
“শরীর ভালো লাগছে না,” ধীর স্বরে বললাম আমি।
উনি দ্রুত আমার হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে নিলেন। দুজনের কাপ চেয়ারে রেখে আমার হাত মুঠোয় পুরলেন। আমি বললাম,
“ধরতে হবে না, যেতে পারব।”
উনি যেন শুনলেনই না কথাটা। একহাত মুঠোয় নিয়ে, অপর হাতের বাহু আগলে নিয়ে চললেন। ওনার রুমের দিকে এগোনো ধরতেই আমি থেমে গেলাম। মিনমিনে গলায় বললাম,
“আমার রুমে যাব।”
ওনার রাশভারী উত্তর,
“অসুস্থ শরীরে দুজনের সাথে ঠেলাঠেলি করে শুয়ে এমনিতেও স্বস্তি পাওয়া যায় না। আমার রুমে দুই-তিনজন নেই ঠেলাঠেলি করার জন্য।”
“যাব না আমি।”
আফরা আপুর বলা কথাগুলো মাথায় ঘুরপাক খাওয়ায় গোঁ ধরলাম আমি। উনি টু শব্দটি করলেন না। হাতের বাঁধন শক্ত করে একপ্রকার টেনে নিয়ে চললেন। কোনো বাঁধা শোনা তো দূর, একটা কথাও বললেন না। রুমে ঢুকে দেখলাম অলি বিছানায় পা ছড়িয়ে বসে হিমেল কাকার ফোনে গেমসে মগ্ন। আমাদের দেখে উৎসুক দৃষ্টি তুলে তাকিয়ে বলল,
“ইলুপিকে এভাবে ধরে এনেছ কেন? পানিশমেন্ট দিবে? কী ভুল করেছে?”
তাজ ভাই আমাকে বিছানায় বসাতে-বসাতে অলির প্রশ্নের উত্তর দিলেন,
“তোমার ইলুপি আবার কোনো ভুল করতে জানে না কি? সে তো মহীয়সী নারী। সে শুধু জানে জগত উদ্ধার করতে। তাই তার সেবাযত্ন করে নিজেকে ধন্য করতে নিয়ে এলাম।”
আমি কপাল কুঁচকে তাকালাম। ছোটো বাচ্চাটার সামনেও পচালো! অলি তাজ ভাইয়ের কথার মাথামুণ্ডু বুঝতে না পেরে গোল-গোল চোখে শুধু তাকিয়ে রইল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে দারুণ ভাবুক ভঙ্গিতে বলল,
“ইলুপি, বুঝিনি।”
আমি ঠোঁট এলিয়ে মেকি হেসে বললাম,
“আমিও না।”
তাজ ভাই অলিকে বললেন,
“অলি, যাও তো, তোমার ইলুপির রুম থেকে তার ফোনটা নিয়ে এসো।”
অলি সঙ্গে-সঙ্গে বিছানা থেকে নেমে ছুট লাগাল। আমি আলগোছে কাত হয়ে শুয়ে পড়লাম। উনিও চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। অলি এসে আমার হাতে ফোন দিয়ে গেল। ফোনটা অন করতেই আমার দুই ভ্রু কুঞ্চিত হলো। দ্রুত ফোন আনলক করে নোটিফিকেশন চেক করলাম। পরপর দশটা মিসড কল আর পাঁচটা আনরিড ম্যাসেজ। ম্যাসেজ অন করে চোখ বুলাতে লাগলাম। প্রথম ম্যাসেজ রাত এগারোটা ষোলোতে।
‘শরীর কেমন আছে? জ্বর কমছে, না বাড়ছে? বেশি ঠান্ডা পানি গিলো না, ঠান্ডা লেগে যাবে।’
দ্বিতীয় ম্যাসেজ রাত এগারোটা বাইশে।
‘কী করছিস তুই? রিপ্লাই দিচ্ছিস না কেন? আপুকে পেয়ে দুনিয়া ভুলে বসে আছিস? এরপরও রিপ্লাই না পেলে আজ সারারাত বেলকনিতে দাঁড় করিয়ে রাখব।’
তৃতীয় ম্যাসেজ রাত এগারোটা ছত্রিশে।
‘কী আনব? চাইনিজ আইটেম, না বিরিয়ানি? না কি অন্য কিছু? তাড়াতাড়ি বলো।’
চতুর্থ ম্যাসেজ রাত এগারোটা উনত্রিশে।
“কী হচ্ছে এটা? এখনও রিপ্লাই নেই! আমি ফেরার আগে রিপ্লাই না পেলে কিন্তু তোর ফোনের মেয়াদ আজই শেষ।’
পঞ্চম এবং শেষ ম্যাসেজ বারোটা দুইয়ে।
‘ঘুমিয়ে পড়েছ? শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে?’
মাথায় হাত দিয়ে আমি থম মে’রে শুয়ে ম্যাসেজগুলোর দিকেই তাকিয়ে রইলাম। এর একটা ম্যাসেজ যদি ঘুমানোর আগে করত, তাহলে তো এমনটা হত না। ইশ্! আম্মিকেও তো একবার ফোন করতে পারত। রেগে গিয়েছিল নিশ্চয়ই? কতক্ষণ রেগে ছিল? বাসায় ফিরেও কি রেগে ছিল? খোঁজ করেনি? হঠাৎ করেই মনটা বিষণ্ণতায় ছেয়ে গেল। শরীর খারাপ ভাবটা আরও একটু পরে হলে কী হত? অন্তত একটা কল তো রিসিভ করতে পারতাম। তীব্র মন খারাপ নিয়েই দ্বিতীয় দফা ঘুমটা দিলাম। ঘুম থেকে উঠে রুমে কাউকে দেখলাম না। বেড সাইড টেবিলের ওপর ছোট্ট ঘড়িটার দিকে তাকালাম। সকাল নয়টা। কিন্তু বিছানা ছাড়তে মোটেও ইচ্ছে করছে না। জ্বরে পড়ে এত মানুষের ক্যাঁচ-ক্যাঁচ একদমই ভালো লাগছে না। তার ওপর আবার আফরা আপু। আজও ঘুম থেকে ওঠার কিছুক্ষণের মধ্যে আফরা আপু এসে উপস্থিত হলো। সাথে আনহা আপু। আফরা আপুর কালো মুখ আর কুঁচকানো কপাল দেখেই বুঝা হয়ে গেল এখনই আরেক দফা ঝড় উঠবে। আমি শোয়া থেকে আর উঠলাম না। মনে হচ্ছে উঠলেই মাথাটা চক্কর দিবে। এমনিতেই তাপমাত্রার আধিক্যে কপাল পুড়ে যাচ্ছে। আফরা আপু দাঁড়িয়ে থেকেই বলল,
“উঠেছিস তাহলে? কেমন হলো ঘুম?”
আমি স্বাভাবিক গলায় উত্তর দিলাম,
“ভালো।”
“ভালো না হয়ে উপায় আছে? দ্য গ্রেট তাজ ভাইয়ের বিছানায় ঘুমিয়েছিস যে। তারপর? ভালোই তো ডুবে-ডুবে জল খাচ্ছিস। ফিলিংস কেমন?”
আমি কপালে মৃদু ভাঁজ ফেলে বললাম,
“মানে?”
“ওহ্! বুঝতে পারছিস না? আহারে, বাচ্চা মেয়েটা! আমি তো ভেবেছিলাম শুধু বিছানা দখলের চেষ্টা চালাচ্ছিস। অথচ কাল যা দেখলাম, তাতে তো মনে হচ্ছে রীতিমতো পটানোর কাজও শেষ। তা কীভাবে পটালি, শুনি একটু? বিছানা দখল করতে এসে নিজেই দখলে চলে গিয়েছিলি না কি?”
শেষের কথাটার সুর এতটা বিশ্রী ছিল যে আমি তড়াক করে শোয়া থেকে উঠে বসে পড়লাম। একহাতে কপাল চেপে ধরে মাথা ঝাঁকুনি দিলাম। নিচু স্বরে শক্ত গলায় বললাম,
“আপু, তুমি কিন্তু এবার লিমিট ক্রস করছ। কাল পর্যন্ত যা বলেছ, চুপচাপ শুনে গেছি। ভেবেছিলাম তুমি কটা দিনের জন্য এসেছ, ঝামেলা পাকাব না। কিন্তু এত খারাপ মনোভাব কীভাবে পোষণ করলে তুমি? তুমি কি আমাকে চেনো না, না কি তাজ ভাইকে চেনো না? এমন একটা কথা কীভাবে বললে তুমি?”
আফরা আপু তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,
“চিনি বলেই বলতে পেরেছি। এসে হতে কীর্তিকলাপ দেখছি তো। প্রথমে তোর কাহিনি দেখলাম, আর গতকাল তাজ ভাইয়ের। বাপরে, শপিং থেকে ফিরে বাসায় ঢুকতে না ঢুকতে তোর রুমে দৌড়। আবার জ্বর বেড়েছে দেখে সেকি চিন্তা! চিন্তার ঠেলায় একেবারে নিজেই জলপট্টি দিতে লেগে পড়ল। যেন বাসায় আর কেউ ছিল না তোর চিন্তা করার জন্য। তাজ ভাই এমনি-এমনি পটে গেছে, এটা তুই বললেই আমি বিশ্বাস করব ভেবেছিস? কোন রঙ্গ দেখিয়ে বশ করেছিস তুই-ই জানিস।”
গতকাল রাতে তাজ ভাই এসব কাণ্ড করেছে, সে সম্পর্কে মোটেও অবগত ছিলাম না আমি। তবে এই মুহূর্তে খবরটা জেনেও তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া এল না। কারণ আফরা আপুর বিশ্রী ইঙ্গিতপূর্ণ কথায় ভেতরটা রাগে-দুঃখে ফেটে যাচ্ছে। চোখ দুটোও ছলছল করে উঠল। রাগ ঝাড়ব ভেবেও নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলাম। বাসা ভর্তি আত্মীয়-স্বজন। কারো কানে এই কথোপকথনের একটা শব্দ গেলে ব্যাপারটা প্রচণ্ড খারাপ হয়ে যাবে। চোয়াল শক্ত করেই অনুরোধ করে বললাম,
“আফরা আপু প্লিজ। দয়া করে চুপ করো। এত খারাপ ইঙ্গিত কোরো না। তুমি যেসব ভাবছ, এসব কিছুই সত্য না। বিবেকে বাঁধছে এসব শুনতে।”
আফরা আপু থামল না। নতুন উদ্যমে বলতে শুরু করল,
“খারাপ তো লাগবেই। খারাপ লাগার জন্যই তো বলছি। গোপনে খারাপ কাজ করে বেড়াবি, আর খারাপ কথা শুনবি না? ভাই তোর কি এই ঢাকা শহরে একজন আত্মীয়ও ছিল না যে, এই বাসাতেই এসে গেড়ে বসলি? না কি হল ছিল না? বাপের বন্ধুর বাসায় এসে দিনের পর দিন থাকছিস কীভাবে রে? লজ্জা করে না। ওপস্! লজ্জা থাকলে তো লজ্জা করবে। এখানে এসেছিলিই তো এই পরিবারে নিজের জায়গাটা পার্মানেন্ট করতে। ঠিক না? মামার টাকা দেখেছিস, তাজ ভাইয়ের বড়ো পদ দেখেছিস। তীরটা একদম সঠিক দিকেই তাক করেছিস। বাহবা তোকে।”
আমার আগে আনহা আপু রাগত স্বরে বলে উঠল,
“আপু, কী সব বলা শুরু করলে তুমি? ইলোর আব্বুর সাথে আঙ্কেলের কেমন সম্পর্ক, তা কি তুমি জানো না? না কি ওর প্রতি ফুপা-ফুপির টান সম্পর্কে জানো না? সবই তো জানো। শুধু-শুধু এই বাজে কথাগুলো কেন বলছো? ও কি নিজের ইচ্ছায় এখানে এসেছিল? ফুপা-ফুপির কথাতেই তো এসেছিল। তা-ও তো তুমি জানো। আর তাজ ভাই আর ওর সম্পর্কে এত খারাপ মনোভাব এল কীভাবে তোমার? চিন্তা-ভাবনা পজিটিভ করো, প্লিজ।”
আমি ধরা গলায় বললাম,
“দেখো আপু, এই খারাপ কথাগুলো তুমি না থামালে আমি সত্যিই ভুলে যাব তুমি আমার বড়ো, বা এই বাসা ভর্তি লোকজন আছে। মিথ্যে দিয়ে আমাকে বোকা বানানোর আর কথা শোনানোর বয়সটা কিন্তু এখন আর নেই। বিবেকটাকে একটু কাজে লাগাও। ঝামেলা বাঁধলে তোমারও কিন্তু খুব একটা ভালো হবে না।”
আজ আর আফরা আপুর মুখে লাগাম টানা গেল না। একের পর এক তীর ছুঁড়েই চলল। আমি আর আনহা আপু বহু চেষ্টা করলাম তাকে থামানোর। কিন্তু কে শোনে কার কথা? কষ্টে চোখের পানি বাঁধ ভাঙলেও, ভেতরটা রাগে-ক্ষোভে ফুঁসছে। কতটা খারাপ মানসিকতা হলে মানুষ এমন কথা বলতে পারে! ঝড়ের মাঝেই হঠাৎ পরিবেশ গুমোট ভাব টেনে উপস্থিত হলেন তাজ ভাই। সঙ্গে-সঙ্গে আফরা আপু ঝুপ করে থেমে গেলো। একপ্রকার পালিয়ে গেল রুম থেকে। তাজ ভাই প্রশ্নভরা অবাক দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। দুহাতে ধরা ট্রেটা বিছানার একপাশে রেখে প্রশ্ন করলেন,
“কী হচ্ছিল এখানে?”
আমি দৃষ্টি ফিরিয়ে নীরবে চোখের পানি মুছলাম। আনহা আপু এগিয়ে এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে মৃদু কন্ঠে বলল,
“কাঁদিস না, ইলো। মাথাব্যথা আরও বাড়বে। ভুলে যা।”
তাজ ভাই এবার আনহা আপুকে জিজ্ঞেস করলেন,
“কী হয়েছে রে আনহা?”
আনহা আপু বলতে চাইল না। কিন্তু তাজ ভাই রেগে যাওয়াতে চুপসে গেল। বাধ্য হয়ে আফরা আপুর বলা কথাগুলো সব গড়গড় করে বলে দিলো। তাজ ভাই সব শুনে আনহা আপুকে শুধু বললেন,
“গিয়ে আম্মিকে বল গতকাল ফ্রিজে রাখা খাবারগুলো গরম করতে।”
আনহা আপু চলে গেল। তাজ ভাই একই জায়গায় চুপ মে’রে দাঁড়িয়ে রইলেন টানা দুই মিনিট। ওনার স্থির দৃষ্টি আমার মুখে। এরপর ধ্যান ভেঙে এগিয়ে এসে বিছানায় বসলেন। আলতো হাতে চোখের পানি মুছে দিলেন। মুখের রাগত, শক্ত ভাবটা বজায় রেগেই কন্ঠ যথাসম্ভব গম্ভীর করে বললেন,
“চুপ, আর এক ফোঁটা পানিও যেন না গড়ায়। মুখের ওপর জবাব দিতে যখন পেরেছ, তখন শক্তও থাকতে শেখো। কান্না থামাও বলছি।”
আমি অধর কামড়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলাম। গাল থেকে ওনার হাত দুটো আলগোছে সরিয়ে দিলাম। সিক্ত গলায় নিম্ন স্বরে বললাম,
“একটা মেয়ের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা তার জন্য কতটা অপমানের, লজ্জার আর কষ্টের, তা শুধু ওই মেয়েটাই বোঝে। আপনার কাছে একটা অনুরোধ করি? রাখবেন?”
উনি উত্তর দিলেন না। দৃষ্টি যেন গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে আমার চোখে। আমি বিরক্তির সহিত বললাম,
“মাইন্ড রিডিংয়ের চেষ্টা চালাবেন না, তাজ ভাই। আপনি আমার থেকে দূরে থাকবেন। আজ আমাকে এই বাজে অপবাদগুলো পেতে হত না, যদি না আপনার দৃষ্টিটা সবসময় আমার ওপর থাকত। সবসময় জেদ কেন দেখান, বলুন তো? টানা পাঁচ বছর আমি ছিলাম আপনার সবচেয়ে অসহ্যকর, অপ্রিয় মুখ। এখনও না হয় তা-ই ভাববেন। আপনার এই হঠাৎ পরিবর্তনগুলোর কারণেই আমি রোজ অন্যের মুখের বাজে কথা শুনছি।”
ওনার চোখ-মুখ রাগে লাল হয়ে উঠেছে। রাগ দমাতেই হয়তো জোরে দম নিচ্ছে। কপালের শিরা ফুলে ঝড়ের পূর্বাভাস জানান দিচ্ছে। তবু উনি দাঁতে দাঁত চেপে ফিসফিস করে বললেন,
“রাগ ঝাড়া শেষ হলে নিজের রুমে যাও।”
বিছানা ছেড়ে নেমে পড়লাম আমি। চলে যাওয়ার আগে শেষবারের মতো বললাম,
“মিথ্যে অপবাদ আমার সহ্য হয় না। সব বোঝেন, এটা বোঝেন না? আবার অনুরোধ করছি, দূরে থাকবেন আমার থেকে। তা না হলে আপনার সব ধোঁয়াশা কা’টিয়ে আমার নাম নিবেন।”
গতকাল রাতে শপিং শেষে সবাই রেস্ট্রন্টে খাওয়া-দাওয়া করে বাসায় ফিরেছিল। বাসায় যারা ছিল তাদের জন্যও নিয়ে এসেছিল। আমার খাবারটা আম্মি ফ্রিজে রেখে দিয়েছিল। সেই খাবার গরম করে দেওয়া হলো ঠিকই, কিন্তু তা আর আমার গলধঃকরন করা হলো না। ইচ্ছেটাই ম’রে গেল। অজুহাত দিলাম তেতো মুখের বিস্বাদের। সারা দিনটা আমি ঠিক কিসের ওপর কা’টালাম, ভাবতেও ইচ্ছে করে না।‌ একদিকে মাথাব্যথার সাথে পাল্লা দিয়ে জ্বর বাড়ল, অন্যদিকে মানসিক দুরবস্থা। না চাইতেও কান্নারা গলায় দলা পাকাল একটা অবাধ্য অনুভূতির কারণে। এক বেলার খাবারও ঠিকমতো খেতে পারলাম না। ওদিকে অ্যাপার্টমেন্টের মালিকপক্ষের সাথে আগে থেকেই সব কথাবার্তা ঠিক ছিল যে, রাজ ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে গ্রাউন্ড ফ্লোর আর ছাদ ডেকোরেশন করা হবে। বিশাল জায়গা জুড়ে অ্যাপার্টমেন্টটা তৈরি, বিধায় এই দুটো জায়গাই মানানসই। আজ সারাদিন সবাই ওদিকেই ব্যস্ত ছিল। সাথে চলল সন্ধ্যার মেহেদি উৎসবের জমজমাট প্রস্তুতি। কেবলমাত্র আমিই বদ্ধ ঘরের বিছানায় বেহুঁশের মতো পড়ে রইলাম। সময়ে-সময়ে সবাই এসে আমার খোঁজ নিল, শুধু দুজন মানুষ ছাড়া। অথচ শ্রেয়ান ভাইয়া পর্যন্ত এসে সবার আগে আমার অসুস্থতার খোঁজ নিয়েছে। আফরা আপু আর তাজ ভাই। আম্মি নিজের ব্যস্ততার মাঝেও আমার জ্বর কমানোর নানারকম চেষ্টা চালাল। আমিরা আপুরা বারবার এসে কাঁদো-কাঁদো মুখে আফসোস করল। সবার একটাই চাওয়া, সন্ধ্যায় যেন আমি তাদের সাথে যুক্ত থাকতে পারি। রাজ ভাইয়ের বিয়েতে নিজের আনন্দ বিসর্জনের জন্য আমার যতটা না খারাপ লাগল, তার চেয়ে বেশি খারাপ লাগল এই মানুষগুলোর জন্য। শুধুমাত্র তাদের জন্য আমি নিজের সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করলাম। কিন্তু হায়! কপালের লিখন কি আর পালটানো যায়? বিন্দুমাত্র উন্নতি আমার হলো না। সন্ধ্যায় সবাই শাড়ি, মেকআপ নিয়ে ব্যস্ত হলো, আর আমি নীরব চোখে দেখলাম। তাজ ভাইয়ের শর্ত ত্যাগ করে আফরা আপুকে ভারী মেকআপ করতে দেখলাম। মিনহা আপুরা আমাকে শাড়ি পরানোর জন্য অনেক জোরাজুরি করেছে, কিন্তু শরীর-মন অসুস্থ থাকলে কি আর আনন্দ উৎসবে মন বসে? আমি নাকচ করে দিলাম। তাদের বিষণ্ণ মুখ দেখে এটুকু আশ্বাস দিলাম যে, উৎসব শুরু হলে আমি তাদের সাথে ছাদে যাব। ব্যস, এতেই তাদের মন খারাপ উবে গেল। সন্ধ্যায় আমি সত্যিই তাদের সাথে ছাদে গেলাম। অনেকটা সময় নিয়ে মুগ্ধ হয়ে চোখ ধাঁধানো ডেকোরেশন দেখলাম। অবশ্য এটা আগে থেকেই জানতাম যে, ডেকোরেশন সবটাই তাজ ভাইয়ের পছন্দমতো হয়েছে। উনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সবটা করিয়েছেন। স্টেজে রাজ ভাইকে মেহেদি পরানো হচ্ছে। আফরা আপুরাও ইতোমধ্যে মেহেদি পরতে শুরু করেছে। সবার মুখে আনন্দের হাসি। মেহেদি পরার বেলাতেও আমার অনীহা চলে এল। মনে হলো এতটা সময় এক জায়গায় বসে মেহেদি পরা সম্ভব হবে না আমার পক্ষে। কখন আবার শরীর বেশি খারাপ হয়ে যায়, তার তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। জুম্মান ভাইয়ারা একেকজন রীতিমতো জোরাজুরি করল। শেষে আমি বললাম। আমার ভালো লাগলে পরে দেবো। কিন্তু তা হবে কীভাবে? ভাগ্য যে আমার প্রতিকূলে। এক ঘন্টাও বসে থাকতে পারলাম না। কারণ সাউন্ড বক্সটা রীতিমতো মাথায় হাতুড়ি পে’টাচ্ছে। আমার উস-খুস দেখে সায়মা আপু আম্মিকে বলে আমায় বাসায় নিয়ে এল। ছাদ থেকে আসার আগেও আমি চারদিকে সন্ধানী দৃষ্টি বুলিয়েছি। কিন্তু ওই মুখটার দেখা পাইনি। এমনকি আজ সকালের পর সারাটা দিনে একবারের জন্যও মুখ দর্শন হয়নি। দিনের বেলায় না হয় আমি রুমেই পড়ে ছিলাম, কিন্তু এখন? এই সময় তো এখানেই থাকার কথা। নেই কেন? প্রশ্নভরা মন নিয়েই বাসায় ফিরলাম। সায়মা আপু আমায় নিজের হাতে খাবার খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে দিলো। সে আর আমাকে একা রেখে ছাদে যেতে চাইছিল না, কিন্তু আমিই তাকে জোর করলাম। শুধু-শুধু আমার কারণে কেন তার আনন্দটা মাটি হবে। তাছাড়া এখন এমনিতেও আমার ঘুম পাচ্ছে। সায়মা আপুকে ঘুমের কথা বলে পাঠিয়ে দিলাম। ক্লান্ত চোখ জোড়াও অবাধ্যের মতো গটগট করে গভীর নিদ্রায় ঝাঁপ দিলো।
পরবর্তী সকালটা হলো আমার জন্য আস্ত এক চমকপ্রদ সকাল। বিস্ময়ে বিমূঢ় করে দেওয়ার মতো, যা আমি কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। প্রথম চমকটা ছিল একান্তই আমার জন্য। তা হচ্ছে ঘুম থেকে উঠেই দুহাত রাঙানো মেহেদি দেখা। ডিজাইনই বলে দিলো কাঁচা হাতের পরিচয়। খুব বেশি ভালো না, আবার খুব খারাপও না। মেহেদি শুকিয়ে কড়কড়ে হয়ে ছিল। হতবুদ্ধি হয়ে আমি নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে আকাশ-কুসুম ভাবলাম। বহু ভাবনার পর অদ্ভুত এক জিনিস দৃষ্টিগোচর হলো। ঘন নকশার মাঝেই বেশ কায়দা করে ইংরেজি অক্ষরে ‘ই’ লেখা। আসল চমকটা হলো এই ই-এর মাথাটায় শুধু ডানদিকে নয়, বাঁ দিকেও দাগ কা’টা। অর্থাৎ বিচক্ষণতার প্রমাণ স্বরূপ ‘ই’ এর সাথে কায়দা করে ‘টি’ বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাহ্! বাহবা পাওয়ার যোগ্য। এটুকু প্রমাণই যথেষ্ট ছিল মেহেদী পরানো ব্যক্তিটিকে চেনার জন্য। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এসব কখন আর কীভাবে সম্ভব হলো? এতটা সময় কীভাবে পেল? কী ভেবেই বা কাণ্ডটা ঘটাল।‌ পরবর্তী চমকটাই ছিল আমাকে মূর্তি বানানোর আসল রহস্য। বিরাট বিস্ময়কর এক সংবাদ, যা শুধু আমাকে নয় বাসা ভর্তি সবাইকেই আহাম্মক বনে পাঠিয়ে বসে আছে। সবার মুখে-মুখে না কি গতকাল রাত থেকে এখনও পর্যন্ত ওই এক বিস্ময় খেলছে। সঙ্গে সকলের মুখে শুধু একটাই বুলি, আফরার বিয়ে ফিক্সড। আর তা না কি আফরা আপুর সম্মতিতে। সংবাদটা শুনে আমি মিনিট খানেক হা হয়ে বসে রইলাম। আমার জানামতে আফরা আপুকে আজ পর্যন্ত তার বাবা-মা বিয়েতে রাজি করাতে পারেনি। গত কয়েক দিন ধরে একটা পাত্রপক্ষ তাকে বউ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। কিন্তু কোনোভাবেই তাকে রাজি করানো সম্ভব হয়নি। অথচ সেই আফরা আপু কি না এক সন্ধ্যায় নিজের মত পালটে ফেলল? কীভাবে সম্ভব? তাজ ভাইয়ের আশা এত সহজেই ছেড়ে দিবে সে? এ-ও কি বিশ্বাস করা যায়? গতকাল পর্যন্তও তো তাজ ভাইয়ের জন্য আমাকে যত বাজে কথা শোনাল। শেষে আমদের গ্যাং এসে ফিসফিস করে আরও এক ভয়ানক সংবাদ দিলো। আর তা হচ্ছে, আফরা আপুর বিয়ে ফিক্সড হওয়ার আসল মাথা আমাদের মহামান্য ডিটেকটিভ আহনাফ তাজওয়ার।

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

(ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)