মহাপ্রস্থান পর্ব-২০+২১

0
226

#মহাপ্রস্থান
#পর্ব_২০
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
______________
(১৮+সতর্কতা)

হাসপাতালে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল দিবা। সেই সময়ে কলিংবেলের শব্দ পেয়ে সে দরজা খুলে দেয়। পৃথুলাকে দেখে যেমন চমকে যায় ঠিক তেমনই অবাকও হয়। বিস্ময় না লুকিয়েই সে বলে,

“আরে পৃথুলা! এতদিন পর। এসো, এসো ভেতরে এসো।”

পৃথুলা দিবার সঙ্গে ভেতরে গেল। ড্রয়িংরুমে বসতে চাইলে দিবা বলল,

“এখানে নয়। ডাইনিং-এ আসো।”

পৃথুলাও দিবাকে ফলো করে ডাইনিংরুমে গেল।

“তারপর বলো কেমন আছো?” জানতে চাইল দিবা।

পৃথুলা স্মিত হেসে বলে,

“ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?”

“আমিও ভালো আছি। তুমি নিশ্চয়ই নাস্তা করোনি এখনো? আর করলেও তোমায় আবার আমার সাথে নাস্তা করতে হবে এখন।”

পৃথুলা হাসল। বলল,

“না, করিনি। হাঁটতে বের হয়েছিলাম একটু। ভাবলাম আপনার সঙ্গে দেখা করে যাই।”

“ভাবনাটা এতদিন পর হলো কেন? আমি প্রতিদিন হাসপাতালে যাওয়ার সময় এবং আসার সময় তোমায় খুঁজতাম।”

“একটু সমস্যায় ছিলাম।”

“খাওয়া শুরু করো। খেতে খেতে গল্প করি।”

কয়েক সেকেন্ড বাদে দিবা নিজেই বলল,

“তোমার হাতে, মুখে এত দাগ কীসের?”

কিছু সময়ের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলেও পৃথুলা মিথ্যে করে বলল,

“এ-ক্সি-ডে-ন্ট!”

এরপর বুদ্ধিমত্তার সাথে প্রসঙ্গ বদলে বলল,

“ভাইয়া বাড়িতে নেই?”

“উঁহু! থানায় চলে গেছে। আচ্ছা শোনো, তুমি খাবার শেষ করো। আমি চটজলদি রেডি হয়ে আসছি।”

“জি, আচ্ছা।”

এরমধ্যে পৃথুলারও খাওয়া শেষ হয়ে যায়। দিবা আসলে সে উঠে দাঁড়ায় চলে যাওয়ার জন্য।

“আমাকে এখন বেরোতে হবে সোনা। এক্সট্রিমলি সরি, তোমায় সময় দিতে পারলাম না।”

“কোনো সমস্যা নেই ম্যাম। আবার দেখা হবে আমাদের।”

“আমার ভীষণ খারাপ লাগছে। তুমি রাতে আসবে বলো? একসাথে ডিনার করব আমরা।”

“আসব। তবে আজ হয়তো সম্ভব হবে না। অন্যদিন।”

দুজনে একসাথে ফ্ল্যাট থেকে বের হয়। দিবা মুচকি হেসে বলে,

“আজ নয় কেন? বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে দেখা করবে বুঝি?”

সত্যিই আরশানের সঙ্গে দেখা করবে পৃথুলা। তবে এ কথা দিবার জানার কথা নয়। তাছাড়া পৃথুলা তো কখনো বলেইনি যে তার বয়ফ্রেন্ড আছে। সে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বলে,

“ইয়ে মানে ম্যাম! আপনি জানলেন কী করে?”

“জানতাম না। আন্দাজ করে বলেছি। ঐদিন তোমাকে একটা ছেলের সঙ্গে দেখলাম। দুজনে হাত ধরে ছিলে। সে কি তোমার বয়ফ্রেন্ড?”

পৃথুলা বুঝতে পারে দিবা আরশানের কথাই বলছে। কেননা এছাড়া পৃথুলার কোনো ছেলে বন্ধু নেই। আর সে কারও হাত ধরা তো দূরে থাক; দেখাও করে না। তাই সে লাজুক হেসে বলল,

“হুম।”

“দুজনকে দারুণ মানিয়েছে।”

“থ্যাঙ্কিউ ম্যাম।”

“মোস্ট ওয়েলকাম। দুজনের দাওয়াত রইল ডিনারের। একদিন সময় করে এসো। এটা আমার কার্ড।”

পৃথুলা কার্ডটি নিয়ে বলল,

“নিশ্চয়ই আসব। আপনি সাবধানে যাবেন।”

“তুমিও সাবধানে যেও। টেক কেয়ার।”
_______

দেলোয়ার রহমান এবং শান্তি বেগম অবসর সময় পেয়ে লুডু খেলছিল। মিনিট পাঁচেক হবে হিমেলও এসে যোগ দিয়েছে। দোলা বাড়িতে এসেছে এক ঘণ্টার মতো। রেস্ট নিয়ে একাই রুমে পায়চারি করছে। সেদিন হিমেলকে ডাক্তারের কাছে নেওয়া তারপর নিজের বাড়িতে এনে মায়ের ওপর সেবার দায়িত্ব দেওয়া এগুলো কীসের ইঙ্গিত? ভালোবাসা নাকি মায়া, করুণা? তার মন কেন বলে হিমেলকে একটা সুযোগ দিতে? সে বেশ ক’বার মনের সাথে যুদ্ধ করেছে। তবে মনের বিরুদ্ধে যেতে পারেনি। সত্যি বলতে সেও একটা সুন্দর জীবন চায়। হাসি-খুশিভাবে বাঁচতে চায়। অতীতের হাতছানি থেকে নিস্তার চাই তার। নতুন করে যদি কিছু শুরু করতে না পারে তাহলে অতীত থেকেও তার মুক্তি মিলবে না। তাই অনেক ভেবেচিন্তে সে সিদ্ধান্ত নেয় যে এই বিয়েটা সে করবে। বিয়ে আজ না হয় কাল করতে হবেই। তাহলে সেটা হিমেলকেই কেন নয়?

লম্বা শ্বাস নিয়ে সে ড্রয়িংরুমে আসে। থমথমে মুখে বাবা-মায়ের উদ্দেশ্যে বলে,

“তোমাদের সাথে আমার কিছু কথা আছে।”

তারা না তাকিয়েই বলল,

“এখন হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছে মা। পরে বলিস কী বলবি।”

“এখনই বলব।”

“আচ্ছা বল।”

বাবা-মা কিংবা হিমেল কারও-ই মনোযোগ নেই ওর দিকে। তবুও দোলা সময় বিলম্ব না করে বলে ফেলে,

“আমি হিমেলকে বিয়ে করতে রাজি।”

তার কথা বলা হলে আর এক সেকেন্ডও এখানে অপেক্ষা করে না। রুমে চলে যায়। এদিকে এ কথা শুনে তিনজনেই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কয়েক মুহূর্তের জন্য সব যেন থমকে গেছে। হিমেল নিজের খুশি প্রকাশ করার ভাষাই হারিয়ে ফেলেছে। এত সহজে এত তাড়াতাড়ি যে সে দোলার মন জয় করে ফেলতে পারবে এটা সে কল্পনাতেও ভাবেনি।
.
.
আরশান পৃথুলাকে আজ তাদের দ্বিতীয় ফ্ল্যাটে নিয়ে এসেছে। এই বাড়িটা শহর থেকে কিছুটা দূরে। খুব একটা যাওয়া-আসা নেই। মাঝে মাঝে শুধু রাফসান আসতো। আরশানেরও আসার প্রয়োজন হতো না। তবে পৃথুলার জন্য এই জায়গাটা সেইফ। বাইরে দেখা করাটা মুশকিল। কখন কোন বিপদ নেমে আসে বলা তো যায় না। তাই ঝামেলা এড়াতে আরশান এই বাড়িটাকে বেছে নিয়েছে। শিমুলকে দিয়ে কেয়ারটেকারকে আগেই নিজের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিল।

পৃথুলা বাড়িটা দেখে ঠোঁট উলটে বলে,

“কত্ত সুন্দর! আপনাদের অনেক টাকা তাই না?”

আরশানকে কিছুটা ব্যস্ত দেখাল। দেখা হওয়ার পর থেকেই বিষয়টা পৃথুলা লক্ষ্য করেছে। সে ফোন নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। গাড়ি থেকে শুধু ওরা দুজনই নেমেছে। শিমুল চলে যাওয়ার পর পৃথুলা শুধাল,

“এখানে কি আমরা দুজনই থাকব?”

“না। শিমুল আসবে আবার।” ফোনের স্ক্রিন থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই জবাব দিল আরশান।

“তাহলে কোথায় গেল?”

“খাবার আনতে। তুমি আসো।”

দরজার তালা খুলতে খুলতে আরশান কাউকে কল দিচ্ছে। তার সম্পূর্ণ মনোযোগ অন্যদিকে দেখে ভীষণ রাগ হলো পৃথুলার। অভিমানি কণ্ঠে বলল,

“আপনি ব্যস্ত?”

“একটু। তুমি ভেতরে গিয়ে বসো। আমি কথা বলে আসছি।”

মুখ গোমড়া করে পৃথুলা সোফায় বসে রইল কিছুক্ষণ। আরশান আসছে না দেখে পৃথুলা পুরো বাড়িটা একা একা ঘুরে দেখে। সময় তো কাটাতে হবে! আরশানের কণ্ঠ শুনে সে দৌঁড়ে করিডোর থেকে বেরিয়ে আসে।

“কোথায় ছিলে?” জানতে চাইল আরশান।

“বাড়িটা দেখছিলাম।”

আরশান আর কিছু না বলে সোফায় গা এলিয়ে বসল। দুশ্চিন্তায় তার মাথা ব্যথা করছে। পৃথুলা হয়তো বুঝতে পেরেছে। সে এগিয়ে গিয়ে পাশে বসে আরশানের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

“মাথা ব্যথা করছে?”

“কিছুটা।”

“শিমুল তুলাকে মেডিসিন আনতে বলেননি?”

আরশান হেসে ফেলে। পৃথুলাকে টেনে কাছে এনে জড়িয়ে ধরে বলে,

“না। সামান্যই ব্যথা। ঠিক হয়ে যাবে।”

গাড়ির শব্দ শুনে আরশান পৃথুলাকে ছেড়ে দিল। ব্যস্ত হয়ে উঠে গেল দরজা খুলতে। শিমুলের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ল,

“এনেছ?”

“হ্যাঁ।”

একটা ভাঁজ করা কাগজ দিল শিমুল আরশানকে। সম্ভবত পত্রিকা। আর খাবারগুলো দিল পৃথুলার হাতে। আরশান মনোযোগ দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পত্রিকার লেখাগুলো পড়ছে। পৃথুলা পাশে গিয়ে বসল। শিরোনামে চোখ আটকে গেল। দে’শ’দ্রো’হী নিয়ে এত মনোযোগ দিয়ে পড়ার কী আছে?

“খাবেন না?” সন্তর্পণে প্রশ্ন করল পৃথুলা।

“না, তুমি খাও। আর প্লিজ, এখন কোনো কথা বলো না! একটু সময় দাও।”

কাজই যদি করবি তাহলে এখন দেখা করার কী দরকার ছিল? রাগ হলেও পৃথুলা কিছুই বলল না। মিনিট বিশেক সময় আরশান পত্রিকার পেছনেই দিল। এরপর ফোনে কথা বলল প্রায় ঘণ্টাখানেক। একজনের সাথে নয়। অনেকজনের সাথেই কথা হয়েছে। শিমুলও ব্যস্ত ল্যাপটপ নিয়ে। একটা জলজ্যান্ত মেয়ে মানুষ যে একা বসে আছে কারও-ই সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। রাগ করে পৃথুলা খেলও না। কাজ শেষ হলে আরশান পৃথুলার কাছে আসে। গোমড়ামুখে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করে,

“কী হয়েছে?”

পৃথুলার নির্লিপ্ত উত্তর,

“কিছু না।”

“বলো না!”

“বললাম তো কিছু না।”

“রাগ করেছ?”

“না।”

“খাবার খাওনি কেন?”

“এমনিই। ক্ষুধা নেই। আমি বাসায় যাব।”

“এত তাড়াতাড়ি?”

“হু।”

“রাত দশটায় বাড়ি ফিরবে বলেছিলে। এখন মাত্র আটটা বাজে।”

“ভালো লাগছে না।”

“কেন ভালো লাগছে না? কী হয়েছে আমার পৃথুর?” আলতো করে গাল টিপে দিয়ে বলল আরশান।

পৃথুলা হাত সরিয়ে দিল। আরশান এক হাতে খাবার আর অন্য হাতে পৃথুলার হাত ধরে বেডরুমে নিয়ে এলো। এরপর কান ধরে বলল,

“আ’ম সরি। আর রাগ করে থেকো না।”

পৃথুলা নিশ্চুপ।

“এখনো রাগ কমেনি?”

“হয়েছে। আর ঢং করতে হবে না।”

“এত ভালোবাসি। তবুও বলো ঢং করি। এই দুঃখ আমি রাখব কোথায়?”

“ভালোবাসেন না ছাই! সবসময় ব্যস্ত থাকেন।”

“ব্যস্ত থাকি এটা সত্য কথা। তবে হাজারও ব্যস্ততার মাঝে থেকেও যে তোমার জন্য সময় বের করি এগুলো চোখে পড়ে না?”

পৃথুলা গিয়ে আরশানকে জড়িয়ে ধরে বলল,

“পড়ে তো! এজন্যই তো রাগ করে থাকতে পারি না।”

আরশান হাসল। অনেকক্ষণ নিরব থেকে পৃথুলা আরশানকে জিজ্ঞেস করে,

“একটা কথা বলব?”

“বলো না?”

“তখন এত মনোযোগ দিয়ে দে’শ’দ্রো’হীর নিউজ পড়ছিলেন কেন? আর আপনাকে এত চিন্তিতই বা কেন দেখাচ্ছিল? আপনি আবার দে’শ’দ্রো’হী’র সাথে যুক্ত নন তো?”

আরশান হেসে বলে,

“কী যে বলো না!”

পৃথুলা কপট রাগ দেখিয়ে চোখ রাঙিয়ে বলে,

“হুহ! হাসির কী হলো?”

“হাসলাম তোমার কথা শুনে। আচ্ছা একটা কথা বলো, ধরো আমি দে’শ’দ্রো’হী। তখন তুমি কী করবে?”

“খুব কাঁদব।”

“কাঁদবে কেন?”

“আশ্চর্য! আমার বয়ফ্রেন্ড একজন দে’শ’দ্রো’হী আর আমি কাঁদব না? অবশ্য আরও একটা কাজও করব।”

“কী?”

“আপনাকে পুলিশে ধরিয়ে দেবো।”

“বলো কী! তোমার কষ্ট হবে না? মায়া লাগবে না?”

“লাগবে। তবুও দেবো। কিন্তু আমি তো আর ভালোবাসার জন্য দেশের ক্ষতি করতে পারি না।”

“পুলিশ তো আমায় মে’রে ফেলবে তখন?”

“আমিও ম’রে যাব।”

“তুমি কেন ম’র’বে?”

“আপনি ছাড়া এই পৃথিবী আমার কাছে নস্যি। তুচ্ছ এই পৃথিবীতে আপনি বিহীন আমি পূর্ণ নই। আপনাকে ছাড়া তাই আমার বেঁচে থাকাও সম্ভব নয়। সত্যিই ম’রে যাব।”

“চুপ! এসব কথা বলে না।”

আরও শক্ত করে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরল আরশান। পৃথুলা আবদার করে বলল,

“মুভি দেখব।”

“এখন?”

“হু।”

“রুমে তো টিভি নেই। ড্রয়িংরুমে যেতে হবে।”

“চলেন যাই।”

“খাবার?”

“ওখানে বসেই খাব।”

ড্রয়িংরুমে এসে দেখে শিমুল নেই। সে অন্য রুমে। আরশান পৃথুলার পছন্দমতো টাইটানিক মুভি ছাড়ল।
জ্যাক-রোজের চুমু খাওয়ার দৃশ্যটি দেখে পৃথুলা হুট করেই বলে বসে,

“চুমু খাব।”

আরশান মুচকি হেসে বলে,

“বারণ করল কে?”

পৃথুলা সঙ্গে সঙ্গে আরশানের গালে, কপালে, নাকে, ঠোঁটে চুমু খাওয়া শুরু করে। আরশানও তখন মাতোয়ারা হয়ে যায়। সেও পালাক্রমে পৃথুলাকে চুমু খাওয়া শুরু করেছে। উন্মত্ত হয়ে গলা থেকে নিচে নামতেই পৃথুলা বাঁধা দিয়ে বলে,

“হুস! এটা বেডরুম নয়। ড্রয়িংরুম।”

আরশান ততক্ষণে পাগল হয়ে গেছে। নিজেকে আটকে রাখতে পারছে না। পৃথুলাও সহজে ধরা দিচ্ছে না। আরশান না পেরে পৃথুলাকে কোলে করে বেডরুমে নিয়ে যায়। শার্ট খুলে এগিয়ে যায় পৃথুলার দিকে। কোমরে চেপে ধরে কাছে এনে পৃথুলার শার্টের বাটন খোলা শুরু করে। পৃথুলা বাঁধা দেওয়ার পূর্বেই আরশান বুকে, ঠোঁটে এলোপাথাড়ি চুমু খাওয়া শুরু করে। জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ে বিছানায়। পৃথুলার বাঁধা দেওয়ার শক্তি শেষ। নিজেকে বিলীন করে দেওয়ার জন্য সেও প্রস্তুত। তখনই আরশানের ফোনটা বেজে ওঠে। সে তৎক্ষণাৎ পৃথুলাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে যায়। পৃথুলা অবাক হয়ে বলে,

“কী হলো?”

“সরি ফর মাই মিস্টেক পৃথু। আ’ম এক্সট্রিমলি সরি।”

পৃথুলাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আরশান চলে গেল। ফোনটাও নেয়নি। আবারও ফোন বেজে উঠল। ফোনের স্ক্রিনে ভাসছে ‘সিক্রেট গার্ল’।

চলবে…

#মহাপ্রস্থান
#পর্ব_২১
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
__________
“এই সিক্রেট গার্ল কে?”

আরশান ড্রয়িংরুমে এসে সিগারেট খাচ্ছিল। পৃথুলা ইতোপূর্বে কখনো তাকে সিগারেট খেতে দেখেনি। সাথেও পায়নি। এমনকি কখনো সিগারেটের গন্ধও আরশানের শরীরে পায়নি। তাই আজ হঠাৎ এই মানুষটাকেই সিগারেট খেতে দেখে যারপরনাই অবাক হচ্ছে পৃথুলা। তবুও সে নিজের বিস্ময় চেপে রেখে ফোনটি আরশানের চোখের সামনে ধরে উক্ত প্রশ্নটি করে।

অস্থরিতা এবং নিজের দুর্বোধ্য ইচ্ছে ও কামনাকে কন্ট্রোলে আনতে জ্ব’ল’ন্ত সিগারেটে অনবরত টান দিচ্ছিল আরশান। ধোঁয়ায় চতুর্দিক ভর্তি। পৃথুলা কাঁশছে। আরশানের এটা বোধোদয় হতেই সে সিগারেটটি ফ্লোরে ফেলে পা দিয়ে পিষে ফেলল। হাত দিয়ে পৃথুলার সামনে থেকে ধোঁয়াগুলো সরাতে সরাতে বলল,

“সরি পৃথু, সরি!”

পৃথুলা কাঁশতে কাঁশতে বলে,

“ইট’স ওকে। এই মেয়েটা কে?”

এবার আরশানের খেয়াল গেল ফোনের দিকে। তখনও ফোনের রিংটোন বেজে চলেছে। এক প্রকার ছো মেরেই সে ফোনটা পৃথুলার থেকে কেড়ে নিল। উদভ্রান্তের মতো ছুটে গেল ছাদে। তার এমন আচরণে পৃথুলা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। আজ এই ছেলের কী হয়েছে? এমন আচরণই বা কেন করছে?

পৃথুলা গায়ের শার্ট ঠিক করে সোফায় বসল। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর আরশান আসে। খুবই শান্তকণ্ঠে বলে,

“আজ আর বাড়িতে যেতে হবে না। রুমে গিয়ে ঘুমাও।”

পৃথুলা কথার জবাব না দিয়ে মুখোমুখি দাঁড়াল। চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল,

“আমি জানতে চেয়েছিলাম এই সিক্রেট গার্লটা কে?”

আরশান অপ্রস্তুত হয়ে বলে,

“তুমি চিনবে না। আর আমি সরি পৃথু! তখন যে হঠাৎ কী হয়েছিল, আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি।”

“প্রসঙ্গ বদলাবেন না। আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।”

“বাচ্চাদের মতো জেদ করছ কেন? আমি বললাম তো, তুমি চিনবে না।”

“বেশ! জাস্ট আমাকে এতটুকু এক্সপ্লেইন করুন যে, ‘সিক্রেট গার্ল’ এরকম একটা নাম দিয়ে নাম্বার কেন সেভ করা? এর মানেটা কী? এই মেয়েটাই বা আপনার কী হয়?”

“আমার কাজের সাথে জড়িত। তুমি যেমন ভাবছ, তেমন কেউ নয়।”

“আপনার কাজ কী?”

আরশান চুপ করে থাকে। পৃথুলা ফোর্স করে জানার জন্য।

“আপনার কাজ কী?”

“আমি বিজনেস করি তুমি তো জানোই।”

“কোনো বিজনেসম্যানের যে সিক্রেট গার্ল থাকে সেটা তো জানতাম না।”

“তুমি কি আমাকে সন্দেহ করছ?”

“বাধ্য হচ্ছি! আপনি আমাকে বাধ্য করছেন সন্দেহ করতে। কী লুকাচ্ছেন আমার থেকে?”

আরশান এগিয়ে এসে পৃথুলার মুখটা দু’হাতের আজলায় নিয়ে বলে,

“আমার ভালোবাসা নিয়ে সন্দেহ কোরো না পৃথু!”

পৃথুলার চোখে অশ্রু এসে জড়ো হয়। সেই মুহূর্তে আবারও আরশানের ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে। দুজনে একই সঙ্গে স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে ‘সিক্রেট গার্ল।’

পৃথুলার রাগ, জেদ, ক্ষোভ একসঙ্গে একত্রিত হয়। সে আরশানের হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে রিসিভ করতে যাবে, ঠিক তখনই আরশান ফোনটা নিয়ে নেয়। প্রচন্ড জোরে ধমক দিয়ে বলে,

“সমস্যা কী তোমার?”

পৃথুলাও যেন ক্ষোভে উন্মাদ হয়ে গেছে। সেও চেঁচিয়ে বলে,

“আমি জানতে চাই, কে এই মেয়ে। ফোনটা আমাকে দিন। আমি কথা বলব।”

“লিমিট ক্রস কোরো না পৃথু। সবকিছুতে ইন্টারফেয়ার করবে না।”

“কেন করব না? আমি আপনার গার্লফ্রেন্ড। আমার রাইট আছে আপনার সবকিছুতে।”

“না, নেই। নেই আমার সবকিছুতে তোমার রাইট। ভালোবাসি বলে তোমার সব ক্রেজ আমি এলাউ করব না। তোমাকে এটা মেনে নিতে হবে।”

দুজনের বাকবিতণ্ডার মাঝে তখনো কল আসছিল। এদিকে ওদের চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে পাশের রুম থেকে শিমুলও বেরিয়ে আসে। আরশান কাঠিন্য বজায় রেখেই বলে,

“আমায় এখন যেতে হবে। আসছি।”

আরশান চলে যাচ্ছে দেখেও পৃথুলা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। আরশান যে এখন ঐ সিক্রেট গার্ল নামে সেভ করা মেয়েটির কাছেই যাবে সেটা বুঝতে তার বেগ পেতে হয় না। অঝোরে তার চক্ষুদ্বয় থেকে পানি ঝড়ছে। সে শুধু পেছন থেকে আরশানের উদ্দেশ্যে বলে,

“আপনি কি কোনোভাবে আমাকে ঠকাচ্ছেন?”

আরশান মন কেমন করা দৃষ্টিতে ফিরে তাকায়। তার মুখাবয়ব অন্যরকম। যেন কিছু বলতে গিয়েও অদৃশ্য কিছু বলতে দিচ্ছে না। সে মায়ায় আটকে না গিয়ে, এমনকি কোনো জবাবও না দিয়ে চোখের পলকেই প্রস্থান করে।

পৃথুলা কান্নাজড়িত টলমলে চোখ মেলে শিমুলের দিকে তাকায়। পৃথুলার অন্তর্ভেদী দৃষ্টি দেখে বুক কেঁপে ওঠে শিমুলের। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে পৃথুলা জিজ্ঞেস করে,

“আপনি কি জানেন কে এই সিক্রেট গার্ল?”

শিমুল মাথা নত করে ফেলে। এর অর্থ, সে জানলেও বলতে পারবে না। আরশানের অগোচরে তার ব্যাপারে অজানা কিছু জানানো তো বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। এতদিনে পৃথুলা এতটুকু বুঝেছে যে, দুনিয়াতে যা কিছু হয়ে যাক, শিমুল কখনোই আরশানের বিশ্বাস ভঙ্গ করবে না। তাই সে শিমুলকে আর জোর করেনি। কাঁদতে কাঁদতেই রুমে এসে শুয়ে পড়েছে। একসময় ক্লান্ত হয়ে সে ঘুমিয়েও পড়ে।

কাজ শেষ করে আরশানের বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত দুটো বেজে যায়। শিমুল তখনো জেগে ছিল।

“পৃথু কোথায়? ঘুমিয়েছে?” জানতে চাইল আরশান।

শিমুল বিষন্নস্বরে বলল,

“মনে হয়।”

আরশান পৃথুলার কাছে গেল। পৃথুলা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। গালে লেপ্টে আছে চোখের পানি। চটচটে লাগছে গাল দুটো। আরশান আলতো করে গালে হাত বুলাল। কপালে চুমু খেয়ে বুকে টেনে নিল। ম্রিয়মাণ কণ্ঠে বলল,

“আই এম সরি পৃথু!”

চলবে…

[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।