মিথ্যা_অপবাদ পর্ব-১৯

0
2167

#মিথ্যা_অপবাদ
#ফারজানা_আফরোজ
#পর্ব_১৯

আরিয়ান চুপচাপ ড্রাইভ করেই যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কোনো রোবট । সোনালী তখন বিরক্তি প্রকাশ করে বললো…..

—” এই লেখক আমরা কোথায় যাচ্ছি?”

—” ভদ্র ভাবে কথা বলো।”

—” মাননীয় লেখক সাহেব আমরা কোথায় যাচ্ছি যদি সুন্দর করিয়া উত্তর দিতেন তাহলে খুবই উপকৃত হইতাম।”

—” সাধু চলিত সব ভাষায় কথা বলো বাহ ধারণ টেলেন্ট তো তোমার।”

—” হুম মিশ্র প্রতিক্রিয়া টেলেন্ট। এখন বলুন কোথায় যাচ্ছি আমরা?”

—” সিলেট।”

—” ওয়াও আচ্ছা সিলেটের কোন কোন জায়গায় যাবো আমরা?”

—” কোথায় কোথায় যেতে চাও তুমি?”

—” ওয়েট লিস্ট করে বলছি।”

সোনালী চোখ বন্ধ করে এক দমে বলতে শুরু করলো….

—” হযরত শাহ্ পরাণ (রাঃ) এর মাজার,কুলুমছড়া, লাক্কাতুরা চা বাগান, মালনীছড়া চা বাগান, হযরত শাহজালাল (রঃ) মাজার,জাফলং, লোভাছড়া, রাতারগুল, পান্তুমাই জলপ্রপাত আরো আছে কিন্তু মনে পড়ছে না।”

আরিয়ান গাড়ি থামিয়ে সোনালীর দিকে তাকিয়ে খুব ভালো করে সোনালীর মুখ দেখে বললো…..

—” এক কথায় বললেই তো হয় যে, তুমি সিলেটের আনাচে কানাচে যত জায়গা আছে সব ঘুরতে চাও।”

ইতি তখন লাফিয়ে উঠে বললো……

—” দেখ সোনালী লেখক দুলাভাই তোর মনের কথা কিভাবে বুঝে ফেলে এইটাকেই বলে রিয়েল ভালোবাসা। যে ভালোবাসায় মুখ ফোটে কিছু বলতে হয় না মনের মিল থাকলে এমনি হয়ে যায়।”

আরিয়ান ইতির কথা শুনে একবার মানহা আরেকবার সোনালীর দিকে তাকালো। সোনালী লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে রেখেছে আর মানহা জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। আরিয়ান মানহা কে আর না দেখে সোনালীর লজ্জা মাখা মুখ দেখতে থাকে তখন হৃদয় কেশে উঠল……

–” হুহ হূহ তোরা তো দেখছি ভারতীয় বাংলা ছবির মত শুভ দৃষ্টি করা শুরু করে দিয়েছিস। শুন, এখনো অনেক সময় আছে ভাবীকে দেখার জন্য এখন বরং গাড়ি চালা। ”

—” লেখক দুলাভাই আপনি তো এখন সোনালীর স্বামী সো পরেও দেখতে পারবেন সমস্যা নাই । এখন ভালো করে গাড়ি চালান কেননা আমার নাতি নাতনীদের নাতি নাতনী না দেখে মরতে চাই না আমি।”

সোনালী আস্তে করে থাপ্পড় মারলো ইতিকে । আরিয়ান আবারো ড্রাইভ করতে লাগলো। মানহা তখন ইতিকে বললো…..

—” ওদের তো বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে কিন্তু বিয়ে তো হয় নি।”

—” আপু তুমি জানো না ওদের বিয়ে হয়ে গেছে। লেখক দুলাভাই সোনালীকে অনেক আগেই বিয়ে করে ফেলেছে কিন্তু কাওকে জানায় নি। আমরা চারজন জানতাম আজ তুমি জানলে।”

—” ওয়াও গুড। তো মিস্টার আরিয়ান সেই উপলক্ষে কি আমাদের এই ট্রিট দিচ্ছেন?”

মানহার মুখে আপনি ডাক শুনে আরিয়ানের বুক কেপে উঠলো বাট প্রকাশ করলো না। ড্রাইভ করতে করতেই বললো….

—” আপনার ধারণা ঠিক। ইতি অনেক দিন ধরে ট্রিট চাচ্ছে । সোনালীর ঘুরতে যেতে ইচ্ছা করছে বিভিন্ন উপন্যাস পড়ে তাই আমিও ভাবলাম সবাই যেহেতু একসাথে আছি এখন আমিও ফ্রী তাহলে ঘুরতে যাওয়াটা মন্দ হয় না।”

সোনালী তখন বললো…..

—” আমি উপন্যাস পড়ে ঘুরতে চাই কে বলেছে আপনাকে?”

—” ফেসবুকে প্রতিদিন যা পোষ্ট করো কি ভেবেছিলে আমি দেখি না। তোমার সব পোষ্টেই আমি ফোলো করি যদিও বা রিয়েক্ট কমেন্ট করি না কিন্তু ফলো করি হাজার হোক তুমি আমার ওনলি ওয়ান বউ।”

ইতি হৃদয় জোরে জোরে হাসা শুরু করলো। আরিয়ান মানহা কে শুনিয়ে শুনিয়ে কথা বলতে লাগলো। মানহা মনে মনে ভাবছে…..

—” ভালো হয়েছে আরিয়ান সোনালীকে মেনে নিয়েছে। আমি জানি আরিয়ানও সোনালী কে পছন্দ করে এখন আমি ওদের মাঝে আশায় আরিয়ান বুঝতে পারছে না। হতে পারে আমার জীবনের খারাপ মুহূর্ত শুনে ওর মনে আমার জন্য ভালোবাসার পাশাপাশি মায়া সৃষ্টি হচ্ছে তার জন্য সোনালীকে ওর অ্যাকসেপ্ট করতে দ্বিধাবোধ করছে। আরিয়ানকে বুঝাতে হবে আমার। আমি খুব ভালো আছি আমার মেয়েকে নিয়ে সে যেনো সোনালীকে নিয়ে খুশি থাকে। ওর সাথে আমার কথা বলতে হবে।”

।।

।।

।।

।।

—” নাহিদ তুই এখন কোথায়?”

—” আমি সিলেট আছি। তুই তো জানিস সিলেট আমার লুকানোর অনেক জায়গা আছে। বাসায় মাঝে মাঝে ঝগড়া হলে তো আমি সিলেট চলে যেতাম সেইটা তো তোরা সবাই জানতি।”

—” আরেহ গাধা এই কথা তো আরিয়ানও জানে এখন যদি ও ওইখানে চলে যায়।”

—” আরিয়ানের কি এই কথা আর মনে আছে? কলেজ ভার্সিটিতে লাইফের কথা বিশেষ করে আমার সাথে ওইগুলো এখন আর ওর মনে নেই।”

—” আরিয়ান যে কথা একবার শুনে বা জানে তা সে ভুলে যায় না জানিস না?”

—” আরিয়ান জানে আমি সিলেট আসি কিন্তু কোথায় থাকি তা তো জানে না ? আমার মন বলে ও সিলেট আসবে না।”

—” তবুও সাবধানে থাকিস। বাহিরে একদম বের হবি না। আমি পরশু আসছি বায়। এখন আরিয়ানকে ফোন দেওয়া যাবে না ও যদি কিছু আঁচ করতে পারে ।”

—” শালা ছোট থেকেই গোয়েন্দা ।”

—” রাখ ফোন তুই।”

—” হুম।”

।।

।।

।।

।।

সিলেট পৌঁছাতে তাদের সারা রাত লাগলো। মাঝে রাস্তায় অনেকবার গাড়ি থামিয়েছে তারা। গ্রান্ড সুলতান টি রিসোর্ট এন্ড গলফ এই রিসোর্টে এসে উঠে তারা। আরিয়ান হৃদয় একটি রুম বুক করে ।সোনালী,ইতি ও মানহার জন্য একটি রুম বুক করা হয়।

গ্র্যান্ড সুলতান টি রিসোর্ট এন্ড গলফ একটি পাঁচ তারকা মানের রিসোর্ট। সিলেট বিভাগের প্রথম পাঁচ তারকা মানের বিলাসবহুল এই রিসোর্টে বিনোদনের জন্য আধুনিক সকল সুযোগ সুবিধা রয়েছে। গ্রান্ড সুলতান রিসোর্ট মৌলভীবাজারজেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলায় অবস্থিত। সবুজ প্রকৃতি ও চা বাগানে ঘেরা শ্রীমঙ্গলের প্রায় ১৩.২ একর জায়গার ওপর এই রিসোর্টটি গড়ে তোলা হয়েছে। সোনালী,ইতি ও মাওয়া শুয়ে পড়েছে। সোনালী ইতি খুব ক্লান্ত। মানহা লাগেজ থেকে জামা কাপড় বের করে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে।

—” সোনালীর আড়ালে আরিয়ানের সাথে কথা বলতে হবে। আরিয়ানকে বুঝাতে হবে ওর দয়া আমার লাগবে না। আমি আমার মেয়েকে নিয়ে খুব ভালো আছি। ও যেনো সোনালীকে নিয়ে ভালো থাকে। আরিয়ান যদি এখন আমার জন্য ওর বিয়ে করা বউকে দূরে ঠেলে দেয় তাহলে সেটা সোনালীর সাথে অন্যায় করা হবে। আমি জীবনে ওর প্রথম ভালোবাসা ছিলাম তেমন প্রথম ভালোবাসাই থাকতে চাই। আমি চাই সোনালী আরিয়ানের শেষ ভালোবাসা হোক। আমার জায়গা যেমন সোনালী নিতে পারবে না ঠিক তেমনি আমিও সোনালীর জায়গা নিতে পারবো না। কেননা, কেউ কোনোদিন কারো জায়গা নিতে পারে না নতুন জায়গা তৈরি করে। তাছাড়া আরিয়ান আমাকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে ওর জীবন থেকে বের করে দিয়েছে। আমি এখন আর ওর জীবনে যেতে চাই না। ”

মানহা আরিয়ানের সাথে কিভাবে কথা বলবে তা নিয়ে ভাবছে। সারা রাত জেগে থাকা সত্বেও ঘুম আসছে না তার। মনের ভিতর কেমন যেনো ভয় ভয় করছে তার । সোনালী যদি তাদের সত্যিটা জানতে পারে তাহলে কি আরিয়ানকে মেনে নিবে? নাকি দূরে চলে যাবে? সোনালীর তো জানা উচিত এইসব কথা।

মানহা রুম থেকে বের হয়ে রিসোর্ট ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো। হটাৎ অনেক বড় আর সুন্দর লাইব্রেরী দেখে লাইব্রেরীর ভিতর চলে গেলো।

মানহা একটা ভালোবাসার উপন্যাস পড়ছে কারণ, সে জানতে চায় মানুষের জীবনে ভালোবাসার প্রকারভেদ আছে কি না ? একটা মানুষ কি একজন কে ভালোবাসা সত্বেও অন্যজনকে ভালোবাসতে পারে কি না ?”

—” দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম প্রেম বলে কিছু নেই ।মানুষ যখন প্রেমে পড়ে তখন প্রতিটি প্রেমেই প্রথম হয়। উক্তিটি হলো হুমায়ূন আজাদ স্যারের। তারমানে ভালোবাসা কেউ কারো স্থান নিতে পারে না সবাই সবার স্থান থেকে একই জায়গায় স্থির থাকে।”

—” আপনার প্রথম ভালবাসা সর্বদা বেঁচে থাকবে এবং চিরকাল আপনার হৃদয়ে বাস করবে। আপনি যতই ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করুন না কেন, তা কখনই আপনার হৃদয় থেকে দূরে যাবে না। এই জন্যই তো আমি আপনার প্রথম ভালোবাসা ছিলাম না। তাই খুব সহজে ভুলে গেছেন।”

মানহা চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে ওর সামনে আরিয়ান বসে আছে। ওর সামনে ‘প্রথম ভালোবাসা’ নামক এক উপন্যাস। সোনালী আরিয়ানকে দেখে ‘থ’ মেরে যায়। ও আশা করে নাই আরিয়ান এইখানে থাকবে……

—” তুমি এইখানে?”

—” বাহ আপনি থেকে তুমি? গুড ভেরী গুড। শুনুন আপনার সাথে আমার কিছু জরুরি কথা আছে। তাই আপনাকে এইখানে সাথে করে নিয়ে এসেছে।”

—” আমারও কথা আছে আপনার সাথে।”

—” বলুন কি কথা আপনার?”

—” আপনি প্লিজ আমার জন্য আমার বোনকে কষ্ট দিবেন না। ও খুব ভালোবাসে আপনাকে।”

—” আপনার মাথা কি ঠিক আছে? আমি কেনো আমার বউকে কষ্ট দিবো আজব তো। শুনুন আমি আমার বউ নিয়ে খুব খুশি। এইটা ঠিক আমি আপনাকে ভালবাসতাম কিন্তু কি জানেন বিশ্বাসঘাতকের কোনো জায়গা এই আরিয়ানের জীবনে নেই। এখন যার জন্য আপনাকে এইখানে নিয়ে এসেছি মন দিয়ে শুনুন।”

মানহা আরিয়ানের কথায় লজ্জা পেলো। ও ভাবতে পারে নাই আরিয়ান এতটা বদলে গিয়েছে। যে ছেলের মুখে সব সময় মধুর কথা ছিল সেই ছেলের কথা আজ তার কাছে বিষাক্ত লাগছে। দূরত্ব অনেক দুরত্ব সৃষ্টি হয়েছে তাদের জীবনে……

—” হুম বলেন?”

—” নাহিদ এইখানেই আছে।”

আরিয়ান শান্ত গলায় বললো মানহা চেঁচিয়ে উঠে বললো…..

—-” হোয়াট?”

চলবে……

বানান ভুল হলে ক্ষমা করবেন।