#মেঘবিলাসী
#israt_jahan_arina
#part_32
কিছুর তীব্র ঘ্রাণ নাকে আসতেই তিন্নির ঘুম ভেঙে গেলো। চোখ মেলে কয়েক সেকেন্ড পর বুঝতে পারলো এটা শিউলি ফুলের ঘ্রাণ। ভোরের ধমকা হাওয়ায় বারান্দার পর্দাটা এলোমেলো উড়ছে।পরক্ষণে চোখ পড়লো দেয়ালে টানানো ঘড়িটার দিকে। সারে ছয়টা বাজে।অনেক দিন পর এতো সকালে তিন্নির ঘুম ভাঙলো।এমন সময় বারান্দায় দাড়িয়ে এক কাপ গরম চা না খেলেই নয়।
বিছানা ছেড়ে উঠতে যেতেই দেখলো সে করো হাতে আবদ্ধ।মাথা ঘুরিয়ে দেখলো জিসান তাকে পেছন থেকে ঝাপটে ধরে আছে।তিন্নি মুচকি হাসলো।এটা আজ নতুন নয়।ঘুমানোর সময় মাঝে একটা কোল বালিশ রাখলেও কোনো দিন তা সকালে খুজে পাওয়া যায় না।প্রথম প্রথম একটু অসস্তি লাগলেও এখন খুব ভালো লাগে।এই মানুষটার ছোঁয়া তার কখনো খারাপ মনে হয়নি।
তিন্নি খুব সাবধানে জিসানের হাতের বাধন আলগা করে উঠে পড়লো।ফ্রেশ হয়ে চা হাতে বারান্দার চেয়ারে বসলো।চারিদিক নিস্তব্ধতায় ঘেরা। রাস্তায় খুব অল্প সংখ্যক মানুষের আনাগোনা।পরিবেশটা চমৎকার।
তারপর সে তার দৃষ্টি ফেরালো জিসানের দিকে।তিন্নি ভাবছে সকল কবিরা শুধু মেয়েদের সুন্দর্যের বর্ণনা দিয়েছে।আচ্ছা তার সামনে যেই পুরুষটি ঘুমিয়ে আছে তাকে দেখলে নিশ্চয়ই কবিরা ছেলেদের রূপের বর্ণনা দিতে বাধ্য হতো।
তিন্নি তার পর তাকালো পাশের দেয়ালে।তাদের বিয়ের একটা ছবি বড় করে বাঁধানো।এই বাসায় প্রথম এসেই সে এটা খেয়াল করেছে।বিয়ের দিন মানুষটাকে ভীষণ সুন্দর লাগছিলো।অবশ্য সে সেই দিন খেয়াল করে নি।তবে মানুষটা বার বার তাকেই দেখছিলো সেটা সে খেয়াল করেছে। মুনা এসে বার বার বলছিলো
-“জানো আপু,দুলাভাইকে পুরো হিরো লাগছে।আমার জন্যও কিন্তু এমন জামাই খুজে বের করবে।”
তখন এক ধমক দিয়েছিলো তাকে।কথাটা মনে পড়তেই মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল তার।
এই কয়েক দিনে এই বাসাটা তার খুব আপন মনে হয়।যেমন বারান্দার ডান পাশের চেয়ারটা তার, ক্লোজেটের একটা পাস তার,এমনকি ডাইনিং এ জিসানের পাশের চেয়ারটা তার জন্য বরাদ্দ।সব কিছু আপন মনে হলেও মানুষটিকে এখনো পুরো পুরি আপন ভাবতে পারেনি।
ডোর বেলের শব্দে তার ধ্যান ভাঙ্গলো। সে জানে এই সময়ে রোজিনা খালা আসে। তাই সে চলে গেল দরজা খুলতে। তিন্নিকে দেখে রোকিনা খালা হেসে বললেন
-“সক্কাল সক্কাল তোমার মুখখানি দেখলে সারাদিন আমার অনেক ভালা যায়।”
-“তাই নাকি খালা? আপনার ছেলে মেয়ে কয়জন?”
-“একটা পোলা দুইটা মাইয়া। একটা মাইয়া আর একটা পোলারে বিয়া দিয়া ফালাইছি। ছুডু মাইয়াডা লেহাপড়া করে। শুনলাম তুমি নাহি ডাক্তার।”
-“না খালা আমি এখনো ডক্টর হইনি। এখনো লেখাপড়া করছি। পাশ করতে পারলে ডাক্তার হতে পারব।”
-“তোমার মুখখানা দেখলে অসুস্থ মানুষ অসুস্থ হইয়া যাইব।জিসান বাবাতো দুই দিন পর পর শরিলে কাডা ছেড়া কইরা বাসায় আহে। ভালা হইছে তুমি তহন সেবা করতে পারবা। শোনো একখান কতা কই।জামাইর হইলো লোহা।আর বউরা হইলো চুম্ববুক।এই সাট ফেন্ট না পিন্দ্দা শাড়ি পিনবা। দেখবা জামাই কেমন অচলের তলে আইসা থাকবো।”
তিন্নি জানে এখন তিনি আরও নানা উপদেশ দেওয়া শুরু করবে। মানুষটাকে প্রথমদিকে বিরক্তিকর লাগলেও এখন তার ভীষণ মজা লাগে তার কথা শুনে। তিন্নি বললো
-“খালা আপনার জিসান বাবাকে আমার আঁচলের নিচে না রেখে ভাবছি আমার জিন্স এর পকেটে রাখবো। বিষয়টা ইন্টারেস্টিং হবে না?”
রোজিনা খালা যেন বোকা বনে গেলো। এমন কথা তিনি জীবনেও শুনেনি।
কিছুক্ষণ পর এলার্মের শব্দে জিসানের ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম থেকে উঠে আসে পাশে সে তিন্নিকে দেখতে পেল না। দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে দেখল তিন্নি আর রোজিনা খালা টেবিলে নাস্তা সাজাচ্ছে।
তারা নাস্তা খেয়ে রেডি হয়ে নিলো।তিন্নি বললো
-“আপনার এখনই অফিসে জয়েন করা ঠিক হচ্ছে না। এখনো পুরোপুরি সুস্থ নন আপনি।”
-“চিন্তা করো না আমি সুস্থ আছি। আর আমি আজ জয়েন করছিনা। কিছু ইম্পরট্যান্ট কাজ আছে সেটা সেরেই চলে আসব। আমি কিন্তু তোমার কলেজের সামনে থাকব।তোমার ক্লাস শেষে আমরা একসাথে আসবো বাসায়।”
-“আচ্ছা ঠিক আছে।”
কলেজে এসেই তিন্নি মনোযোগ দিয়ে ক্লাস গুলো করলো। এই কয়েকদিনে অনেক গাফিলতি হয়েছে। এখন তাকে ভালো মতো পড়তে হবে।
ক্লাস শেষ করে বের হয়ে তিন্নি সীমাকে বললো
-“তোকে ভীষণ খুশি খুশি লাগছে,কাহিনী কি?”
সুমাইয়া বললো
-“হ্যাঁ আমিও খেয়াল করেছি। বেশ এক্সাইটেড দেখাচ্ছে তোকে। সত্যি ঘটনা কি সেটা বল?”
সীমা মুচকি হেসে বললো
-“আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।”
রত্ন অবাক হয়ে বললো
-“এই কাহিনী কবে হলো কিছুই তো জানালি না?”
-“আসলে হঠাৎ করেই তাহসান ওর বাবা মা নিয়ে চলে আসলো আর বাবাও রাজি হয়ে গেলো।”
রত্না অবাক হয়ে বললো
-“এই কোন তাহসান?জিসান ভাইয়ের কলিগ উনি?”
এবার সীমা একটু লজ্জা পেয়ে মুচকি হাসলো আর মাথা নেড়ে হ্যা জানালো।”
-“ও! তলে তলে এত দূর?”
তিন্নি হেসে বললো
-“সেন্টি খাইস না বান্ধবী। একদিন তোরও হবে।”
-“আল্লাহ এই সব বিবাহিত মহিলাদের মাঝখানে আমি একাই অবিবাহিত রয়ে গেলাম। কেমন এতিম এতিম লাগছে নিজেকে।”
রত্নার কথা শুনে সবাই হেসে উঠল। কলেজ গেইটে এসে তিন্নি কিছুটা থমকে দাঁড়ালো। সামনে জিসান দাঁড়িয়ে একটা মেয়ের সাথে কথা বলছে। তিন্নির মোটেও ভালো লাগছে না। সে মেয়েটাকে একদম সহ্য করতে পারছে না। পরক্ষণেই বেশ অবাক হয়ে নিজেকে প্রশ্ন করলো
‘আমি এমন ট্রিপিক্যাল ওয়াইফের মত কেন বিহেভ করছি। এগুলো মোটেও আমার সাথে যায় না।’
বান্ধবীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সে জিসানের সামনে গেলো। ততক্ষণে মেয়েটিও চলে গেছে। তিন্নি কে দেখে জিসান মুচকি হাসলো। কিন্তু আজকের হাসিটা তিন্নির মটেও ভাল লাগলো না। হাসি দেখিয়ে মেয়েদের পাগল করে এই লোক। তিন্নি জিজ্ঞাসা করলো
-“মেয়েটি আপনার পরিচিত?”
অবাক হয়ে জিসান বললো
-“কোন মেয়েটি?”
তিন্নির এবার রাগ হচ্ছে। সে কিছুটা রেগে বললো
-“আমি আসার আগে কত জন মেয়ের সাথে কথা বলেছেন আপনি?”
বিষয়টা ধরতে পেরে জিসান মুচকি হেসে বললো
-“এত জেলাস হওয়ার দরকার নেই বউ। মেয়েটার সাথে আমার অফিসে দেখা হয়েছিল। তার বাবার একটা কেস আমাদের হাতে এসেছিল। তখনই তার সাথে পরিচয়। আজ হঠাৎ অনেকদিন পর দেখে কথা বললো।”
-“আমি মোটেও জেলাস না।”
-“তা তো দেখতেই পাচ্ছি।”
-“আপনি বেশি কথা বলেন। চুপচাপ গাড়ি চালান।”
জিসান বুঝতে পারল তার প্রিয়তমার মাথা গরম হয়ে গেছে। তাই তার মাথা ঠান্ডা করার জন্য লং ড্রাইভে বের হলো। সারাটা বিকেল ঘুরে সন্ধ্যার দিকে তারা একটা আইসক্রিম পার্লারে থামল।
তিন্নি মনোযোগ দিয়ে আইসক্রিম খাচ্ছে আর জিসান মুগ্ধ হয়ে তা দেখছে। এই মেয়ের আইসক্রিম খাওয়াতে কোন বাচ্চামো নেই। মুখের আশেপাশে আইসক্রিম লেগে থাকলে তা সে খুব যত্নসহকারে মুছে দিতে পারতো। কিন্তু না তার বউ অলওয়েজ পারফেক্ট।
দুজন অনেক গল্প করছে আর আইসক্রিম খাচ্ছে। হঠাৎ টিভির একটা নিউজ দেখে তিন্নি থমকে গেলো। তিন্নি অস্থির হয়ে উঠল। তার পুরো শরীর রীতিমতো কাঁপছে। তার গলা শুকিয়ে আসছে। সামনে থাকার গ্লাসে পানি নিয়ে খেতে পারল না। অলরেডি তার হাত থেকে পড়ে গ্লাসটা ভেঙে গেছে।
তিন্নি কেন বিচলিত হচ্ছে সেটা সে বুঝতে পারলো না।পিছনে ঘুরে টিভির দিকে তাকালো জিসান।খেয়াল করতেই দেখতে পেলো টিভিতে নির্বাচনী প্রচারণার খবর চলছে। হঠাৎ করে তিন্নি এমন কেন করছে কিছুই তার বোধগম্য হলো না। জিসান তিন্নিকে জিজ্ঞাসা করলো
-“তিন্নি আর ইউ ওকে? তোমাকে এমন অস্থির লাগছে কেন?”
তিন্নির মুখ দিয়ে যেন কথা বের হচ্ছে না। তার ঠোটজোড়া কাপতে শুরু করলো। মনে হচ্ছে দম বন্ধ হয়ে আসছে। অনেক কষ্ট সে বললো
-“আ…. আ…আমি বাসায় যাবো।”
-“ঠিক আছে যাবো। কিন্তু তুমি এমন করছ কেন সব ঠিক আছে।”
-“সব ঠিক আছে।প্লিজ আমি এক্ষুনি বাসায় যাব।”
কথাটা বলে তিন্নি দ্রুত বেরিয়ে গেলো। জিসানও দ্রুত তিন্নির পিছন পিছন আসলো। সারাটা রাস্তা তিন্নি কোনো কথা বলেনি। বাসায় এসে সে সোজা গেস্ট রুমে ঢুকে গেলো। জিসান কিছুক্ষণ দরজায় নক করলো।আর বললো
-“তিন্নি তোমার শরীর ঠিক আছে?প্লিজ কিছু বলো।”
ওপাশ থেকে তিন্নি বললো
-“আমি ঠিক আছি। প্লিজ আমি কিছুক্ষন একা থাকতে চাই।”
জিসান আর কিছুই বলতে পারলোনা। চুপচাপ রুমে চলে আসলো। তিনি হঠাৎ এমন কেন করছে। আগে কখনো সে তাকে এতোটা অস্থির হতে দেখেনি।তিন্নি কি তার কাছ থেকে কিছু লুকাচ্ছে? টেনসনে সারারাত সে ঘুমাতে পারলোনা। ভোরের দিকে তার চোখ লেগে আসলো।
রোদে ঝলমলে আলো চোখে পড়তেই জিসানের ঘুম ভেঙে গেল। সে দ্রুত উঠে বসলো। রাতের কথা মনে পরতেই সে গেস্ট রুমের দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার দরজাটা খোলা। তিন্নি সেখানে নেই। সারা বাসা খোঁজে সে তিন্নিকে পেল না। ভীষণ টেনশন হতে লাগল তার।
হঠাৎ চোখ পরল তার টেবিলের দিকে। এখনে তিন্নির বই ছিল। কিন্তু এখন টেবিলটা ফাঁকা। কিছু একটা ভেবে জিসান দ্রুত ক্লজেট খুললো। তিন্নির কোন জামাকাপড় নেই। তিন্নিকে ফোন কল করেও পেলো না।তার ফোনটা বন্ধ। উপায় না পেয়ে জিসান তিন্নির বাবাকে কল করলো। তিন্নির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বললেন
-“চিন্তা করো না বাবা।তিন্নি সকালেই বাসায় এসেছে।তার নাকি নেক্সট উইকে পরীক্ষা। তবে তার তোমাকে বলে আসা উচিত ছিল। আমি কথা বলব তিন্নির সাথে।”
-“না বাবা সমস্যা নেই। আমিও বুঝতে পারছিলাম তিন্নির এখানে লেখাপড়ায় খুব ডিস্টার্ব হচ্ছিলো। আপনি কিছু বলার প্রয়োজন নেই। আমি পরে ওর সাথে কথা বলে নেব।”
-“ঠিক আছে বাবা।”
তিন্নির বাবার সাথে কথা বলার পরও জিসানের মনটা অস্থির হয়ে আছে। তিন্নির এভাবে চলে যাওয়ায় জিসান খুব কষ্ট পেয়েছে। সে তিন্নিকে এখানে বেঁধে রাখতে চায়নি। তিন্নি নিজের ইচ্ছায় এখানে ছিলো।তবে এভাবে চলে যাওয়ার মানে কি?আর রাতে তিন্নি সেখানে এমন কি দেখেছিল যে এমন অস্থির হয়ে উঠেছিল?