ম্লান সন্ধ্যায় পর্ব-১০

0
410

#ম্লান_সন্ধ্যায় (১০)

অগ্রহায়ণ ২৭
পৌষের আগমনী বার্তা হিসেবে ভোরের দিকে কুয়াশার আবরণে শহর আবৃত। তবে এই কুয়াশা কর্মব্যস্ত জনতাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। মাঘের কনকনে শীত কি গ্রীষ্মের কালবৈশাখী, কর্মজীবীদের কর্মস্থলে হাজির হতেই হবে। বেঁচে থাকার তাগিদে,এসব উপদ্রব এদের কাছে তুচ্ছ মনে হয়।অফিস টাইমে পাবলিক বাসগুলো ঝড়ের গতিতে এগিয়ে যেতে চাইলেও, নিজেদের ভেতর গন্তব্যে আগে পৌঁছানোর যুদ্ধে রাস্তায় অজগর সাপের মতো জ্যামের সৃষ্টি করেছে। অথচো এরা ওভারটেকিং না করলে এহেন যানজট সহজেই এড়ানো যায়। কিন্তু এ পৃথিবীর মানুষগুলো কাওকে এক সূচাগ্র পরিমাণ জায়গা ছাড়বে না,ক্ষতি হয় হোক।

ওরা জ্যামের মাঝখানে পড়ে আছে। সরফরাজ চালকের আসনে বসা। অনিক,সারাহ সিটে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে। কোয়েলিয়ার দৃষ্টি বাইরের পানে। সরফরাজ গাড়ি ঘোরানোর চেষ্টা করছে।এ রাস্তায় কতক্ষণে জ্যাম ছাড়বে বলা যাচ্ছে না।
সম্ভবত আধঘন্টা পর সরফরাজ গাড়ি ঘোরানোর সুযোগ পেল। মিনিট বিশেকের মধ্যে ওদের গাড়ি দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলতে লাগলো,ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের দিকে।

অনিকের খুব ইচ্ছে ছিল বাইকে করে নেত্রকোনা যাবে। কিন্তু আফসার শিকদার কোনোমতেই রাজী হননি। একেতো ছেলে অ্যালকোহলে আসক্ত,তার ওপর তিনি নিজেই দেখেছেন অনিকের বাইক চালানোর গতি।দেশে যে হারে বাইক দূর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বাড়ছে,তাতে কোনোমতেই ছেলের ক্ষেত্রে এ ঝুঁকি নিতে চাননা। অনিকের এহেন প্রস্তাবে নাজমা বলেছিল,

‘দেখো,ও হয়তো বাইকে অভ্যস্ত না।যদি কিছু একটা ঘটে যায়। তুমি তো আস্তে চালাতে পারো না,আর পথটাও অনেক দূরের।তার থেকে গাড়িতে যাও।’
অনিক প্রতিবাদ করে বলেছিল,
‘ওখানের রাস্তাঘাট তেমন একটা ভালো না। এমনিতেই বাইক লাগবে।অন্যের বাইকে আমি কমফোর্ট ফিল করি না।’
‘সে ব্যবস্থা দাদাভাই করে দেবে।’

সবার পীড়াপীড়িতে শেষমেশ অনিক রাজী হলো। এসব দেখে কোয়েলিয়ার বেশ মজাই লাগে।এই লোক যেন রূপকথার কোন রাজকুমার ,যার খুশি মনোরঞ্জনের জন্য সবাই সব কথা মেনে নেয়। তাকে কেউ ধমক দেয় না বা কেউ নিচু চোখে দেখেনা। আজীবন এরা সবার কাছে গুরুত্ব পায়।আর ওর মতো মানুষেরা সবার কাছে নগন্য।এইযে এরা ঘুরতে যাচ্ছে,একবারও কি ওকে জিজ্ঞেস করেছে, তুমি যেতে চাও কিনা? করেনি।কারণ এদের কাছে ওর মতামতের কোনো মূল্য নেই।ওইযে সুন্দর মানুষটা,যার জন্য তার পরিবার ভেবে সারা।সে ওর স্বামী হয়।ও হলফ করে বলতে পারে,মানুষটা ওর সমন্ধে কিছুই জানে না।কারণ ওর প্রতি তার কোন আগ্রহ নেই। কিন্তু ও এমন বড়ঘরের বৌ হতে চায়নি।ও একটা সংসার চেয়েছিল,যেখানে মধ্যবিত্তের টানাপোড়েন থাকবে, খুনসুটি ভালোবাসা ঝগড়া থাকবে।ওর মতামতের গুরুত্ব থাকবে।আর পেল কি? এমন একটা সংসার, যেখানে সবাই যদি ফ্রুট সালাদ খায়,ওর ও সেটাই খেতে হবে।আর যদি না খেতে চাও, নির্লজ্জ হয়ে অন্য খাবারের কথা বলতে হবে। কেউ তোমার ভালো লাগা শুনতে চাইবে না।আফসার শিকদার, নাজমা এরা কেউ ওর সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলেনা। নাজমার দৃষ্টি বারবার ওকে মনে করিয়ে দেয়, ওরা আর সে আলাদা শ্রেণীর।

কোয়েলিয়া দুটো দিন ধরে এসব ভেবে হাঁপিয়ে গেছে।ওর হঠাৎ এই মিছে বন্ধন থেকে মুক্ত হতে ইচ্ছে করছে।কি হবে ওই পরিবারের কথা ভেবে,যারা নিজেদের স্বার্থের জন্য ওকে একরকম বিক্রি করে দিয়েছে? অবশ্যই এটা বেচা-কেনা, নয়তো সামান্য হলেও এদের কাছে ওর মূল্য থাকতো। ওকে আনা হয়েছে এক রাজকুমারকে ভালো করার জন্য।পুরাকালে রাজার খেয়াল রাখার জন্য দাসী থাকতো।ও হচ্ছে সেই দাসীরূপী স্ত্রী।

মাঝরাতে হঠাৎ ওর খুব কান্না পেয়েছিল। একটা মানুষের জীবন এতোটা মূল্যহীন কি করে হতে পারে?ও তো শিক্ষিত একজন নারী। তবুও কেন ওর মেরুদন্ড ক্ষয়ে গেল।ওর গায়ের রং কালো বলে? কোন ছেলে স্বেচ্ছায় ওকে গ্রহণ করবে না বলে? সমাজ ওর পরিবারের দিকে আঙুল তুলবে বলে?ওকি স্বেচ্ছায় হারিয়ে যেতে পারে না? অবশ্যই পারে‌। কিন্তু মানুষরূপী জানোয়াররা যে ওকে ছিঁড়ে খাবে।মেয়ে হয়ে বাইরে বেরোনোর আগে সবথেকে বেশি প্রয়োজন নিরাপদ আশ্রয়।
গতরাত জুড়ে এসব ভেবেছে,যার ফলে ঘুমেরা ওর ওপর অভিমান করে ছিল। কিন্তু নির্ঘুম রাত কাটানোর পর ও ওর ঘুম আসছিল না। বাইরের দিকে তাকিয়ে সকালটা উপভোগ করছিল। জানালাটা খোলা থাকলে হয়তো আরও বেশি ভালো লাগতো।

সরফরাজ মিররে তাকিয়ে কোয়েলিয়াকে দেখলো। ওকে বড্ড উদাস দেখাচ্ছে। কিছু কি হয়েছে?ও ভেবে পায়না,এই মেয়েটা এতো ধৈর্য্য কোথায় পায়!

*
সূর্য ততক্ষনে মাথার ওপর উঠে গিয়েছিল।দিনটা বেশ রৌদ্রজ্জ্বল।অনিক ড্রাইভ করছিল, সরফরাজ পাশে বসে ফোন স্ক্রল এ ব্যস্ত। সকালের খাবারটা ওরা ময়মনসিংহে সেরে নেয়। ছিমছাম পরিবেশ,তবে তা উচুস্তরের মানুষের জন্য নয়। সরফরাজ সবকিছুতেই মানিয়ে নিতে পারে,এটা ওকে দেখেই কোয়েলিয়া বুঝেছিল। কিন্তু অনিককে স্বতস্ফূর্তভাবে খেতে দেখে বেশ অবাক হলো। শুধু বিরক্ত হয়েছিল সারাহ।তেল চটচটে পরোটা দেখে ওর খাওয়া মরে গেল।তাই ও গাড়িতে এসে ওদের জন্য নাজমার দেওয়া খাবার খেল।
ময়মনসিংহ থেকে ওদের যাত্রা এখন নেত্রকোনার দিকে।

নেত্রকোনা, বাংলাদেশের উত্তর সীমান্ত ঘেষা প্রাকৃতিক নৈস্বর্গিক সৌন্দর্যে ঘেরা জেলা। কথিত আছে,মগরা আর কংসের মিলিত রেখা অনেকটা চোখের মতো।তাই এর নাম নেত্রকোনা। তবে নামকরণ যাই ই হোক না কেন, মানুষের চোখ যেমন সুন্দর একটি ইন্দ্রিয়, তেমনি নেত্রকোনা বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর একটি জেলা।
কোয়েলিয়ার মন খারাপের মাত্রা কিছুটা কমে গিয়েছে।সারাহ প্রথমদিকে গল্প জুড়ে দিলেও,যখন দেখলো ওর কথা কেউ শুনছে না, তখন ও অভিমান করে কানে হেডফোন গুজলো।

জেলা সদর ছেড়ে ওরা যতোই কলমাকান্দার দিকে এগোচ্ছিল, রাস্তার দু’পাশের সৌন্দর্য ওদের মোহিত করছিল।প্রশস্ত রাস্তার দু’পাশে বিস্তির্ণ ফসলের মাঠ।মনে হবে সবুজের বুকচিরে একটি রেখা এঁকেবেঁকে গিয়েছে। কোথাও ধানকাটা জমি পড়ে রয়েছে, কোথাও বা সরিষার হলুদ ফুলের দেখা মিলছে।স্থানে স্থানে জলাবদ্ধ জমির পাশে গরু ছাগলের চরে বেড়ানোর মতো মনোমুগ্ধকর দৃশ্য।
সরফরাজ বললো,
‘আগে এখানকার রাস্তা খুব বাজে ছিল।ওইযে সামনে গনেশ্বরী নদী।’
গনেশ্বরীর সৌন্দর্যে ওরা মুগ্ধ হলো।প্রশস্ত নদীর বুকে তৈরি সেতু দিয়ে ওদের গাড়ি যাবার সময় মৃদু বাতাসে কোয়েলিয়ার মনে খারাপের রেশ কমে গেল।সারাহ বললো,
‘জায়গাটা একেবারেও খারাপ না।’
‘এখনো সুন্দরের দেখা মেলেনি।’
সরফরাজ কোয়েলিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘আপনি কিছু বলছেন না।মন খারাপ?’
‘সেরকম কিছু না।’
‘বেড়ানোর সময় মন খারাপকে প্রাধান্য দেবেন না। কতদিন এই সুন্দর পৃথিবীতে বাঁচবো,তা আমরা বলতে পারি না।’

কলমাকান্দা বাজারে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল রাকিব হোসেনের বাংলোর কেয়ারটেকার যাদব হাজং।রোদে পোড়া লালচে মুখ, ছোট চোখ, মুখে সর্বদা হাসির মানুষটা বেশ বিনয়ের সাথে বললো,
‘আপনারা গাড়ি না এনে মোটরসাইকেল আনলে ভালো করতেন। কিছু কিছু জায়গায় গাড়ি নিয়ে চলাচলটা সুবিধার হবে না।’
সরফরাজ বললো,
‘বাংলো পর্যন্ত যেতে পারবো তো?’
‘জ্বি পারবেন। তবে মাঝে রাস্তার কন্ডিশন ভালো না।’

*
রাস্তার চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ওরা যখন বাংলোয় পৌঁছাল, ততক্ষনে দুপুর গড়িয়ে গেছে। তবে বাংলো দেখে ওদের ক্লান্তি নিমেষেই দূর হয়ে গেল।রাস্তা থেকে অনেকটা উপরে টিলাসদৃশ উচু জায়গায় দ্বিতল বাড়িটা। ছাদের ওপর লালচে টিনের ছাউনি।ওপরতলার সামনে প্রশস্ত খোলা ছাদ। বাড়ির একপাশে পুকুর তাতে,পাথরে বাঁধানো ঘাট। চারপাশ প্রাচীরে ঘেরা।সদর দরজার লোহার গেটের ওপর বাগানবিলাসের ঝাড়,যদিও এখন তাতে গুটিকয়েক ফুল দেখা যাচ্ছে। উঁচু উঁচু শাল সেগুন,রেইনট্রি,আম কাঁঠালের বেষ্টনে আবৃত বাড়িটি দূর থেকে দেখলে মনে হবে টিলার ওপর লালচে টিনের ছোট্ট ঘর।মূল সড়কের থেকে ইট বিছানো মিনিট পাঁচেকের রাস্তা এসে বাড়ির সামনে থেমেছে। রাস্তার দু’পাশে উচু উচু সুপারি আর নারকেলের বেষ্টনী। মাঝেমাঝে শাল আর রেইনট্রি।রোজ ভোরে এই রাস্তা ধরে হাঁটলে যেকারো মনে প্রশান্তি খেলা করতে বাধ্য ‌।
সবমিলিয়ে ওদের মানতেই হলো, রাকিব হোসেন যথেষ্ট শৌখিন লোক ‌।

যাদব ওদের ওপর তলায় থাকার ব্যবস্থা করেছিল।সারাহ আর কোয়েলিয়া এক ঘরে, সরফরাজ অনিক আলাদা আলাদা ঘরে। ঠান্ডা জলে গোসল করে,দুপুরের খাবারটা ওরা সাদা চালের ভাত, তিতিরের মাংস,রুই মাছের কালিয়া দিয়ে সারলো।প্রত্যেকটা রান্না চমৎকার কিন্তু ঝাল তুলনামূলক বেশি।তবে অনিককে আপত্তি করতে দেখা গেল না। সরফরাজ হয়তো অনিকের ব্যাপারে জানতো, কিন্তু সারাহ আর কোয়েলিয়া বেশ অবাক হলো।আজ ওর আচরণ সম্পূর্ণ আলাদা,চোখেমুখে প্রশান্তির ছাপ।তবে সকালে রেস্তোরাঁয় একবার খাবার অর্ডার করা ছাড়া ওকে একটা কথা বলতেও কেউ শোনেনি। সারাহ একবার আফসোস করে বলেছিল,
‘বড় ভাইয়া ঘোরার আনন্দ মাটি করে দিলো।’

খাবার পর যে যার ঘরে গেল। এখন আর বের হবার মতো কারো ইচ্ছে নেই।তবে কোয়েলিয়ার ঘরে বসে থাকতেও ইচ্ছে করলো না।ও নিচে নেমে পুকুরঘাটের কাছে গেল।পাথরে বাঁধানো সিঁড়ির পাঁচটা ধাপ জলের ওপর দৃশ্যমান।গাছের বেষ্টনী ভেদ করে সূর্যের কিরণ জলের ওপর পড়ে নানা ভঙ্গিতে নৃত্য করছে।ও চতুর্থ ধাপে বসলো।গাছের ছায়ায় পুকুরের জলটা হালকা সবুজ দেখাচ্ছে।ও গালে হাত দিয়ে আনমনা হয়ে বসেছিল। পিঠের ওপর কোঁকড়া চুল মেলা, শাড়ির আঁচলটা সিঁড়ির ধাপে পড়ে রয়েছে। বাতাসে গাছের পাতা দুলতে দুলতে পুকুরের ওপর পড়ছে। কিছুক্ষণ পর ওর পাশে কারো উপস্থিতি বুঝে মুখ তুললো।ঠিক ওর একধাপ ওপরে অনিক বসলো।
কোয়েলিয়া একসময়ে ওর উপস্থিতি আশা করেনি।বললো,
‘আপনি ঘুমাননি?’
‘ঘুম আসছে না।’
‘তারপরও বিশ্রাম করা উচিত ছিল।আর ওগুলো আমি এনেছি।যাদবদা ফ্রিজে রেখেছে।তালেব তো নেই,তাই কষ্ট করে হলেও আমাকে বলবেন।’
‘বাহ্, আপনার মতো স্ত্রী সবপুরুষ কামনা করে।’
‘সত্যিকারের স্ত্রী হলে আমি কখনোই এগুলো ছুঁতে দিতাম না।’

অনিক থমকে গেল। কোয়েলিয়া পিঠ ফিরিয়ে বসে থাকায় ওর মুখ দেখতে পেল না। গতকাল থেকেই খেয়াল করছিল, কোয়েলিয়ার মুখটা কেমন বিবর্ণ।ও কোয়েলিয়ার কথা কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছে । কিন্তু ও কি করবে? নতুন করে শুরু করার মতো মানসিকতা ওর নেই। আবার মেয়েটার মুখের দিকে তাকালে ওর মনটা কেমন করে। যেদিন শুনলো ওর মা নেই, সেদিন ওর নিজের কাছে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল।এই মেয়েটাকে ও সুখী রাখতে পারছে না। মায়ের অভাব কি ও ভালো করেই জানে। সেখানে এই মেয়ে তার মা’কে দেখতেও পায়নি।অথচো মেয়েদের প্রথম বন্ধু তার মা হয়।

ওর কোন জবাব না পেয়ে কোয়েলিয়া আবার বললো,
‘আপনার সবরকম খেয়াল রাখার দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘদিনের অভ্যাস তো একনিমিষে যাবার নয়। তবে চেষ্টা করবেন তাড়াতাড়ি এসব থেকে বের হবার।’
‘সে দায়িত্ব আপনাকে দেওয়া হয়েছে। আমার এসব ভেবে সময় নষ্ট করার কারণ নেই।’
‘আপনি নিজে থেকে এসব না ছাড়লে আমি কিভাবে তা পারবো!’
‘আমার এসব থেকে বের হবার ইচ্ছা নেই।’
‘তাহলে তো আপনাদের বাড়িতে আমার বেশিদিন থাকা হবে না।তাতে অবশ্য আপনারই ভালো।’
‘তা অবশ্য ঠিক। পেয়ারা খাবেন?’
কোয়েলিয়া কথা বুঝতে না পেরে পেছন ফিরে তাকালো। অনিকের ক্যামেরার ফোকাস ওর দিকে।ও কিছু বুঝে ওঠার আগেই,বেশ কয়েকটা ছবি তুলে নিলো। তারপর বললো,
‘আপনাকে দিয়েই নতুন করে ফটোগ্রাফী শুরু করলাম।’
কোয়েলিয়া বিস্মিত হয়ে বললো,
‘এটা কি আপনি সত্যি!’
‘আমাকে দেখে ভূত মনে হচ্ছে!’
‘এতক্ষণ মনে হচ্ছিল।কিন্তু ছায়া দেখে মনে হলো, ভূতের তো ছায়া হয়না। আপনার বোধহয় একটু পান করা উচিত। আমি এনে দিচ্ছি।’
অনিক বিরক্ত হলো। বললো,
‘যেতে হবে না। আমাকে কয়েকদিন দেখলেন, ওমনি ভেবে নিলেন আমি রাগী, বদমেজাজি, হাসতে জানি না!’
‘তাহলে কি ভেবে নেব শুনি? আমি যা দেখেছি তাই ই মনে করেছি।’
‘দেখলেই মনে করতে হবে। আমি যথেষ্ট প্রাণবন্ত এক মানুষ।’
‘সে তো দেখছি।’
‘ঠাট্টা করছেন!’
‘ছিঃ,ছিঃ আপনার সাথে ঠাট্টা করতে পারি। আমার গর্দান চলে যাবে?’

রাগে অনিকের চোখ মুখ কুঁচকে গেল। কোয়েলিয়া ওর দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসলো। বিকেল নেমে আসছে। আশেপাশের কোনো মসজিদ থেকে আসরের আজান ভেসে আসছে ‌। কোয়েলিয়া শাড়ির আঁচল তুলে মাথায় দিলো।অনিক মুগ্ধ হয়ে খেই হারিয়ে ফেললো।সময় বোধহয় এই পুকুরঘাটে বসা ওই রমনীর ইশারায় থেমে গেছে।ভালোবাসা বুঝি এভাবেই হয়?এই যুবক বুঝি কপোতীর সে ইশারায় ভুলে যাবে?

*
পাহাড়ে রাত নেমে আসে তাড়াতাড়ি।যদিও আগের মতো এখন আর সেই অন্ধকার যুগ নেই।এখানে প্রায় অর্ধেক বাড়িতে বিদ্যুৎ রয়েছে।তবে সন্ধ্যার পর চারপাশটা একদম নিস্তব্ধ হয়ে যায়। ঝিঁঝিঁ পোকা,কুকুরের ডাক আর মাঝরাতে শেয়ালের হাক ছাড়া আর তেমন শব্দ পাওয়া যায় না। মাঝেমাঝে বিজিবিরা শূন্যে গুলি ছুড়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয়।এরা অতন্দ্র প্রহরী, পরিবার পরিজন থেকে বহুদূরে রাত জেগে দেশমাতৃকাকে বহিশত্রুর হাত থেকে রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছে।

কোয়েলিয়া রান্নাঘরে যাদবকে হাতে হাতে সাহায্য করছিল।যদিও যাদব নিজেই রান্নায় সিদ্ধহস্ত।কথায় কথায় জানলো,রাকিব হোসেন প্রায় দশ বছর আগে এখানে ঘুরতে এসে পরিবেশ দেখে মুগ্ধ হয়ে জায়গা কেনেন।পরে এই বাড়ি করতে অবশ্য তিন বছরের অধিক সময় ব্যয় হয়েছে। তিনি এখন মাঝেমাঝে নির্জনবাসের জন্য এখানে আসে।যাদব ওকে হাজংদের মাতৃভাষা শোনালো, আফসোসের সুরে এও বললো এ ভাষা এখন আর তেমন চর্চা হয়না।কারণ সবকাজে বাংলা জানাটা খুব জরুরী। মাতৃভাষার জন্য যদি বায়ান্নতে আন্দোলন হয়,তবে ওরা হাজং হিসেবে ওদের মাতৃভাষাকে কেন ভুলে অন্য ভাষার চর্চা করবে?

রাতে ওদের তাড়াতাড়ি খেতে হলো। কেননা এ অঞ্চলে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের দারুন সুনাম আছে,যাদবকেও ওর ঘরে ফিরতে হবে। খাওয়া শেষে ওরা সবাই মিলে খোলা ছাদে বসলো।যাদব পূর্বেই চেয়ার টেবিল পেতে রেখেছিল। কোয়েলিয়া অনিকের পাশে বসেছে।ওর মুখোমুখি সারাহ,পাশে সরফরাজ। রাতে বেশ শীত পড়েছে তা অনিকের থ্রি কোয়ার্টার ছেড়ে ফুলপ্যান্ট দেখে বোঝা যাচ্ছে।সারাহ রীতিমতো সোয়েটার টুপি পরে কাশ্মীরী বনে গেছে। ছাদের এই কোণা বসে দূরের মেঘালয় রাজ্য আবছা দেখা যায়। পাহাড়গুলো দেশের সীমানাতে প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। অমাবস্যা চলছে,তাই দূরের পাহাড়গুলোকে ঘোর অন্ধকার মনে হচ্ছে। মাঝেমাঝে শেয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে।যাদব বলেছিল এখনও নাকি বুনো হাতির দল মাঝেমাঝে মাঠে নেমে আসে।দূর থেকে তাদের হুঙ্কার ভেসে আসে। গেল বছর পলি পড়া কাদামাটিতে আটকে একটা হাতি মারা পড়েছিল।তবে তার গায়ে গুলি ছিল। নিশ্চয়ই কোন সভ্য মানুষের কাজ।

হলদে বাতির আলোয় অনিক আর সরফরাজ দাবাতে মেতে উঠলো।অনিক অবশ্য ফাঁকে ফাঁকে অ্যালকোহলের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছিল। সরফরাজের এমন কোন অভ্যাস নেই। খেলা শেষে ওরা এখানকার পরিবেশ নিয়ে আলোচনা করছিল।মাঝে একবার যাদব বলে গেছে, আবহাওয়া ভালো ঠেকছে না, বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। ওরা তাতে ভ্রুক্ষেপ করলো না। ওদের কথা বলার ফাঁকে সরফরাজ কোয়েলিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘এমন চমৎকার পরিবেশে একখানা রবীন্দ্রসঙ্গীত আপনার কন্ঠে শুনতে ইচ্ছুক। শোনাবেন?’
কোয়েলিয়া এমন আবদারে ইতস্তত করে বললো,
‘আমার সুর তাল ঠিক হয় না।’
‘বেসুরোই শুনবো।’
তবুও কোয়েলিয়া রাজী হয় না। এদের ভেতরে ওর গান ভালো হবে না।সারাহ বেশ জোরাজুরি করে‌।
‘ভাবী তুমি গাওনা। আমরা এমনিতেই গান পারিনা,ছোটভাইয়া একটু আধটু পারে।’
ও ফের আপত্তি করতে যাচ্ছিল, আচমকা অনিক বলে ওঠে,
‘গাননা। আমরা সবাই শুনতে উৎসাহী।’
এরপর আর আপত্তি থাকে না।ও গায়,

‘এই কথাটি মনে রেখো, তোমাদের এই হাসি খেলায়
এই কথাটি মনে রেখো…
আমি যে গান গিয়েছিলেম,মনে রেখো
আমি যে গান গেয়েছিলেম…
জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়,মনে রেখো।

কোয়েলিয়ার কন্ঠস্বর নিঝুম পরিবেশে ঝর্ণা থেকে জল গড়িয়ে পড়ার মতো মূর্ছনা তুলছিল।ওরা মোহাচ্ছন্ন হয়ে শুনছিল।অনিক আনমনেই বললো,
‘কোয়েলিয়া অর্থাৎ কোকিল। আপনার নামটা সার্থক। কবিগুরু হয়তো জানতো না,একবিংশ শতাব্দীতেও কোন সুকন্ঠী তার গানের চর্চা করবে।’

চলবে…
®️ সুমি খানম