রইলো তোমার নিমন্ত্রণ পর্ব-১৮+১৯

0
388

#রইলো_তোমার_নিমন্ত্রণ।
[১৮]

দ্রুত পায়ে হাটছে আর চোখের পানি মুছছে ভূমি। কান্না করতে কারতে চোখ নাক লাল হয়ে গেছে। এবার সে হেচকি তুলে কান্না করছে। বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেই ছবিগুলো। এভাবে কেউ কাউকে নিয়ে কি করে মজা করতে পারে। এখন তো সবাই তার চরিত্রের দিকে আঙ্গুল তুলবে। আরাভকে নিয়ে সবাই তাকে নানা কথা শুনাবে।কিন্তু সবাই তো আর তাদের সম্পর্কের কথা জানেনা, তাছাড়া তারা বিবাহিতও নয়। কি করে মুখ দেখাবে সে কলেজে। সবাই একটাই কথা বলবে, ছাত্রী হয়ে শিক্ষকের সাথে নোংরামি করে বেড়ায়। আরাভ নিয়ে সবাই বাজে কথা বলবে। না ভূমি পারবে না এসব সহ্য করতে আর এই মুখও কাউকে দেখাতে পারবে না সে। এলোমেলো পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আর মনে মনে হাজারো কথা ভাবছে ভূমি। একটা ব্রিজের কাছে এসে পা থামিয়ে দেয় ভূমি। চারিদিকে একবার দেখে ব্রিজের কিনারায় এসে দাঁড়ায়। ব্রিজের নিচে পানি ঢেও খেলছে তার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে নৌকা। মাঝিরা নদী থেকে ঝাল তুলছে। ভূমি গভীর দৃষ্টিতে নদীর দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর ধীর পায়ে ব্রিজের উপর উঠে দাঁড়ায়। আর তখনি ওর পাশে এসে দাঁড়ায় আরাভ আর দিগন্ত। আরাভের পা থমকে গেছে। মাথা শূন্য, কাজ করা বন্ধকরে দিয়েছে। শুধু ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে ভূমির দিকে। দিগন্তের ও একই হাল। ওরা দু’জনেই ভূমিকে খুঁজতে বেড়িয়ে ছিলো। দারোয়ানকে জিগ্যেস করে এদিকে চলে আসে। ভূমি তার চোখ বন্ধকরে এক পা সামনের দিকে বাড়িয়ে দিলো আর তখনি আরাভ ওকে টান দিয়ে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়। আকস্মিক ঘটনায় চমকে উঠে ভূমি। চোখ খুলে নিজেকে এক সুঠাম দেহের সাথে নিজেকে আবিষ্কার করে। ভূমির বুঝতে বাকি নেই এটা কে হতে পারে। ভূমি দু-হাতে আরাভকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পরে। আরাভ ভূমির মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করে। ততক্ষণ দিগন্ত গাড়ি থেকে একটা পানির বোতল এনে আরাভের হাতে দেয়। আরাভ ভূমিকে ছাড়িয়ে ওকে একটু পানি খাইয়ে দেয়। ভূমির কান্না থেমে গেছে তবে মাঝে মাঝে হেচকি তুলছে। আরাভ দিগন্তের হাতে পানির বোতল দেয়। তারপর ভূমির দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলে,

” পালিয়ে এলে কেন? তুমি কি কোন ভূল করেছো? তাহলে পালিয়ে এলে কেন?”

দিগন্ত বলল,
” এখন থাকনা। এমনিতেই অনেক কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা। এখন আবার আপনি বকবেন নাকি?”

আরাভ দিগন্তের দিকে একবার তাকিয়ে ভূমির কাঁধে হাত রাখলো। ভূমির চোখ থেকে অঝোর ধারায় আবার জল গড়াতে লাগলো। আকস্মিক আরাভের বুকের উপর খামচে ধরে বলতে থাকে,
” কেন বাঁচালে তুমি আমায়। এই মুখ আমি কাউকে দেখাতে পারবো না। সবাই তোমাকে আমাকে নিয়ে নোংড়া কথা বলবে। না, আমি এসব সহ্য করতে পারবো না। আমি আর বাচতে চাইনা। মরে যাব আমি। মরে যাব।”

ভূমি আবার ব্রিজের উপর উঠতে যাবে তখন আরাভ ওর দু কাঁধে হাত রেখে চিৎকার করে বলতে থাকে,
” কি বললি তুই মরে যাবি। তুই মরে গেলে সবটা সমাধান হবে। তখন সবাই তোকে নিয়ে আরো বাজে কথা বলবে। তুইতো কোন ভুল করিসনি, সব দোষ করেছে ওই ডেথ। তাহলে তুই কেন নিজের প্রান প্রান দিবি।”

ভূমি চমকে আরাভের দিকে তাকালো। আরাভ ওর সাথে তুই তুকারি করছে। কথা বলার ভাষা হাড়িয়ে ফেলল সে। আরাভ ভূমির হাত ধরে বলল,
” চল,,,,

” কো-কোথায়?”

” যোগ্য জবাব দিতে।” তারপর দিগন্তের দিকে তাকিয়ে বলল, “গাড়ি ঘোরান ডিটেকটিভ।”

ভূমি নিজের হাত ছাড়াতে ছাড়াতে বলল,
” আমি যাব না। ওখানে সবাই তোমাকে নিয়ে নোংরা কথা বলবে। আমি এটা শুনতে পারবো না।”

” ভালোবাসি তোকে আমি।”

” ছাত্রী হয়ে শিক্ষকের সাথে প্রেম করছি সবাই এটাই বলবে। ভালোবাসাটা কেউ দেখবে না।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরাভ। তারপর ভূমির গালে হাত রেখে কোমল কন্ঠে বলে,
” তোমাকে ভালোবেসে তোমার সমস্ত সুখের দায়িত্ব নিয়েছি আমি। তোমার সম্মান রক্ষার দায়িত্বও আমার। চলো এবার।”

ভূমি কিছু বলতেই যাচ্ছিল, আরাভ ভূমির ওষ্টে নিজের তর্জনী বসিয়ে ওকে চুপ করিয়ে দেয়। তারপর হাত ধরে টেনে গাড়ির পিছন সিটে বসিয়ে দিয়ে নিজে তার পাশে বসে। দিগন্ত ড্রাইভ করছে। কিছুক্ষণের মধ্যে কলেজ ক্যাম্পাসে উপস্থিত হয় আরাভ ভূমি দিগন্ত।চারিদিকে সবাই আরাভ আর ভূমিকে হায়হায় করছে। সেসবে পাত্তা দিলো না আরাভ। আরাভ ভূমির হাত ধরে সামনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে আর দিগন্ত পিছন পিছন যাচ্ছে। আরাভ ভূমিকে নিয়ে সোজা স্টিজের উপর উঠে যায়। ভূমিকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে মাইক্রোফোন হাতে নেয়। সবার দৃষ্টি আরাভ আর ভূমির উপর। আরাভ বলতে শুরু করলো,

” সাইলেন্স, সাইলেন্স এভরিওয়ান। আমি প্রথমেই আমার আর ভূমির সম্পর্ক নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই।”

অন্য ডিপার্টমেন্টের একজন স্টুডেন্ট বলে উঠলো,
” আপনার আর কি বলার আছে। শিক্ষক হয়ে ছাত্রীর সাথে নোংরামি করেন। আমরা আপনার কোন কথাই শুনবো না।”

আরাভ হাসলো। শব্দকরে হাসলো। তারপর বলল,
” নোংরামি, কোনটাকে বলছো নোংরামি। ভালোবেসে একদিন প্রিয়মানুষটাকে নিয়ে ডিনারে যাওয়া যদি নোংরামি হয়। তাহলে দিনের পর দিন হোটেলে মেয়েদের নিয়ে রাত কাটানোটাকে কি বলে।” ছেলেটার মুখ চুপসে গেল। সে আমতা আমতা করে কিছু বলতে চাইলো। আরাভ আবার বলতে শুরু করল,

” আজ যেটা ভূমির সাথে হয়েছে কাল সেটা আপনাদের যে কারো সাথে হাতে পারে। তাই বলছি আগেই কেউ কোন মন্তব্য করবেন না।, দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো আরাভ। আবার বলতে শুরু করলো, ” ভূমি আমার ফিওন্সে। আজ থেকে প্রায় তিন মাস আগে আমাদের এইনগেজমেন্ট হয়েছে। তারপরেই আমরা ভালোবাসার সম্পর্কে বাধা পরি। আমার ডিপার্টমেন্টের প্রায় সবাই এটা জানে। এখন কথা হলো, ভালোবেসে আমি আমার বাগদত্তাকে নিয়ে ডিনারে যাব, লং ড্রাইভে যাবো, তাকে জড়িয়ে ধরলো আদর করবো নাকি চুমু খাবো সেটা সম্পূর্ণ আমাদের ব্যাক্তিগত ব্যাপার। কিছুক্ষণ আগে পর্দায় আমার আর ভূমির যে ছবি ছিলো সেটা আমাদের প্রথম ডেট এর। আচ্ছা এখানে এমন কেউ আছেন, যে তার ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়ে একটু স্পেশাল সময় কটাতে চাননা। সবাই চায়, আমিও চেয়েছি। আমাদের কি কোন প্রাইভেসি নেই, আমার ব্যাক্তিগত ভালোবাসার মুহূর্তগুলো কেন সবার সামনে তুলে ধরা হলো। আর সেই ছবি দেখে আপনারা বলছেন আমরা নোংরামি করছি। আরে নোংরামি তো তখন হত যখন আমরা আমাদের একান্ত ব্যাক্তিগত সময় সবার সাথে শেয়ার করতাম। যে মানুষটা তার কু-রুচি নিয়ে আমাদের প্রাইভেসি নষ্ট করলো তাকে ঘৃনা না করে আমাদের ঘৃনা করছেন। একটা মানুষ কতটা অমানবিক, মনুষ্যত্বহীন বিকৃতমস্তিষ্কের মানুষ এবং কু-রুচি সম্পন্ন হলে এভাবে কারো প্রাইভেসি নষ্ট করতে পারে।কই একবারও তো তার কথা জানতে চাইলেন না। আচ্ছা এই ঘটনা তো আপনাদের সাথেও ঘটতে পারতো। আপনাদের আর কি দোষ বলুন, সময়টাই এখন এমন। একটা ইস্যু পেলেই হলো। আগাগোড়া কিছু না জেনে সেটা টেনে লম্বা করাই আমাদের কাজ।”

এটুকু বলেই থামলো আরাভ। অন্য আরেকজন বলে উঠলো,
” বুঝলাম মেয়েটা আপনার ফিয়ন্সে। কিন্তু ওই ছবিগুলো?”
” ওগুলো সব ফেইক। এডিটিং করা।”

উপস্থিত সকলে কানাঘুষা শুরু করলো। এক পর্যারে তাদের নিয়ে আর কেউ বাজে মন্তব্য করলো না। সবাই ওদের আগামি জিবনের জন্যে শুভকামনা জানতে লাগলো। তখন আরেকজন বলল,
” কিন্তু এই ঘটনা তো মেয়েটার মনে সাইড ইফেক্ট তৈরী হবে। মেয়েটা কি ভুলতে পারবে।”

আরাভ ভূমিকে আরো শক্তকরে নিজের সাথে জড়িয়ে নেয়। তারপর বলে,
” পারবে। ভুলতে পারবে। একটা ঘটনা ভুলার জন্যে অন্য একটা ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতেই পারে।”

এই বলে আরাভ ভূমির সামনে হাটুগেরে বসে নিজের হাতটা বাড়িয়ে। আর বলে,
” নীলাদ্রিতা,
মাছরাঙার নীল ছুঁয়ে নীল শাড়িতে তুমি,
তোমার চপল চোখের রক্তিম ঠোঁটের হাসিতে ঝরে পরে দুস্পাপ্য নীল জোছনা। নীল বসনে তুমি, নীলে ভরা সুন্দর।তুমি মরক্কোর নীল শহরে, নীলের রাজত্বে পূর্নিমার নীল চাঁদ।তুমি বসন্তের নীলমনি লতা, তুমি গ্রীষ্মকালের নীলচে ‘লোবেলিয়া’।তুমি নীল তাপসী, নীল মনিহার, নীল আকাশের নীলাঞ্জনা।তোমার নীলিম শাড়ির আঁচলের ভাঁজেলুকানো কবির নীল কবিতা। আই লাভ ইউ নীলাদ্রিতা।”

ভূমি আরাভের হাতের উপর নিজের হাত রেখে হাটুগেরে বসে পরলো। আরাভ ভূমির হাতের নিজের অধোর ছুইয়ে উঠে দাঁড়ালো। তারপর ভূমির কপালে নিজের অধোর ছুঁইয়ে ভূমিকে ভূমিকে জড়িয়ে ধরলো। আর চারিদিক থেকে ভেসে আসলো করতালির আওয়াজ।

__________________
আরাভ আর দিগন্ত দুজনে ভূমিকে বাড়ি পৌছে দেয়। তারপর আবার দুজনে একই গাড়ি করে ফেরার পথে রওনা দেয়। আরাভ ড্রাইভ করছে আর দিগন্ত পাশের সিটে বসে আছে। আরাভ ড্রাইভ করলেও ওর মাথায় ঘুরছে নানা ভাবনা। দিগন্ত এতক্ষণ নিজের চিন্তায় মশগুল থাকলেও এবার খেয়াল করলো আরাভের দিকে। আরাভের ড্রাইভিং এ মন নেই সেটা সহজেই সে বুঝতে পারলো। ভ্রু কুচকালো দিগন্ত। সামনে তাকিয়ে আতকে উঠলো।দ্রুত স্টিয়ারিং ঘুড়িয়ে দিলো। চমকে উঠলো আরাভ।পাশ ফিরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল আর একটু হলেই হতে পারতো বড় কোন এক্সিডেন্ট। ভাগ্যিস দিগন্ত ঠিক সময় খেয়াল করছিলো। আরাভ স্টিয়ারিং ধরে বড় বড় করে শ্বাত নিতে চলল। কি হলো তার, এমন খামখেয়ালি তো সে কখনোই করে না। আর একটু হলেই বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেত। দিগন্তের দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতার হাসি হাসলো। তবে দিগন্ত সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আরাভের দিকে। কিছুক্ষণ পর দিগন্ত বলল,

” কি এত ভাবছেন?”
” তেমন কিছু না।”
” কেইস সম্পর্কে কিছু হলে আমায় বলতে পারেন। যদি আমি আপনায় কোন সাহায্য করতে পারি।
দিগন্ত এক হাসে কপালে স্লাইড করলো। তারপর বলল,
” আচ্ছা একটা কথা বলুন তো ডিটেকটিভ।”
“হ্যাঁ বলুন।”
” দ্যা ডেথ এলিমেন্ট” নিয়ে আপনি কারো সাথে আলোচনা করেছেন।”
” হ্যাঁ, আমার ডিপার্টমেন্টে।”
” ডিপার্টমেন্টের বাইরে।”
দিগন্ত কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
” মনিরুল ইসলাম স্যার। তিনি আমাদের সাথে আমাদের ডিপার্টমেন্টে কাজ করেন। অনেক সাহায্য করেছেন তিনি তাই তাকে বলেছিলাম।”
আরাভ চুপ করে রইলো। কিছুক্ষণ পর বলল,
” আচ্ছা এই কলেজে আসার পর কি আপনার সাথে এমন কিছু হয়েছে, যেমন কেউ কোন কিছু দিয়েছে আপনাকে? চকলেট আইসক্রিম লজেন্স সিগারেট জাতীয় এমন কিছু।”
দিগন্ত কিছুক্ষণ ভাবলো তারপর বলল,
” একবার একজনের কাছ থেকে একটা চকলেট খেয়েছিলাম আর একবার মনিরুল ইসলাম আমায় কেক খাইয়েছিলো। কেকটা দারুন ছিলো। স্যারের হাতের বানানো।”
” হোম মেইড কেক?”
” হ্যাঁ, তবে কেকের স্বাদটা অন্যরকম ছিলো। দারুন।”
আরাভ গাড়ি থামিয়ে দিলো। দিগন্তের মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
” একটা কথা বলবো?”
” হ্যাঁ, বলুন।”
” আমাদের মাঝে কি কথা হবে সেটা কাউকে বলবেন না।কাউকে মানে কাউকে না। মনিরুল স্যারকেও নয়। বুঝতেই তো পারছেন প্রাইভেসির দরকার আছে।”
” আপনি কি তাকে সন্দেহ করছেন?”
“যতক্ষণ যা আসল অপরাধী ধরা পরছে ততক্ষণ ভিক্টিম সবাই। আপনি শুধু আমার এই কথাটা রাখেন।”
” আপনি আমায় ভরসা করতে পারেন।”
” ধন্যবাদ ডিটেকটিভ।”
দিগন্ত মৃদু হাসলো। আরাভ আবার গাড়ি স্টার্ট দিলো। সামনের দিকে তাকিয়ে ড্রাইভ করতে করতে বিড়বিড়াল,
” এই মনিরুল ইসলাম স্যার হয়তো এক্কেবারে ভালো। না হয় খুব খারাপ, একদম জঘন্য খারাপ।”

“চলবে,,,,,,,,,,,,,

#Mahfuza Afrin Shikha,

#রইলো_তোমার_নিমন্ত্রণ।
[১৯]

আজ আর ফ্ল্যাটে যাওয়া হলোনা আরাভের। ক্লান্ত শরীরে নিজ বাড়িতে প্রবেশ করলো সে। অনিমা বেগম ড্রাইনিং পরিষ্কার করছিলেন এমন সময় কলিংবেলের শব্দ মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠে তার। ছেলের আগমনে উৎফুল্ল মন নিয়ে দরজা খুলে দেন তিনি। দরজার ওপাশে আরাভ দাঁড়িয়ে ছিলো। একহাত পকেটে অপর হাত দিয়ে কাধের উপর নিজের ব্লেজার ঝুলিয়ে রেখেছে। অনিমা বেগমকে দেখে আরাভ একগাল হেসে একহাতে তাকে জড়িয়ে ধরে ভিতরে নিয়ে যায়। ড্রয়িংরুমে এসে অনিমা বেগমকে সুফায় বসিয়ে দিয়ে নিজে তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরে। অক্ষিদ্বয় বন্ধকরে বলে,
” মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দাওনা মা, বড্ড ক্লান্ত লাগছে।

অনিমা বেগম হাসলেন। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন পরম যত্নে। মনে পরে সেই পুরনো দিনের কথা। আরাভ হুট করে মায়ের কোলে মাথা রেখে বলল, ” আমি আজ তোমার সাথে ঘুমাবো। তুমি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে গান শুনাবে।” অনিমা বেগম রাতভর ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে গান গেয়ে ঘুম পারাতো। আরাভের বাবা ছিলেন একজন নেভী অফিসার।কর্মসূত্রে তাকে দেশের নানা জায়গায় যেতে হতো। এমনকি দিনের পর দিন তিনি সাবমেরিনেও কাটিয়েছেন। তাই ছোটবেলা থেকে বাবার খুব একটা সঙ্গ পায়নি সে। ছোট্ট্ বেলা থেকা তারা মা-ই সুখ দুঃখের সাথী। অনিমা বেগম হাসলেন। তার ছেলেটা আজও বড় হলো না। এখনো ক্লান্তি অনুভব করলে মায়ের কোলে মাথা দিয়ে তাকে শুতেই বলে। অনিমা বেগম খেয়াল করলেন আরাভ এখানেই ঘুমিয়ে গেছে। শরীর অধিক ক্লান্ত থাকায় শোয়ার সাথে সাথে রাজ্যের ঘুম এসে ভর করেছে আরাভের দুচোখে।

পরেরদিন আরাভ কলেজে গেলেও ভূমির দেখা পেলো না। ভূমির নাম্বারে কল দিতেই তন্মর রিসিভ করে বলল,
” আপু আজ কলেজে যাবে না বলছে। আপুর নাকি মাথা ব্যাথা।”

” ঠিক আছে।” বলে কল কেটে দেয় আরাভ। ভূমি যে আজ কেন কলেজে আসেনি সেটা তার অজানা নয়। আসলে কালকের ব্যাপারটা নিয়ে সহজ হতে পারেনি। আরাভ পরপর নিজের ক্লাসগুলো করে বেড়িয়ে যাচ্ছিল, মনিরুল স্যারের কেবিনের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় একবার দাঁড়ালো সে। ঘাড় ঘুড়িয়ে ভিতরে দেখলো স্যার মনোযোগ দিয়ে লেপটপে কিছু একটা করছে। আজকাল মনিরুল স্যারের উপর তার বেশ সন্দেহ হয়।মনে মনে ভাবে, স্যার নিজেকে যতটা সহজ দেখায় আধোও কি সে ততটা সহজ সরল।” দাঁড়ায় না আরাভ। বাহিরের দিকে চলে যায়। মাঠ পেড়িয়ে যাওয়ার সময় দিগন্তকে দেখলো একটা ছেলের সাথে কথা বলছে। আরাভ ভ্রু কুঁচকে সে দিকে তাকালো। দিগন্ত দীর্ঘসময় ধরে ছেলেটার সাথে কথা বলে কলেজের ভিতরে চলে গেলো। আরাভ সবটা লক্ষ করলো কিন্তু কিছু বলল না। ততক্ষণ তুহিন তাকে একটা মেসেজ দিয়েছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে ফ্ল্যাটে যেতে হবে। জরুলি তলপ না হলে তুহিন তাহমিদ সোহান তাকে ডাকে না তাই সে কোন দিক না ভেবে ফ্ল্যাটের দিকে রওনা দেয়।

প্রায় পনেরো মিনিট পর ফ্ল্যাটে এসে পৌঁছায় সে। তাদের স্পেশাল রুমের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখে তাহমিদ পিসির সামনে বসে আছে আর বাকি দুজন দুপাশ থেকে। তিনজনে মিলে কিছু দেখছে পিসি তে। আরাভ সেখানে গিয়ে দাঁড়াতে তাহমিদ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
” এটা দেখ।”
আরাভ বসে পরলো তাহমিদের জাগায়। পিসিতে স্পষ্ট দৃশ্যমান প্রায় দশ মিনিট আগে ডেথ আর কিং এর কথোপকথন। সেখানে কিং লেখেছে,
” এই অফিসারটা বেশ ঝামেলা করছে। একে শেষ করতে হবে।” নিচে লেখা, KING.

ডেথ এর ওপাশ থেকে রিপ্লাই এলো,
” ডিটেকটিভ বয়ের থেকেও আরাভ বেশী ভয়ংকর, ওকে ফলো করো।” নিচে লেখা, DEATH.

“সরি মিস্টার ডেথ, আজ এই অফিসারের শেষ দিন হবে। আপনার কথা মানতে পারলাম না। আমি আজ একে প্রানে মেরে দিবো।” নিচে লেখা, KING.

আরাভ উঠে দাঁড়ালো। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ডিটেকটিভ বয় নামটা। এই নামটা সে কোথাও শুনেছে। কিন্তু কোথায় মনে পরছে না। অনেক্ষন ভেবেও যখন মনে করতে পারলো না। তখন আবার বসে পরলো। তাহমিদ বলল,
” এখন উপায় কি? ডিটেকটিভের প্রাণ সংশয়।”

ডেথ এর ভাবনায় দিগন্তের কথা ভুলেই গিয়েছিলো আরাভ। এই অভি যে আজ দিগন্তের সাথে ঝামেলা করবে এটা নিশ্চিত। মানুষের প্রান নেওয়াটা এদের কাছে খেলা বৈ কিছুই নয়। দিগন্তকে কল করে সাবধান করতে হবে। পকেট থেকে মোবাইল বের করে দিগন্তের নাম্বারে কল করলো কয়েকবার। কিন্তু দিগন্ত রিসিভ করলো না। তাই বাধ্যহয়ে আরাভ বেড়িয়ে পরে কলেজের উদ্দেশ্যে। যে করেই হোক দিগন্তের প্রান বাঁচাতেই হবে।

__________________________
এদিকে মনিরুল ইসলাম কাজ শেষ করে হাত ভাজ করে তার উপর চিবুক ঠেকিয়ে লেপটপের সামনে বসে আছে। অভিকে নিষেদ করার পরেও সে কোন কথা শুনলো না। অভি যে দিগন্তকে এ্যটাক করবে এটা নিশ্চিত সে। তবে যেই হোক দিগন্ত মরবে না হয় অভি। যার প্রাণ যাক তাতে তার কিছু যায় আসেনা। এমনিতেই কদিন পর তার কাজ শেষ হলে অভিকে ছুড়ে ফেলে দিত মনিরুল। আরাভ হয়তো তার সমন্ধে জেনেগেছে এতক্ষণ। এবার তার কাজ শেষ করতে হবে। তারপর সবাইকে নিজের গোলাম বানাবে। এই দেশের সরকার যাবে তার হাতের মুঠোয়। সে যা চাইবে তাই হবে। সকলকে দিয়ে তার গোলামি করাবে। নিজের উদ্দেশ্য সফলের কথা ভেসে শয়তানি হাসি হাসে মনিরুল ইসলাম।

দিগন্ত গাড়ি নিয়ে কলেজ থেকে কিছুদূর আসতেই অভি তার বাইক নিয়ে দিগন্তের গাড়ির সামনে দাঁড়ায়। দিগন্ত কিছু বুঝে উঠার আগেই অভি বাইক থেকে নেমে দিগন্তের দিকে রিভালবার তাক করে। ভ্রুকে কিঞ্চিৎ ভাজ ফেলে বিরক্ত সহকারে গাড়ি থেকে নামে দিগন্ত। নিজের রিভালবার অভির দিকে তাক করে বলে,
” সমস্যা কি তোমার? পথ আটকে দাঁড়িয়েছ কেন?”

” তোর প্রাণ নিবো তাই।”

” মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে কিসের পাগলামি করছো?”

” কোন পাগলামি না অফিসার। সেদিন তুই আমার ভাইয়ের পায়ে গুলি করেছিস। আজ আবার তার পিছু নিয়েছিস। তোর জন্যে কোন কাজ করতে পারছিন।”

” ওও আচ্ছা, তাহলে তুইও ডেথ এর গোলাম। নে শ্যুট কর। দেখি তোর কত দম।”

দিগন্ত অভির পা বরাবর শ্যুট করে। অভি শ্যুট করবে এমন সময় পিছন থেকে আরাভ এসে অভির গলা চেপে ধরে যার ফলে অভি লক্ষভ্রুষ্ট হয়। আর গুলি লাগে গাড়িতে। আরাভ অভির নাক মুখ বরাবর কয়েকটা ঘুসি দিতেই দিগন্ত এসে অভিকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,

” আরাভ কন্ট্রোল। এদের শাস্তি আইন দিবে।”

আরাভ বলে,
” ঠিক বলেছেন ডিটেকটিভ, এই নরকের কিটের উপর হাত দিয়ে নিজের হাত নোংরা করাটা একদম বোকামি।”

দিগন্ত পুলিশকে কল করে। কিছুক্ষণ পর পুলিশ ভ্যান এসে অভিকে নিয়ে যায়। আর আরাভ দিগন্তের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
” বের হতে লেট করলেন যে?”

” মনিরুল ইসলাম স্যারের সাথে কথা বলছিলাম।”

মনিরুল ইসলাম নামটা শুনতেই আরাভের মনে পরলো উনার ডাক, ডিটেকটিভ বয়। আরাভের ভ্রু কুঁচকে এলো। তার সন্দেহ সোজা মনিরুল ইসলামের দিকে। আচ্ছা আরাভ নিজে ভুল নয়তো। এভাবে কোন প্রমান ছাড়া মনিরুল ইসলামকে সন্দেহ করাটা কি ঠিক হচ্ছে। দিগন্তের কথায় ঘোর কাটলো আরাভের।
” আপনি কি সবটা জানতেন?”

আরাভ প্রসন্ন হাসলো। তারপর বলল,
” ভুলে যাচ্ছেন ডিটেকটিভ, আমি হ্যাকিং গ্রুপ লিড করি।”

” ধন্যবাদ, আমার প্রান বাচানোর জন্যে।”

আরাভ হাসলো কোন জবাব দিলোনা। তারপর দুজন দুজনকে বিদায় জানিয়ে চলে গেলো।

_______________________
ঘড়ির কাটা বারোটা ছুঁইছুঁই। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেটের ধোয়া উড়াচ্ছে আরাভ। দু আঙ্গুলের ফাকে সিগারেট রেখে সেটা মাঝে মাঝে নিজের অধোরে ছুয়াচ্ছে আর ভূমির কথা ভেবে চলেছে। আজ সারাদিনে একবারও ভূমির সাথে দেখা কিংবা কথা হয়নি তার। অথচ এমন ফিল হচ্ছে যেন কত জনম ধরে তাদের দেখা হয় না।বুকের বা পাশটা চাপা ব্যাথায় আর্তনাদ করছে। চিনচিন ব্যাথা করছে বেশ অনেক্ষন ধরে। দূর আকাশে মিটিমিটি জ্বলতে থাকা তারার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো আরাভ। তারপর বলল,

” আজ আমার মনের অব্যক্ত কথাগুলো আমি তোমার কাছে দিলাম আমার নিলাদ্রিতার কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে। আমরা তো একই আকাশের নিচে আছি তাহলে সে নিশ্চয় বুঝবে এই নিগাঢ় কালো অন্ধকারের কাছে নিরবে বলা আমার অনুভূতি গুলো।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল আরাভ। মনটা বড্ড ছটফট করছে। একবার, শুধু একবার যদি তার নীলাদ্রিতার কন্ঠশ্বর শুনতে পেতো তাহলে হয়তো একটু শান্তি পেতো। কিন্তু এত রাতে তাকে কল করে কথা বলাটাও সম্ভব না। তার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে। বেলকনি ছেড়ে রুমে আসলো আরাভ। বিছানা হাতরে মোবাইলটা হাতে নিলো। এখন ভূমিকে কল করে বলতে ইচ্ছে করছে,
” আচ্ছা নীলাদ্রিতা, তুমি কি আকাশে আমার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাও? শুনতে কি পাও আকাশের কাছে বলা আমার অব্যক্ত কথাগুলো। অনুভব করতে পারো আমার হৃদয়ের আর্তনাদ।”

ভূমির নাম্বারে ডায়াল করেও কেটে দিলো। মোবাইলটা বিছানায় রেখে মাত্র বিছানায় গা এলিয়েছে অমনি সোহানের হাক পরলো। আকস্মিক এমন ডাকে চমকে উঠে আরাভ। দ্রু বিছানা ছেড়ে চলে আসে তাদের তৈরী করা স্পেশাল রুমে। সামনে পিসির দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো, পিসিতে জ্বলজ্বল করছে, ডেথ কলিং।
আরাভ হেডফোন কানে নিয়ে পিসির সামনে বসে পরলো। কল রিসিভ করে হ্যালো ডেথ বলতেই ওপাশ থেকে ডেথ বলল,
” কেমন সারপ্রাইজ দিলাম জুহায়িন আহমেদ আরাভ।”

আরাভের মুখের অভিব্যক্তির কোন পরিবর্তন হলো না। সে জনতো ডেথ তার পরিচয় জানে। আরাভ বলল,
” কেন এমন মৃত্যর খেলা খেলছো ডেথ?”
” ডেথ এর কাজই হলো মানুষের প্রান নিয়ে খেলা।”
” কি চাই তোমার? কেন নষ্ট করছো তরুন সমাজ। কি ক্ষতি করেছে তোমায় এই মানুষগুলো। তুমি অনেক ট্যালেন্ট ডেথ। তোমার এই প্রতিভা তুমি ভালো কাজে ব্যবহার করো দেখবে সবাই তোমায় মাথায় করে রাখবে। ছেরে দাও এই মৃত্যু খেলা।”
ডেথ হাসলো।শব্দ করে হাসলো। তারপর বলল,
“আমার যেটা চাই সেটা তো আমি নিবোই আরাভ। আর মাত্র দুটো দিন।”
” কি করবে তুমি? আতঙ্কিত কন্ঠে বলল আরাভ।
” গোলাম বানাবো। এই দেশের সবাইকে আমার গোলাম বানাবো। তুমি কিচ্ছু করতে পারবে না আরাভ।”
” এত রাগ তোমার এই দেশের প্রতি। যে দেশ তোমায় আলো দিয়ে ছায়া দিয়ে বড় করেছে সেই দেশকে তোমার গোলাম বানাবে। এতটা অকৃতজ্ঞ তুমি ডেথ।”
ডেথ হাসলো ব্যাঙ্গাত্বক হাসি তার।চোখমুখ শক্তকরে বলল,
” কৃতজ্ঞতা! কোন দেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের কথা বলছো তুমি আরাভ। যে দেশে সত্যি বলার জন্যে জিবন দিতে হয়। ক্ষুদার তাড়নায় দুটো বাচ্চাকে চুরি করতে হয়। এই দেশের মানুষ বাড়ির কুকুরকে ভালোভালো খাবার দেয় অথচ একটা ক্ষুধার্ত বাচ্চার দিকে তারা ফিরেও তাকায় না। এই দেশের প্রতি তুমি কৃতজ্ঞতা থাকার কথা বলছো।”

আরাভ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। ডেথ যে তার ব্যাক্তিগত ক্ষোপ থেকে এমন ভুল করছে সেটা বুঝতে বাকি রইলো না তার। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
” তোমার ব্যক্তিগত ক্ষোভের কারনে এতগুলো মানুষের প্রান নিয়ে খেলবে তুমি। এই মানুষগুলো তোমার কি ক্ষতি করেছে?”
” দেশের মানুষ! যতদিন না দেশের মানুষের উন্নতির হচ্ছে ততদিনে দেশের উন্নত সম্ভব নয়। একটা দেশ তখনি উন্নতির শিখরে পৌঁছাবে যখন দেশের মানুষের মনের উন্নতি হবে।”
আরাভ ভেবে পায়না এমন সুশিক্ষিত মানুষ কি করে এমন জঘন্য কাজ করতে পারে। আরাভের ভাবনার মাঝে ডেথ বলল,
” একটা গল্প শুনবে আরাভ। গ্রামের এক স্কুল শিক্ষক ও তার ছেলের গল্প। শুনবে?”

চলবে,,,,,,,,,

#Mahfuza Afrin Shikha.