রহমত পর্ব-০১

0
290

#রহমত
#সূচনা_পর্ব
#Tabassum_Khondokar

“সদ্য কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে ভার্সিটি তে ভর্তি হওয়া আঠারো বছরের তাগড়া যুবক গতকাল এক ছেলে সন্তান এর বাবা হয়েছে।”

খবর টা ইতিমধ্যে পুরো ভার্সিটি আর কলেজে ছড়িয়ে পড়েছে।মোটামুটি সব স্টুডেন্ট এর মাঝে কথা টা কানাঘু”ষা চলছে।মাত্র আঠারো বছর বয়সে আবার আরেক ছেলের বাবা হয়েছে?বিষয় টা যেন সবার কাছে চরম আশ্চর্য এর ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।কেউ কেউ তো একটু খানি কথাতে মসলা মাখিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত নিয়ে গেছে।”নিশ্চয় অবৈধ ভাবে কোনো কাজ করে বাবা হয়েছে,জা”রজ সন্তান হয়তো বাচ্চাটা,কোন মেয়ের জানি সম্মানে আঘা”ত হেনেছে,এই কেমন ছেলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি?,পা”পের কাজ তো করেছে,আবার পা”পের ফল ও জন্ম দিয়েছে”–এমন নানান কথা ভার্সিটির মধ্য রটে গিয়েছে।কেউ জানতে চায়নি সম্পর্ক এর নাম।তার আগে-ই নিজে দের মতো যুক্তি সাজিয়ে কথা রটিয়ে দিচ্ছে এই কান থেকে ওই কান, ওই কান থেকে আরো দশটা কান।

ভার্সিটির প্রবেশ দোর দিয়ে প্রবেশ করছিলো লেকচারার নুফায়ের।তখনি প্রবাহমান বাতাসের সাথে কানে এসে পৌঁছায় ভার্সিটি তে রটানো ব্রেকিং নিউজ টি।বিন্দু মাত্র কথা না বলে অফিস রুমে এসে নির্ধারিত নিজস্ব কেবিনে গিয়ে চেয়ার পেতে বসে।প্যান্ট এর পকেট হাতড়ে মুঠো ফোনটা হাতের মুঠে নিয়ে পকেট থেকে বের করে।ফোন ওপেন করে-ই কল লিস্টে গিয়ে কাঙ্ক্ষিত নাম্বার টা খুঁজতে থাকে চোখ বুলিয়ে।মিনিট পার হওয়ার আগেই পেয়ে যায়।সাথে সাথে নাম্বার টাতে ডায়াল করে।দুই বার রিং হতেই অপর পাশ থেকে মৃদু পুরুষালি কণ্ঠে কেউ সালাম দিয়ে বলে,

“আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু “।

বিনিময়ে নুফায়ের ও মৃদু আওয়াজ করর সালাম নেয়।কিছুক্ষণ চুপ থেকে অপর পাশের ব্যক্তি কে উদ্দ্যেশ্য করে নুফায়ের বলে উঠে,

“এসব কি শুনছি শুভ?পুরো ভার্সিটি তে ব্রেকিং নিউজ হিসেবে এখন তুমি।তুমি ভার্সিটি তে কেনো আসছো না।ভার্সিটি তে আসো,তোমার সাথে আমার কথা আছে।”

নুফায়ের এর কথা শেষ হতে-ই অপর প্রান্ত থেকে শুভ রিনরিনে স্বরে স্বগতোক্তি করে বলে,

“স্যার বিশ্বাস করুন আমি হারাম কিছু করিনি।কিন্তু আমি খবর পেয়েছি অলরেডি সবাই আমাকে নিয়ে নানান বাজে কথা রটিয়ে দিয়েছে। এই অবস্থায় আমি কিভাবে যাবো ভার্সিটি? ”

শুভ এর ভ”য়ার্ত,লজ্জা মাখানো কথা শুনে নুফায়ের অভ”য় দিয়ে বলে,

“চিন্তা করোনা।আল্লাহ ভরসা!আমি আছি,তুমি আসো।সব শুনবো তোমার মুখ থেকে।বাকি ভার্সিটির বিষয় আমি দেখবো।তুমি আসো।কেউ কিছু বললে উত্তর দিবে না।সরাসরি আমার কেবিনে চলে আসিও।কেমন?

প্রিয় লেকচারার থেকে অভ”য় বাণী পেয়ে শুভ মৃদু হেসে বলে,

:-“আচ্ছা স্যার।ইংশা আল্লাহ আমি উর্মির জন্য ওষুধ গুলো পাঠিয়ে দিয়েই আসছি।”

-“আচ্ছা। আমি অপেক্ষারত থাকবো ইংশা আল্লাহ”

-“জি।আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।

-“ওয়ালায়কুম সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। ”

ফোন কে”টে দিয়ে চেয়ারে পিঠ সহ মাথা হেলিয়ে দেয় নুফায়ের।অফিস রুম সম্পূর্ণ ফাঁকা।এখনো পর্যন্ত কেউ আসেনি অফিস রুমে।দুই তিনজন লেকচারার এসেছে,তারা বাইরে খোশগল্প করছে।অফিস রুমে আসেনি।

নুফায়ের চোখ বন্ধ করে-ই হিসেব কষে বয়স এর পরিসংখ্যান এর।জীবন এর সাতাশ বছর পার করছে।এখনো বিয়ে করতে পারেনি।অথচ তার স্টুডেন্ট আঠারো বছর বয়স এই একটা ছেলে সন্তান এর পিতা ট্যাগ ও লাগিয়ে নিয়েছে। এটাকে-ই কি বলে রহমত?রবের রহমত ছিলো বিধায় কি শুভ বিয়ে করে সন্তান এর বাবা ও হয়ে গিয়েছে অল্প বয়সে?হয়তো। ইংশা আল্লাহ উত্তম সময়ে রবের এমন রহমত আমার উপর ও বর্ষিত হবে।তার জন্য ধৈর্য আর দোয়া করে যেতে হবে।

কথা গুলো মনে মনে বলে আরেকটু চওড়া হাসে নুফায়ের।সোজা হয়ে বসে ল্যাপটপ নিয়ে কিছু কাজ শুরু করে।এর মধ্যে একবার হাতের ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নেয়।পুনরায় কাজে মনোযোগ স্থির করে।

🌸🌸

প্রায় এক ঘণ্টা ত্রিশ মিনিট পর শুভ ভার্সিটি তে আসে।তখন ভার্সিটি মাঠ ফাঁকা।ঘুটি কিছু স্টুডেন্ট দেখা যাচ্ছে।যার মধ্যে কেউ গাছের নিচে বসে আছে,তো কেউ ক্যান্টিনে। বাকিরা বোধহয় ক্লাসরুমে আছে।শুভ সব দিক চোখ বুলিয়ে অফিস রুমের উদ্দ্যেশ্যে যেতে যেতে নিজ মনে বলে,

:-“আল্লাহ বড় জোর বাঁচিয়ে নিয়েছে।সবাই যদি থাকতো আর যদি দেখতো আমায়।নিশ্চিত বাজে কথা,লেগফুল করতে ছাড় দিতো না এক ইঞ্চি পরিমাণ ও।আল্লাহর অশেষ মেহেরবান। ”

অফিস রুমের সামনে এসে-ই মাথা উঁচিয়ে উঁকিঝুঁকি দেয় শুভ।যদি নুফায়ের স্যার কে দেখতে পায় এই আশায়।কিন্তু তার দৃষ্টি নুফায়ের এর কেবিন পর্যন্ত যেতে পারছে না।এই দিকে আজ সাহস করে ও অফিস রুমের ভিতরে যেতে পারছে না।এর আগে যে আর যায়নি এমন না।মূলত আজ বাবা হওয়ার বিষয় টা জানা জানি হওয়ার পর থেকেই কেমন লজ্জা আর ইতস্ততা কাজ করছে। সাহস সঞ্চয় করে ও কোনো কাজ করতে পারছে না।

হঠাৎ প্যান্ট এর পকেটে ফোন টা ভাইব্রেট করে উঠতে-ই পকেটে হাত গলিয়ে দিয়ে ফোনটা বের করে আনে।ফোনের স্কিনে জ্ব’লজ্ব’ল করে ভেসে উঠে “নুফায়ের স্যার” নামটা।ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা টেনে ফোন রিসিভ করে শুভ।সালাম আদান প্রদান করে নিতে-ই নুফায়ের ফোনের অপর পাশ থেকে বলে,

-“অফিসে রুমের ভিতরে আমার কেবিনে চলে আসো।ভয় নেই,আর কেউ নেই অফিসে আমি ছাড়া।”

-“জি স্যার আসছি।আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।

যোগাযোগ ছিন্ন করে ফোনটা আবার পকেটে পুরে নেয়।পরিহিত শার্ট এর কলার্ট,হাতা টেনে টুনে ঠিক করে, চুল গুলো তে ও হাত চালিয়ে আরেকটু ঠিক করে পা বাড়ায় অফিস রুমের ভিতরে।সোজা চলে যায় নুফায়ের এর কেবিনের সামনে।অনুমতি নিয়ে কেবিনে প্রবেশ করে শুভ।

নুফায়ের এর দৃষ্টি ল্যাপটপে।দ্রুত হাতে টাইপিং করে যাচ্ছে কি-বোর্ডে। ল্যাপটপ স্কিনে ভেসে উঠছে গুটি গুটি অক্ষর,অক্ষর থেকে -ই একটা চরণ,আর চরণ থেকে একটা একটা করে বাক্যে রূপান্তর করছে।সময় যখন এক মিনিট এর ঘর পার হতে এক সেকেন্ড বাকি তখনি নুফায়ের হাত চালনা বন্ধ হয়।মাথা তুলে দৃষ্টি ফেলে সামনে দাঁড়ানো শুভ’র উপর।ছেলে টা এমন ভাবে ভ’য় নিয়ে দাড়িয়ে আছে যেন, কোন বিশাল বড় অপরাধ, পাপ কাজ করে ফেলেছে। নুফায়ের হাসে,হেসেই শুভ কে সামনের চেয়ার দেখিয়ে বলে বসতে।শুভ চেয়ার পেতে বসে।মাথা তুলে তাকায় না নুফায়ের এর দিকে।তার লজ্জা করছে স্যার এর দিকে।নুফায়ের শুভ’র এমন আড়ষ্টতা দেখে রম্যতা নিয়ে বলে,

-“তারপর বলেন,ছেলের বাবা।কি খাবেন? চা,কফি নাকি শরবত?”

নুফায়ের এমন রম্যতা সূচক কথায় শুভ আরো মিইয়ে যায় লজ্জায়।নুফায়ের এর শুভ’র মুখের দিকে তাকায়।কেমন লজ্জায় মাথা আরো নিচু করে ফেলেছে শুভ,ঠোঁটের কোণঘেঁষা সুক্ষ হাসি ও দেখা যাচ্ছে।নুফায়ের এর কাছে বেশ লাগছে শুভ কে এমন লজ্জানত দেখতে।কেউ বলবে?এই ছেলে বিয়ে করে সদ্য বাবা ও হয়ে গিয়েছে?

নুফায়ের শুভ কে আরেকটু লজ্জা দিতে হেসে বলে ফেলে,

-“আহা!লজ্জা পাচ্ছেন কেন?ছেলের বাবা হয়ে গিয়েছেন।অথচ এখনো লজ্জা পাচ্ছেন। এটা কোনো কথা?জাতি এটা মেনে নিবে কি করে?জাতি মানলে ও আমি কি করে মানবো বলুন তো?”

নুফায়ের এহেন কথা গুলোতে বিপাকীয় অবস্থায় পড়ে যাচ্ছে শুভ।ভার্সিটির একমাত্র নুফায়ের স্যার এর সাথে সম্পর্ক টা ফ্রেন্ডলি।সেই ফায়দা লুটে নিয়ে স্যার কেমন রম্যতা মিশালো কথা বলে লজ্জায় ফেলে দিচ্ছে তাকে।স্যার এর সাথে ভার্সিটি তে পরিচয় হয়েছে এমন না।দুই জনে-ই পূর্ব পরিচিত।বছর খানেক আগে দুই জনে প্রতিবেশী ছিলো। সেই সুবাধে সম্পর্ক টা আরেকটু বেশিই বন্ধুত্ব পূর্ণ।

নিজেকে ধাতস্থ করে শুভ এবার মাথা তুলে নুফায়ের এর দিকে তাকায়।নুফায়ের এর ঠোঁটে হাসি লেগে আছে যা,শুভ’র তাকানো তে আরেকটু প্রশস্ত হয়েছে।

শুভ আড়ষ্টভাব নিয়ে বলে,

-“স্যার আপনি ও মজা করছেন?আপনি-ই বাকি ছিলেন মজা করার জন্য।বাসায় ও আপি,বাবা,ভাইয়া সবাই মজা করছে।এমনকি উর্মি ও মজা নিচ্ছে।অথচ ও ছেলের মা।”

নুফায়ের এবার শব্দ করে হেসে উঠে শুভ’র কথা শুনে।নুফায়ের হাসি থামিয়ে কিছু বলার জন্য উদ্যত হবে তার আগে-ই তার ফোন বেজে উঠে সশব্দে।ফোন হাতে নিয়ে দেখে “মা” নামটি ভেসে আছে।ফোন রিসিভ করে কানে তুলে নেয়।সালাম বিনিময় করে।অপর পাশ থেকে নুফায়ের মা কিছু বলতেই নুফায়ের কিছুক্ষণ চুপ করে যায়।ফোন কেটে টেবিলের উপর রাখে।মৌনতা কা”টতেই নিজ মনে হেসে বলে উঠে,

-“আলহামদুলিল্লাহ।রহমত বর্ষণ হতে যাচ্ছে ইংশা আল্লাহ”।

এই দিকে নুফায়ের কে আনমনে হাসতে দেখে তার দিকে বেআক্কেল এর মতো চেয়ে থাকে শুভ।তার বুঝে আসছে না নুফায়ের স্যার নিজে নিজে কেন হাসছে?ফোনের অপর পাশের ব্যক্তি কি এমন বলেছে যে নুফায়ের হাসছে।

চলবে