রাখিব তোমায় যতনে পর্ব-১০

0
623

#রাখিব_তোমায়_যতনে
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ১০
স্নিগ্ধ সকালে।সূর্য উঠেছে বেশ কিছুক্ষন হলো।রোদের আলো জানালা ভেদ করে তীর্যকভাবে নীবদ্ধ’র চোখে মুখে এসে পরতেই কপাল কুচকে ফেলে নীবদ্ধ।আলোটা চোখের লাগছে বেশ।পিটপিট করে দূর্বল চোখজোড়া মেলে তাকানোর চেষ্টা করলো অনেকক্ষন।চোখ খুলে চারপাশ তাকালো।সোয়া থেকে কষ্ট করে উঠে বসলো।বেশ দূর্বল লাগছে।গলা শুকিয়ে কাঠ।নিজেকে যে রুমে আবিষ্কার করবে ভাবিনি।ও গাড়ি নিয়ে বাড়িতে এসে সোফায় বসেছিলো তারপর শুদ্ধতা ডেকেছিলো ওকে।মেয়েটা শাড়ি পরেছিলো তখন।কি সুন্দর লাগছিলো।কিন্তু এরপর আর কিছু মনে নেই।রুমে আসলো কিভাবে ও? ঘার মুড়িয়ে এদিক সেদিক তাকাতেই নজরে পরে শুদ্ধতাকে।হৃদয়টা থমকালো,ভড়কালো,শ্বাস আটকে আসলো।শুদ্ধতাকে যে এমন একটা অবস্থায় দেখতে পাবে নীবদ্ধ ভাবতেও পারিনি।খাটের সাথে হেলান দিয়ে সুয়ে আছে শুদ্ধতা।চুলগুলো এলোমেলো,মুখশ্রীতে হালকা তৈলাক্ত ভাব।মুখটায় যেন রাজ্যের মায়া উপচে পরছে।শরীরের দিকে নজর যেতেই দমবন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হলো।মেয়েটা এতো বেখায়ালি কিভাবে হলো?এমনিতেই শাড়ি পরিহিতা শুদ্ধতাকে দেখে নিজেকে সামলানো কষ্ট হয়ে যাচ্ছিলো তার উপর এখন আবার মেয়েটার এই অবস্থা।শুদ্ধতা সেইযে শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুজেছিলো।ঠিকসেইভাবেই ঘুমিয়ে পরেছে।আঁচল কোমড়ে গুজার কারনে শুদ্ধতার সাদা,মসৃণ কোমড় দৃশ্যমান।নারীদেহের প্রতিটা বাঁক যেন সুস্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে।নীবদ্ধ চোখ সরিয়ে নিলো।জোড়ে জোড়ে শ্বাস ফেলছে।নিজের ভীতরে যে কি চলছে তা হয়তো কেউ আন্দাজ করতে পারবে না।আর এই মেয়েটা তো একদমই না।নীবদ্ধ’র বুকে আগুন ধরিয়ে দিয়ে কি সুন্দর ঘুমাচ্ছে।নীবদ্ধ উঠে দাড়ালো।দাঁতে দাঁত চিপে শুদ্ধতার কাছে গেলো।নিজেকে যথাসাধ্য নিয়ন্ত্রনে রেখে শুদ্ধতাকে ঠিকভাবে সুইয়ে দিলো।তারপর শুদ্ধতার গায়ে কম্বল দিয়ে দিলো। হালকা হাসলো নীবদ্ধ।মেয়েটা বোধহয় সারারাত সেবা করেছে।বিছানার পাশে রাখা বালতি আর রুমাল দেখেই বুঝতে পারছে।রাতে মনে হয় অনেক জ্বর এসেছিলো।নীবদ্ধ একবুক ভালোবাসা ঢেলে দিয়ে শুদ্ধতার কঁপালে আদুরে স্পর্শ দিলো।তারপর জামা কাপড় নিয়ে ফ্রেস হতে চলে গেলো।

গরমে হাঁসফাঁস করছে শুদ্ধতা।ঘেমে উঠেছে শরীর।অসস্থিতে ঘুম ভেংগে গেলো শুদ্ধতার।নিজেকে বিছানায় শোয়া অবস্থায় আবিষ্কার করে ভ্রু-কুচকালো।পরক্ষনে বিছানায় নীবদ্ধকে না দেখে সবটা বুঝতে পারলো শুদ্ধতা।নীবদ্ধ’র সেবা করতে কর‍তে বসা অবস্থাতেই ঘুমিয়ে পরেছিলো ও।আর নীবদ্ধ’ই ওকে ঠিকঠাকভাবে সুইয়ে দিয়েছে।গায়ে কম্বলটা সরালো শুদ্ধতা।সরাতেই আসমান থেকে পরলো।শাড়ি পুরো এলোমেলো হয়ে আছে।চোখ কপালে উঠে গেলো শুদ্ধতার।যা বুঝার বুঝে ফেলেছে শাড়ির এই অবস্থা দেখেই নীবদ্ধ ওর গায়ে কম্বল দিয়ে দিয়েছে তা বেশ ভালো করেই বুঝলো।লজ্জায় গালগুলো লাল হয়ে উঠলো।নিজেকে সামলে দাঁড়িয়ে শাড়ি ঠিক করে নিলো।তারপর নীবদ্ধ’র বিছানা গুছানো শুরু করলো।এর মাঝেই বেড়িয়ে আসলো নীবদ্ধ।শুদ্ধতাকে কাজ করতে দেখে থেমে গেলো ওর পা জোড়া।এইতো এই স্বপ্ন নীবদ্ধ প্রতি দিন দেখে, প্রতি রাত দেখে।শুদ্ধতা এইভাবেই ঠিক বউদের মতো ওর সকল কাজ করে দিচ্ছে।আর ও মুগ্ধ নয়নে শুদ্ধতাকে দেখছে।হাসলো নীবদ্ধ ভ্রু উঁচু করে বলে,
-‘ কখন উঠেছেন? আর উঠলেন কেন?আরেকটু ঘুমাতেন।’

শুদ্ধতা চমকালো।তবে তাকালো না নীবদ্ধ’র দিকে।মোট কথা নীবদ্ধ’র দিকে তাকাতে কেমন যেন লাগছে।বিছানার চাঁদর ঠিক করতে করতে বলে,
-‘ ওই এমনিতেই ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছে। তা আপনার জ্বর কমেছে?’

-‘ এমন সুন্দরী একজন রমনী যদি দিনরাত এক করে আমার সেবা করে তাহলে জ্বর না কমে যাবে কোথায়?’

নীবদ্ধ’র রসিকতায় শুদ্ধতা মিথ্যে রাগ দেখিয়ে বলে,
-‘ দেখুন উল্টাপাল্টা বলবেন না।বাড়িতে সবাই ঘুমিয়ে পরেছিলো।তাই কাউকে ডাক দেইনি।আর আপনার জ্বর অনেক বেশি ছিলো তাই মানবতার খাতিরে এটুকু তো করতেই পারি। আপনি সেটাকে ভুলভাব ভেবে বসবেন নাহ।’

নীবদ্ধ একটু কষ্ট পেলো বোধহয়।তার হালকা রেশ রেখেই বলে,
-‘ শুধুই মানবতা থেকে করেছেন?আর কিছু না?’

শুদ্ধতা চমকে তাকালো নীবদ্ধ’র দিকে। লোকটার কন্ঠটা কেমন যেন শোনালো।বুকটা একটু কেঁপে উঠলো কি এমন কন্ঠস্বর শুনে?নীবদ্ধ’র চোখে ব্যাকুলতা, আক্ষেপ দেখতে পারছে শুদ্ধতা।একটু খানি ভালোবাসা পাবার জন্যে ছটফট করছে নীবদ্ধ’র হৃদয় তা ওর চোখে মুখে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে শুদ্ধতা।নিজেকে পাগল পাগল লাগছে শুদ্ধতার।এলোমেলো অজানা অনুভূতির বেড়াজালে বোধহয় আটকা পরে যাচ্ছে শুদ্ধতা।কিন্তু ও তো চায়না আটকা পরতে।মুক্ত পাখির ন্যায় উড়ে বেড়াতে চায় শুদ্ধতা।কারো অনুভূতির জালে তো ও ধরা দিবে না।মুখ শক্ত হয়ে আসলো শুদ্ধতার।তেজ নিয়ে বলে,
-‘ না আর কোন কিছুর কারনে না। শুধু মানবতার জন্যেই করেছি।’

নীবদ্ধ কয়েকপলক তাকিয়ে থাকলো শুদ্ধতার দিকে।তারপর আস্তে করে অন্যদিকে চলে গেলো।গায়ের টি-শার্ট খুলে ফেললো।শুদ্ধতা ভড়কে গিয়েছিলো কিন্তু নীবদ্ধ’র গায়ে সেন্ডু গেঞ্জি দেখে সস্থির নিঃশ্বাস ফেললো।নীবদ্ধ আলমারি খুলে একটা কালো রঙের পাঞ্জাবি গায়ে জড়িয়ে নিলো।তারপর ড্রেসিংটেবিলের সামনে গিয়ে চুলগুলো আচঁড়ে,গায়ে আঁতর দিলো।ড্র‍য়ার হতে ঘড়ি বের করে হাতে পরলো।ওয়ালেট নিয়ে পকেটে পুরে আবার আলমারির কাছে গিয়ে কিছু একটা বের করে বেশ সাবধানে তা পেটের কাছে গুঁজে নিলো।ভ্রু-কুচকে নীবদ্ধকে দেখছে শুদ্ধতা। লোকটা এমন অসুস্থ শরীর নিয়ে এমন পরিপাটি হয়ে কোথায় যাচ্ছে।তাও আবার বন্দু*ক টন্দু*ক নিয়ে।নীবদ্ধ ঘর ছেড়ে বের হতে নিবে তখনই শুদ্ধতার কথায় থেমে যায় ও।
-‘ অসুস্থ শরীর নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?আপনার শরীর এখনো অনেক দূর্বল।’

নীবদ্ধ তাকালো না শুদ্ধতার দিকে।কাঠ কাঠ গলায় বলল,
-‘ মানবতার খাতিরে যা যা করেছেন তার জন্যে আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ।অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।তবে প্লিজ আর মানবতার দোহাই দিয়ে কিছু করতে আসবেন না।আমার সহ্য হবে না।’

গটগট শব্ধ তুলে দ্রুত পায়ে বেড়িয়ে গেলো নীবদ্ধ।স্তব্ধ হয়ে শুদ্ধতা সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষন।অতঃপর আস্তেধীরে বেড়িয়ে পরলো নীবদ্ধ’র রুম থেকে।এখনো উঠেনি কেউ।আটটা বাজে এখন।না উঠলেও উঠে যাবে।নিচে রান্নাঘর থেকে টুকটাক আওয়াজ আসছে।আয়েশা রহমান উঠে গিয়েছে বুঝে ফেললো শুদ্ধতা।তাই দ্রুত পায়ে নিজের জন্যে বরাদ্ধকৃত রুমে চলে গেলো।অতঃপর ফ্রেস হয়ে নিচে এসে দেখলো সবাই এসে পরেছে নাস্তার টেবিলে।সবার সাথে নাস্তা করতে বসলো।টুকটাক কথার মাঝে জানলো নীবদ্ধ কিছু না খেয়ে আজও চলে গেছে কাজে।আয়েশা রহমানকে বলে যাবার সময় তিনি জোড় করেও নীবদ্ধকে কিছু খাওয়াতে পারেনি।কেমন যেন মনটা খারাপ হয়ে গেলো শুদ্ধতার।বুকের বা-পাশটায় চিনচিনে ব্যাথার উপস্থিতি টের পেলো বোধহয়।নাস্তা শেষ হলে শুদ্ধতা সবার থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হলো।আজও ভার্সিটি যাবে না।কাল রাতে ঠিকঠাক ঘুম হয়নি।শরীরটা ম্যাজ ম্যাজ করছে।ফোন করে বিষয়টা সানামকে বলে দিলো।আর সানামকে ওদের বাসায় আসতে বলে দিলো।দু বান্ধবী আজ ভার্সিটি না গিয়ে জমিয়ে আড্ডা দিবে।

_______________
নিজের অফিসরুমে চেয়ারা বসে পা দুলাচ্ছে নীবদ্ধ। সামনে ওর কিছু লোক দাঁড়িয়ে আছে।নীবদ্ধ লম্বা শ্বাস ফেলে এইবার তাদের উদ্দেশ্যে বলে,
-‘ তোমাদের দশজনকে আমি পাঠিয়ে ছিলাম ভার্সিটির বে-আই*নি কাজগুলোর খোঁজ লাগাতে। পাকাপোক্ত প্রমান জোগাড় করার জন্যে।দশজনের এমন একটা গ্রুপ থেকে কিভাবে হৃদয়কে ওরা একা পেলো?আর ওকে এইভাবে খু*ন করলো কিভাবে?তোমরা এতোজন থাকতে কিভাবে সম্ভব হলো?’

ওদের মাঝে লিমন নামের একটা ছেলে বলে,
-‘ বস হৃদয় ভাই আমাদের সবাইকে জোড়ায় জোড়ায় কাজে পাঠিয়েছিলো।তাই আমরা সবাই একেক জায়গায় ছিলাম একেকজন।’

নীবদ্ধ গম্ভীর গলায় বলে,
-‘ হৃদয়ের সাথে কে ছিলো?’

-‘ বস সাকিব ছিলো।’

নীবদ্ধ এইবার সাকিবের দিকে তাকাতেই।সাকিব আগেই হরবরিয়ে বলা শুরু করলো,
-‘ বস আমি আর হৃদয় ভাই জোড়ায় গিয়েছিলাম ঠিকই।কিন্তু হৃদয় ভাই আমাকে হঠাৎ করে অন্যদিকে যাওয়ার জন্যে পাঠিয়ে দেয় খোঁজ নেওয়ার জন্যে।উনি ভার্সিটির পিছনে যে পরিত্যাক্ত একটা বিল্ডিং আছে সেখানেই গিয়ে আমাকে বলে একপাশে যেতে আর তিনি অন্যপাশে চলে যান।আমি পুরো বিল্ডিং চক্কর লাগিয়ে কিছুই পায়নি।তারপর আমি হৃদয় ভাইকে খোঁজা শুরু করি।কিন্তু তাকে পায়নি কোন জায়গায়।না পেয়ে হৃদয় ভাইকে ফোনও করি।কিন্তু তিনি ফোনটাও কেঁটে দেন। তারপরেই একটা মেসেজ আসে আমার ফোনে।হৃদয় ভাই মেসেজ দেন যে তিনি নাকি ওখান থেকে চলে গিয়েছেন।আর আমাকেও বলেন সেখান থেকে চলে আসতে আর বাড়ি ফিরে যেতে।সেও নাকি বাড়ি ফিরে গিয়েছে।আমি এতোশতো ভাবিনি বস।মেসেজ পেয়েই আমি বাড়ি এসে পরেছিলাম।এরপর সকালে ফোন করে এই ঘটনা শুনি।’

বলতে বলতে সাকিব নামের ছেলেটি কেঁদে দেয়।হৃদয় ছেলেটা সবার বড্ড প্রিয় ছিলো।নীবদ্ধ’র অনুউপস্থিতিতে হৃদয় ছেলেটাই সবকিছু সামলাতো।নীবদ্ধ সবাইকে চলে যেতে বলে। দুহাতে মাথার চুল খামছে ধরে। জ্বরটা আবার আসছে বোধহয়।মুখটা তিঁতা হয়ে গিয়েছে।না খেয়ে থাকার কারনে শরীরটা অনেক দূর্বলও লাগছে।ঘড়ির দিকে তাকালো নীবদ্ধ।দুপুর বারোটা বাজে। আরো অনেক কাজ বাকি আছে।দীর্ঘশ্বাস ফেললো নীবদ্ধ।এমন সময় ওর রুমের দরজায় কেউ নক করে।নীবদ্ধ সোজা হয়ে বসে বলে,
-‘ কাম ইন!’

হুরমুর করে প্রবেশ করলো জয়।এসেই তড়িঘড়ি করে বলে,
-‘ বস জুনায়িদ শেখ এর ঠিকানা জোগাড় করেছি।’

#চলবে_________
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।