রাখিব তোমায় যতনে পর্ব-০৯

0
472

#রাখিব_তোমায়_যতনে
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ০৯
ক্লান্ত দেহটা কোনরকম টেনেটুনে নিয়ে বাড়িতে আসলো নীবদ্ধ।বাড়ির কলিংবেল বাজালো না।হয়তো সবাই ঘুমিয়ে পরেছে ভেবে চাবি দিয়ে গেট খুললো।লম্বা লম্বা শ্বাস ফেলছে নীবদ্ধ।চোখ দুটো জ্বালা করছে ভীষন,বুকটা ভার হয়ে আসছে।তবুও পাথরের ন্যায় হেটে বাড়িতে ঢুকে সোফায় বসে পরলো।দু চোখের পাতা বন্ধ করে নিলো নীবদ্ধ।বারবার চোখের সামনে হৃদয়ের ক্ষ*ত-বিক্ষ*ত লাশটার ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠছে।ওর আন্ডারে কাজ করা প্রতিটি লোককে ও খুব ভালোবাসে।সবাইকে নিজের আপন ভাবে।সেখানে তাদের মধ্যে থেকে একজন নেই।বড্ড খালি খালি লাগছে চারপাশটা। মনে মনে প্রতিক্ষাবদ্ধ হলো নীবদ্ধ,
-‘ তোকে ওয়াদা করলাম হদয়।তোর শরীরের থেকে যতো ফোটা রক্ত ঝরিয়েছে ওরা তার থেকে দ্বিগুন র*ক্ত ওদের শরীর থেকে ঝড়াবো আমি।তুই যতোটা কষ্ট পেয়েছিস তার থেকে হাজারগুন বেশি কষ্ট দিয়ে মারবো ওদের।’

নীবদ্ধ আনমনে যখন এসব ভাবনায় ব্যস্ত তখন হঠাৎ কানে মিষ্টি একটা কন্ঠস্বর ভেসে আসে,
-‘ কখন এসেছেন আপনি? আর এখানে কি করছেন?যান ফ্রেস হয়ে আসেন।আমি আপনাকে খাবার দিচ্ছি।’

চোখ খুলে তাকায় নীবদ্ধ।চোখের সামনে রাজ্যের মায়াজড়ানো মায়াবিনীকে দেখে হৃদয়টা থমকে গেলো বোধহয়।এতোক্ষনের ক্লান্তি যেন একনিমিষেই হাওয়া হয়ে উড়ে গেলো।ও কি সত্যি দেখছে না-কি ভুল।শুদ্ধতা শাড়ি পরেছে। এই একটা বছরে কোনদিন শুদ্ধতা শাড়ি পরিহিত দেখেনি নীবদ্ধ।অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু হঠাৎ করে দেখে যেন নীবদ্ধ নিজের হুশ হারিয়ে ফেলেছে।নীবদ্ধ আনমনেই বলে,
-‘ মাশা-আল্লাহ!’

শুদ্ধতা হকচকিয়ে গেলো নীবদ্ধ’র কথায়।হঠাৎ এমন বলাতে কেমন যেন অসস্থিতে পরে গেলো শুদ্ধতা।গালগুলো ভারি হয়ে আসলো বোধহয়।নীবদ্ধ’র কথায় কি ও লজ্জা পাচ্ছে? নাহ, লজ্জা পাবে কেন?এখানে লজ্জা পাওয়ার কি হলো? সামান্য একটা কথাই তো বলেছো।শুদ্ধতা এলোমেলো দৃষ্টিতে এদিক সেদিক তাকিয়ে বলে,
-‘ কি হলো যাচ্ছেন না কেন?’

নীবদ্ধ হাসলো।কি সুন্দর সেই হাসি।হাসলে যেন নীবদ্ধ’র চোখও হাসে সেই সাথে।শুদ্ধতার বুকটা ধ্বক করে উঠলো।মনের মাঝে সূক্ষ্ণ একটা চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করলো। শুদ্ধতা চোখ বন্ধ করে দু একটা শ্বাস ফেলে তাকালো।বলল,
-‘ এভাবে হাসছেন কেন অহেতুক পাগলের মতো?’

নীবদ্ধ নিষ্প্রভ কন্ঠে বলে,
-‘ আপনি লজ্জা পাচ্ছেন শুদ্ধতা।আপনাকে আজ প্রথম লজ্জা পেতে দেখলাম।আপনার লজ্জারাঙ্গা মুখটা বড্ড স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে।’

শুদ্ধতা সহ্য করতে পারছে না নীবদ্ধ’র এমন কথা।লোকটার আজ হলোটা কি?এমনভাবে কথা তো কোনদিন বলেনি লোকটা ওর সাথে।কি হচ্ছে এসব?শুদ্ধতা আজ প্রথমবার নিজ ইচ্ছায় নীবদ্ধ’র হাতটা ধরতে উদ্যত হলো। এভাবে চললে হবে না।লোকটাকে উঠাতে হবে এখান থেকে।নাহলে এইভাবে আবলতাবল বকতেই থাকবে।শুদ্ধতা যেই না নীবদ্ধ’র হাতে আলতো করে স্পর্শ করলো চমকে উঠলো শুদ্ধতা।কি গরম নীবদ্ধ’র শরীর।মাত্রারিক্ত গরম হয়ে আছে।শুদ্ধতা অস্থির হলো।এলোমেলোভাবে হাত ছোঁয়ালো নীবদ্ধ’র গালে, কপালে,গলার ভাজে।নীবদ্ধ অস্থির শুদ্ধতাকে নিভু নিভু চোখে দেখছে।শুদ্ধতা চিন্তিত কন্ঠে বলে,
-‘ আপনার শরীরে তো প্রচুর জ্বর।এমন ভয়ানক জ্বর আসলেন কিভাবে?কি সর্বনাষ।শরীর তো পুরে যাচ্ছে।দেখি একটু কষ্ট করে উঠে দাড়ান।রুমে যেতে হবে। একটু কষ্ট করুন।’

শুদ্ধতা নীবদ্ধ’র সাথে প্রায় একপ্রকার যুদ্ধ করে ওকে দাড় করালো।শুদ্ধতার সাস্থ্য মাশা-আল্লাহ দিলে ভালোই।কিন্তু যতোই হোক।নীবদ্ধ’র মতো সুসাস্থ্য অধিকারি বলিষ্ঠ দেহকে উঠানো শুদ্ধতার মতো মেয়ের জন্যে অনেক কঠিন একটা কাজ।শুদ্ধতা বহু কষ্টে নীবদ্ধ’কে রুমে নিয়ে আসলো।রুমে আনতেই একপ্রকার নীবদ্ধ’র শরীর আছড়ে পরলো বিছানায়।হাপিয়ে উঠেছে শুদ্ধতা।জানটা বের হয়ে যাচ্ছিলো প্রায়।এতো কষ্ট মনে হয় ও ওর বাইশ বছরের জীবনে কোনদিন করেনি।নীবদ্ধ অজ্ঞানপ্রায়।তার হুশ জ্ঞান নেই কোন।চোখ বন্ধ করে বিরবির করছে কি জানি।শুদ্ধতা শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুজে নিলো।এই শাড়ি আরেক ঝামেলা।এতো এতো সমস্যায় শুদ্ধতা আর নিতে পারছে না।উফ।জামা কাপড় না থাকায় শুদ্ধতাকে আয়েশা রহমান শাড়ি দিয়েছেন পরতে।আর নীবদ্ধ’র তো কোন বোনই ও নেই যে তার একটা থ্রী-পিচ পড়বে।অগত্যা উপায় না পেয়ে শাড়িই পরতে হয়েছে ওকে।এখন এই শাড়ি যেন ওর কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।শুদ্ধতা একপলক তাকালো নীবদ্ধ’র দিকে।এলোমেলো হয়ে বিছানায় সুয়ে নীবদ্ধ।জ্বরের কারনে ফর্সা মুখশ্রী লাল টকটকে হয়ে আছে।শুদ্ধতা এগিয়ে গিয়ে নীবদ্ধকে অনেক কষ্টে টেনেটুনে সোজা করে সুইয়ে দিলো।এখন লোকটার গা’টা মুছিয়ে দিতে হবে। তাহলে ভালো হয়।কিন্তু জামা-কাপড় খুলে দিবেটা কে?বাড়িতে সবাই এখন ঘুমিয়ে পরেছে। শুধু ও একাই সজাগ ছিলো।অপেক্ষা করছিলো নীবদ্ধ’র জন্যে।লোকটা সকাল থেকে না খাওয়া।আসলে জোড় করে কিছু খাইয়ে দিতো অবশ্য সে জানে শুদ্ধতা বললে নীবদ্ধ না করবে না।আয়েশা রহমান নিজেই থাকতে চেয়েছিলেন কিন্তু উনি অসুস্থ একজন মানুষ তাই শুদ্ধতা তাকে ঘুমোতে পাঠিয়ে নিজেই জেগে রয়েছিলো।এখন কেইবা জানতো যে নীবদ্ধ’র এমন জ্বর আসবে।কোন উপায় না পেয়ে শুদ্ধতা নিজেই নীবদ্ধ’র পাঞ্জাবি আর সেন্ডু গেঞ্জিটা খুলে দিলো।আর তা যে কতো কষ্টে করেছে হিসাব নেই।এখন মনে হচ্ছে শুদ্ধতা নিজেই জ্ঞান হারাবে।ওর ছোট্ট শরীরটা নীবদ্ধ’র মতো দৈ*ত্য মানবের শরীর উঠাতে উঠাতে কখন যেন শরীরের নিচে পরে আলু ভর্তা হয়ে যায়।শুদ্ধতা বিরবির করতে করতে বাথরুম থেকে এক বালতি পানি এনে তাতে রুমাল ভিজিয়ে নীবদ্ধ’র গা মুছে দিতে লাগলো।পানি পট্টি দিতে লাগলো কপালে।কিন্তু না জ্বর কমার কোন উপায় নেই।এভাবে চলবে না।জ্বরের মেডিসিন খাওয়াতে হবে।কিন্তু কিভাবে লোকটা না খাওয়া খালি পেটে মেডিসিন খেলে সমস্যা হবে।লোকটার তো কোন হুশও নেই যে খাবার খাবে নিজ ইচ্ছায়।উপায় না পেয়ে শুদ্ধতা আবারও নিচে কিচেনে গেলো।ঝটপট করে স্যুপ রান্না করে নিলো।এখন এটাই বেটার হবে।এক বাটি স্যুপ নিয়ে আবারো রুমে ফিরে আসলো শুদ্ধতা।স্যুপের বাটিটা পাশের টেবিলে রেখে নীবদ্ধ’কে আলতো স্বরে ডাকতো লাগল,
-‘ শুনছেন? একটু কষ্ট করে স্যুপটুকু খেয়ে নিন।আমি খাইয়ে দিবো তো।শুনছেন?’

পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালো।সামান্য একটু তাকিয়ে আবারও চোখ বন্ধ করে নিলো নীবদ্ধ।জ্বর বারছে আরো।চোখজোড়া মেলে তাকানোও যেন অনেক কষ্টের হয়ে গিয়েছে।সাঁত পাঁচ না ভেবে শুদ্ধতা নীবদ্ধ’কে খাইয়ে দিতে লাগলো।ভালো কথা নীবদ্ধও খাচ্ছেও।সারাদিন পেটে কিছু পরেনি। খিদে লাগবে স্বাভাবিক।স্যুপটুকু সম্পূর্ণ শেষ করে।জ্বরের মেডিসিন খাইয়ে দিলো শুদ্ধতা।অতঃপর আবারও নীবদ্ধ’র সেবাযত্নে নিয়োজিত হয়ে পরলো। নীবদ্ধ আবারও কিছু বিরবির করছে।শুদ্ধতা ভ্রু-কুচকে ফেললো।জ্বরের ঘোরে নাকি মানুষ অনেক সত্যি কথা বলে।বিষয়টা একবার পরখ করার জন্যে শুদ্ধতা নীবদ্ধ’র মুখের কাছে ঝুকে শোনার চেষ্টা করলো নীবদ্ধ কি বলছে।নীবদ্ধ বিরবির করছে,
-‘ আমি তোমাকে ভালোবাসি শুদ্ধতা।খুব ভালোবাসি।আমি তোমাকে কোনদিন ধোকা দিবো না।একবার বিশ্বাসের হাতটা বাড়িয়ে দেও শুদ্ধতা।ওয়াদা করলাম সারাজীবন তোমাকে আমার বাহুডোরে আগলে রাখবো।’

চট করে সরে আসলো শুদ্ধতা।বুকটা ধরফর করছে।নীবদ্ধ’র কথাগুলো কানে বারি খাচ্ছে বারবার। মন বলছে, ‘ শুদ্ধতা,একবার বিশ্বাস করে দেখ না ঠকবি না কোনদিন।’।কিন্তু মস্তিষ্ক বলছে, ‘ তোর বুবুর মতো তুইও একই ভুল করিস না শুদ্ধতা।পস্তাবি পরিশেষে।’
মন আর মস্তিষ্কের যুদ্ধ চললো সারারাত।ব্যাকুল হৃদয়টা নিয়ে নীবদ্ধ’র সেবা করে আর সহস্র কিছু চিন্তে করে পুরো রাতটা কাটিয়ে দিলো শুদ্ধতা।ভোড়ের দিকে নীবদ্ধ’র জ্বর ছাড়তেই। বিছানার সাথে হেলান দিয়ে এলোমেলো অবস্থাতেই ঘুমিয়ে পরলো ও।

#চলবে_________
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।