রাখিব তোমায় যতনে পর্ব-১৬

0
671

#রাখিব_তোমায়_যতনে
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ১৬
নিস্তব্ধ কক্ষ।শুভ্র চাদরে নিমজ্জত বিছানায় সুয়ে আছে নীবদ্ধ।গায়েও তার শুভ্র রাঙ্গা কম্বল।পিটপিট করে চোখ মেলে তাকানোর প্রয়াস চালাচ্ছে সে।কিন্তু চোখের পাতা এতোটাই ভারি লাগছে যে চোখ দুটো মেলে তাকাতেও ভীষন কষ্ট হচ্ছে ওর।সারা শরীরে তীব্র যন্ত্রনা অনুভব করছে সে।তাও অনেক কষ্টে চোখ মেলে তাকালো নীবদ্ধ।ঝাপ্সা দৃষ্টিজোড়া স্পষ্ট হয়ে আসতেই সম্মুখে নিজের হৃদয়ের রানির কোমল মুখশ্রী দৃষ্যমান হতেই মনটা ভালো লাগায় ছেঁয়ে গেলো।এতোক্ষনের যন্ত্রনাগুলো যে একনিমিষেই কোথায় যেন নিঃশেষ হয়ে গেলো।ব্যাথাতুর মুখশ্রীতেই হাসলো নীবদ্ধ।তা দেখে শুদ্ধতা বলে,
-‘ হাসছেন কেন আপনি? সবাইকে এইভাবে দুশ্চিন্তায় ফেলে এখন আপনি হাসছেন?খারাপ লোক একটা!’

নীবদ্ধ’র ঠোঁটজোড়া আরো প্রসারিত হলো।আসন্ন কন্ঠে বলল,
-‘ আপনি কি আমার জন্যে চিন্তা করেছেন শুদ্ধতা?’

শুদ্ধতা কি বলবে ভেবে পেলো না।তাই প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলে,
-‘ এখন কেমন লাগছে আপনার?’

-‘ কথা ঘুরাচ্ছেন? তবে আপনাকে দেখে আমার ব্যাথাগুলো কেমন যেন হাওয়ায় উড়ে গিয়েছে।’

নীবদ্ধ’র এমন কথায় শুদ্ধতা কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
-‘ একদম কোন চুক্তিছাড়া কথা বলবেন নাহ।জানেন আজ পুরো ২ দিন পর আপনার জ্ঞান ফিরেছে।’

বলতে বলতে শুদ্ধতার চোখজোড়া টলমল করে উঠলো।এখানে এসে যখন নীবদ্ধ’র সারা শরীরের ব্যান্ডেজের অস্তিত্ব দেখে শুদ্ধতার কেমন লাগছিলো তা ও নিজেই হয়তো বিস্লেষন করতে পারবে নাহ।শুধু অপেক্ষায় প্রহর গুনছিলো লোকটা কখন চোখ মেলে তাকাবে।শুদ্ধতার লাল হয়ে যাওয়া টলমলে চোখ দেখে নীবদ্ধ মনটা যেন আজ আনন্দে নেচে উঠলো।নিষ্প্রভ কন্ঠে বলল,
-‘ আপনি আমার জন্যে কাঁদছেন শুদ্ধতা?’

শুদ্ধতা ভড়কালো,থমকালো।এলোমেলো হাতে নিজের চোখজোড়া দুহাতের সাহায্যে ঢলে নিলো।ঠোঁট ফুলিয়ে বলে,
-‘ আপনি কিসব বলছেন?আমি খামোখা কাঁদবো কেন?’

-‘ লুকাচ্ছেন কেন শুদ্ধতা?আমি দেখেছি তো।’

নীবদ্ধ’র কন্ঠে হালকা তেজের আভা দেখা গেলো।শুদ্ধতা নিজেই অবাক।ও আজ এতো কান্না পাচ্ছে কেন?এখানে আসার পর থেকে ঠেলেঠুলে কান্না আসছে শুদ্ধতার।শুদ্ধতা তো এতো নরম হৃদয়ের ছিলো না।ও তো কবে ঠিকঠাকভাবে কেঁদেছে তাও মনে নেই।শুদ্ধতার ভাবনার মাঝেই নীবদ্ধ’র কন্ঠ পাওয়া গেলো,
-‘ কান্নামাখা মুখশ্রীতে আপনাকে অনেক ভালোলাগে শুদ্ধতা।’

শুদ্ধতা স্থির দৃষ্টিতে তাকালো।তবে কিছু বললো না।নীবদ্ধ ফের বলে,
-‘ আপনাকে আমি আবার কাঁদাবো শুদ্ধতা।আপনি কাঁদলে আপনাকে এতো সুন্দর লাগবে ভাবতে পারিনি আমি।দেখুন আপনাকে দেখে আমার বুক কাঁপছে শুদ্ধতা।’

শুদ্ধতা ঠান্ডা কন্ঠে বলে,
-‘ কেন আগে ভালো লাগতো না বুঝি?’

নীবদ্ধ সাথে সাথে বলে,
-‘ আরে ভালো লাগবে না কেন? আপনার রাগি চেহারাটা আমার সবচেয়ে বেশি পছন্দ।আমি তো আপনার সেই রাগে রক্তিমবর্ণ ধারন করা মুখশ্রী দেখে প্রেমে পরেছিলাম।তবে আপনাকে কাঁদতে দেখেনি কোনদিন।আজ প্রথমবার দেখলাম তো।আমার ভালো লেগেছে। তাই সুযোগ পেলে আমি আপনাকে আবার কাঁদাবো।’

নীবদ্ধ’র এসব কথা শুনে হাসি পাচ্ছে এখন শুদ্ধতার।তাও হাসলো না।নীবদ্ধ আবার কিছু বলবে তখন দরজায় করাঘাত হয়।শুদ্ধতা অনুমতি দিতেই দরজা ঠেলে প্রবেশ করে ঐক্য। ঐক্য নীবদ্ধ’কে সজাগ দেখে একদৌড়ে ভাইয়ের কাছে চলে আসে।অস্থির কন্ঠে বলে,
-‘ ভাই তুই ঠিক আছিস?’

নীবদ্ধ হালকা হেসে বলে,
-‘ হ্যা ঠিক আছি আমি।
-‘ কোথায় কি ব্যাথা হচ্ছে?ডাক্তার ডাকবো?’
-‘ নাহ ব্যাথা নেই।’

-‘ মিথ্যে বলছেন কেন?’

শুদ্ধতার এমন কথায় নীবদ্ধ ভ্রু উচিঁয়ে বলে,
-‘ মিথ্যে বললাম কোথায়?’
-‘ এইযে বলছেন ব্যাথা করছে না।’
-‘ তো?’
-‘ তো কি?ব্যাথা করবে না কিভাবে? আপনার কপলা কেটে গিয়েছে সেখানে তিনটে স্টিচ লেগেছে।বা হাতের কুনুই তে দু টা।পেটের কাছে পাঁচটা।ডানপায়ে ফ্রেকচার হয়েছে। তাও কিভাবে বলছেন ব্যাথা লাগছে না আপনার?’

নীবদ্ধ শুদ্ধতার কথায় কপাল কুচকালো।এতো এতো ব্যাথা পেয়েছে সে? শুদ্ধতা বলাতেই যেন ব্যাথাগুলোর অস্থিত্ব টের পেলো।ডানপা’টা হালনা নড়ানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু হলো না।সেখানে বিশাল বড় ব্যান্ডেজ করা।ঐক্য বলে,
-‘ কি করছিস ভাইয়া? পা নাড়াচ্ছিস কেন?’
-‘ নাহ দেখছিলাম।’

এর মাঝে আকস্মিক জয়ের কথা মনে হতেই। নীবদ্ধ অস্থির গলায় বলে,
-‘ জয় কোথায় ঐক্য? ও ঠিক আছে?’

ঐক্য’র জবাব,
-‘ হ্যা ভাই চিন্তা করিস না।জয় ঠিক আছে।ও মাথায় আঘাত পেয়েছে আর বামহাত ফ্রেকচার হয়েছে।’

সস্থির নিশ্বাস ফেললো নীবদ্ধ।শুদ্ধতার দিকে তাকালো একবার।তারপর বলে,
-‘ আমাদের রিলিজ এর ব্যাবস্থা কর ঐক্য! ‘

ঐক্য অবাক হলো বেশ বলে,
-‘রিলিজ মানে?কি বলছিস এসব?তুই এখনো অসুস্থ।’
-‘ এইটুকুতে কিছু হবে না। তোর ভাবিকে নিয়ে আমি এখনে আর একদিনই থাকতে চাইনা। দরকার হলে ঢাকা ব্যাক করে আবার হাসপাতালে ভর্তি হবো।’

শুদ্ধতা তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে,
-‘ তো আপনি বলতে চাচ্ছেন আমি এখানে থাকলে আপনার সমস্যা হবে?’
-‘ আমি কখন সেটা বললাম?’
-‘ মাত্রই তো বললেন!’

নীবদ্ধ হতাশ নিশ্বাস ফেলে বলে,
-‘ আমি সেটা বুঝাইনি আপনাকে শুদ্ধতা।আমি বুঝাতে চেয়েছি।এইভাবে অপরিচিত একটা জায়গায়। আবার হাসপাতালে আপনি থাকবেন সেটা আমার ভালো লাগবে না।তাও আপনি এখানে একা একটা মেয়ে।আমি আপনাকে নিয়ে কোন রিস্ক নিতে চাই না।ঢাকা ব্যাক করে হাসপাতালে আমাকে ভর্তি করিয়ে দিয়ে তারপর যতো ইচ্ছা আমার সাথে, আমার পাশে থাকিয়েন।আমি কোন মানা করবো নাহ।’

শুদ্ধতা মনে মনে নীবদ্ধ’র কথায় খুশি হলেও।সেটা প্রকাশ করলো না। নীবদ্ধ’কে ভেংচি কেটে বলে,
-‘ হুহ্! আমার ঠেকা পরেছে।আপনার সাথে হাসপাতালে দিন কাটানোর।’

হাসলো নীবদ্ধ শুদ্ধতার কথায়।তবে কিছু বললো না।ঐক্যকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-‘ যা বললাম তা কর গিয়ে।জলদি যাহ।’

ঐক্য হতাশার নিশ্বাস ফেললো।সে জানে তার ভাই যা বলে তা হাজার বার বলেও ফেরানো যায় না।তাই অগত্যা চুপচাপ মেনে নিলো।ঐক্য যেতে নিবে শুদ্ধতা ওকে ঢেকে উঠলো,
-‘ ঐক্য ভাইয়া শুনেন?’
-‘ হ্যা ভাবি?’
-‘ যাওয়ার আগে আপনার ভাইয়ের জন্যে খুশি খাবার পাঠিয়েন।’
-‘ আচ্ছা ভাবি।’
-‘ ফ্রুটস হলে ভালো হয়।এমনিতেই উনার শরীর থেকে অনে রক্ত ঝরেছে।’

ঐক্য বিনাবাক্যে সব মেনে নিয়ে চলে গেলো।ঐক্য যেতেই নীবদ্ধ বলে,
-‘ আমাকে একটু উঠে বসতে সাহায্য করবেন শুদ্ধতা?’

শুদ্ধতা মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো।তারপর নীবদ্ধকে অনেক কষ্টে বেডের সাথে হেলান দিয়ে বসালো।হাপিয়ে উঠেছে শুদ্ধতা। এমন লম্বাচুড়া সুসাস্থবান একটা ছেলেকে ওর একার টেনে তুলা চারটিখানি কথা না।কোথায় দৈ*ত্যদের মতো শরীরের অধিকারি নীবদ্ধ।আর কোথায় ও চিকন চাকন একটা মেয়ে।এমনিতে শুদ্ধতা বেশ লম্বা।তাও নীবদ্ধ কাধ বরাবর পরে শুদ্ধতা।লোকটা অনেক লম্বা।শুদ্ধতা একগ্লাস পানি খেয়ে নিলো।নীবদ্ধ হেসে বলে,
-‘ এইটুকুতেই এই অবস্থা?’
শুদ্ধতা করা গলায় বলে,
-‘ তো আমি কি আপনার মতো গন্ডার নাকি?যে আমার এতো এতো শক্তি থাকবে?’
-‘ বিয়ের পর কিন্তু এই গন্ডারের শরীরের ভাড় সকাল, দুপুর, রাত সহ্য করতে হবে তখন কি করবেন?’

হা হয়ে গেলো শুদ্ধতা। নীবদ্ধ যে ওকে এসব কথা এতো অকপটে বলে ফেলবে ভাবেনি শুদ্ধতা। এক্সিডেন্ট করায় বোধহয় লোকটার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে।নাহলে এমন ঠোঁটকাটা স্বভাবের তো নীবদ্ধ না।অন্তত ওর সাথে এমন সব কথা তো কোনদিন বলেনি নীবদ্ধ। তবে আজ কি হলো? গালগুলো লজ্জায় ভারি হয়ে আসলো। কান লাল হয়ে উঠলো ভীষন লজ্জায়।সেদিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে নীবদ্ধ। ঘোরলাগা কন্ঠে বলে,
-‘ লজ্জা পেলে আপনাকে আরো বেশি,ভীষন সুন্দর লাগে শুদ্ধতা।’
-‘ আপনি একটু চুপ করে থাকেন।কি শুরু করলেন?’ লজ্জায় শুদ্ধতার গলা কেমন যেন কাঁপছে।
নীবদ্ধ একটুও থামলো না।বরংচ তার কথার মাত্রা আরো বেড়ে গেলো।নীবদ্ধ আবিষ্ট কন্ঠে বলল,
-‘ গোটা আপনিটাই আমার কাছে ভীষন সুন্দর শুদ্ধতা। আপনার নামের মতোই আমনি ভীষন শুদ্ধ, শুদ্ধতা।’

#চলবে__________