লাভ গেম পর্ব-২৮+২৯

0
685

#লাভ_গেম
#ফাবিহা_নওশীন

২৮.

আদ্রিশ বসার ঘরে সোফায় বসে আছে। দু পা আরাম করে টেবিলের উপরে রেখেছে। হাতে মোবাইল, পাশেই কোর্টটা রাখা। রুশা ওর আশেপাশে ঘুরঘুর করছে কিছু বলার জন্য কিন্তু পারছে না। কয়েকবার ঘুরে চলে এসেছে। সবটাই আদ্রিশের চোখে পড়েছে কিন্তু না দেখার ভান করে আছে। রুশা আদ্রিশের সামনে দাঁড়িয়ে উশখুশ করছে। আদ্রিশ আড়চোখে একবার চোখ সরিয়ে নিল। তারপর নিজের মতো ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
রুশা বিরক্ত হলো ওর আচরণে।

“এত ভাব নেওয়ার কিছু নেই। আমি তোমার সাথে প্রেমালাপ করতে আসিনি যে পাত্তা দিচ্ছো না টাইপ ভাব দেখাবে।”

আদ্রিশ রুশার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। রুশা ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে দুহাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে মুখে বিরক্তি।
আদ্রিশ পা নামিয়ে তাচ্ছিল্য করে বলল,
“তো আমি কী সাহায্য করতে পারি? কী প্রয়োজন পড়ল আমাকে?”

রুশা দু’হাতের ভাজ খুলে আদ্রিশের দিকে চেয়ে বলল,
“আমি সেজান ভাইয়ের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি।”

আদ্রিশের ব্যাপারটা ঠিক হজম হলো না। রুশা এসেছে সেজানের ব্যাপারে কথা বলতে। সেজানের ব্যাপারে হলে সেজান নিজেই আসবে। রুশাকে কেন পাঠাবে? ওদের মধ্যে লজ্জা, সংকোচের সম্পর্কও না।
তাই অনেকটা বিস্ময় নিয়ে বলল,
“সেজান!”

“হ্যা। সেজান ভাইকে নিয়ে।”

“সেজানের আবার কী হয়েছে?”

“না, কিছু হয়নি। আসলে আমি উনার ব্যাপারে কিছু বলতে এসেছি।”

“সেজান, তোমাকে পাঠিয়েছে? ওর কিছু বলার থাকলে সরাসরি আমাকে বলবে। তোমাকে কেন পাঠাবে?”

“আমি কোথায় বললাম সেজান ভাই পাঠিয়েছে? আমি নিজে এসেছি উনার ব্যাপারে কথা বলতে। আসলে আমি সেজান ভাইয়ের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি।”

আদ্রিশ ওর কথা শুনে দাঁড়িয়ে গেল।
“কী? বিয়ে? সেজান বিয়ে করবে?”

“বিয়ে করালে অবশ্যই করবে। তুমি বড় ভাই। এটা তোমার দায়িত্ব।”

আদ্রিশ বসে পড়ল। তারপর আবার ভাবতে লাগল। কিছুক্ষণ ভেবে গম্ভীরমুখে বলল,
“আমি চাই না সেজান বিয়ে করুক।”

“কিন্তু কেন? তোমার কী সমস্যা?”

“অবশ্যই সমস্যা আছে। ও আমার ছোট ভাই। আমি ওর লাইফে আঁচ আসতে দেব না। আমি চাই না ও কষ্ট পাক। নারী মানেই প্রতারক। তুমি আমার বিশ্বাস নিয়ে যেভাবে খেলেছো, আমার জীবন যেভাবে ছাড় খার করে দিয়েছো ওর লাইফে আমি এমন কাউকে এলাও করব না। কারো হাতে ওর জীবন তুলে দেব না।”

“আমার আর তোমার বিষয়টা আলাদা। এর সাথে সেজান ভাইকে কেন জড়াচ্ছো?”

“তোমাকে এ নিয়ে ভাবতে হবে না। আমি ওর বিয়ে দিচ্ছি না ব্যস!”

“কিন্তু তারও একটা চাওয়া পাওয়া আছে। তারও কাউকে প্রয়োজন।”

“সেটা যেদিন সেজান এসে বলবে সেদিন ভেবে দেখব। এ নিয়ে আর একটা কথা শুনতে চাই না। অন্তত তোমার মুখ থেকে।”

আদ্রিশ সোফায় থাকা কোর্ট আর মোবাইল হাতে নিয়ে চলে গেল। রুশা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। সেজান কবে বলবে আর কবে ওদের বিয়ে হবে৷ কথাকে কি উত্তর দিবে বুঝতে পারছে না। কথার ঘরের দিকে পা বাড়ালেই সেজানকে দেখতে পেল। সেজান সামনাসামনি পড়ে গিয়ে ইতস্তত করছে।
আমতা আমতা করে বলল,
“ভাইকে এসব কী বলছিলেন? কেন বলছিলেন?”

“আপনার আর কথার জন্য। কথাকে তো ভালোবাসেন।”

সেজান জোরপূর্বক হেসে বলল,
“আমি এখুনি বিয়ে করতে চাই না। আর তাছাড়া কথা শান্ত শিষ্ট খুব ভালো একটা মেয়ে। ওকে কারো না ভালো লাগার কারণ নেই। কিন্তু ব্যাপারটা আপনি যেমন ভাবছেন তেমন নয়। জাস্ট একটা ভালোলাগা ছিল কিন্তু ভালোবাসি তা নয়। ওসব কিছু না।”

রুশা সেজানের দিকে তাকাল। ও দৃষ্টি লুকাচ্ছে। রুশার বুঝতে বাকি নেই আদ্রিশের বিপক্ষে ও যাবে না৷ রুশা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“হয়তো আমারই বুঝতে ভুল হয়েছে। কথাকে আমি ছোট বোনের মতো মনে করি। ওর দায়িত্ব নিয়েছি। ওকে ভালো ঘর, ভালো বর দেব। আর সে দায়িত্ব আমি পালন করব। বাবা-মা নেই বলে সবাই ঠঁকিয়ে যাবে তা কি হয়? ওর জন্য আমি ছেলে দেখেছি। আপনি যখন চাইছেন না তাহলে সে ছেলের সাথে কথা বলব।”

সেজানের ভেতরটা ছিড়ে যাচ্ছে রুশার কথা শুনে। টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে সাজানো ভালোবাসা। তবুও জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে রেখেছে৷ আদ্রিশের বিরুদ্ধে কিছুতেই যাবে না। জীবন দিয়ে দিতে পারবে আর এ তো জীবনের সামান্য অংশ ভালোবাসা।
“জি ভাবি, যা ভালো মনে করেন।”
সেজান নিজের ঘরে চলে গেল। রুশা সেজানের আচরণে অবাকের পাশাপাশি বিরক্ত। কি করে কথাকে ফেস করবে। মেয়েটা কত আশা নিয়ে বসে আছে। রুশার কথাকে ফেস করতেই হবে। তাই কথার ঘরের দিকে পা বাড়াল।

.

কথা বসে বসে চোখের পানি মুছছে। রুশা ওর মুখোমুখি অসহায় ফেস করে বসে আছে। কাঁদতে নিষেধও করেনি। কারণ কথা আগে হোক পরে হোক কাঁদবে যেহেতু সেজান অস্বীকার করেছে নিজের ভালোবাসা। তাই চাইছিল ওর সামনেই কাঁদুক। কথা চোখের পানি মুছে জিহবা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিজেকে সামলে বলল,
“আপু, আমিই ভুল ছিলাম। ভুল ভেবে এত এত স্বপ্ন দেখেছিলাম। সেজান ভাইয়ের কী দোষ। আমার মতো এতিম মেয়েকে বিয়ে করা যায় না, ভালোবসাও যায় না। আমি ভুলে গিয়েছিলাম। উনার জন্য কি মেয়ের অভাব বলো। আমিই বোকা।”

রুশা ওর অবস্থা বুঝে বলল,
“কথা এভাবে বলছো কেন? কখনো নিজের অবস্থা নিয়ে আফসোস করবে না। নিজেকে ছোট মনে করবে না। তোমার শিক্ষা, মনুষ্যত্বই তোমার পরিচয়। নিজেকে কখনো ছোট মনে করবে না। আমি তোমার জন্য ভালো ছেলে খুঁজব৷ সে তোমাকে খুব ভালো রাখবে, ভালো বাসবে।”

কথা শুকনো হেসে বলল,
“এসব বাদ দেও৷ আমি কষ্ট পাচ্ছি না। যে আমাকে ভালোবাসে না তার জন্য কেন কষ্ট পাব? আমি আর কষ্ট পাব না। সব ভুলে যাব। তুমি খামোখা এ নিয়ে চিন্তা করো না। চলো আমরা বেবি নিয়ে কথা বলি। জানো আপু তোমাকে এখন মুরুব্বী মুরুব্বী লাগে। হি হি হি।”

রুশাও ওর কথা শুনে হেসে ফেলল। ও আগের চেয়ে অনেক মুটিয়ে গেছে। শরীর, মুখ সব ফুলে গেছে। নিজের চেহারার তেমন যত্ন নেয় না। সব মিলিয়ে কিউটনেস চলে গেছে।

.

কয়েকদিন পর।
রুশাকে আদ্রিশ নিচে শিফট করে দিয়েছে। ভারী শরীর নিয়ে সিড়ি বেয়ে নামতে উঠতে সমস্যা হয়। কোন দূর্ঘটনা ঘটে যায় তাই ওকে নিচে শিফট করে দিয়েছে। ওর যত্নের কোনো ত্রুটি রাখে না কিন্তু পরোক্ষভাবে। নিজেকে আড়ালে রেখেই ওর দেখাশোনা করে। কথাকে ওর রুমে থাকতে বলেছে যাতে রাতের বেলায় কোনো সমস্যা হলে জানতে পারে। কথা রুশাকে ধরে ধরে ডাইনিং টেবিলের কাছে নিয়ে গেল। রুশা একাই সব করতে পারে কিন্তু কথা নাছোড়বান্দা। ওর সাথে সাথে হাঁটতে হবে। কথা চেয়ার টেনে রুশাকে বসতে দেয়। বসানোর পরে ওর চোখ যায় বসার ঘরের সোফার দিকে। সেজান সেখানে স্থির দৃষ্টিতে বসে আছে। কথার দিক থেকে চোখ ফেরাচ্ছে না। কথা চোখ সরিয়ে এমন ভান করে যেন ওকে দেখেই নি। নরমাল বিহেভ করছে। কিচেন থেকে খাবার এনে রুশাকে দিচ্ছে৷ তারপর রুশার পাশে বসে নিজেও খাচ্ছে। এক বারের জন্যও সেজানের দিকে তাকাচ্ছে না। বিষয়টা সেজানকে গভীর ভাবে পীড়া দিচ্ছে। কথা রুশার হাসে হেসে হেসে কথা বলছে আর খাচ্ছে। খাওয়া শেষ করে উঠে আবার ঘরে গিয়ে রুশার মেডিসিন এনে রুশাকে খাইয়ে দিচ্ছে। সেজান আর সহ্য করতে পারছে না। ও কথাকে ইগনোর করতে পারছে না কিন্তু কথা স্বাভাবিকভাবেই ইগনোর করে যাচ্ছে। যে কথা ওকে দেখলেই হাসি মুখে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করত,
কেমন আছেন? কিছু খাবেন? কফি করে দেই? আজ সে নির্বাক শুধুমাত্র ওর সাথে। ওকে কত সহজভাবে ইগনোর করে যাচ্ছে। সেজান বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। চুপচাপ বাইরে চলে গেল। আদ্রিশের জন্য গাড়িতে গিয়ে অপেক্ষা করছে। কথা আড়চোখে ওর যাওয়া দেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল যা কারো চোখে পড়েনি।

~বিকেল বেলা~
কথার সাথে রুশা বাগানে হাঁটছে আর গল্প করছে। আদ্রিশ দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওকে দেখছে। হুট করে রুশা যেন বদলে গেল। প্রায় বছর খানেক আগে যখন ওকে দেখেছিল লম্বা, পাতলা, অবুঝ ধরনের একটা মেয়েকে দেখেছিল। যাকে টোকা দিলেই যেন ভেঙে পড়বে এমন ছিল। আজ তার মধ্যে কত পরিবর্তন। একদম ম্যাচিউর একটা মেয়ে। কয়েকমাস আগেও লাফিয়ে, ঝাঁপিয়ে বেড়িয়েছে। শত্রুর সাথে লড়াই করেছে। এখন সে গুটিগুটি পায়ে হাঁটে। আদ্রিশ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ওর ইচ্ছে করছে রুশার হাত ধরে ওর মতো গুটিগুটি পায়ে বাগানে হাঁটতে আর রাজ্যের গল্প করতে। কিন্তু অভিমান ওকে বাঁধা দিচ্ছে।
রাতের বেলায় রুশা ডাইনিংয়ে বসে বসে ছুরি দিয়ে আপেল কাটছে। কিছু ভালো লাগছে না। তাই অযথাই আপেল কাটছে। আদ্রিশের জন্য মন কেমন কেমন করছে। না পারছে সব ভুলে ওকে কাছে টানতে আর না পারছে এতটা দূরত্ব সহ্য করতে। আদ্রিশ সোফায় বসে কফি খাচ্ছে আর রুশাকে আড়চোখে দেখছে। আদ্রিশ চাইলে ঘরে বসেও খেতে পারত এখানে মূলত রুশার জন্য বসে আছে। রুশা আড়চোখে আদ্রিশকে দেখছে। আদ্রিশ কি সত্যিই ওকে আর ভালোবাসে না? সত্যিই কি বাচ্চা হওয়ার পর ওকে তাড়িয়ে দিবে? আদ্রিশ কি জোর করে ওর সন্তান ওর কাছ থেকে কেড়ে নিবে? রুশার মাথায় এসব চিন্তাভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে। হঠাৎ করে ছুরি ওর আঙুলে লেগে যায়। কিছুটা কেটে গিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। রুশা আকস্মিক দূর্ঘটনায় কিছুটা জোরে শব্দ করে উঠে। আঙুল চেপে ধরে। আদ্রিশ কফির মগ ফেলে দৌঁড়ে আসে। কফি আর মগের ভাঙা অংশ মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আদ্রিশ দৌঁড়ে এসে ওর আঙুল চেপে ধরে। তারপর চেঁচিয়ে সার্ভেন্টদের ডাকে।

রুশাকে ধমক দিয়ে বলল,
“তোমাকে এসব কে করতে বলেছে? একদিন নিষেধ করিনি? আমার বাড়িতে কাজের মানুষের অভাব পড়েছে?”
রুশা ওর ধমক খেয়ে থমথমে মুখ করে রেখেছে। সার্ভেন্টরা ভয়ে যবথব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আদ্রিশ সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“সবাই চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে বাড়িতে চলে যান৷ রুশাকে যদি কাজ করতে হয় তবে আপনাদের কী প্রয়োজন?”

রুশা ওর কথা শুনে বলল,
“আদ্রিশ, উনাদের কী দোষ? আমার ভালো লাগছিল না তাই কাটছিলাম।”

“তুমি চুপ থাকো। দেখো কত রক্ত বের হচ্ছে। কেন এমন করো রুশা? এমনিতেই তোমার শরীর দূর্বল। একটা বাচ্চা বহন করছো। একটু তো খেয়াল রাখো। সব সময় এত জেদ কেন করো?”

আদ্রিশ সার্ভেন্টদের দিকে চেয়ে ধমকে বলল,
“দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার মুখ দেখছেন কেন? ফার্স্ট এইড বক্স আনুন। ডাক্তার খবর দিন।”

রুশা অবাক হয়ে বলল,
“সামান্য একটু কেটেছে। ডাক্তার কী প্রয়োজন?”

আদ্রিশ চিন্তিত হয়ে বলল,
“এত রক্ত বের হচ্ছে যদি শরীর আরো দূর্বল হয়ে মাথা ঘুরে পড়ে যাও, ব্যথা পাও। তখন আরো অসুস্থ হয়ে পড়বে। বলা তো যায় না। ডাক্তার দেখিয়ে নেওয়া ভালো।”

একজন ফার্স্ট এইড বক্স এনে দিলে আদ্রিশ নিজ হাতে ব্যান্ডেজ করে দিল। রুশা অবাক হয়ে চেয়ে আছে আদ্রিশের দিকে। ওর জন্য কত চিন্তা। মনে হচ্ছে সেই আদ্রিশ যে ওর আগে ব্যথা পায়। কোথাও না কোথাও আদ্রিশের মনে ওর জন্য নিগুঢ় ভালোবাসা আছে। সেটা শুধু প্রকাশ করতে চায় না। ব্যান্ডেজ করে আদ্রিশ রুশাকে ঘরে নিয়ে গেল। ধীরে ধীরে ওকে বিছানায় বসিয়ে দিল।
তখনই রুশা ‘উউহ’ শব্দ করে পেটে হাত দিল। চোখে পানি ছলছল করছে। আদ্রিশ বিচলিত হয়ে ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“কী হয়েছে রুশা, শরীর খারাপ লাগছে?”

রুশা ছলছল চোখে হাসি মুখ করে কিছু বলার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। নিজেকে একটু শান্ত করে বলল,
“কিক মেরেছে। পেটে ফুটবল খেলছে। স্থির থাকার মতো বাচ্চা ও না।”

আদ্রিশ ওর কথা শুনে হেসে ফেলল। তারপর বিরবির করে বলল,
“মা, কম কিসে? দেখতে হবে না।”

রুশা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলল,
“তুমি কম কিসে? তুমি তো বেশ শান্ত, ভদ্র একটা মানুষ। হুহ! তোমার মতো হয়েছে। একদম তোমার মতো হয়েছে।”
দুজন বাচ্চা কার মতো হয়েছে তা নিয়ে ঝগড়া শুরু করে দিয়েছে।

চলবে……

#লাভ_গেম(বেবি স্পেশাল)
#ফাবিহা_নওশীন

২৯.

সকাল থেকেই রুশার শরীর মেজমেজ করছে। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে। থেমে থেমে পেটে ব্যথা হচ্ছে। কথা আশ্রম যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। আশ্রমে গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। আজ যেতেই হবে। কথা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কানে দুল পরতে পরতে বলল,
“আপু, কোন কিছু প্রয়োজন হলে কাউকে ডেকো। আমি সবাইকে বলে যাব তোমার দিকে খেয়াল রাখতে। পানি আর মোবাইল হাতের কাছে রেখেছি। একা একা উঠে কোথাও যাবে না। আগামীকাল তোমার ডেট।এই একটা দিন সাবধানে থাকবা। আমি যাচ্ছি। তাড়াতাড়ি চলে আসব।”

রুশা আধশোয়া হয়ে মুচকি হেসে বলল,
“কথা, এত চিন্তা করো না। তুমি যাও। কাজ শেষ করে আসবে। তাড়াহুড়োর প্রয়োজন নেই।”
কথা বিছানার উপরে থেকে লেডিস্ ব্যাগটা হাতে নিয়ে রুশার দিকে মুচকি হেসে বিদায় নিল।
ও যেতেই রুশার মলিন মুখে পেটে হাত রাখল। ও বুঝতে পারছে না ওর এমন লাগছে কেন। তারপর আবার শুয়ে পড়ল। ঘন্টাখানেক পরে ব্যথাটা চাড়া দিয়ে উঠল। আজগুবি চিন্তাভাবনা মাথায় প্রবেশ করতেই খিঁচুনি উঠে যাচ্ছে। শ্বাস নিতে পারছে না। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। রুশা বেড সাইড টেবিল থেকে পানি নিয়ে খেল। তারপর আবার শুয়ে পড়ল। কিন্তু এখন ব্যথায় নড়তে পারছে না। হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা নেওয়ার চেষ্টা করছে। কাউকে ডাকবে মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। শুধু জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। মোবাইলটা ধরতে পারছে না আর না কেউ এই ঘরে আসছে। রুশা মাথা উঁচু করে দরজার দিকে তাকাল। ওর মনে হচ্ছে এই ঘরে কখনো কেউ আসবে না আর ওর অবস্থা জানবে না। রুশার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। মোবাইলটা আঙুলের স্পর্শ পেয়েছে। রুশা আরেকটু চেষ্টা করছে। নিজেকে বোঝাচ্ছে আর সাহস জোগাচ্ছে ওকে পারতেই হবে। কিন্তু সে আশাও নিভে গেল। হাতের স্পর্শ পেয়ে মোবাইলটা নিচে পড়ে গেল। রুশার অসহায়ত্ব আরো বেড়ে গেল। ও ব্যথায় ছটফট করছে আর কাঁদছে। তারপর মাথায় আসলো পানির গ্লাসটা নিচে ফেলতে হবে। রুশা আবারও নিজেকে সামলালো। সাহস জুগিয়ে আরেকটু চেষ্টা করছে।

আদ্রিশ অফিসের জন্য বের হচ্ছে। কিছু পড়ার শব্দে স্থির হয়ে দাঁড়াল। তারপর ভাবল রুশা হয়তো রাগ করে কিছু ছুড়াছুড়ি করছে। ওর অফিসের জন্য দেরি হয়ে যাচ্ছে তাই আর সেদিকে যাওয়ার কথা ভাবল না। তারপর দেখা যাবে দু’জনের মধ্যে ঝগড়া লেগে যাবে।
আদ্রিশ তাই কোট হাতে অফিসের জন্য বের হয়ে গেল। রুশা ছটফট করছে আর কাঁদছে। মৃদুস্বরে বিরবির করছে। বিরবির করে কিছু বলছে। গোঙ্গানি দিচ্ছে। কপাল বেয়ে চিকন ঘামের রেখা ফুটে উঠেছে।
আদ্রিশ কি মনে করে আবার ফিরে এল। রুশাকে দেখার জন্য ওর ঘরের দরজার সামনে এলো। দরজা ভেড়ানো ছিল। আদ্রিশ দরজায় টোকা দিতে চেয়েও দেয় না। আস্তে আস্তে দরজা খুলে। দরজা খুলতেই ওর চোখ যায় বিছানার দিকে। যেখানে রুশা হাত পা নাড়িয়ে ছটফট করছে। আদ্রিশ হাতের কোট ফেলে রুশার কাছে দৌঁড়ে যায়। আতংকিত হয়ে ওর দিকে তাকাল। আদ্রিশকে দেখে রুশার প্রাণ ফিরে এল। আদ্রিশ রুশার হাতের তালুতে হাত ঘঁষছে।
বিচলিত, ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,
“কী হয়েছে তোমার এমন করছো কেন?”

রুশা বিরবির করে বলল,
“আদ্রিশ…!”

“হ্যা, হ্যা, বলো আমি শুনছি। বলো কী বলবে? কী হয়েছে তোমার?”

“আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি শ্বাস নিতে পারছি না। আমাকে হাসপাতালে নিয়ে চলো।”

আদ্রিশ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছে। কী করবে বুঝতে পারছে না। রুশার অবস্থা ওকে নার্ভাস করে দিয়েছে। চেঁচিয়ে সবাইকে ডাকছে আর রুশার চোখের পানি মুছে দিচ্ছে। রুশাকে পাজা কোলে নিয়ে বলল,
“আমি আছি কিছু হবে না তোমার। আমরা এখুনি হাসপাতালে যাব।”

আদ্রিশ রুশাকে নিয়ে ঘর থেকে বের হতেই কাজের লোকেরা দৌঁড়াতে শুরু করল। গাড়ির দরজা খুলে দিল। ওর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গাড়িতে তুলে দিল। রুশার খিঁচুনি বেড়ে যাচ্ছে। রুশার অবস্থা দেখে আদ্রিশের নিজেকে অসহায় লাগছে। হাসপাতালে কল করল। সব কিছু ব্যবস্থা করে রাখল। যাতে রুশাকে নেওয়ার সাথে সাথে চিকিৎসা শুরু করে দেয়। আদ্রিশ রুশাকে আগলে রেখেছে নিজের সাথে। রুশা আদ্রিশের একটা হাত নিজের হাতে চেপে ধরেছে। ওর চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।
“রুশা, আরেকটু কষ্ট করো। আমরা চলে এসেছি। বিশ্বাস করো তোমার এই অবস্থা আমি দেখতে পারছি না। আমি সহ্য করতে পারছি না।”
আদ্রিশ আঙুল দিয়ে চোখের কোনের পানি মুছল যা রুশার চোখে পড়েনি।

হাসপাতালে রুশাকে নিতেই ট্রিটমেন্ট শুরু হয়ে গেল। সেজান আর কথাও চলে এসেছে। কথার নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। তাই এসে থেকে মাথা নিচু করে রেখেছে। ডাক্তার বের হয়ে এসেছে। আদ্রিশের কাছে এসে বলল,
“পেসেন্টের অবস্থা ভালো না। খিঁচ উঠছে বারবার।”

আদ্রিশ ডাক্তারের কলার চেপে ধরে চেঁচিয়ে বলল,
“ভালো না মানে কী? ওর এখানেই চেকাপ হয়েছে। সব সময় তো বলে এসেছেন সব নর্মাল আর এখন বলছেন ভালো না। কেন?”

সেজান ওকে ছাড়িয়ে নিল। ডাক্তারকে বলল,
“আমার স্ত্রীর কিছু হলে হাসপাতাল জ্বালিয়ে দেব। এতদিন সব ঠিক ঠিক বলে ভুল চিকিৎসা দিয়েছে এরা। এদের আমি ছাড়ব না। ”

ডাক্তার ঘাবড়ে যাওয়া কন্ঠে বলল,
“আসলে স্যার, মেম কোন ট্রমার মধ্যে চলে গেছেন। বিরবির করে বলছেন আমার বাচ্চা কাউকে দেব না। কেউ নিতে পারবে না। মনে হচ্ছে মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত। উনার মনে কোন ঘটনা বিশেষ প্রভাব ফেলেছে। আমরা ওটিতে নিয়ে যাচ্ছি।”
কথা আর সেজান দুজনেই আদ্রিশের দিকে তাকাল। ওদের তিনজনের কারো বুঝতে বাকি নেই ঘটনাটা।

কথা আমতা আমতা করে বলল,
“আপু কয়েকদিন ধরে অনেক ডিস্টার্ব ছিল। রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারত না। তার মনে একটা ভয় জেঁকে বসেছিল আপনি তার বাচ্চাকে যদি ছিনিয়ে নেন। আমি অনেক বুঝিয়েছি কিন্তু রুশা আপু তো মা। আর মায়ের মনে সব সময় সন্তানের জন্য দুশ্চিন্তা লেগেই থাকে। রুশা আপুর ক্ষেত্রেও তাই।”

আদ্রিশ জানে ওকে কি করতে হবে। ওটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সেজান আর কথা একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে আদ্রিশকে অনুসরণ করল। আদ্রিশ জোর করে ওটির ভেতরে ঢুকে গেল। ডাক্তার, নার্স অপারেশনের ব্যবস্থা করছে৷ আদ্রিশকে দেখে তারা রেগে গেলেন এভাবে ওটিতে প্রবেশ করার জন্য। আদ্রিশ কাউকে পরোয়া না করে কোন বাঁধা না মেনে রুশার কাছে চলে গেল। ওর গালে হাত রেখে কানের কাছে ঠোঁট নাড়িয়ে বলল,
“রুশা, আমাকে শুনতে পাচ্ছো? আমি আদ্রিশ। আমি জানি তুমি আমাকে শুনতে
পাচ্ছো। তোমার বেবি তোমারই থাকবে। ওকে কেউ কেড়ে নিবে না। সব সময় তোমার সাথে থাকবে। আমি চাই তুমি আর আমাদের বেবি সুস্থ ভাবে আমার বাড়িতে প্রবেশ করো। আর কিছু চাই না আমি। তোমার বেবি তোমার সাথে থাকবে আমি প্রমিস করছি। একটু শান্ত হও। আর আমি প্রমিস করলে সেই প্রমিস রাখি তুমি জানো।”

রুশা বন্ধ চোখে ঠোঁট নাড়াচ্ছে। আদ্রিশ উঠে দাঁড়াল। রুশার দিকে আরেকবার তাকাল।

কথা একটা বেঞ্চির উপর বসে আছে। অপেক্ষা করছে বেবির জন্য। অপেক্ষা করছে কখন শুনবে বেবি আর রুশা দুজনেই ভালো আছে। ওর মাথাটা ধরে আছে। কিছুক্ষণ পর পর চোখ মুখ কুকঁড়াচ্ছে। সেজান ওয়ান টাইম গ্লাসে কফি এনে ওর সামনে ধরল। কথা মাথা তুলে স্বাভাবিকভাবেই বলল,
“আমি কফি খাব না সেজান ভাই। ধন্যবাদ।”
তারপর আবার দু-হাত গালে দিয়ে মাথা নিচু করে রইল। সেজান কি করবে বুঝতে পারছে না। কথা ওকে এভাবে ইগ্নোর করছে ওর ভালো লাগছে না। এটা হাসপাতাল আর রুশার এই অবস্থা তাই চুপ করে আছে নয়তো কথাকে দুটো কড়া কথা শুনিয়ে দিত। ওটি থেকে তোয়ালে পেঁচিয়ে একজন নার্স বের হয়ে এল। কথা দৌঁড়ে গিয়ে বাবুকে কোলে তুলে নিল।

নার্স মুচকি হেসে বলল,
“কংগ্রাচুলেশন! আপনার ছেলে হয়েছে। মাশাল্লাহ অনেক সুন্দর।”

সেজান আর কথা বেবিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও আদ্রিশ বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করল,
“আমার স্ত্রী?”

“উনি ঘুমাচ্ছেন। ডাক্তারের সাথে উনার বিষয়ে কথা বলে নিবেন। উনি অনেক দূর্বল। শরীরের কন্ডিশন ভালো না। আমি আসছি।”

“আমি ওকে একটু দেখতে পারি?”

“জি অবশ্যই।”

আদ্রিশ, কথা আর সেজানের দিকে চেয়ে বলল,
“আমার ছেলেকে দেখো। আমি রুশাকে একটু দেখে আসি।”

তারপর জবারের অপেক্ষা না করে আদ্রিশ রুশার সাথে দেখা করতে চলে গেল। রুশা ঘুমাচ্ছে। ধীরে ধীরে আদ্রিশ রুশার কাছে এগিয়ে গেল। ওর কপালে ঠোঁট ছুইয়ে বলল,
“এত বড় লড়াইতে যখন জিতে ফিরেছো তখন তুমি এক তুড়িতে সুস্থ হয়ে যাবে। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ আমার ঘরে রওনক আনার জন্য। আমাদের ছেলেটা নাকি অনেক সুন্দর হয়েছে। এই দেখেছো ওকে তো এখনো দেখিই নি। আমি ওকে দেখে আসি। তুমি তাড়াতাড়ি জেগে যাও।”

আদ্রিশ রুশার গালে হাত ছুইয়ে উঠে দাঁড়াল। গন্তব্য সদ্য জন্ম নেওয়া ছেলেকে ছুয়ে দেখার। আদ্রিশ অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করছে ছেলেকে কোলে নেওয়ার। এত সুন্দর রাজপুত্রকে দেখে ওর চোখে পানি এসে পড়েছে। কোলে নেওয়ার লোভ জেগেছে৷ কিন্তু ওকে কোলেই নিতে পারছে না। ওর ভয় লাগছে। কোলে নিলে যদি ব্যথা পায়। কথা বারবার হেসে কুটিকুটি হচ্ছে আর সেজানের ধমক খাচ্ছে।

রুশাকে বেডে সিফট করা হয়েছে। শুয়ে শুয়ে আদ্রিশকে দেখছে। বাচ্চাকে কোলে নিয়ে আহ্লাদী কন্ঠে কি যেন বলছে। রুশা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কথা ওকে দেখতে ভেতরে এলে রুশা বলল,
“আদ্রিশের আমাকে নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। একবার দেখতেও এলো না।”

কথা অবাক হয়ে বলল,
“কি যে বলো আপু। আদ্রিশ ভাইয়া বাচ্চাকে দেখার আগে, কোলে নেওয়ার আগে তোমার কন্ডিশন জিজ্ঞেস করেছে। তোমার সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে তোমাকে দেখে গেছেন। ডাক্তারের সাথে তোমার শারীরের অবস্থা নিয়ে কথা বলেছেন। আমাকেও এখন এখানে পাঠালো তোমাকে দেখতে। ডাক্তার যখন বলেছে তোমার শরীরের কন্ডিশন ভালো না, তার কলার চেপে ধরেছে। অপারেশনের পুরোটা সময় অস্থির অস্থির করেছে। আর মাত্রই ছেলেকে কোলে নিল। জানো ভাইয়া কি বলে তার বাচ্চাকে কোলে নিতে ভয় লাগে,এত নরম শরীর উনার শক্ত হাতের স্পর্শে যদি ব্যথা পায়। কত সেন্সেটিভ দেখেছো? ছেলেকে খুব আদরে রাখবেন ভাইয়া। ভাইয়া তোমাকে খুব ভালোবাসে আপু।”

চলবে…..