#লাভ_গেম
#ফাবিহা_নওশীন
৩৪.
আদ্রিশ আর সেজান অফিস থেকে ফিরেছে। ওরা মেইন ডোর দিয়ে কথা বলতে বলতে ঢুকছে। রুশা অনুভূতি শূন্য হয়ে উঠে দাঁড়াল। ওর মনে হচ্ছে ভেতরে, বাহিরে কিছু নেই। হাওয়ায় ভাসছে। কিছু ভাবতেও পারছে না। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। দু পা এগিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। আদ্রিশ আর সেজান এগিয়ে আসতে আসতে কথা রুশাকে ধরে বলল,
“আপু কী হয়েছে? কীভাবে পড়লে?”
রুশা কিছু বলল না। কথাকে সরিয়ে নিজেই উঠে দাঁড়াল। কথা, আদ্রিশ, সেজান ওকে অবাক চোখে দেখছে। রুশাকে স্বাভাবিক নয় বিধ্বস্ত লাগছে। ওর কিছু একটা হয়েছে। আদ্রিশ ওর দিকে এগিয়ে এল। রুশা ঘরের দিকে যাচ্ছে আর বিরবির করে একা একাই বলল,
“ভাই ভাইকে কী করে খুন করতে পারে? বাবার মতো ভাইকে খুন করতে হাত কাঁপেনি? ছোট থেকে যে মানুষ করল তাকে মারতে বিবেকে বাঁধেনি? আমি বিশ্বাস করি না। সব মিথ্যা। হ্যা, সব মিথ্যা।”
রুশা সিড়ি দিয়ে উঠে যাচ্ছে। আদ্রিশ এক পলকে ওর দিকে চেয়ে আছে। সেজান কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“ভাই, ভাবি কী বলছেন?”
“যা ভেবেছিলাম তাই। শান প্রকৃত খুনি। আর রুশা তার প্রমাণ পেয়ে গেছে। ও শকে আছে। ছিহ! ভাই হয়ে ভাইকে খুন করল? আর সে দায়ভার আমার উপর চাঁপিয়ে দিল। এক মাত্র বোনকে আমার পেছনে লেলিয়ে দিল। শান রুশাকেও ভালোবাসে না। যদি ভালো বাসত তবে রিক্স নিয়ে আমার কাছে পাঠাতো না। শান খুব ভালো করে চিনে আমাকে। এতগুলো দিন রুশার রাগকে পুঁজি করে আমার বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে। রুশাকে বলেছিলাম আফসোস করতে হবে এখন তাই করছে।”
রুশা দরজা বন্ধ করে দিল। হোঁচট খেয়ে আবারও মেঝেতে পড়ে গেল কিন্তু উঠল না। চিৎকার করে কাঁদছে। ও কিছুতেই মানতে পারছে না। সবকিছু বিষাদ লাগছে। রাগে, কষ্টে দু’হাতে নিজের চুল ধরে টানছে আর কাঁদছে৷ ও হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। দুই হাতের নখ দিয়ে নিজের দুই হাত, গাল আঁচড় কাটছে। ব্যথা, যন্ত্রণা যেন ফুরিয়ে গেছে। গাল, দুই হাত, শরীর খাঁমচে রক্তাক্ত করে ফেলেছে। মেঝেতে দুই হাত দিয়ে ঘুঁষি মারছে। হাত ফেটে রক্ত পড়ছে। ওর চিৎকার করে কান্নার শব্দ নিচে চলে গেছে। রুশা উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের জিনিসটা ছুড়ে মারছে। ওর সবকিছু বিষাক্ত লাগছে। মুক্তি পেতে ইচ্ছে করছে সবকিছু থেকে। ও কিছুতেই মানতে পারছে যে ভাইকে এত ভালোবাসে, বিশ্বাস করে সে আরেক ভাইকে মেরে ফেলেছে। আর ওকে মিথ্যা বলে, নিজের স্বার্থের জন্য ব্যবহার করেছে৷ প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে এতদিন কি কি না করেছে। আদ্রিশ বারবার বলা স্বত্তেও বিশ্বাস করেনি ওকে। ওর সামনে কোন মুখে গিয়ে দাঁড়াবে। রুশা জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। ওর দম বন্ধ হয়ে আসছে। ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে গেছে। হাত থেকে রক্ত ঝড়ছে। এই মুহুর্তে ওর কারো কথা মাথায় আসছে না, কারো কথা ভাবতে পারছে না। পাগলের মতো আচরণ করছে। ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় ডান হাত দিয়ে সজোরে আঘাত করল। ঝনঝন শব্দে কাচের টুকরো নিচে পড়ে গেল।
কিছু ভাঙার শব্দে আদ্রিশ উপরের দিকে তাকাল। অজানা আতঙ্কে বুক কেঁপে উঠে। দৌড়ে সিড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেল। দরজা বন্ধ। ভেতরে থেকে গোঙানির শব্দ আসছে। আদ্রিশ দরজা খোলার অপেক্ষা না করে দরজায় কয়েকটা লাথি মারল। তিন চারবার লাথি মারার পর দরজা খুলে গেল। রুশা চোখে ঝাপসা দেখছে৷ পুরো পৃথিবী দুলছে। হাত, পা, গাল, কপাল, মাথা, গলা বিভিন্ন জায়গা দিয়ে রক্ত ঝড়ছে। আদ্রিশ ওকে দেখে আতংকিত হয়ে তাকাল। রুশা যে নিজের সাথে এমন কিছু করবে ঘূর্ণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি। আদ্রিশ দৌড়ে এসে ওকে ধরতে ধরতে রুশা মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে৷ আদ্রিশ রুশার মাথা তুলে নিয়ে বারবার ওর নাম ধরে ডাকছে। রুশা বন্ধ চোখে বিরবির করে বলছে,
“আমি বাঁচতে চাই না।”
সেজান আর কথাও চলে এসেছে। রুশার অবস্থা দেখে সবাই ভয় পেয়ে গেল। কেউ ভাবতে পারেনি রুশা এমন কিছু করবে। আদ্রিশ রুশাকে বারবার ধাক্কা দিচ্ছে। কিন্তু রুশা চোখ মেলছে।
সেজানের দিকে অসহায় মুখ করে চেয়ে বলল,
“ও চোখ খুলছে না। চোখ কেন খুলছে না? ওর কিছু হলে আমি বাঁচব না।”
তারপর রুশাকে আকুতি মিনতি নিয়ে বলল,
“রুশা, প্লিজ চোখ খোল। তুমি এসব কেন করলে? আমার কথা নাহয় না ভাবলে কিন্তু আর্দ্রের কথা ভাবলে না? তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি কি করব? চোখ খোল প্লিজ।”
“ভাই, ভাবি সেন্স হারিয়ে ফেলেছে। উনাকে হাসপাতালে নিয়ে চলুন।”
সেজান গাড়ি বের করতে চলে গেল। কথাকে আর্দ্রের দায়িত্ব দিয়ে গেল।
আদ্রিশ রুশাকে আঁকড়ে ধরে বসে আছে। ওর অস্থির লাগছে। রুশা নিজের কি অবস্থা করেছে। রুশা নিজের চেহারা বিভৎস করে ফেলেছে আঁচড় দিয়ে। রুশা এমন বিহেভ করবে বুঝতে পারলে ওকে একা ছাড়ত না।গাড়ি চলছে হাসপাতালের দিকে।
.
রুশাকে আরো উদ্ভট লাগছে। ওর গালে, হাতে, গলায়, কপালে, পায়ে ব্যান্ডেজ করা। চোখ মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। কথা আর্দ্রকে নিয়ে হাসপাতালে চলে এসেছে। ও কেঁদেই যাচ্ছে। কথা আর সেজান ওকে সামলাতে পারছে না। আদ্রিশ ডাক্তারের সাথে কথা বলছে।
“উনার মানসিক অবস্থা ভালো না। কোন কারণে মানসিক ভাবে আঘাত পেয়েছে। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি। কাছের মানুষের সাপোর্ট প্রয়োজন। জ্ঞান ফেরার পর উনার সাথে স্বাভাবিক ব্যবহার করতে হবে। বিশেষ করে আপনার সাপোর্ট প্রয়োজন। আমি কিছু ওষুধ লিখে দিচ্ছি।”
“জি, ধন্যবাদ। আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। আপনি আপনার মতো চেষ্টা করুন। ওকে সুস্থ করে তুলুন প্লিজ।”
আদ্রিশ ভেবেছিল যখন রুশা সত্যিটা জানতে পারবে ওর কাছে ক্ষমা চাইবে তখন ওকে খুব সহজে মাফ করবে না। রুশাকেও কষ্ট দিবে, যেমন কষ্ট ও দিয়েছে। কিন্তু এখন সেটা পারছে না। রুশার জন্য এই বিষয়টা মেনে নেওয়া এত সহজ না। ও অনেক বড় আঘাত পেয়েছে। কারণ ভিক্টিম আর খুনি দুজনই ওর ভাই। এক ভাই খুন হয়েছে আরেক ভাই খুন করেছে। কি করে মেনে নিবে? এছাড়া এতদিন রুশাকে ব্যবহার করেছে, ভুল পথে চালিত করেছে, ধোঁকা দিয়েছে সেটাও কম গুরুতর ব্যাপার নয়।
আদ্রিশ রুশার রুমের সামনে গিয়ে দেখে ও পাগলামি করছে। নার্স ওকে সামলাতে পারছে না। ও সবকিছু ভেঙে ফেলছে। আদ্রিশ দৌড়ে ভেতরে ঢুকল। রুশা চিৎকার করছে। আদ্রিশ ওকে ঝাপটে ধরল। রুশা কিছুক্ষণ ছটফট করে থেমে গেল। আদ্রিশের বলিষ্ঠ শরীরের সাথে পেরে উঠেনি।
“রুশা, শান্ত হও। এমন করছো কেন? কেন এমন করছো?”
রুশা হেঁচকি তুলতে তুলতে বলল,
“আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি মুক্তি চাই। বাঁচতে চাই না।”
“আমাকে ছেড়ে চলে যেতে চাও? আর আর্দ্র ওর কথা ভাবলে না? বাচ্চা একটা ছেলে মা ছাড়া কি করে বড় হবে?”
রুশা মাথায় হাত দিয়ে বলল,
“আমি কারো কথা ভাবতে পারছি না। পারছি না আমি। আমার বুকের ভেতরে খুব যন্ত্রণা হচ্ছে।”
“আমি আছি তো। আমি আছি তোমার সাথে। সব এক সাথে মোকাবিলা করব।”
“আমি কোন মুখে তোমার কাছে ক্ষমা চাইব? অনেক অন্যায় করেছি তোমার সাথে। অনেক ক্ষতি করেছি তোমার, ভুল বুঝে এসেছি এতগুলো দিন। কী করেছি আমি এতগুলো দিন? নিজের উপর ঘৃণা হচ্ছে। আমার এক ভাই আরেক ভাইকে মেরেছে।”
রুশা আবারও কাঁদছে। কথা আর্দ্রকে নিয়ে ভেতরে এলো। আর্দ্র কাঁদছে। কথা ওকে সামলাতে পারছে না। আদ্রিশ রুশাকে নিজের বুক থেকে তুলে বলল,
“আর্দ্র অনেকক্ষণ ধরে কাঁদছে। তুমি একজন মা। তোমাকে আরো শক্ত হতে হবে। ওকে একটু নেও। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে গেছে।”
রুশা কাঁদতে কাঁদতে আর্দ্রকে কোলে নিল। কোলে নিয়েও কাঁদছে।
চলবে……
#লাভ_গেম
#ফাবিহা_নওশীন
৩৫.
রুশা ব্যান্ডেজ করা শরীর নিয়ে বিবর্ণ মুখে শুয়ে শুয়ে আর্দ্রকে ঘুম পাড়াচ্ছে। রুশা এতটাই বেখেয়ালি যে আর্দ্র ঘুমিয়ে পড়েছে সেদিকেও খেয়াল নেই। একমনে কিছু ভেবে চলেছে আর আর্দ্রের গায়ে হাত দিয়ে ছোট ছোট করে ছুয়ে দিচ্ছে ঘুম পাড়ানোর জন্য। আদ্রিশ ঘরে এসে এভাবে রুশাকে দেখে ওর সামনে গিয়ে বলল,
“রুশা!”
রুশা ভাবনা থেকে বের হয়ে হকচকিয়ে আদ্রিশের দিকে চেয়ে বলল,
“হু।”
আদ্রিশ আর্দ্রের দিকে ইশারা করে বলল,
“ঘুমিয়ে পড়েছে।”
রুশা আর্দ্রের দিকে চেয়ে দেখে ও ঘুমে বিভোর। রুশা উঠে সোজা হয়ে বসে। আদ্রিশ ওকে আবারও বলল,
“এদিকে এসো কথা আছে।”
রুশা বিছানা থেকে নেমে আদ্রিশের পেছনে পেছনে গেল।
আদ্রিশ দাঁড়িয়ে গেলে রুশাও দাঁড়িয়ে গেল।
আদ্রিশ ওর কাঁধে হাত রেখে বলল,
“কী হয়েছে তোমার?”
রুশা চোখের পানি ছেড়ে দিল। তারপর বলতে লাগল,
“নিজের ভাইকে বিশ্বাস করা কী ভুল? যাদের ছায়ায় বড় হয়েছি তাদের কী করে অবিশ্বাস করি? সাজ্জাদ ভাইয়া শুধু ভাই নয়, বাবা আর বন্ধুও ছিল। দিন শেষে আমরা এক সাথে হয়ে কত আড্ডা দিয়েছি। স্কুলে, কলেজে, ভাইয়ার অফিসে কী হয়েছে সব আমরা একে অপরের সাথে শেয়ার করেছি। এমনকি নিজেদের সিক্রেটগুলোও। কোন ছেলে প্রপোজ করেছে, কিভাবে রিজেক্ট করেছি, শান ভাইয়া কোন মেয়ের সাথে ফ্লার্ট করেছে সবকিছু বলত। শান ভাইয়াকে দেখেছি সব সময় সাজ্জাদ ভাইয়াকে সম্মান করতে, ভাইয়ার কাছ থেকে সব বিষয়ে পরামর্শ নিত, ভাইয়াকে সব সময় মান্য করত। আর সব সময় বলত সাজ্জাদ ভাইয়া আমাদের মাথার উপরের ছায়া। তার হাত যদি কখনো মাথার উপর থেকে সরে যায় তবে বাঁচা কঠিন হয়ে যাবে। ভাইয়া আমাদের জন্য যা করেছে তার ঋণ কখনো শোধ করার নয়। শান ভাইয়া তো সাজ্জাদ ভাইয়াকে ছাড়া চলতেই পারত না। আর আমি ছিলাম তাদের দুজনের চোখের মনি। সেই শান ভাইয়াকে আমি কী করে অবিশ্বাস করব? কেন করল এমন? শান ভাইয়া আমাদের কাউকে ভালোবাসেনি। সাজ্জাদ ভাইয়াকেও না আর আমাকেও না। যদি আমাকে ভালোবাসত তবে কিছুতেই আমার ব্রেইন ওয়াশ করত না। আমাকে উস্কাতো না তোমার লাইফে আসার জন্য। কারণ তুমি আমার সাথে কি করতে পারো তার আইডিয়া তো তার আছে। শান ভাইয়া জানত আমি কতটা জেদি। সে আমার জেদকেই পুঁজি করেছে। যখন বলেছে তুমি ভাইয়াকে খুন করেছো তখন আমার মাথায় আগুন জ্বলছিল। শোকে, রাগে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। তারপর আমি ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিলাম আমার ভাইয়ার মতো সহজ, সরল মানুষকে মারার জন্য আমিও ভয়ানক প্রতিশোধ নেব। তারপর তাই করলাম? রক্তের সম্পর্কের ভাইকে বিশ্বাস করা কি খুব দোষের? আমি কি করতাম?”
আদ্রিশ রুশার দুই হাত নিজের হাতে নিয়ে বলল,
“দোষ তোমার নয়। তুমি সম্পর্কের মূল্য দিতে জানো। তাদের বিশ্বাস করো, ভালোবাসো। তবে বর্তমান দুনিয়ায় নিজের স্বার্থ ছাড়া কেউ কিছু বুঝে না সেক্ষেত্রে আমাদের সাবধান হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু তুমি কী করে শিওর হলে শান খুনি? আমার ওকে ডাউট হয়েছিল কিন্তু এতটাও শিওর ছিলাম না।”
রুশা চোখ বন্ধ করে আবারও কাঁদতে লাগল। তারপর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চোখের পানি মুছল।
“আমি সেদিন ভাইয়ার ল্যাপটপে আজগর আলী নামে একজনকে পাই। সেখানে তোমার ছবি, এড্রেস আর কিছু ডিটেইলস দেওয়া ছিল। আর ছোট একটা বার্তা ছিল, এমন যে ‘আরেকটা মার্ডার করতে হবে সেম ওয়ে। সময় আমি বলে দেব।’ তোমাকে মারার কন্ট্রাক্ট দেখে আমি ভয় পেয়ে গেলেও অবাক হয়নি। কেননা আমি জানি শান ভাইয়া তোমাকে মারতে চায়। কারণ আমিও জানতাম তুমি সাজ্জাদ ভাইয়ার খুনি। শান ভাইয়া সে হিসেবে নিজের প্রাণপ্রিয় ভাইয়ের খুনির শাস্তি চাইবে স্বাভাবিক। কিন্তু আমার সমস্যা সৃষ্টি হয় আরেকটা শব্দটাতে। এই ‘আরেকটা’ শব্দ আমার মন, মস্তিষ্কে এমন ভাবে গেঁথে যায় যে কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিলাম না। কেমন অস্থির অস্থির লাগছিল। অনেক প্রশ্ন ঘুরছিল মাথায়। এর আগেও শান ভাইয়া কারো মার্ডার করিয়েছে কিন্তু কাকে? আর তাছাড়া আমি শান ভাইয়াকে যতটুকু চিনি খুনখারাবি করার মানুষ সে নয়। সাজ্জাদ ভাইয়া রাজনীতি করত, যে বাবাকে মেরেছিল চাইলে নিজের পাওয়ারের খাতিরে তাকে মেরে গুম করে দিতে পারত কিন্তু তেমন কিছু করেনি। যে পজিশনের জন্য, যে পাওয়ারের জন্য বাবাকে মেরেছিল তা কেড়ে নিয়েছিল এটাও সৎভাবে করেছিল। তার একটাই কথা কেউ অমানুষের মতো আচরণ করলে তার বিপরীতে অমানুষ হতে নেই। খুনের বদলা খুন হতে পারে না। বাবার দেওয়া শিক্ষা এমন ছিল না। সেখানে শান ভাইয়া কাকে মারতে পারে।
এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমি তোমাকে না জানিয়ে শান ভাইয়ার কাছে গিয়েছিলাম। তার মোবাইল নিয়ে আজগর আলীর নাম্বার সার্চ করি। পেয়েও যাই। ডিটেইলস চেক করে জানতে পারি গতকালও তার সাথে কথা হয়েছে। আমি তারপর কল রেকর্ডিং চেক করি। ভাইয়ার মোবাইলে সব সময় দেখতাম অটো কল রেকর্ড হয়ে থাকত। আমি সেখানে রেকর্ডিং চেক করি।”
রুশা আবারও কাঁদতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“অন করে আমি ওদের কথোপকথন শুনি। এক পর্যায়ে ওই লোকটা বলছে টেনশন করবেন না। কেউ ঘূর্নাক্ষরেও টের পাবে না এটা মার্ডার। এই মার্ডারকে কার এক্সিডেন্ট বলে চালিয়ে দেব আগের বারের মতো। আগের বার কেউ বুঝেনি এইবারও বুঝতে পারবে না। কেউ আপনার দিকে ভুলেও আঙুল তুলবে না। ওই দুজনের মতো আদ্রিশকেও কার এক্সিডেন্টে মেরে ফেলব। আপনি শুধু ডেট বলুন। আর হ্যা ভাই প্রায় দুই বছর আগে যে টাকা দিয়েছেন তাতে কিন্তু হবে না। এইবার আরো বেশি লাগবে। ওই দুজন আর কার এক্সিডেন্টের কথা শুনে আমার মাথায় ভাই, ভাবির কার এক্সিডেন্টের কথাই মাথায় এসেছে। কারণ তাদেরকেও কার এক্সিডেন্টে মারা হয়েছে। আমি আর এক মুহুর্ত ওখানে দাঁড়াতে পারছিলাম না। এসেই ল্যাপটপ খুলে সাজ্জাদ ভাইয়ার মৃত্যুর তারিখের আগে পরে ওদের মধ্যে কোনো যোগাযোগ হয়েছে কি না সেটা খুঁজতে লাগলাম। খুঁজতে খুঁজতে পেয়েও গেলাম। ওদের মধ্যে অনেকদিনের পুরনো সম্পর্ক। মৃত্যুর আগের তারিখ গুলোর কিছু মেসেজ ডিলিট করা ছিল। হয়তো প্রমাণ রাখতে চায়নি। ভাইয়ার মৃত্যুর আগের দিন মেসেজ করে জানিয়েছে ভাইয়া আর ভাবি কোথায় যাচ্ছে আগামীকাল, কখন যাচ্ছে। ওরা ভাবিকেও ছাড় দেয়নি। ছোট বাচ্চাটা…”
রুশা কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ল। আদ্রিশের বাবাও কাছের মানুষের কাছে ধোঁকা খেয়েছে। কাছের মানুষ স্বার্থের জন্য তাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে বাবার ঝুলানো লাশটা। হঠাৎ পায়ে রুশার স্পর্শ পেল। রুশা ওর পা ধরে বলছে,
“আমাকে মাফ করে দেও। আমি তোমার সাথে অনেক অন্যায় করেছি। তোমার ইমোশনের সাথে খেলেছি। দেড় বছরের দাম্পত্য জীবন নষ্ট করে দিয়েছি। আমি তোমাকে বিশ্বাস করিনি। আমাকে মাফ করে দেও।”
আদ্রিশ ওর দুইহাত পা থেকে সরিয়ে বলল,
“কী করছো? আমি তোমাকে মাফ করে দিয়েছি। তোমার প্রতি আমার কোন রাগ নেই।
আসলে আমি তোমাকে একটু বেশিই ভালোবেসে ফেলেছি। তাই আমার সাথে করা অন্যায়ের পরেও তোমার প্রতি আমার অভিযোগ নেই। তোমাকে আর আর্দ্রকে নিয়ে আমি একটা পৃথিবী গড়তে চাই। আমার পৃথিবী।”
আদ্রিশ রুশাকে জড়িয়ে ধরল। রুশাও পরম নির্ভরতার আশ্রয়ে ওর বুকে মাথা রাখল।
“আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি। সাজ্জাদ ভাইয়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ আমি নেব। যে তোমার আবেগ নিয়ে খেলেছে, নিজের স্বার্থে তোমাকে ব্যবহার করেছে তাকে তার শাস্তি দেব। এতবড় ধোঁকার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ছাড়া আর কিছু হতে পারে না।”
একদিন পর আদ্রিশ অনেক চেষ্টার পর আজগর আলীকে ধরতে সক্ষম হয়। কিন্তু সে কিছুতেই মুখ খুলছে না। আদ্রিশ অবশেষে বাধ্য হয়ে ওর উপর নির্মম অত্যাচার করে সব স্বীকার করিয়ে নিয়েছে। এতে করে ওরা সবটা শিওর হয়। পুরো দুনিয়ার কাছে শানকে অপরাধী প্রমাণিত করা যাবে। তার আগে রুশা কথা বলবে শানের সাথে। জবাব চাইবে কেন এমন করল। আদ্রিশ আর রুশা এক সাথে শানের বাড়িতে গেল। প্রথমে আদ্রিশ ঢুকল। শান ড্রয়িংরুমে আদ্রিশকে পায়ের উপর পা তুলে বসে থাকতে দেখে রাগে জ্বলে উঠল।
“তুই? তোর সাহস হলো কী করে আমার বাড়িতে আসার?”
আদ্রিশ মুচকি হাসল তারপর বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“শুনলাম তুই নাকি আমাকে মারার জন্য খুঁজছিস? তাই নিজেই চলে এলাম।”
শান ওর কথা শুনে চমকে উঠে। ওকে মারার কন্ট্রাক্ট করলেও প্রসেস এখনো শুরু হয়নি। তাহলে আদ্রিশ কি করে জানল। চিন্তায় ওর কপালে ভাজ পড়ে গেল। আদ্রিশ ওর সামনে চুটকি বাজাল।
শান বিরক্ত হয়ে বলল,
“আজেবাজে কথা না বলে বের হয়ে যা।”
“আরে রিলেক্স সমস্যা কী? আমি তোর বড় ভাইয়ের খুনি আমাকে মারতে চাইতেই পারিস। আমি হলেও মারতাম। স্বীকার করতে ভয় পাচ্ছিস কেন?”
“হ্যা, তোকে আমি মারব। তোকে আমি মেরে পুঁতে দেব।”
আদ্রিশ কঠিন গলায় বলল,
“কিন্তু কেন? সাজ্জাদ চৌধুরীকে তো তুই মেরেছিস। তাহলে আমার উপর কীসের প্রতিশোধ নিবি?”
শান ওর কথা শুনে ঘাবড়ে গেল। ওর কপালে চিকন ঘামের রেখা দেখা দিয়েছে।
“আমার ভাইকে আমি মারব কেন? কেন মারব? তুই বললেই হয়ে যাবে না।”।
আদ্রিশ আলতোভাবে হাসল। তারপর বলল,
“তোর ওই আজগর আলী আমার কাছে। আর তোর সত্যটা কে বের করেছে জানিস? তোরই বোন পিউ চৌধুরী।”
শান এতক্ষণ তেমন ভয় না পেলেও রুশার কথা শুনে ভয় পেয়ে ওর দিকে স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইল। রুশা তখন ওর সামনে এসে ছলছল চোখে, বিমর্ষ মুখে বলল,
“কেন ভাইয়া? সাজ্জাদ ভাইয়া কী দোষ করেছিল? কেন করলে? ভাই হয়ে ভাইয়ের রক্ত ঝড়ালে কী করে?”
শান রুশার সামনে এসে অসহায় মুখ করে বলল,
“এই আদ্রিশ তোকে ভুল বুঝিয়েছে। আমার বড় ভাই, আমার বাবার মতো বড় ভাইকে আমি কেন মারব? তুই জানিস না ভাইয়াকে আমি কত ভালোবাসি?”
“ব্যাস ভাইয়া! আর নাটক করো না। ভালোবাসা না ওসব তোমার নাটক ছিল। তুমি আমাকে, সাজ্জাদ ভাইয়া কাউকেই ভালোবাসোনি। সব সময় অভিনয় করেছো। ভাইয়াকে কেন মারলে?”
“পিউ, আমার কথা… ”
“শাট আপ! আর মিথ্যা বলো না। সব প্রমাণ আছে আমার কাছে। আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারিনি। যে ভাইকে ফেরেশতার মতো জানতাম সে নিজের স্বার্থের জন্য নিজের বড় ভাইকে খুন করল? ছোট বোনকে মিথ্যা বলে অন্য একটা ছেলেকে বিয়ে করতে বাধ্য করল? জানতো সেই ছেলে ওর বোনকে খুন করে ফেলতে পারে। তবুও তার রাগ, জেদ, বড় ভাইয়ের প্রতি বিশ্বাস, ছোট ভাইয়ের প্রতি অগাধ বিশ্বাসকে ব্যবহার করল। কিন্তু কেন? জবাব চাই আমার?”
রুশা রাগে চিৎকার করছে, কাঁপছে থরথর করে।
শান বুঝতে পারছে না রুশা এতটা শিওর কিভাবে।
“পিউ, তোর ভুল হচ্ছে কোথাও।”
“না ভাইয়া। ভাইয়া? তুমি তো ভাইয়া বলার লায়েক নও। তোমাকে ভাইয়া বলা যায় না৷ খুনি বলা যায়। আমি তোমার ল্যাপটপ হ্যাক করেছি, তোমার মোবাইল ব্যবহার করে সব জানতে পেরে গেছি আর নাটক করো না।”
শানের পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে যাচ্ছে। পিউ তাহলে সব জেনে গেছে। এখন তাহলে উপায় কি বাঁচার। কি করে পিউকে বুঝাবে। পিউ যদি ভালোয় ভালোয় না বুঝে তবে ওকেও আদ্রিশের সাথে মেরে ফেলবে।
শান নিজেকে মনে মনে বুঝিয়ে বলল,
“আমি কিছু বুঝে করিনি পিউ। বিশ্বাস কর। কি করতে কি করে ফেলেছি। কি করতাম বল। ভাইয়া অতিরিক্ত নীতিবান ছিল। বাবার খুনিকেও ছেড়ে দিল। কিছু বলল না। আমি তাকে মারার চেষ্টা করলাম বলে আমাকে থাপ্পড় মেরে দিল। ভাইয়া রাজনীতি করত, অনেক দলবল ছিল তার। কিন্তু তাদের ব্যবহার করত না। আরে ক্ষমতা যদি না দেখাই তাহলে কেউ দাম দিবে? ভয় পাবে আমাদের? আমার সব কিছুতেই তার সমস্যা। ব্যবসায়ের দায়িত্ব আমার অথচ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। সবকিছু তাকে জিজ্ঞেস করে করতে হবে। আমার কোন অস্তিত্বই নেই। যতদিন তার ব্যবসা, তার দুনিয়া থেকে দূরে ছিলাম ততদিন আমাকে ভালোবাসত। তারপর যখন সবকিছুতে হস্তক্ষেপ করেছি তখনই তার চোখের বালি হয়ে গেলাম। আসলে ভাইয়া আমাদের ভালোবাসা দেখাত কিন্তু সম্পত্তি, ব্যবসা সবকিছুতে তার একার হস্তক্ষেপ পছন্দ করত। দেখা যেত দুদিন পর আমাকেই তার রাস্তা থেকে সরিয়ে দিত৷ তাই ভয়ে ঝুঁকের বশে আমি এই কাজটা করে ফেলেছি।”
রুশা রাগে শরীর কাঁপছে। মাথায় যেন ধপ করে আগুন জ্বলে উঠল। চিৎকার করে বলল,
“লেম এক্সকিউজ। তুমি সম্পত্তি, ব্যবসায়ে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করার জন্য বড় ভাইকে মেরে দিলে? এত লোভ তোমার? ছোট একটা বাচ্চাকেও মেরে ফেললে? তুমি মানুষ নয় রাক্ষস একটা। বড় ভাইকে খেয়ে ফেলেছো। নর্দমার কিট, খুনি যার শাস্তি একমাত্র ফাঁসি। পুরো দুনিয়ার কাছে তোমার আসল রুপ দেখাব৷ জানোয়ার একটা।”
রুশা প্রচন্ড রেগে গেছে।
শান রুশার দিকে তেড়ে এলে আদ্রিশ রিভলবার বের করল।
চলবে…