শরতের এক সাঁঝবেলায় পর্ব-০২

0
714

#শরতের_এক_সাঁঝবেলায়
#পর্বঃ০২
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি

” আপনার পায়ে কি কোন সম’স্যা আছে?আপনি কি হাঁটতে পারেন না?” কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলো পালক।প্রতিউওরে যুবকটি শুধু হালকা হাসলো।যুবকটির ভাব দেখে পালকের বুঝতে বাকি রইলো না যে সে আসলেই হাঁটতে পারে না।এটা বুঝতে পেরেই পালক মনে মনে নিজেকে ধি’ক্কার জানালো।

” ছিঃ পালক না জেনে তুই কত কিছু বলেছিস।তোর উচিত হয়নি এরকমটা বলা।”

আশেপাশে চোখ বুলিয়ে পালক দেখতে পেলে কিছুটা দূরে একটা উইলচেয়ার উলটে পড়ে আছে।দ্রুত পায়ে সেটা নিয়ে এসে যুবকটির সামনে রাখলো।তার থেকেও যুবকটি স্বাস্থ্যবান,একটু কষ্ট হলেও পালক তাকে উইলচেয়ারে বসতে সাহায্য করলো।

” আপনি ঠিক আছেন?আর এই রকম পরিস্থিতিতে আপনি একা কেন?সাথে কেউ নেই?”

” আমার ফোনটা একটু তুলে দেবেন।” বিনীত কন্ঠে বললো যুবকটি।

পালা তাড়াতাড়ি নিচে থেকে ফোনটা তুলে তাকে দিলো।নম্বর ডায়াল করে কাউকে ফোন দিলো সে।

” আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।আজ আপনি না হলে অনেক বড় বিপ’দে পড়তাম।”

” এটা আমার দায়িত্ব।কিন্তু আপনি একা কেন?”

যুবকটি কিছু বলবে তার আগেই একটা লোক কোথাও থেকে যেন ছুটে এলো।

” স্যার আপনি ঠিক আছে তো?”

” হুম আমি ঠিক আছি।গাড়ি কি ঠিক হয়েছে?”

” জ্বি স্যার আমি এখুনি নিয়ে আসছি।”

লোকটি আবারো দৌড়ে চলে গেলো এবং কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই একটা গাড়ি নিয়ে হাজির হলো।লোকটি গাড়ি থেকে দ্রুত নেমে যুবকটিকে উইলচেয়ার থেকে গাড়িতে বসতে সাহায্য করলো।পালক চিন্তায় পড়ে গেলো তার কি যাওয়া উচিত।কিছুক্ষণ ভেবে সেও যুবকটির পাশে বসে পড়লো।এতে যুবকটি খানিকটা চমকে গেলো।

” আপনাকে এখন হসপিটালে হওয়া প্রয়োজন।আর উনি একা পারবেন না।তাই আমার যাওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।”

লোকটির দ্রুত গাড়ি ছুটিয়ে হসপিটালে এসে পৌঁছালো।লোকটি এবং হসপিটালের একজন ওয়ার্ড বয় মিলে যুবকটিকে উইলচেয়ারে করে ডাক্তারের কেবিনে নিয়ে গেলো।সে হাতে অনেক চোট পেয়ে,রাস্তায় পড়ার কারণে কনুইয়ের কাছে শার্টটা ছিড়ে গিয়েছে পুরো।বাম হাতের কনুইয়ের দিকে চামড়া ছিড়ে অনেকখানি রক্ত বের হচ্ছে।

পালক ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো অনেকখানি দেরি হয়ে গিয়েছে,তাকে এখন বাসায় যেতেই হবে।পালক নিজের পার্স চেক করে দেখলো তাতে ১ হাজার টাকার তিনটে নোট আছে।যুবকটির সাথে থাকা লোকটিকে পালক একটা হাজার টাকার নোট দিলো,সেইসাথে নিজের ফোন নম্বরটাও দিলো এবং বললো হসপিটালে কোন সমস্যা হলে যেন তাকে ফোন করে।

বাড়ির সামনে পৌঁছে পালক হাঁপাচ্ছে।একপ্রকার দৌড়েই সে বাড়িতে এসেছে।একবার বেল বাজাতেই দরজা খুলে গেলো।

” এতো দেরি কেন হলো?” শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো প্রিসা।

” আর বলোনা আপু অনেক ঘটনা।মা কোথায়?”

দরজা বন্ধ করতে করতে হতাশার স্বরে প্রিসা উওর দিলো, ” আর কোথায় থাকবে।তোমার চিন্তায় অস্থির হয়ে যাচ্ছে।”

” আমি এখুনি ফ্রেশ হয়ে আসছি।তুমি ততক্ষণে খাবার সাজাও তারপর বলবো ঘটনা।”

পালক দ্রুত জামাকাপড় বদলে মুখ হাত ধুয়ে নিলো।তারপর দ্রুত পায়ে মায়ের রুমে গেলো।

” এবার বল কি এমন হয়েছে যে তোর এতটা দেরি হলো?”

পালক ধীরে সুস্থে পুরো ঘটনাটা বললো।পালকের কথা শুনে তার মা ভিষণ ভয় পেয়ে গেলেন।

” কেন শুধু শুধু ঝা’মে’লা করতে গেলি?তোর যদি কিছু হয়ে যেতো তখন?তোকে কতবার বলেছি ওতো দূরে যেতে হবে না।কাছে কোথাও টিউশন করা কিন্তু আমার কথা কে শোনে।তোরা জানিস না,তোদের ছাড়া আমার আর কেউ নেই।তোদের কোন ক্ষ’তি হলে আমি কি নিয়ে বাঁচবো।”

” মা তুমি কেন এতো চিন্তা করছো?আমরা মেয়ে বলেই কি এতো চিন্তা তোমার?আমরা ছেলে হলেও কি এই কথাটা বলতে?”

” আমি কখনোই ছেলে মেয়ের মধ্যে পাথর্ক্য করি না।তোরাই আমার ছেলে,তোরাই আমার মেয়ে।কিন্তু মারে এটা মায়ের মন,সন্তানের জন্য তার চিন্তা সবসময় থাকে।”

” মা আমি জানি তুমি আমাদের নিয়ে সবসময় চিন্তায় থাকো কিন্তু তুমি এটাও একবার ভেবে দেখো ছেলেটার পায়ে সমস্যা,সে উইলচেয়ার ব্যবহার করে।সে সুস্থ হলে আমাকে সাহায্য করতে হতো না কিন্তু সে তো দুর্বল মা।আমি কিভাবে তাকে এড়িয়ে চলে আসতে পারি?তুমিই তো শিখিয়েছিলে বিপ’দগ্র’স্ত মানুষকে সাহায্য করতে।”

” আচ্ছা অনেক হয়েছে।এবার তোমরা খাও তো।অনেক রাত হয়ে গিয়েছে।”

তাদের মধ্যে কিছুক্ষণ নীরবতা থাকলেও অনিলা শেখ এর কথা শুনে তাদের দু’বোনের খাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো।

” তোদের তো বলতেই ভুলে গিয়েছিলাম আজকে বিকেলে অয়ন এসেছিলো।তোদের দু’জনকে কত খুঁজেছে কিন্তু তখন তো তোরা কেউ ছিলিনা।”

” কেন এসেছিলো অয়ন ভাই?ওনার এখানে কি কাজ?” গম্ভীর কন্ঠে বললো পালক।

” পরশু দিন অয়ন আর দীপ্তির রিসেপশন।তার দাওয়াত দিতেই এসেছে।”

” কিন্তু মামা না বললো আর কোন অনুষ্ঠান হবে না?” ভ্রু-কুচকে জিজ্ঞেস করলো পালক।

” কি জানি।হয়তো রাদিয়া মানিয়ে নিয়েছে।পরশু তৈরি থাকিস কিন্তু।”

অনিলা শেখ খালি প্লেটটা নিয়ে উঠে গেলেন।পালক প্রিসার দিকে তাকালো।সে নিজের মতো প্লেটের দিকে তাকিয়ে খেয়েই যাচ্ছে।যেহেতু প্রিসা কিছু বললো না তাই পালকও চুপ করে রইলো।কি দরকার কথা বাড়িয়ে তার কষ্টটা আরো বাড়ানোর।

পরেরদিন সকালে পালক হসপিটালেরে যুবকটির সাথে দেখা করতে এসেছে।লোকটি তাকে ফোন করে জানিয়েছে যুবকটিকে ডাক্তার হসপিটালে থাকতে বলছে।

কেবিনের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই দেখতে পেলো যুবকটির পাশে তার বয়সী একটা ছেলে বসে আছে।কিছু নিয়ে কথা বলছে তারা দু’জন।

” আমি কি ভেতরে আসতে পারি?”

পালকের কথায় দু’জনেই দরজার দিকে তাকালো।পালককে দেখে যুবকটি হাসি মুখে তাকে ভেতরে আসার আহ্বান জানালো।ভেতরে প্রবেশ করেই পালক একবার রুমটাতে চোখ বুলিয়ে নিলো।উইলচেয়ারটা ভাজ করে রুমের এককোণে রাখা হয়েছে।

” ইয়াসিন তুমি একটু বাইরে যাও।”

ছেলেটি উঠে চলে গেলে যুবকটি তাকে বসার অনুরোধ করলো।

” কেমন আছেন এখন?হাতের কনুইতে নাকি সে’লাই করা হয়েছে?”

” হুম তা তো করা হয়েছে।আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।আপনি না থাকলে আরো বড় কিছু হতে পারতো।”

” এতো ধন্যবাদ দিয়ে আমাকে লজ্জায় ফেলবেন না।এটা আমার একপ্রকার দায়িত্ব ছিলো।ডাক্তার কখন ছেড়ে দেবে বলেছেন?”

” আজকে বিকেলের মধ্যেই ছেড়ে দেবে।”

” আপনার পা কেমন আছে?ভালো আছে তো?”

” আমার পা দুটোতে তো কোন অনুভূতিই নেই।তাই কি করে বলি যে কেমন আছে।” হেসেই উওর দিলো যুবকটি।কিন্তু তার এই হাসির পেছনে যে কতটা ক’ষ্ট লুকিয়ে আছে সেটা পালক কিছুটা হলেও বুঝতে পারছে।কথা ঘুরানোর জন্য যুবকটি বললো,

” আপনার নামটাই তো জিজ্ঞেস করা হয়নি।”

” পালক আমার নাম।”

” মুরগীর পালক নাকি কবুতরের?” দুষ্টমি করে বললো যুবকটি।তবে তার কথায় পালকের মুখের ভাব মোটেও পরিবর্তন হলো না।কারণ ছোট থেকে সে এধরণের কথায় অভ্যস্ত।পালককে কোন রকমের রিয়েক্ট করতে না থেকে যুবকটির মুখের হাসি চলে গেলো।

” আপনি কি আমার কথায় কিছু মনে করেছেন?আমি সত্যিই দুঃখিত।আমি শুধু একটু মজা করেই কথাটা বলেছে।আমি বুঝতে পারিনি আপনি এতে কষ্ট পাবেন।”

” না আমি কিছু মনে করিনি।ছোট থেকে এধরণের কথা শুনতে শুনতো অভ্যস্ত আমি।ছাড়ুন এসব।আপনার নাম কি?”

” ফারিদ রহমান রাদ।আপনার নাম কি শুধুই পালক?আমার নামটা কত বড়,আর আপনারটা কত ছোট।এর আগে পিছে ডানে বামে উপরে নিচে কি কিছুই নেই?”

” ঈপ্সিতা পালক।”

বালিশে আলতো করে মাথাটা রেখে মুচকি হাসলো রাদ।
___________________________________________

প্রিসা এবং পালক দু’জনেই ঘরকুনো হওয়ায় কোন অনুষ্ঠানে যেতে তারা প্রায় সময় অনিচ্ছা প্রকাশ করে।তাদের মা অন্যসময় কিছু না বললেও এবার তাদের জোড় করলেন কারণ এটা বলতে গেলে একটা পারিবারিক অনুষ্ঠান।অনিচ্ছা সত্ত্বেও পালক অয়নের রিসেশনে এসেছে।

অয়ন আর দীপ্তি হাসিখুশি ভাবে বিভিন্ন ভাবে ছবি তুলছে।তাদের মুখ থেকে যেন হাসিটা সরছেই না।অয়ন তো খুব খুশি।তার হাসি দেখে মনে হচ্ছে বর্তমানে সেই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ।কিন্তু এই মানুষটাই যে আরেকজনের মুখের হাসিটা কেঁড়ে নিয়েছে।অয়ন আর দীপ্তির বন্ধুত্ব ভার্সিটি থেকে।সম্পর্কে অয়ন প্রিসার মেজো মামার বড় ছেলে,তার থেকে দু’বছরের বড়।

মায়ের জোড়াজুড়িতে প্রিসা উপহারটা নিয়ে স্টেজে উঠলো।এতোক্ষণ অয়নের মুখে হাসি তো ছিলোই তবে এখন তা আরো চওড়া হলো।

” আরে প্রিসা রাণী যে।এসো এসো।তোমারই অপেক্ষা করছিলাম।এতো দেরি করলে কেন বলো তো?বয়ফ্রেন্ড বুঝি আসতে দিচ্ছিলো না।” কথাটা বলেই সজোরে হেসে উঠলো অয়ন যেন অনেক মজার কিছু বলেছে সে।হাসি থামিয়ে সে আবারো বললো,

” দেখো তো আমাদের কেমন লাগছে?আমার বউটাকে অনেক সুন্দর লাগছে তাই না?অবশ্য সৌন্দর্যের তুমি কি বুঝবে।তুমি কি আর এতোসব বোঝ নাকি।তুমি তো সেই আদিকালের গ্রামের মেয়েদের মতো ভু’ত সেজে ঘুরে বেড়াও।হাহাহা….।শোন প্রিসা দীপ্তি না খুব ভালো মেকাপ জানে,তার ড্রেস চেন্স খুবই ভালো।তুমি বরং সপ্তাহে একদিন করে এসে দীপ্তি থেকে ট্রেনিং নিয়ে যেও।টাকা পয়সা নিয়ে একদম চিন্তা করো না।দীপ্তির টাকার অভাব নেই,সে তোমাকে ফ্রীতেই শিখিয়ে দেবে।”

অয়নের কথায় প্রিসা বেশ অপমানিত বোধ করলো।তার বুঝতে অসুবিধা হলো না অয়ন তাকে সবার সামনে অপমান করছে।উপহারটা দীপ্তির হাতে দিয়ে চলে আসতে চাইলে পেছন থেকে অয়ন তার হাত টেনে ধরলো।রাগে,ঘৃণায় প্রিসার ঘা কেঁপে উঠলো।রেগে প্রিসা পেছন ফিরে তাকালো।প্রিসার রেগে যাওয়া দেখেও অয়ন হাতটা ছাড়লো না,বরং সে খুশি হলো।

” হাত ধরেছেন কেন অয়ন ভাই?” গম্ভীর এবং রাগী কন্ঠে বললো প্রিসা।

” আরে প্রিসারাণী তুমি চলে যাচ্ছো কেন?বসো বসো ছবি তুলবো তো তোমার সাথে।”

” আমি কোন ধরণের ছবি তুলতে আগ্রহী নয়।হাতটা ছাড়ুন।”

অয়ন প্রিসার কোন কথা শুনলো না।জোড় করে তাকে নিজের পাশে বসালো।না চাইছেও প্রিসা জোড় করে মুখে হাসি ভাব আনলো।

” নিশ্চয়ই কত স্বপ্ন দেখেছো আমাকে নিয়ে।সেদিন যদি আমাকে ফিরিয়ে না দিয়ে তাহলে হয়তো দীপ্তির জায়গায় তুমি থাকতে,হয়তো কিন্তু।কিন্তু কিন্তু ফিরিয়ে দিয়ে একদিকে ভালোই করেছো।দীপ্তি তোমার থেকে হাজার গুণ সুন্দরী,মার্ডান তোমার মতো ক্ষেতমার্কা না।এছাড়াও তোমাকে বিয়ে করলে আমি অনেক কিছু পেতাম না।সারাজীবন আফসোস করতে হতো।দীপ্তিকে বিয়ে করে আমার ভাগ্যেই খুলে গেলো।ইশ কত কষ্ট হচ্ছে প্রিসা রাণীর।সমস্যা নেই আমি তোমার জন্য তোমার মতোই ক্ষেতমার্কা কোন ছেলেকে খুঁজে এনে দেবো।তার সাথেই বরং সংসার করো।”

প্রিসার কানে ফিসফিস করে উক্ত কথাগুলো বললো অয়ন।প্রিসা ঘৃ’ণাভারা দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো তার দিকে।

চলবে……..