শরতের এক সাঁঝবেলায় পর্ব-০৭

0
559

#শরতের_এক_সাঁঝবেলায়
#পর্বঃ০৭
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি

আচমকাই চোখ খুলে ফেললেন শাকিল হোসেন।এসি চলছে মাঝারি পাওয়ারে।ঠান্ডা রুমের মধ্যেও ঘমে যাচ্ছেন তিনি।মূলত ভয়ের কারণেই এই ঘেমে যাওয়া।শাকিল হোসেন মনে করেছিলেন টাকা দিয়ে লোকটাকে হাত করা যাবে কিন্তু তাকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত করে দিলো পুরুষটি।

” তোর ওই নোং’রা টাকার কোন দরকার নেই আমার।আমার তো দরকার তোকে।স্যাম।” পুরুষটি নাম নেওয়ার সাথে সাথে স্যাম নামের ছেলেটি শাকিল হোসেনের মুখ বেঁধে দিলো।মূলত শব্দ বাইরে না যাওয়ার জন্য এই কাজটা করা।চোখের নিমেষে পুরুষটি ভারী কিছু দিয়ে শাকিল হোসেনকে মা’র’তে লাগলো।ব্য’থা’য় অদ্ভুত শব্দ করছে শাকিল হোসেন।একসময় ব্য’থা সহ্য করতে না পেরে তিনি অজ্ঞান হয়ে যায়।তবে পুরুষটি মা’রা বন্ধ করে না।এমনভাবে তাকে মা’রে যে বাম হাত এবং পায়ের কয়েকটা হাড় বেশ ভালোভাবে ভেঙে গিয়েছে।

সেইরাতে হঠাৎ এক আগন্তুকের আগমন,তারপর আচমকা আক্রমণ,ব্যথা সব মিলিয়ে শাকিল হোসেন মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।

” বিজনেসম্যান শাকিল হোসেন।এতো সময় পর তাহলে জ্ঞান ফিরেছে আপনার।বাহ্ বেশ ভালো।আমি তো ভেবেছিলাম আপনি কিছু আর কখনই চোখ খুলবেন না।”

শাকিল হোসেন চোখ নামিয়ে দেখলেন পুলিশের পোশাক পরিহিত একজন মধ্যবয়স্ক লোক সহ আরো দু’জন দাঁড়িয়ে আছে।পুলিশ দেখে শাকিল হোসেন ভাবলেন হয়তো তাকে আক্রমণকারী ব্যক্তির খোঁজে তারা নেমেছে।

” চিনতে পারছেন না নিশ্চয়ই।নমস্কার মিস্টার শাকিল হোসেন।আমি হচ্ছি তন্ময় পাল,এই থানার বর্তমান এস.আই।আপনার কেসটা বর্তমানে আমিই দেখছি।” মুখে বড় হাসি রেখে বললেন ইন্সপেক্টর তন্ময়।

শাকিল হোসেন তড়িৎ গতিতে প্রশ্ন করলে, “কালকে আমাকে কে হামলা করেছে জানতে পেরেছো?”

” কালকে নয় বরং তিন দিন আগে।আপনি তিনদিন ধরে অজ্ঞান ছিলেন।”

” তিনদিন!ওই লোককে জানতে পেরেছো?জানতে না পারলে ৫ ঘন্টার মধ্যে খুঁজে বের করো।পাঁচ ঘন্টা শেষ হওয়ার আগেই আমার ওই শু’য়ো’রে’র বা’চ্চা’কে চায়।শা’লাদের বুকে বেশি সাহস হয়ে গিয়েছে,আমাকে মেরেছে।যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওদের খুঁজে আনো।ওদের আমি জা’নে মেরে ফেলবো,শু’য়ো’রের বাচ্চা।আর যদি না পারো কাজটা করতে তাহলে ওদেরকে তো আমি খুঁজে বের করে মা’র’বোই সাথে তোমাদেরও ছাড়বোনা।এখন আমার মুখ না দেখে তাড়াতাড়ি দূর হও।” আদেশের স্বরে বললো শাকিল হোসেন।তার এধরণের হুকুম শুনে বাকি দু’জন পুলিশ রে’গে গিয়ে মনে মনে দু’টো গা’লি দিলো।তবে ইন্সপেক্টর তন্ময় রেগে গেলেন না বরং হাসলেন।মুখে হাসি বজায় রেখেই বেডের পাশে থাকা চেয়ারটা টেনে পায়ের উপর পা তুলে আরাম করে বসলেন তিনি।তার এধরণের ভাব দেখে শাকিক হোসেন বড়ই অসন্তুষ্ট হলেন।

” এই তুই কি জানিস না আমি কে?আমার সামনে এভাবে পায়ের উপর পা তুলে বসেছিস।চাকরির মায়া নেই নাকি?” রেগে বললেন শাকিল হোসেন।তার এরকম কথা শুনেও তন্ময় পালের মুখে হাসি লেগেই রইলো।যেন মজা কিছু শুনেছেন তিনি।

” জানেন মিস্টার শাকিল হোসেন।আমার না অনেক জায়গায় বদলি হয়েছে।আগে ছিলাম ময়মনসিংহে,সেখান থেকে বদলি হয়ে এখন চট্টগ্রামে।এর কারণ কি জানেন?ধুর,আমি না বললে জানবেন কি করে।আসলে আমি না একটু ত্যাড়াটাইপের লোক,মায়া-দয়া খুব কম।তাই চাকরির মায়াটাও কম।জানেন আমার না সারপ্রাইজ জিনিসটা বড্ড ভালো লাগে।এখন আপনাকে এমন একটা খবর বলবো যে আপনি পুরোই সারপ্রাইজ হয়ে যাবেন।”

” কি খবর?” ভ্রু-কুচকে জিজ্ঞেস করলো শাকিল হোসেন।

” আপনি এখান থেকে সোজা জেলে যাবেন এবং আমার আর্শীবাদে সেটা হবে পারমান্টেলি।অর্থাৎ আপনি আর আপনার বাসায় যেতে পারবেন না,এখন থেকে আপনার বাসা হচ্ছে জেলখানা।আবার ভাবেন না সিনেমার মতো ফাইল স্টার জেলখানা,নো।ওটা হচ্ছে সাধারণ জেলখান।যেখানে থাকবে শক্ত বিছানা,হয়তো সারাদিনে দু’বার খাবার পেলেন তাও শুকনো রুটি আর পেঁয়াজ।”

” এসব কি বলছিস তুই?তুই আধো জানিস আমি কে?আমি বিজনেসম্যান শাকিল হোসেন।আমার কত কত টাকা আছে তুই জানিস।রাজপ্রাদাধের মতো বাড়ি আমার।প্রতিবেলায় হাজার টাকার খাবার খায় আমি আমি তুই বলছিস আমি নাকি জেলের খাবার খাবো।হাহাহা……” বিদ্রুপের হাসি হাসলেন তিনি।ইন্সপেক্টর তন্ময় খানিকক্ষণ চুপ করে থাকলেও আচমকা হেসে উঠলেন।তার হাসি দেখে শাকিল হোসেনের হাসি বন্ধ হয়ে গেলো।

” মিস্টার শাকিল হোসেন আগেকার কথা ভুলে যান।এখন থেকে আপনার লাইফস্টাইল সম্পূর্ণ রূপে পরিবর্তন হয়ে যাবে।আপনাকে একটা শকিং নিউজ দি।আমার ভান্ডা ফুটে গিয়েছে।আপনার সব কালো কারবারি,ড্রা’গের ব্যবসাসহ আরো যা যা আছে সব সবার সামনে চলে এসেছে।ভাবেন না টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে নেবেন।তা হবেনা কারণ আপনার সবটাকা এখন পুলিশের হেফাজতে আছে।আপনি সুস্থ হলেই আপনাকে আদালতে নেওয়া হবে এবং আপনার সবকিছু সরকারের ভান্ডারে জমা হবে নয়তো অন্যকোন ব্যবস্থা নেওয়া হবে।আপনার কারসাজির সব প্রমাণ আমাদের কাছে আছে।”

” কিসের প্রমাণ?আর কে দিয়েছে এসব?”

” হয়তো রাতের আঁধারে যে আপনাকে আধ’ম’রা করেছে সে আবার অন্যকেউ।তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যান শাকিল সাহেব,জেলখানা আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।আসি তাহলে,নমস্কার।” ইন্সপেক্টর তন্ময় হাসতে হাসতে চলে গেলেন।এদিকে শাকিল হোসেন এখনো বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে পারেননি।কি হচ্ছে,কিভাবে হচ্ছে কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না।

” এইদিনের ঘটনা তো বাইরের কারো জানার কথা নয়।তাহলে কি কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করেছে নাকি এটা অন্য কেউ?”

শাকিল হোসনের জ্ঞান ফিরেছে শুনে পুরুষটি হাসলো।

” খেলা তো মাত্র শুরু।আস্তে আস্তে তোদের সবকটাকে আমি গর্তা থেকে বের করবো আর তোদের ভালো মানুষের মুখোশ টেনে ছিঁ’ড়ে ফেলবো।তোদের এমন অবস্থা করবো যে কাউকে মুখ দেখাতে পারবিনা।”

কাল রাত থেকে প্রত্যেকটা নিউজ চ্যানেলে একটা নিউজ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখানো হচ্ছে। ” ব্যবসায়ী শাকিল হোসেনের জ্ঞান ফিরেছে আজ সন্ধ্যায়।পুরো সুস্থ হলে তাকে থানায় নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।”

একই নিউজ দেখতে দেখতে পালক বেশ বিরক্ত হয়ে টিভি বন্ধ করে দিলো।প্রিসা নিজের ও পালকের টিফিন তৈরি করে,সব ঘুছিয়ে স্কুলের জন্য বেরিয়ে পড়লো।স্কুলে প্রায় কাছাকাছি আসতেই প্রিসার বুদ্ধিমান মস্তিষ্ক সন্দেহ করতে লাগলো হয়তো কেউ তাকে দূর থেকে দেখছে।আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো প্রিসা তবে সন্দেহজনক কিছু না দেখে আবারো হাঁটতে লাগলো।প্রিসা এগিয়ে যেতে লাগলে আগন্তুকটিও আড়াল থেকে বেরিয়ে তার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটতে লাগলো।
___________________________________________

বিকেলে পালকের বাসায় এলেন তাদের মেজো মামা অন্তিম খন্দকার এবং সেজো মামা আরিয়ান খন্দকার।তাদের এখানে আসার কারণ তাদের তিনজনকে নিতে আসা।আরিয়ান খন্দকারের মেয়ে ফারিয়া নতুন জামাইকে সাথে নিয়ে প্রথমবার বাবার বাড়িতে এসেছে।তাদের দেখতে অনেকে আসবে।তাই দু’ভাই বড় বোন আর তার মেয়েদের নিতে এসেছেন।পালক প্রথমে না না করলেও পরে রাজি হয়ে যায়।প্রিসাও যেতে রাজি আছে।ছোট থেকে এমনকি বাবা মা’রা যাওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত এই মামারাই তাদের দু’বোনকে আদরযত্ন করে আগলে রেখেছে।নিজের মেয়েদের চেয়ে কম ভালোবাসি।যেখানে তারা নিজে নিতে এসেছে এরপর তাদের খালি হাতে ফিরিয়ে দেওয়া মানে তাদের অপমান করা।যেটা তারা কেউ চায়না।মা-মেয়েরা মিলে কিছুদিনের কাপড় প্যাক করে,ঘর ঘুছিয়ে বেড়িয়ে পড়লো “খন্দকার কুঞ্জ ” এর উদ্দেশ্য।

একমাত্র বোন আর বোনের মেয়েরা আসাতে অনিলা শেখ এর চার ভাই বেশ খুশি।তাদের আপ্যায়নে চার ভাই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।তবে তাদের এতো খাতির যত্ন রাদিয়া খন্দকার এর খুব একটা পছন্দ হলো না হয়তো।তিনি বাঁকা চোখে তাকিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলেন।

সবার ভীড় এড়াতে প্রিসা ছাদে চলে এসেছে।আকাশে ছোট ছোট তারা এবং অর্ধচাঁদ দেখা যাচ্ছে।ছাদে ইট দিয়ে বাঁধানো বাসার জায়গাটাতে বসলো প্রিসা।নিরিবিলি জায়গা তার বরাবরই প্রিয়।তাই ছাদে এসে সে একটা স্বস্থির নিশ্বাস নিলো।তবে তার স্বস্থি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না।

” বাহ্ আজতো দেখি শান্তি রাণী আমাদের বাড়িতে।সূর্য কি আজ উল্টো উঠেছে নাকি?এতোদিন পর এ বাড়ির মুখো হলে।”

” পৃথিবীতে এমনকিছু কিছু মানুষ আছে যারা হচ্ছে চরম বে’হা’য়া।” আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো প্রিসা।প্রিসার কথা অয়ন গায়ে না মেখে বললো,

” তা প্রিসা তুমি এ বাড়ি আগে সপ্তাহে একবার আসলেও এখন তো তোমার দেখা মাসের পর মাস গেলেও পাওয়া যায় না,একেবারে অমাবস্যার চাঁদ হয়ে গিয়েছে।বয়ফ্রেন্ড ছেঁকা দিয়েছে বুঝি?নাকি এই বাড়িতে এলে করো সুখ দেখে তোমার কষ্ট হয়?” টিটকারি নিয়ে বললো অয়ন। ” তুমি যদি আমার কথা শুনতে তাহলে হয়তো,হয়তো কিন্তু তুমি এতো বড় বাড়ির বউ হতে পারতেন।দামী দামী গহনা,টাকা,ফ্রীতে সম্মান সব পেতে।কিন্তু তুমি তা নিজের ইগোর কারণে মিস করলে।তোমার জন্য বড়ই কষ্ট লাগছে আমার।নিশ্চয়ই আমাদের টাকা,পয়সা,গহনা সব নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছো।কিন্তু দেখো কপাল কিছু তো পেলেই না উল্টো এখন এই বাড়িতেও আসতে দ্বিধাবোধ করো।” তাচ্ছিল্যযুক্ত কন্ঠ বললো অয়ন।

চলবে……..