শরতের এক সাঁঝবেলায় পর্ব-২১+২২

0
537

#শরতের_এক_সাঁঝবেলায়
#পর্বঃ২১
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি

বিয়ের পর এই প্রথম রাদ এবং পালক পালকের বাড়িতে এসেছে।তারা আসবে শুনে অনিলা বেগম সকাল থেকে দৌড়ের মধ্যে আছে,সাথে প্রিসাও।পালক এবং রাদের সাথে ইয়াসিনও এসেছিলো।তবে সে জিনিসপত্রগুলো পালকের হাতে দিয়ে দরজার কাছ থেকেই চলে গিয়েছে।অনিলা বেগম তাকে খেয়ে যেতে বলেছেন কিন্তু ইয়াসিন কাজ আছে বলে চলে গিয়েছে।

খাবার টেবিলে একা বসে আছে রাদ।তার চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে পালক,প্রিসা এবং অনিলা বেগম।তিনজনই তাকে এটা সেটা এগিয়ে দিচ্ছে।আজ অনিলা বেগম একদম বাঙালি খাবার রান্না করেছে।মাছ ভাজা,আলু দিয়ে ঝোল করে মাছ,আলু ভর্তা,ভাজি,ঘন করে ডাল,সাদা ভাত।তবে প্রিসার জোড়াজুড়িতে তিনি পরে মাংসের দু’টো পদ রান্না করেছেন।

” বাবা তোমার রান্না পছন্দ হয়েছে?এসব তুমি খাবে তো?প্রিসা আমাকে বলেছিলো বিরিয়ানি,মাংস করতে কিন্তু আমি চেয়েছি আমার জামাই যেন আমার বাড়িতে প্রথম বাঙালি খাবারটাই যেন খায়।”

” সমস্যা নেই মা,আমি এসব খেতে পারবো।আমার মাও এসব খুব পছন্দ করতো।”

” তাহলে বাবা এবার খাওয়া শুরু করো।লজ্জা পেওনা,মন ভরে খাও।”

রাদ হাত ধুয়ে খেতে শুরু করলো।প্রিসা আর পালক রান্নাঘরে চলে গিয়েছে,অনিলা বেগম দাঁড়িয়ে রাদের যত্ন নিচ্ছে।কিছুক্ষণ পর অনিলা বেগম লক্ষ্য করলেন রাদ সব খেলেও মাছের তরকারি খাচ্ছে না।

” বাবা তুমি মাছ খাচ্ছোনা কেন?রান্না ভালো হয়নি বুঝি?”

” না মা আপনার সব রান্না ভালো হয়েছে।আসলে আমি রান্না করা মাছ খায়না,কাঁটা বেছে খেতে ইচ্ছে করেনা।আমি বরং অন্যগুলো দিয়ে খায়।”

রাদের কথা শুনে অনিলা বেগম তাড়াতাড়ি হাত ধুয়ে একটা থালাতে মাছের পিসটা তুলে নিয়ে কাঁটা বেছে রাদের প্লেটে দিতে লাগলেন।রাদ হা করে অনিলা বেগমের কান্ড দেখছে।খানিকের মাঝেই অনিলা বেগম পুরো মাছটা বেছে রাদের প্লেটে দিয়ে দিয়েছে।

” কি হলো বাবা।মাছ বেছে দিয়েছি এবার আস্তে আস্তে খাও।”

রাদ একদৃষ্টিতে প্লেটের দিকে তাকিয়ে রইলো তারপর আচমকা বলে বসলো,

” মা আমাকে একটু খাইয়ে দেবেন?অনেকদিন মায়ের হাতে খাইনি,একটু দেবেন?”

রাদের কোমল আবদার অনিলা বেগম ফেলতে পারলেননা।রাদের প্লেটটা নিজের দিকে টেনে নিয়ে তাকে খাইয়ে দিতে লাগলেন।কয়েক লোকমা খাওয়ার পর রাদের চোখ ছলছল করে উঠলো।সবাই বলে ছেলেদের নাকি কাঁদতে নেই কিন্তু রাদ এসব কিছু ভাবলো।হুট করেই হুহু করে কান্না করে দিলো রাদ।অনিলা বেগম বেশ ঘাবড়ে গেলেন।দ্রুত চেয়ার থেকে উঠে রাদের মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করতে লাগলো।

” কি হয়েছে বাবা?কান্না করছো কেন?আমাদের কোন কিছু কি তোমার খারাপ লেগেছে?”

” আপনাকে একটু জরিয়ে ধরবো?”

অনিলা বেগম রাদকে মাতৃস্নেহ দিয়ে পরম মমতায় আগলে নিলেন।উনার মাতৃহৃদয় ঠিকই বুঝতে পারলেন রাদের কান্নার কারণ।পরশ মমতায় হাত মাথায় হাত বুলিয়ে অনিলা বেগম বললেন,

” পৃথিবীতে কেউ স্থায়ী নয়।সবারই একদিন এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতেই হয়।আমি জানি তোমার তাদের কথা মনে পড়ছে তবে মন খারাপ করোনা।আমি যেমন প্রিসা-পালকের মা এখন থেকে আমি তোমারও মা।তাদের মতো তুমিও আমার আরেকটা সন্তান।একদম কান্না করবে না।”

অনিলা বেগম যত্নসহকারে রাদের চোখের জল মুছে দিয়ে তাকে খাইয়ে দিতে লাগলো।প্রিসা এবং পালক দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে এই দৃশ্যটা।

প্রিসা মজা করে বললো, ” আমাদের আদরে ভাগ বসাতে আরেকজন চলে এসেছে।”

” এখন তো একজন এসেছে আরো একজনের আসা তো এখনো বাকি।”

বোনের সাথে ফোনে কথা বলছিলো নিহাদ।কলিংবেলের শব্দ শুনে নিহাদ তাড়াতাড়ি ফোনটা কেটে দিলো।

” আজ আবার কি কারণে আপনি আমার দ্বারে?”

” এইগুলোর জন্য।” হাতে থাকা থালাটা নিহাদের দিকে বাড়িয়ে দিলো প্রিসা।এতো সব কিছুর মাঝে অনিলা বেগম ঠিকই নিহাদের কথাটা মনে রেখেছেন।এরমাঝে তাদের দু’জনের অনেক কথা হয়েছে,তাদের মাঝের বন্ডিংটাও বেশ ভালো।

” এতো সব খাবার?আজ বিশেষ কিছু আছে নাকি?”

” হুম বিশেষ তো।পালকের বর এসে,তার জন্য এতো আয়োজন।”

” ইশরে আমিও যদি আন্টির হাতে এরকম জামাই আদর পেতাম।”

নিহাদের কথা শুনে প্রিসা হেঁসে ফেললো।তার ধারণা নিহাদ মজা করছে কিন্তু সে হয়তো জানেনা নিহাদ আসলেই কথাটা মন থেকে বলেছে।
.
.

” তূর্যকেও কাদেরের মতো বেহাল অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে তবে তার অবস্থা কাদেরের থেকেও খারাপ।”

” আমি কিন্তু তোমাকে আগেই বলেছি আমার সন্দেহের কথা।”

” কিন্তু এরকমটা হওয়ার কোন সম্ভাবনাই নেই।তুমি জানো আমি কি করেছি,তারউপর আমি সর্বক্ষণ তারউপর নজর রাখছি।”

” তাহলে আরো ভালো করে খোঁজ করো কে হতে পারে।ওরা তিনজনের কেউ দেখেনি লোকগুলোকে,শুধু জুতোর শব্দ শুনেছে।আমাদের দু’জনকে আরো সাবধানে থাকতে হবে।”

.
.

মাঝে কেটে গিয়েছে অনেকগুলো মাস।পালক,রাদের বিবাহিত জীবন বেশ ভালোই চলছে।বাকিদের জীবনও চলে যাবে।কেউ নিজের ভালোবাসা ব্যক্ত করার চেষ্টা করতে,কেউ খুনসুটিময় ঝগড়া করছে।

অফিস থেকে ফিরে পালক রান্নাঘরে চলে গিয়েছে রাতের খাবারের ব্যবস্থা করতে আর রাদ এসেছে তার ফুফার কাছে।

” আমাকে ডেকেছো ফুফা?” দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে করতে বললে রাদ।আদিব সাহেব ফোনটা রেখে হেসে রাদের দিকে তাকালেন।

” কেমন আছো তুমি?কতদিন তোমার সাথে কথা বলিনা।ফুফাকে ভুলে গিয়েছো বুঝি?”

” তুমি এসব কি বলছো ফুফা।আমি তোমাকে কি করে ভুলতে পারি বলো।তোমাকে আমি নিজের বাবার মতো ভালোবাসি,তাহলে কি করে ভুলে পারি বলো?”

” ভালোবাসো তাই বলেই তো আমার খোঁজখবর নাওনি।” অভিযোগ করার মতো করে বললেন তিনি।

” তুমিও তো নাওনি।কই আমি কি রাগ করেছি।”

” হাহাহা….আমার অভিনয় আমাকেই করে দেখাচ্ছো।বেশ ভালো অভিনয় করতে পারো তো তুমি।”

” অভিনয়ের তুমি কি দেখলে ফুফা।ব্যবসা না থাকলে আমি অবশ্যই অভিনয় জগতে পা রাখতাম।তখন আমার অভিনয় দেখে তুমি একদম অবাক হয়ে যেতে।নিজেকেই নিজেকে প্রশ্ন করতে,এটা কি আসলেই সেই রাদ?”

প্রশঙ্গ পাল্টে রাদ প্রশ্ন করলো, ” আমাকে কেন ডেকেছো ফুফা?গল্প করার জন্য নাকি গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলবে?”

” গল্প তো করবোই কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কিছুও বলার আছে।দেখো রাদ তুমি অসুস্থ,এই অসুস্থ শরীর নিয়ে তোমার প্রতিদিন এতো দৌড়ঝাঁপ ভালো নয়।সেইসাথে অফিসের নানা ঝামেলা,কাজের চাপে তোমার শরীর আরো অসুস্থ হয়ে পড়ছে।তুমি বরং এখন কয়েকমাস অফিসে যেওনা,বউমা কয়েকমাস অফিসে না গিয়ে বাড়িতে থেকে তোমার সেবা করুক।অফিসের দিকটা আমি দেখে নেবো,তারউপর এখন তো আয়নাও অফিসে যায়।আমরা দু’জন ব্যবসার দিকটা দেখে নেবো।তুমি বরং বউমাকে নিয়ে ঘরেই থাকো।”

আদিব সাহেবের কথা শুনে রাদ হাসিমুখে বললো,

” ফুফা তুমি শুধু শুধু আমাকে নিয়ে চিন্তা করছো।আমি একদম সুস্থ আছি।অফিস সামলাতে আমার কোন সমস্যা হচ্ছে না।আগে পরে তো আমাকেই সামলাতে হবে।আর সারাদিন আমি ঘরে থেকে কি-ই বা করবো,তারচেয়ে বরং অফিসে যায়।তুমি এতো চিন্তা করোনা এসব নিয়ে।বাবা-মা আমাকে কিভাবে কাজ সামলাতে হয় তা আগেই শিখিয়ে দিয়েছে আর আপু সবসময় বলতো পরিস্থিতি যেমনই হোক যথাসম্ভব চেষ্টা করতে অন্যের হওয়ার নির্ভরশীল না হওয়ার,দেখা যেতে পারে এতে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়ে গিয়েছে।আচ্ছা ফুফা চলো খেয়েনি,রাত তো কম হলেনা।”
.
.

একটা টিউশনি শেষ করে প্রিসা এখন আরেকটা টিউশনে যাচ্ছে।অনিলা বেগমের সাথে কথা বলতে বলতে হাঁটছে সে।আচমকা প্রিসা পেছন ঘুরে তাকালো।প্রিসা যে হঠাৎ এভাবে পেছন ঘুরে তাকাবে সেটা নিহাদ ভাবতে পারেনি,ঘাবড়ে গেলো সে।ফোনটা ব্যাগে রেখে প্রিসা নিহাদের দিকে তাকালো।

” তারমানে আমার সন্দেহই সত্যি হলো।আপনিই সেই ব্যক্তি যিনি আমি টিউশনির জন্য বাসা থেকে বের হওয়ার পর বাসায় যাওয়ার আগপর্যন্ত আমার পিছু করতে থাকেন।”

নিহাদকে কিছু বলার সুযোগ দিলোনা প্রিসা।বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরেই প্রিসার মনে হচ্ছিলো কেউ তাকে ফলো করছে,তারউপর নিহাদের ব্যবহারে তার সন্দেহ হয়।হ্যাঁ সে সন্দেহ করেছিলো কিন্তু সে আশা করেনি এটাই সত্যি হয়ে যাবে।

” কেন আপনি আমাকে ফলো করছেন নিহাদ?আমি কি এটাকে স্ট’ক করা বলবো?আপনি বুঝতে পারবেন না একটা মেয়ে যখন জানতে পারে কেউ তাকে বের হলেই ফলো করে,স্টক করে তার কেমন লাগে।এটা নাটক,সিনেমা নয় নিহাদ বাস্তব এটা।এই বিষয়টা একটা মেয়ের জন্য একটা ভীতিকর ব্যপার,একটা অস্বস্তিকর ব্যপার এটা।সবার অধিকার আছে স্বাধীনভাবে বাঁচার।আপনার থেকে আমি এটা আশা করিনি নিহাদ।আপনি এইধরণের কাজ করে আমার বিশ্বাস ভেঙেছেন।আপনাকে আমি ভালো মনের ভেবেছিলাম কিন্তু আপনি এরকমটা করবেন আশা করিনি।দয়া করে আমাকে একা চলাফেরা করতেদিন,ফলো করবেন না।স্টক করা বন্ধ করুন।”

প্রিসা দ্রুত পায়ে স্থানটা ত্যাগ করলো।নিহাদ নিষ্পলক ভাবে প্রিসার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।প্রিসার যাতে কোন ক্ষতি না হয় তারজন্য সে তাকে ফলো করতো কিন্তু সে ভাবতেও পারেনি প্রিসার কাছে এভাবে ধরা পরে যাবে।নিহাদ বুঝতে পারছেনা এখন কি করবে,শূন্য শূন্য লাগছে তার মস্তিষ্ক।

চলবে…….

#শরতের_এক_সাঁঝবেলায়
#পর্বঃ২২
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি

আজ এক সপ্তাহ থেকেও বেশিদিন ধরে নিহাদের কোন খবর নেই।বাসায় ঝুলছে বড় তালা,স্কুলেও সে আসছেনা।প্রিসা স্কুল থেকে জানতে পেরেছে সে নাকি জরুরি প্রয়োজনে নিজের বাড়িতে গিয়েছে তার জন্যই ছুটি নিয়েছে।তবে প্রিসা খানিকটা হলেও বুঝতে পারছে নিহাদের এই আচমকা চলে যাওয়াটার পেছনে সেইদিন তার বলা কথাগুলোও ভূমিকা রাখে।তবে প্রিসা বেশি ভাবলোনা কারণ সে ভুল কিছু বলেনি।একটা মেয়ের উপর সর্বক্ষণ নজররাখা,তার প্রতিটি পদক্ষেপ পর্যবেক্ষণ করা প্রিসার চোখে এটা ঘোরতর অপ’রাধ।তবে মাঝে মাঝে তার নিহাদের কথা মনে পড়ে।অনিলা বেগমও কখনো কখনো নিহাদকে নিয়ে চিন্তা করেন।প্রিসা কিছু বলেনা,চুপচাপ শুনে যায়।
.
.

ফোনে কথা বলছিলো ইয়াসিন।আচমকা পেছন থেকে কারো কন্ঠ শুনে হাত থেকে ফোনটা আলগা হয়ে গেলো তবে নিচে পড়লোনা।

” ইয়াসিন মির্জা এটা অফিস।আপনি অফিস টাইমে কার সাথে এভাবে হেঁসে হেঁসে কথা বলছিলেন?” আড়াআড়িভাবে হাত ভাঁজ করে বললো আয়না।আয়নাকে দেখে ইয়াসিনের চোখেমুখে খুশির আভাসের দেখা মিললো।লাজুক বললো, ” গার্লফ্রেন্ড এর সাথে কথা বলছিলাম।আসলে আমার গার্লফ্রেন্ডটা আমাকে অনেক অনেক বেশি ভালোবাসে।তাই ঘন্টায় ঘন্টায় ফোন দিয়ে আমার খবর নেয়।কি বলবো বলো আমার গার্লফ্রেন্ডটাই এতো ভালো।”

” ওমা শুনে তো আমার খুশিতে এই চারতলা থেকে লা’ফ দিতে ইচ্ছে করছে।মিস্টার ইয়াসিন এটা অফিস টাইম আর আপনি কাজ না করে কোন মেয়ের সাথে গল্প করছেন আবার সেটার বর্ণনা আমাকে রসিয়ে কসিয়ে শোনাচ্ছেন।” আয়নার কথায় বিরক্তির ছোঁয়া একদম স্পষ্ট।

” কি ভাঙা আয়না হিংসে হচ্ছে বুঝি?ও আমার ভাঙা আয়না আমি জানি তো আমার এতো ভালো গার্লফ্রেন্ডের কথা শুনে তোমার কলিজাটা চিকেন ফ্রাই হয়ে যাচ্ছে।”

” ঢং দেখে বাঁচিনা।শুনুন আমি জানি আপনার কোন গার্ল যোগ ফ্রেন্ড নেই,সব চাপাবাজী।কোন মেয়েই আপনার মতো জুতো চোরকে বয়ফ্রেন্ড বানাবেনা।মেয়েদের কাছে বয় যোগ ফ্রেন্ড থেকে তাদের জু যোগ তো বেশি প্রিয়।তাই মেয়েরা জুতো সেফ রাখার জন্য আপনার মতো জুতো চোরকে তাদের লাইফ থেকে মাই যোগ নেস করে দেবে।আপনাকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি,তাই আমার সামনে অন্তত চাপাবাজী মারবেন না।না হলে হাড় মাইনেস আপনার শরীর হয়ে যাবে।” কথাগুলো বলেই আয়না গটগট করে চলে গেলো।ইয়াসিন কিছুক্ষণ আহাম্মকের মতো আয়নার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো অতঃপর পরমুহূর্তেই তার চেহারায় শোভা পেলো সেই চিরচেনা হাসি।
.
.

বছরের প্রায় শেষ সময় চলমান।শীতে কাবু হয়ে আছে সবকিছু।আজ সরকারি ছুটির দিন তারউপর কনকনে ঠান্ডা বিদায় প্রায় সবাই নিজ গৃহে অবস্থা করছে।

ঠান্ডার কারণে এই সময় অনেকেই স্নান করতে চাইনা তবে পালক এতো ঠান্ডার মধ্যেও সেই কাজটি সম্পন্ন করলো।বর্তমানে সে ঠান্ডায় ঠকঠক করে কাঁপছে এবং বারান্দায় ভেজা কাপড়গুলো মেলে দিচ্ছে।পেছন থেকে নিরবে সব লক্ষ্য করছে রাদ।বারান্দা থেকে রুমে পা দিতেই রাদ পালককে নিজের কাছে ডাকলো।

” বলো কি বলবে।”

” ওমা একটু কি নিজের বউকে ডাকতেও পারিনা?তার জন্যও কি কারণ লাগবে?”

” আরে বাবা তুমি ছোট বাচ্চাদের মতো কথায় কথায় মুখটা এভাবে ফুলিয়ে রাখো কেন?ছোট বাচ্চা তুমি?দেখো রাদসাহেব এই কথায় কথায় মুখ ফুলিয়ে রাখার অভ্যাসটা না এখনই ছেড়ে ফেলো না হয় কয়েকদিন পর বাচ্চারা হাসাহাসি করবে।” পালক খেয়াল করলো না সে কথার ছলে কি বলে ফেলেছে তবে রাদ ঠিকই খেয়াল করলো।সে দুষ্টু হাসি হেসে পালকের দিকে তাকিয়ে রইলো।

” কি হলে এভাবে কি দেখছে?”

” ভেবে দেখো একটু আগে কি বলেছো।”

কয়েক সেকেন্ড ভাবতেই পালক বুঝতে পারলো সে কথার ছলে কি বলেছে।মনে মনে খানিক লজ্জা পেলেও তা প্রকাশ করলো,স্বাভাবিক রইলো।

” এবার বলো কেন ডেকেছো?খাবার গরম করতে হবে তো।”

রাদ পালকের হাত থেকে টাওয়ালটা নিয়ে তাকে পেছনে ঘুরে বসতে বললো।পালক বুঝতে পারলো রাদ কি করতে চাইছে।তাই চুপচাপ পেছনে ঘুরে বসলো।রাদ যত্নসহকারে পালকের ভেজা চুলগুলো মুছে দিতে লাগলো।

চুলমোছা হয়ে গেলে রাদ কাঁধের একপাশে চুল সরিয়ে পালকের কাঁধে নিজের থুতনিটা রাখলো।পালক হাত ঘুরিয়ে রাদের চুলে হাত বুলাতে লাগলো।

” কি হয়েছে রাদসাহেব?মন খারাপ?”

” আমাকে কখনো ছেড়ে যাবে নাতো পালকসাহেবা?তোমাকে ছাড়া আমার আত্মা ম’রে যাবে।তুমিহীনা আমি বেঁচে থেকেও ম’রে যাবো।” চোখ বুজলো রাদ।

” আমি তোমাকে আগেও বলেছি আজ আবারো বলছি।আমি তোমাকে ছেড়ে কখনোই যাবোনা,মৃ’ত্যুর আগ পর্যন্ত তোমার পাশে থাকবো।কিন্তু আমার বিশ্বাস যদি তুমি কখনো ভাঙো তবে তুমি তোমার এই পালকসাহেবাকে হারিয়ে ফেলবে।”

প্রতিবারে মতো এবারো রাদ চুপ করে রইলো।পালকের কথার প্রেক্ষিতে কিছুই বললোনা সে।
.
.

বর্তমানে সবার মধ্যমণি সাব্বির নামের ছেলেটি।এই শীতের মধ্যেও সে তরতর করে ঘেমে চলেছে।ইয়াসিন,আয়না,পালক তার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।বাকি কর্মচারীরা কেউ তুচ্ছ তো কেউ ঘৃণাভরা নজরে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।তবে এতো জোড়া চোখের মাঝে শুধু একজোড়া চোখের দৃষ্টি এখনো স্বাভাবিক আর সেটা হচ্ছে রাদ।

” স্যার ওকে আপনি এখনো কিছু করেননি কেন?এখুনি পুলিশে ফোন করুন।বেয়া’দব ছেলের কত বড় সাহস আমাদের অফিসের ফাইল চেঞ্জ করে,আমাদের তথ্য চুরি করে অন্যকারো কাছে পা’চা’র করে সে।স্যার একবার আপনি বলুন এর মুখ থেকে কি করে ওর সাঙ্গপাঙ্গদের নাম বের করতে হয় সেটা আমি দেখছি।”

পালক খানিকটা অবাক দৃষ্টিকে ইয়াসিনের দিকে তাকালো।এতোগুলো দিনে সে ইয়াসিনকে কখনো রেগে যেতে দেখেনি।সবসময় হাসিখুশি থাকা মানুষটা রেগে যাওয়া মানে যেকোন সময় অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু হয়ে যেতে পারে।অবশ্য তার রেগে যাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।তারা সবাই কষ্ট করে ফাইল রেডি করে,ডকুমেন্ট রেডি করে আর সাব্বির কিনা সেগুলো চু’রি করে অন্যকারো হাতে তুলে দেয়।বিষয়টা খুবই জ’ঘ’ন্য।

” তুমি এইরকমটা কেন করেছো সাব্বির?” শান্তভাবে প্রশ্ন করলো রাদ।রাদের শান্ত কন্ঠ শুনে সাব্বিরের শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেলো,শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বেয়ে গেলো।

” দেখো সাব্বির বললে কিন্তু তোমার জন্যই লাভ।নাহলে পুরো শাস্তিটা কিন্তু তুমি একাই ভোগ করবে।এখন তুমিই চিন্তা করো শাস্তি পুরোটা নিজের ভাগে নেবে নাকি যে কাজটা করতে বলেছে তাকেও ভাগ দেবে।”

কিছু বললোনা সাব্বির,আশাহত হলো সবাই।রাদ চোখের ইশারা করতেই ইয়াসিন টেনে টেনে সাব্বিরকে নিচে নিয়ে যেতে লাগলো।পুলিশ নিচেই দাঁড়িয়ে আছে।

একে একে সবাই ফিসফিস করতে করতে নিজের ডেস্কে চলে যেতে লাগলো।রাদও নিজের হুইলচেয়ার চেয়ারটা ঘুরিয়ে নিজের কেবিনে চলে গেলো।পালকের খুবই খারাপ লাগছে রাদ এবং বাকি সবার জন্য।কারণ তাদের এতো পরিশ্রমের সব কাজ এখন অন্যকোন অজ্ঞাত ব্যক্তির কাছে,যা এখন তাদের আর কোন কাজেই আসবেনা।

কিছুক্ষণ আগেই সাব্বিরকে পুলিশ টানতে টানতে নিয়ে গিয়েছে।পুলিশও অনেকবার জিজ্ঞেস করেছে কিন্তু কোন এক অজ্ঞান কারণে সাব্বির নিজের মুখ একদম খোলেনি।অতঃপর পুলিশ তাকে নিয়ে গিয়ে,থানায় গিয়ে আবারো জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

গ্রাউন্ড ফ্লোরের এককোণে চেয়ারে বসে আছে ইয়াসিন।রাগে ফুঁসছে সে,অগ্যত কারণে তার রাগটা আজ সে দমিয়ে রাখছে পারছেনা।বারবার বেরিয়ে আসতে চাইছে সেটা।সে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে রাগটা কমানোর জন্য।

” জুতো চোর।”

আয়নার মায়াবী কন্ঠ শুনে ইয়াসিন মাথা তুলে তাকালো।অসহায়ভাবে আয়নার দিকে তাকালো সে।ইয়াসিনের পাশে বসে তার হাতে আলতোভাবে হাত রাখলো আয়না।

” শান্ত হোন,পুলিশ ব্যবস্থা নেবে তো।আপনি হচ্ছেন জুতো চোর আর রাগ জিনিসটা ইয়াসিনদের মানালেও জুতো চোরদের মানায় না।তাই এখন রাগকে নিজের মন থেকে মাইনেস করে খুশিকে প্লাস করুন।”

আয়নার কথা শুনে ইয়াসিন হালকা হেসে তার দিকে তাকালো।ইয়াসিনের চোখের ভাষা আয়নার আপাতত বোধগম্য হচ্ছে না তবুও সে ইয়াসিনের কালো ঘন পাপড়িযুক্ত চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।
.
.

স্কুল থেকে এসে প্রিসা একদম ক্লান্ত।শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম টুকু মুছে যেই বেল চাপাবে তখন সে নিজের পায়ের কাছে খেয়াল করলো।অপরিচিত কয়েকজোড়া জুতো।তাদের বাসায় সচরাচর কেউ আসেনা,তাই প্রিসা বুঝতে পারলোনা আজ এতোদিন পর আবার কারা আসতে পারে।

দরজায় হালকা ধাক্কা দিতেই তা শব্দ করে খুলে গেলো।জুতো জোড়া খুলে প্রিসা ভেতরে দিকে অগ্রসর হলো।সোফার কাছেই এসেই সে থেমে গেলো।শব্দহীনভাবে সে উচ্চারণ করলো,

” নিরা!”

চলবে………