শহর জুড়ে আলোর মেলা পর্ব-১৫

0
418

#শহর_জুড়ে_আলোর_মেলা
কলমে:লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব: ১৫

লোভে পড়লে মানুষ বোধ বুদ্ধি হারিয়ে ফেলে। ভালো খারাপের ভেদাভেদ করতে ভুলে যায়। আলোর জ্ঞান নেই। বিছানায় অসাড় হয়ে পড়ে আছে। বেশ রাত হয়েছে দেখে শ্রাবণ ওকে ডাকতে গিয়েছিলো ঠিক তখনই এমন অঘটনটা ঘটলো। শ্রাবণের বাবা রাস্তায় আছে। আসতে সময় লাগবে। শ্রাবণ অপেক্ষা করতে পারলোনা। ভাবলো ওকে এখানকার হাসপাতালে নিবে ঠিক তখনই তুলি ভেতরে প্রবেশ করলো। মেয়েটা ডাক্তারি পড়ছে। শ্রাবণের অস্থির অবস্থা দেখে তাড়াতাড়ি আলোকে চেক করে ভীতু ভীতু কণ্ঠে বলল,

> ভাইয়া ও জ্ঞান ফিরতে সময় লাগবে। অতিরিক্ত মাত্রায় চেতনানাশক ওষুধের প্রভাবে জ্ঞান হারিয়েছে। ওর শরীর দুর্বল না হলে এতোটা অসুস্থ হতো না। ওষুধ প্রয়োগের প্রথম পর্যায়ে রোগী এলোমেলো হয়ে যায়। ওকে দিয়ে কি করানো হচ্ছে বা বলানো হচ্ছে সেসব মনে রাখতে পারেনা। কিন্তু আলোর শরীর অত্যধিক দুর্বল সঙ্গে হার্টের সমস্যা আছে। দুই মিলিয়ে ও সহ্য করতে পারেনি ফলে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। চিন্তা করোনা আমি বাবাকে বলেছি ওষুধ আনতে। ইনজেকশন দিলে সকাল আসতে আসতে ঠিক হয়ে যাবে।

শ্রাবণ থমকে গেলো। তুলি ভয়ে ঢোক গিলছে। সামান্য হাত ধরে রোগীর বর্তমান অবস্থা বোঝার মতো বিশাল মাপের ডাক্তার তুলি না যদিনা আগে থেকে পুরোপুরি শুনে থাকবে। শ্রাবণ মাথা ঠান্ডা করে বলল,

> আলোকে এই ওষুধ কে দিয়েছে?

তুলি কেঁপে উঠলো। এখনো উপরে গান বাজনা চলছে। বিয়ে বাড়ির অনুষ্ঠান মাঠে মারা পড়বে। ওকে চুপচাপ দেখে শ্রাবণ পূণরায় ধমক দিলো,

> বল কে দিয়েছে? আমার ধৈর্য্য পরীক্ষা নিস না। দ্রুত বল।

শ্রাবণের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। আলোর এমন অবস্থা দেখে মেজাজ পুরোপুরি খারাপ। তুলি মিনমিন করে বলল,

> সব মিতু আপুর প্লান ছিল। আপু চাইছিলো তোমার আর আলোর মধ্যে কেমন সম্পর্ক সবটা জানতে। তাছাড়া আলোর কিছু পিক নিতে চাইছিলো। কারণ কি আমি জানিনা। লিজা ওষুধটা কোকের মধ্যে মিশিয়ে ভাবিকে খেতে দিয়েছিলো। বিশ্বাস করো আমি জানতাম না। খাওয়ানোর পর ওদের ফিসফিস করে বলতে শুনে আমি দৌঁড়ে এসেছি। ভাইয়া প্লিজ শান্ত থাকো। বাড়িতে কতো মেহমান এসেছে।

শ্রাবণ এই বিষয়ে একটা শব্দও উচ্চারণ করলোনা। একবার আলোর দিকে চেয়ে বলল,

> ওর সঙ্গে থাক আমি আসছি। এক পাও ঘরের বাইরে ফেলবি না।

শ্রাবণ কথাটা বলে অপেক্ষা করলোনা। হন্তদন্ত হয়ে ছুঁটলো পুরাতন বাড়ির ছাদের দিকে। সেখানে ধুমধাম নাচ চলছে,” মেঘ বালিকা নাচেরে, মেঘ বালিকা নাচেরে”।লিজার সঙ্গে অভিক ডুয়েট নাচ করছে। বাকীরা ভিডিও করছে। কিছু রিল ভিডিও আর কিছু টিকটক এপসে সেগুলো ছাড়া হবে। নাচের মধ্যেই শ্রাবণ গিয়ে লিজার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় ধরে ফেললো। সঙ্গে সঙ্গে নাচ থেমে গেলো। একজন তাড়াতাড়ি করে বক্সের গানটাও থামিয়ে দিলো। কিন্তু জোরে একটা শব্দে সকলে কেঁপে উঠলো। শ্রাবণ লিজার মুখে জোরে একটা থা*প্প*ড় বসিয়ে দিয়েছে। লিজা ছিটকে পড়েছে ফ্লরে। সেখানে বসে মুখে হাত রেখে চোখের পানি ফলেছে। মূহুর্ত্তের মধ্যে এমনটা ঘটবে কেউ আশাকরেনি। অভিক ছুটে গিয়ে লিজাকে ধরে বলল,

> ভাইয়া ওকে মারলে কেনো? কি করেছে ও?

শ্রাবণ উত্তর দেবার প্রয়োজন মনে করলোনা। সোজাসুজি লিজাকে তুলে দাঁড় করিয়ে কঠিন স্বরে জিঞ্জাসা করলো,

> আলোর খাবারে ওষুধ কেনো মিশিয়েছিস? আদর যত্ন করে খু*নি পালন করছি আমরা? আমার ভালোবাসা স্নেরের কোনো দাম নেই তোর কাছে? ভাইকে উপরে উপরে ভালোবাসা দেখিয়ে তার বউকে খু*ন করার পরিকল্পনা করতে লজ্জা করলোনা? কে আপন তোর কাছে বল?

শ্রাবণ ওকে ঝাকিয়ে আবার ছেড়ে দিলো। লিজা ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। পড়ে যেতে গেলো কিন্তু পেছন থেকে মিতু ওকে ধঁরলো। লিজাকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে শ্রাবণের দিকে হুঙ্কার ছাড়লো,

> ও কিছু করেনি।তোমার বউ কি খেয়েছে ও কিভাবে বলবে? প্রমাণ ছাড়া একদম গলাবাজি করবে না। এতোই যখন দর‍দ তোমার বউয়ের পেছনে বডিগার্ড রাখতে পারোনা? অযথা অন্যকে দোষারোপ করে থাপ্পর মারতে এসেছো?

মিতু গা জ্বলানি কথা। শ্রাবণ নিজেকে শান্ত রেখে বলল,

> আমি লিজা আর তুলিকে আলাদা চোখে দেখিনা। বরং ওকে একটু বেশি ভালোবাসা দেখিয়ে ফেলেছি। আমার তো জানা ছিল না ও ভাইয়ের থেকে একজন গণিকাকে বেশি বিশ্বাস করে আর ভালোবাসে। আসলে কি জানিস কু*ত্তার পেটে ঘি ভাত হজম হয়না। সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে ঠিক তেমনই অবস্থা ওর। আমি যতই ওকে ভালোবাসি না কেনো ওর নজর তো নিচের দিকে। যেমন তুই অষ্ট্রেলিয়া থেকে উষ্ঠা খেয়ে ফিরে এসেছিস সে খবর লুকিয়ে গিয়ে ভাবছিস আহা শ্রাবণ মদনাতো আছে। এবার এক্কা দোক্কা করতে করতে ওর ঘাড়ে ঠিক ঝুলে পড়বো। কিন্তু এখানে এসে দেখলি শ্রাবণ বিয়ে করে সংসার করছে ওমনি শুরু করলি তোর নোংরামি। তোর মতো মেয়ে বেঁ*চে আছে কেনো সেটাই ভাবছি আমি। আমার সঙ্গে রিলেশন থাকা অবস্থায় ওই ছেলেকে আলোর মতো ঘুমের মেডিসিন দিয়ে আজেবাজে ভিডিও তৈরী করে সেগুলো দিয়ে ওকে ট্যাপে ফেললি। সবাইকে উল্টো বোঝালি ছেলেটা নেশা করে জোর জবরদস্তি করেছে তোর সঙ্গে। বিশ্বাস কর আমি সবটা বুঝতে পেরেও তোকে বলেছিলাম বিয়েটা করবো। কতটা পাগল ছিলাম ভাব? তুই ভাবলি শ্রাবণের থেকে ও বেটার। তোকে বিদেশে নিয়ে গিয়ে সুখের সমুদ্রে ভাসিয়ে রাখবে অমনি ষড়যন্ত্র করে বিয়ে করে নিলি। কিন্তু সবটা উল্টো হলো। বেচারা বুঝে গেলো তুই কত বড় মাপের খেলোয়াড়। বেশি বুদ্ধির গলাই দ*ড়ি। আমি পুলিশে খবর দিচ্ছি। আমার বউকে আজেবাজে মেডিসিন দিয়ে খু*নের পরিকল্পনা করা হয়েছে। বাকীটা ওরা বুঝে নিবে। শ্রাবণ মাহমুদ তোর মতো মিতুর চোখ রাঙানি দেখে ভয় করবে সেটা একটুও ভাবিস না। পরবর্তী থা*প্প*ড়টা তোর গালে পড়তো কিন্তু নোংরা জায়গায় আমি হাত রাখিনা। গা ঘিনঘিন করে। বমি আসে। তোর মুখটা দেখলেও সেম অবস্থা হয়।

উপস্থিত সকলে হতভম্ভ হয়ে গেলো। মিতুর চোখে পানি উপছে পড়ছে। কথায় বলে বাক্য দ্বারা ব্যক্তিকে জীবন্ত দা*ফন করা যায় তেমন অবস্থা। লিজা মিতুর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সোজাসুজি শ্রাবণের পায়ের কাছে পড়ে গেলো। হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলল,

> ভাইয়া আমাকে মাফ করে দাও। আমাকে মা*রো তবুও মুখ ফিরিয়ে রেখোনা। আমি বুঝতে পারিনি। মিতু আপু আমাকে ভুল বুঝিয়েছে। আমিতো তখন ছোট ছিলাম। ঠিকঠাক জানতাম না। ও আমাকে বলেছে তুমি ওর সঙ্গে চিট করেছিলে তাইতো আমার খারাপ লেগেছিলো।

শ্রাবণ পা ছাড়িয়ে নিলো। মুখটা ফিরিয়ে নিয়ে বলল,

> আজকের পর থেকে আমার থেকে দূরে থাকবি। কোনো খু*নির সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। গিয়ে মিতু ম্যামের সঙ্গে বন্ধুত্ব কর। ও তোকে শিখিয়ে দিবে কিভাবে স্বামীকে ফেলে তার বন্ধুদের সঙ্গে বারে রেস্টুরেন্টে ডিনার করা যায়। চার মাসের বাচ্চাকে পেটের মধ্যে খু*ন করে নিজের ভবিষ্যত উজ্জ্বল করা যায়।

শ্রাবণ নিজের ছাড়িয়ে নিলো। মিতু চোখ মুছে এগিয়ে এসে বলল,

> তুমি কিন্তু অভার রিয়েক্ট করছো। আমার নামে আজেবাজে কথাবার্তা বলে সকলের সামনে আমাকে ছোট করছো। কেনো মিথ্যা বলছো শ্রাবণ? আমি নেহায়েত তোমাকে ভালোবাসি তাই চুপচাপ হজম করছি।

> তোকে চুপ থাকতে বলেছে কে শুনি? তোর কু*ক*র্ম সকালের মধ্যে বাড়িতে পৌঁছে যাবে অপেক্ষা কর। তোর বর আমাকে নক দিয়েছিল। তোর নামে মামলা করেছে সঙ্গে তোর যত নোংরামি আছে তার প্রমাণ সঙ্গে পাঠাবে। ডিভোর্স ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে সেটাতো জানিস? আমি আরেকটা কাজ করেছি বুঝলি? তোর বাপকে খবর দিয়ে বলেছি “বহুকালতো মেয়েকে পরের বাড়িতে রেখে আয়েশ করলেন। এভাবে এই জঞ্জাল এখান থেকে নিয়ে গিয়ে আমাদের মুক্তি দিন। আমরা একটু বাঁচি।” আমার ফুপিকে সু*ই*সাইড করতে বাধ্য করেছিলো তোর বাপ। কার র*ক্ত দেখতে হবে না? যা কাপড় গুছিয়ে রাখ আমি দয়া করে পুলিশ ডাকছি না। প্রাক্তনের উপরে এইটুকু দয়া শ্রাবণ মাহমুদ ভিক্ষা দিচ্ছে। আর একটা গলাবাজি করেছিস তো আমার খারাপ রূপটা দেখিয়ে দিব। প্রমিজ করছি এমন হাল করবো পৃথিবীতে এক সেকেন্ড নিশ্বাস ফেলার মতো সাহস পাবিনা।

শ্রাবণ অপেক্ষা করলোনা। যেভাবে এসেছিল সেভাবেই চলে গেলো। মনে হলো কিছুক্ষণের মধ্যে ভুমিকম্প হয়ে গেলো। লিজা মা এসে মেয়েকে থা*প্প*ড় মেরে চুল টেনে নিয়ে গেলেন। ভাইয়ের থেকে মিতুর সম্পর্কে উনি কিছুক্ষণ আগে সবটা শুনেছেন। ভেবেছিলেন বাড়ির ঝামেলা মিটলে বলবেন কিন্তু এর মধ্যে এতোকিছু হবে ভাবতে পারেননি। মানুষ যতই ননদের ছেলেমেয়েদের ভালোবাসুক নিজের ভাইয়ের ছেলেমেয়েদের থেকেও সেটা বেশি না। ভদ্রমহিলা লিজাকে নিয়ে গিয়ে আচ্ছা করে পি*টালেন। এমন সাহস দেখানোর আগে এবার থেকে একশোবার ভাববে। মিতুর ভয়ে বুক কাঁপছে। ভেবেছিল অষ্ট্রেলিয়া গিয়ে যা করে এসেছে সেটা এখান অবধি পৌঁছাবে না। যদিওবা আসে ততদিনে নিজের জন্য আলাদা একটা জায়গা ঠিক তৈরী হয়ে যাবে। ভরসা ছিল শ্রাবণ আজ সেটাও শেষ। একে একে বাড়ির সকলের ওকে কথা শুনিয়ে দিলো। মিতু নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করলো। অতিরিক্ত লোভ মানুষের ধ্বংসের কারণ কথাটা বুঝতে অনেক দেরি হয়ে গেলো। এখন কূলকিনারা পাচ্ছে না।
****************
ভোররাতে আলো জ্ঞান ফিরলো। মাথা ভার হয়ে আছে। আবছা অন্ধকারে পাশে ছায়ামূর্তি দেখে ঘাবড়ে গেলো। হাত টেনে উঠতে চাইলো তার আগেই শ্রাবণ বলে উঠলো,

> তুমি ঠিক আছো? কোনো সমস্যা হচ্ছে?

আলো শান্ত হলো। ঘুমে চোখ জুড়িয়ে আসছে। শ্রাবণ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে পূণরায় বলল,

> কোনো অসুবিধা হচ্ছে?

আলো পাশ ফিরে ওর দিকে চাইলো। শ্রাবণের হাতের মুঠোয় ওর ডান হাত আবদ্ধ। আলো মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলো,

> আমি ঠিক আছি। আসলে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। আচ্ছা কোকটা কি ভালো ছিল না? ডেট অভার হয়ে গেছে হয়তো। ওখানে কতগুলো মানুষ ছিল। আপনি সবাইকে খেতে মানা করেছেনতো?

ওর বোকাবোকা কথা শুনে শ্রাবণের হাসি পাচ্ছে। তবুও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে ধমক দিলো,

> সাবধানে থাকতে বলেছিলাম না? সামনে কোক দেখে লোভ সামলাতে পারলেনা ওমনি ঢকঢক করে খেয়ে নিলে? বি*ষ আর অমৃতের মধ্যে কি পার্থক্য নেই? খাওয়ার সময় টেস্ট পরিবর্তন দেখলে তবুও খেলে নিলে?কি চমৎকার। আমার কপালে একটা বলদ জুটেছে। যে তখন পারছে সুযোগ পেয়ে বাঁশ দিয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে নিজের কপাল নিজে হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে দেখতে। সেখানে আরও কত ঝামেলা লেখা আছে কে জানে। এমন হলে সংসার কবে করবো আমি?

শ্রাবণের কণ্ঠ হতে আফসোস ঝরে পড়ছে। হুদাই রাগ হচ্ছে। খুব ইচ্ছা ছিল মিতুকে ইচ্ছা মতো পি*টিয়ে আসতে কিন্তু মহিলা মানুষ ভেবে ছেড়ে দিয়েছে। এখানে আরও তিনটা দিন থাকতে হবে। নিজের উপরেও রাগ হচ্ছে। ঘরটা খালি থাকলে আলো বাইরে যেতে পারতো না। দোষ ওর কম নেই। আলো ঘুমুঘমু কণ্ঠে ওকে চমকে দিয়ে উত্তর করলো,

> সকলেই খেয়েছে তাহলে একা আমাকে দোষারোপ করছেন কেনো?আপনি বাইরের লোকদের সঙ্গে ঝগড়া করে পারেন না বলে আমার সঙ্গে সেটা পুষিয়ে নেন। আমি জানিনা ভেবেছেন?

> আমি ঝগড়া করি? শুধু তর্ক ছাড়া কিছু পারোনা। চুপচাপ ঘুমাও। এই বাড়ির পেছনের বটগাছে ভুত আছে। অতিরিক্ত কথা বলে বিরক্ত করলে ওরা নেমে এসে ঘাড় মট*কে দিবে ।

আলো ভয়ে হাতপা গুছিয়ে নিলো। শ্রাবণের হাতটা আরও খানিকটা চেপে ধরে বালিশে মুখ গুজলো। দ্বিতীয়বার মুখ খোলার সাহস নেই। ভুতে প্রচুর ভয় ওর। শ্রাবণ বুঝতে পেরে সামান্য শব্দ করে হাসলো। মেয়েটা পরিস্থিতি বুঝে আচরণ করে। কখনও কঠিন, আবার কখনও নরম।
*******
বিয়ে বাড়িতে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সকাল সকাল কোর্ট পেপার সঙ্গে কয়েকটা এডাল্ট ভিডিও আর ছবি এসে হাজির হয়েছে। সেটা নিয়ে চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। ডাইনিং রুমে সকলে জড় হয়েছে। মিতু মাথা নিচু করে কান্নাকাটি করছে। শ্রাবণ রাত জেগে আলোর দেখাশোনা করেছে বিধায় এখনো ঘুমিয়ে আছে। আলো উঠে এসেছে। কড়া লিকারে একটা চা হলে কিছুটা ভালো লাগবে এই আশায়। মাথা এখনো ঝিমঝিম করছে। বাড়ির সকলে মিতুর বিপক্ষে কিন্তু অদ্ভুতভাবে রতন ওর পক্ষে সাফাই গাইছে। যেটা রাকার পছন্দ হলোনা। পাশ থেকে চাপা কণ্ঠে বলল,

> প্রথমবার যখন ওরকম কাজটা করলো তখন যদি কড়া করে ঠাটিয়ে একটা থা*প্পড় লাগানো হতো তাহলে এসব বদ বুদ্ধি করার সাহস পেতোনা। ছিঃ লজ্জা শরম থাকলে কি কোনো মেয়ে এহেন কাজকর্ম করে?

রতন নাক ফুলিয়ে ধমক দিলো,

> কাজকর্ম ফেলে উকালতি করতে তোকে কে ডেকেছে? আজকাল খুব গলা*বাজি হচ্ছে না? গলা না*মিয়ে দিব। চুপচাপ গিয়ে কাজকর্ম কর। বাচ্চাদের খাবার দে।

রাকা মাথা নিচু করলো। এতোগুলো মানুষের সামনে ধমক শুনে লজ্জা লাগলো। রতন ওকে বিয়ের পরদিন থেকে তুই করে কথা বলে। আগে শুনতে কেমন লাগতো নিষেধ করেও কাজ হয়নি তাই এখন আর বলেনা । রাকার চোখ ছলছল করছে তবুও উত্তর দিলো,

> আমার কাজ কি কেউ করে দেয়? গ*লা*বাজি আমি না বরং কে করছে সবাই দেখছে।

রাকার ইঙ্গিতপূর্ণ কথা শুনে রতন স্থির থাকতে পারলোনা। আগে থেকে রাগ ছিল সেটা ঝেড়ে দিতে রাকার গালে জোরে একটা থা*প্প*ড় বসিয়ে দিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে হৈচৈ পড়ে গেলো। পাশ থেকে বড়চাচি ধমক দিলেন,

> কি হচ্ছে রতন? অযথা বউমাকে মা*রছো কেনো? যে ভুল করছে শাস্তি সে পাবে। মিতুর বাবা আসছে ওকে নিয়ে যেতে। মানুষ করে বিয়ে দিয়েছি দায়িত্ব যা ছিল পালন করেছি বাকীটা ওর নিজের সিদ্ধান্ত। বহুবার বুঝিয়েছি আর কোনো সুযোগ নেই। সোনিয়ার বিয়েতে আমি আর কোনো ঝামেলা চাইছি না।খেয়াল রাখবে উপস্থিত আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে জেনো এই কথা প্রকাশ না হয়। এবার যাও।

রতন বড়মাকে ভীষণ শ্রদ্ধা করে। আদেশ পেয়ে চলে গেলো। একে একে জায়গা শূণ্য হলো কিন্তু রাকা পা তুলতে পারলোনা। ঘরভর্তি মানুষের সামনে অপমানিত হয়ে শরীর কেমন আনচান করছে। আলো পাশ থেকে সবটা লক্ষ্য করলো। রতনকে দেখে নিজের বাবার কথা ভীষণ মনে হলো। ভাবলো এরা নিজেদের রাগ ঝাল মেটানোর জন্য স্ত্রীর গালটাকে বেছে নিয়ে কি এমন আনন্দ পায়? রাকার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে ওর হাতটা ধরে শান্ত হয়ে চাপা কণ্ঠে বলল,

> নিজেকে তুমি যত নিচুস্তরের ভাববে ততই মানুষ তোমাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে ফেলতে চাইবে। সম্মান আর ভালোবাসা নিজ যোগ্যতা অনুযায়ী অর্জন করতে হয় বুবু। এই যে তুমি কাঁদছো,তোমার কান্না দেখে লোকজন আহা বললেই কি তোমার দুঃখ চলে যাবে? বুবু প্রতিবাদ শুধু তর্ক করলেই হয়না। চুপচাপ থেকেও প্রতিবাদ করা যায়। যেখানে তোমার সম্মান নেই, ঝড়ঝঞ্ঝা পার করতে বুকে আগলে নেওয়ার মতো একখানা ভালোবাসার বুক নেই সেখানে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে কি হবে বুবু? কতকাল চলবে এটা?

আলো থামলো। রাকার চোখের পানিও ইতিমধ্যে থেমে গেছে। আজ বাইরে বলে সামান্য থা*প্পড়ে রতন থেমেছে কিন্তু ঘরে হলে কি থামতো? যতক্ষণ রাগ থাকতো ততক্ষণ ঘর বন্ধ করে পি*টাতো। তারপর একটা দিন নিখোঁজ থেকে ঘরে ফিরতো তখন সবটা সেই আগের মতো। বউ পি*টিয়ে যে কাটা জায়গায় মলম লাগিয়ে ভালোবেসে রাগ ভাঙানোর প্রয়োজন হয় সেটা ওর ধাচে নেই। রাকাকে ভাবতে দেখে আলো হাসলো। আর কিছু বলার নেই বাকীটা রাকা নিজ দায়িত্বে করবে। মাঝে মাঝে একটুখানি খল নায়িকা হলে অসুবিধা কিসের? জীবন এতোটা সহজ না।

চলবে