#শানুর_সংসার (১০) (১৮+)
‘শরীর খারাপ তোর? খেতে এলি না কেন। রাজু, কি হয়েছে।’
রাজু মায়ের কথার উত্তর না দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে আছে। ডেলিভারি থেকে ফিরে চা – নাস্তা খায়নি। আলেয়া আক্তার ঔষধের নাম মিলিয়ে দেবার জন্যে ডাকলে যায়নি।
‘কিছু না, মা। তুমি এখন যাও।’
‘মাথা ধরেছ? শরবত করে দেই।’
‘আমার খাবার রুচি নেই। শার্টের পকেটে টাকা আছে নিয়ে নাও।’
‘তোর বাবা এসেছে, দেখা করে আয়। তোদের খবর নিচ্ছিলো’।
রাজুর মুখে এসে যাচ্ছিলো, ‘পারব না’। কিছু না বলে শুয়ে রইলো। শানু আরো কিছু সময় ছেলের রুম টুকটাক গুছিয়ে টাকা নিয়ে দরজা টেনে বেরলো। রাজুর মন খারাপ বুঝতে পেরেছে। কেন মন খারাপ তার কারন এত বড় ছেলে নিজ থেকে না বললে টেনে বের করার উপায় নেই। মেয়েঘটিত কোন ঝামেলা হলে শানু বলবে, বিয়ে করিয়ে দিতে। এ সময়ের আবেগ খুব ভয়ংকর। তুচ্ছ কিছু বড় আকারে মনের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকে। মেয়ের রুমে উঁকি দেয় শানু। মিশু হোমওয়ার্ক করছে। মেয়ের হাসি মুখ দেখে ভালো লাগে। বৃষ্টিতে ভিজে মিশুর সে কি আনন্দ। হাত মুখ নেড়ে আবার গল্প করলো মায়ের সাথে। মিশুকে উচ্ছল দেখে শানুর বুকের পাথর পাহাড় ভোঙে টুকরো হয়ে গুড়িয়েছে। শানুর সাথে মিশু ঐ ছেলেটাকে নিয়েও কথা বলেছে। মিশু বলেছে, ও আর ভয় পাবে না। মেয়েকে শক্ত হতে দেখে শানুর বুকে বল আসে। জগত বড় বিষাক্ত। মেয়েরা দূর্বল থেকে দূর্বল হলে সমাজের লাভ। ইচ্ছে মতন খাটিয়ে মারা যায়।
আসিফ টিভিতে ‘দি কপিল শর্মা ‘ শো দেখে হাসছিলো। স্বামীর মন ভালো দেখে শানু পাশে গিয়ে বসে। আসিফের মাথায় কাঁচা পাকা চুল গায়েন। মনে হয় কলপ করিয়েছে। শানু বসতেই আসিফ উঠে আলমারি থেকে একটা শাড়ির প্যাকেট বের করে আনে।
‘এটা তোমার জন্য।’
শানু উদগ্রীব হয়ে শাড়ির প্যাকেট হাতে নেয়। আসিফ কত বছর পর তার জন্য নতুন কিছু কিনে আনলো। গোলাপী রঙের খাড্ডি কাতানের গায়ে সোনালী জরির পেটানো কাজের দারুণ সুন্দর শাড়ি। শানু আয়নায় গিয়ে নিজের গায়ে মেলে ধরে। আসিফ আবার টিভি ছেড়ে দেখছে। শানু শাড়ির গায়ে হাত বোলায়। শাড়িটা মসৃণ, মিষ্টি রঙ, নিখুঁত কারুকাজের চমৎকার উপহার৷ আসিফের নজরের তারিফ করে শানু।
‘থ্যাঙ্কিউ, আমার খুব পছন্দ হয়েছে।’
‘শাড়িটা পরে আসো, তোমাকে কেমন লাগে দেখি।’
বহুদিন পর স্বামীর আবদারে শানির মন নাচে। দৌড়ে সে আলমারি খুলে আতিপাতি দিয়ে ব্লাউজ খোঁজে। ‘কাজের সময় দরকারী জিনিষের হাত -পা গজায়’ কথাটা মিথ্যে না। শানু গোলাপী কাতান ব্লাউজ পায় না। শেষে সুতি ব্লাউজ নিয়ে বাথরুমে ঢোকে। শরীর ধুতে হবে। শানু হাত চালিয়ে ডলে শরীরে সাবান ঘষে, মাথার চুল ধোয়। আসিফ তাকে আগের মত ডাকে না। তাই শরীরের যত্ন নেয়া হয় না। বৃহস্পতিবারেরা এখন অন্য দশটা সাধারন দিন। মনে মনে নিজেকে দোষ দেয় শানু। ‘মুখপুড়ী, স্বামীর যখন মন চায় তখন ডাকবে, তোকে তৈরী হয়ে থাকতে হবে না!’ ঝট করে শাড়ি পরে রোজীর দেয়া ‘শ্যানেল’ পারফিউম গায়ে মাখে। রোজী বলেছে, এই সুগন্ধি স্বামী বশকারী। চোখে কাজল আঁকতে গিয়ে এলোমেলো করে ফেলে শানু। তাকে আজ কি অস্থিরতায় পেয়ে বসেছে। চোখ মুছে আবার কাজল টেনে ঠোঁট রাঙায় কোনমতে। শ্যাম্পু করা চুল ছেড়ে স্বামীর কাছে যেতে শানুর লজ্জা লাগে। আসিফ কি ভাববে! শানু স্বামী সোহাগের জন্যে পাগল হয়ে ছিলো?
‘সুন্দর লাগছে তোমাকে। শাড়িটা মানিয়েছে।’
‘তুমি পছন্দ করে এনেছো। সুন্দর না হয়ে কোথায় যাবে।’
স্বামীর মুখের প্রশংসা শুনে শানু লজ্জা পায়। আসিফ তাকে কাছে টেনে পিঠে হাত বোলায়। শানু চোখ বন্ধ করে ফেলে। আসিফ ব্লাউজের ভেতর দিয়ে শানুর স্তন আকড়ে ধরে। শানু এবার নেতিয়ে গেলে, আসিফ শানুর স্তনের অগ্রভাগ ঘষে আঙুল চালায় দ্রুত। শানুর অস্ফুট চিৎকারে আসিফের গতি বাড়ে। স্বামীর মুখ বোতাম খোলা ব্লাউজের কাছো টেনে স্তনে চেপে নেয় শানু। আসিফ ব্যস্ত হয় স্ত্রী শরীরের নিম্নভাগের দরিয়া সেচন কাজে। সেখানেও আসিফের হাত মুখ সচল হয় সমানবেগে। শানু তড়পায়, ছটফট করে কাটা মুরগীর মতো। আসিফ আজ তাকে সুখ সায়রে ভাসিয়ে দিচ্ছে। সাময়িক স্খলন শেষে শানু আসিফকে আবারো কাছে টানলে, আসিফ সরে বসে। শানু খুশী প্রকাশ করে না। প্রিয় যা কিছু তা খানিক গোপন থাকা ভালো।
‘ওরা সবাই কি করছে ‘।
‘রাজু শুয়ে আছে, মিশু পড়ছে। আম্মা কোরআন শরীফ নিয়ে বসেছেন।’
‘আম্মা দোকান নিয়ে কি ভাবলেন, জানো কিছু?’
‘আমাকে বলেননি। তুমি জানতে চাইছো যে।’
‘কাজে না আসলে বিক্রি করে দিক। এক দোকান করা নিয়ে বছর ঘুরিয়ে দিচ্ছে, অযথা টাকা নষ্ট করলেন।’
আসিফ মায়ার হাতে শানুর মাথার চুলে বিলি কাটে। স্নেহের আতিশয্যে শানু স্বামীর বুকে মাথা রাখে।
‘তুমি কি আমার থেকে কিছু লুকাচ্ছো শানু?’
চমকে উঠে মুখ তুলে আসিফের দিকে তাকায় শানু। কি বলবে বুঝে উঠতে পারে না।
‘তোমার আলাদা ব্যাংক একাউন্ট খোলার প্রয়োজন হলো কেনো। আমার একাউন্টে টাকা জমা রাখো। ‘
‘ছোটখাটো একটা কাজ শুরু করেছি।’
‘কি কাজ?’
‘মিষ্টি বানিয়ে দেই। ওখান থেকে অল্প কিছু টাকা আসে। ‘
‘ভালো কথা সেটা। কিন্তু, শানু এটা তোমার সংসার। সংসারের সময় বাদ দিয়ে নিজের কাজের জন্য আলাদা করে সময় বের করাটা কি ঠিক?’
‘সংসারের কাজের সমস্যা হয় না। ঐ যে নিউমার্কেট যেতাম, এখানে সেখানে ঘুরতাম এখন আর যাই না। বাসায় থেকে কাজ এগিয়ে রাখি।’
আসিফ আড়মোড়া ভাঙে। শানুর কথা সোজারসরল, ফাঁকফোকর বের করেও প্যাঁচানো যায় না।
‘আমি তোমাকে চাকরি বাকরি করতে মানা করেছি কেনো? তুমি যাতে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে ছেলে মেয়ের যত্ন নিতে পারো। আমি যত পারি খাটবো, রোজগার করব। সংসার তোমার হাতে তুলে দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত থাকি শানু। ‘
‘তুমি না চাইলে, আর করব না। সামনে কয়টা অর্ডার আছে। ওগুলো শেষ করি।’
‘ আমাকে অন্ধকারে রেখে, না জানিয়ে আমার পেছনে কাজ করো, শানু। আল্লাহ কি সহ্য করবে?’
শানুর চোখ ভরে কান্না পায়। স্বামীর অগোচরে কাজ করতে সে চায়নি। আসিফ যে এত সহজে মেনে যাবে কে জানত।
‘বাচ্চাদের দেখে আসো, রাজুর টেস্ট শুরু হবে৷ বাইরের দুনিয়া থেকে নিজেকে সরিয়ে ছেলের পেছনে বসো। মিশুর সামনে এস এস সি পরীক্ষা। মেয়েকে নিয়ে কোচিং এ দৌড়াও। পয়সার চিন্তা তোমাকে করতে হবে না। আমি সব সামলাবো। তুমি ঘর থাকো শানু৷ আমার এতেই শান্তি।’
শানু মাথা নেড়ে আসিফের কথায় সায় দেয়৷ যে লম্বা অর্ডারের লিস্ট সে নিয়েছে তা শেষ করতে ও দেড় থেকে দুই মাস। নতুন করে আর কিছু নেবে না শানু৷ কুশিকাটার কাজ করবে, একদম থামিয়ে না দিয়ে অন্য দিকে একটু হলেও কাজ ধরে রাখলো। সংসার তো করেই শানু, তার একার সংসার। সংসারে কাজ করতে করতে যখন প্রাণ হাঁপায়, শানু তখন এই কাজে স্বস্তি খুঁজে পায়।
রাজুর টেস্ট পরীক্ষা শেষে আরো কিছুদিন পর কাশিফদের দাওয়াত করে শানু। তখন ওরা ভাতিজার পরীক্ষা দেখে আসেনি। আলেয়া বেগমের দোকান এখনো ভাড়া হয়নি। তিনি প্রায়শই ছেলেদের কাছে অনুযোগ করেন, দোকানের একটা গতি হলো না। শানু মা ছেলের বাকবিতন্ডায় হাজির থাকে না।
বাজারের খরচ চেয়ে আসিফের কাছে টাকা চেয়ে ধমক খেয়েছে শানু। কাশিফরা আসবে, আসিফকে মনে করিয়ে দিলে আসিফ নাকি বাজার করে আনত। আজকাল কার্ড দিয়ে চটচট অনেক কিছু দোকান থেকে কিনে ফেলা যায়। শানুর ধারনা নেই। তার টাকা আর পয়সার হিসেব গোনা অভ্যাসের জীবন। রাজুটা কেমন মিইয়ে গেছে। পরীক্ষা শেষে বন্ধুরা মিলে রাজবাড়ী ঘুরতে গেলো। রাজু যাবে না। সারাদিন পরীক্ষার পড়া পড়ে। একটু সময় পেলে ফ্রিল্যান্সিং এর কাজ শেখে। রাজুকে কিস্তিতে একটা ছোট ল্যাপটপ কিনে দিয়েছে শানু৷ আসিফ এর কিছু জানে না৷ অফিসের কাজের চাপ নাকি বেড়েছে খুব। আসিফকে প্রায়শ ঢাকার বাইরে যেতে হয়। রাজু ঠিক করে বাবার সাথে কথা বলে না৷ আসিফ অবশ্য বিষয়টা সহজ ভাবে নিয়েছে বলে রক্ষা। পরীক্ষার ভয়ে আসিফ ও নাকি ঐ সময় শানুর শ্বশুরের সামনে পরত না৷ শানুর মাথায় ঘুরছিলো, রাজুর মুখ। ডেলিভারি করে এসে সেই যে ছেলেটা ঘর অন্ধকার করে শুলো, তারপর বদলে গেছে। একটা দানা মুখে তুলতেও যেনো অনীহা। গতকাল আসিফ শানুকে কুশিকাটার কাজ করতে দেখে খেপে গেলো।
‘আমাকে বান্ধবীরা কিছু টাকা পাঠিয়ে ছিল। এই কাজ করে দিব তার অগ্রীম হিসেবে।
‘তোমাকে মানা করে ছিলাম, শানু।’
‘অল্প করে কুশিকাটার কাজ করে দেব। সুতো কিনব, কুরুশ কিনব। ‘
‘আচ্ছা, তারপর পাঠাবে কিভাবে। বাড়ি বাড়ি ফেরী করবে?’
‘না, ওরা এসে নিয়ে যাবে। ‘
আসিফ কাজে চলে গেলে শানু ক্যালেন্ডারের পাতায় দাগ কাটে৷ আর অল্প কয়েকটা দিন, তারপর শানুর এই সামান্য আনন্দ উৎসেও ইতি টানতে হবে। কাশিফদের জন্য কাবাব বানাতে বসে শানু। হাতে সরিষার তেল মেখে নেয়। গুনে গুনে একশটা কাবাব বানিয়ে হালকা ভেজে রাখে। গরুর গোষ আগে থেকে মাখিয়ে রাখতে হবে৷ রুম্পা খাসির গ্লাসি খেতে ভালোবাসে। আলেয়া আক্তার ছেলে চলে গেলে শানুর কাছে আসেন। আসিফের সামনে তার যেতে ইচ্ছে করে না। ছেলে তাকে গদগদ হয়ে নানা প্রশ্ন করা শুরু করে। দোকানের খবর যেচে পরে নেয়। আলেয়া আক্তার শুধু শুনে যান। হু হা উত্তর দিয়ে শেষ করেন। আসিফ তাকে দোকানের সংস্কার বাবদ হাজার চল্লিশেক টাকা দিয়েছে। আলেয়া আক্তার সেটা আলমিরায় তুলে চাবি মেরে রেখে দিয়েছেন।
রান্নাঘরে ঘেমে নেয়ে একাকার শানুর কাছে ছোট চার্জার ফ্যান চালিয়ে দেন আলেয়া আক্তার। শাশুড়ীকে ফ্যান চালাতে দেখে শানু অবাক হয়। এত বছরে কোন দিন শানুর কষ্ট কেউ চোখে দেখে কদর করতে আসলো না। আজ কি মনে করে এত আদর জুটছে! কাশিফরা আসবে দেখে হয়ত।
‘আম্মা, কাশিফের জন্য বড় বড় গলদা চিংড়ি এনেছি। ‘
‘তুমি দুপুরে ভাত খেয়েছো?
‘খাবো নে আম্মা।’
শানু কাবাবের তেল ছেঁকে আবার নতুন করে তেল ঢালে। তার জীবন চুলোর তাপে পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। এই তাপকে ভালোবাসায় পরিনত করেত চেয়ে ছিলো৷ সেখানেও বাধা এলো। আজ সে দুপুরে খায়নি৷ শাশুড়ী মনে রেখেছেন দেখে শানুর মন ভালো হয়ে যায়।
‘ ভাজাভুজি শেষ করে গা ধুয়ে একবারে খাবো। আম্মা বসেন, দেখেন তো কাবাবের ময়ান ঠিক হলো কি না’।
‘তুমি ভাজো, ভাতের পাতিল কই?’
আলেয়া আক্তার কথা বলতে বলতে হাড়ি কুড়ি নেড়ে দেখেন। ঠান্ডা ভাতের ওপর ছোট মাছ আর লাল শাক ভাজা নিয়ে ওভেনে গরম করে শানুর মুখের সামনে তুলে ধরেন।
‘খেয়ে নাও। শরীর শক্ত করো। শরীর ঠিক থাকলে দুনিয়া ঠিক৷ বিছনায় পরলে শত আপনও পর হয়ে যায়৷ ‘
‘আমার হলো মেয়ে মানুষের শরীর আম্মা। শত আঘাতেও মরব না। ছেলে- মেয়ে বিয়ে দিয়ে টুপ করে মরে যাবো।’
আলেয়া আক্তার নিঃশব্দে লম্বা করে শ্বাস ফেলেন। শানুর পৃথিবীতে এই সংসারটা জুড়ে আছে। সব সংসার শক্ত আর মজবুত হয় না। সংসার করার যোগ্যতা সকলের নেই। শানুর শতভাগ সংসার অন্তঃপ্রাণ মেয়ে। মিশুর ভবিষ্যত কেমন হয় আলেয়া বেগম জানেন না। মাকে দিয়ে সন্তান মাপা যায় কথাটা সর্বৈব ভুল এবং মিথ্যা৷ সন্তান মাপতে হয় বীজ দিয়ে। বীজের মালিক পিতা। তিনি ইদানিং সব বোঝেন।
‘দেখি হা করো। তুমি কাজ শেষ করে খেতে খেতে মাগরিব পার হয়ে যাবে। ‘
আলেয়া আক্তার ছোট ছোট লোকমা তুলে শানুকে ভাত মেখে খাইয়ে দেন। চোখের জলে সৃষ্টিকর্তা লবনের পরিমান কম দিলে ভালো করতেন। শানুর কাবাবটা বোধহয় লবনাক্ত হয়ে গেলো।
কাশিফ আলেয়া আক্তারের জন্য রাজ্যের ফলমূল নিয়ে এসেছে। আলেয়া আক্তার সেখান থেকে কিছু মাথার কাছে তুলে রেখে বাকিটা মিশুকে ফ্রিজে রাখতে দিলেন। মিশুর প্রিয় পিউলা ফল এনেছে চাচা। শানু সেদিন বিশ টাকার পিউলা কিনে এনে ছিলো। মিশু বেছে বেছে পাকা দেখে লাল গোল পিউলা মুখে পুরে চাবায়। বিচি সহ কচমচ করে খেতে মিষ্টি মিষ্টি লাগে। আলেয়া আক্তার আগে নাতনীকে ফল গুলো রেখে আসতে বলেন। কাশিফ গলা খাঁকারি দেয়। মায়ের সাথে স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে বাক্যালাপ কি ভাবে শুরু করবে তাই চিন্তা করে।
‘আম্মা, আপনি কি এভাবে চুপ করে থাকবেন?’
‘আর নয়ত উপায় কি। তুই তোর ভাইকে চিনস না। তার সাথে কথা বলার উপায় আছে কোন?’
‘আম্মা, বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে কিন্তু। ‘
‘চুপ কর। লোক জানাজানি হলে সমাজে তুই মুখ দেখাতে পারবি না। আমি কোথায় যাবো।
‘সবাই মিলে আমার ওখানে উঠবেন।’
‘ তোর বাসায় আমাকে চব্বিশ ঘন্টা দেখার জন্য তো কাজের লোক রাখবি। এই মেয়েটা আমাকে যেমন করে দেখে সে কি সেভাবে দেখবে?’
‘আম্মা, সব কিছুর একটা না একটা সলিউশন আছে’।
‘তোর সলিউশন তোর কাছে রাখ। মিশুর কথা মনে কর। এই মেয়ের ভবিষ্যতে বিয়ে শাদী দেয়ার সময় বাপের কথা কি বলবি? বলবি, আরেকটা সংসার আছে? অত বড় ছেলেটা কুপথে চলে যাবে। তার দায় কে নেবে, তুই না তোর বউ। ‘
রাজু দাদীর রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে সবটা শুনতে পায়। মা তাকে সবাইকে খেতে ডাকার জন্যে পাঠিয়েছে। রাজুর ভীষণ রাগ উঠে গেছে। যে আছে যার যার হিসাবে। মায়ের কথা কেউ ভাবছে না। ঐ মানুষটা যেন মানুষই নয় কারো চোখে। ব্যাটারি দেয়া পুতুল, হাসতে বললে হাসবে, কান্নার দৃশ্য দেখলে কাঁদবে। যার যার প্রয়োজন মিটিয়ে ব্যাটারী খুলে চার্জে লাগিয়ে দেবে। পরদিন সকাল থেকে যেন আবার নতুন করে সকলের দায় নিজের কাঁধে টেনে নিয়ে জোয়াল টানতে পারে। রাজু রুমের ভেতর ঢোকে না, দরজা থেকে ডেকে চলে যায়।
শানু আসিফের প্লেটে ইলিশ মাছ তুলে দিলো। শুক্রবার দুপুর, বাড়ির সকলে খেতে বসেছে৷ কাশিফ টেবিলের উল্টো পাশে ছেলেকে মাছের কাঁটা বেছে খাওয়াচ্ছে। শানু খেতে বসেনি। সবার পাতে খাবার দিয়ে টেবিল গুছিয়ে ডেলিভারি বয়কে খাবার বুঝিয়ে দিয়ে তবে শান্তিতে দুটো মুখে তুলবে। আসিফের শক্ত চোখমুখ দেখে আগে ডাকার সাহস পায়নি। আলেয়া আক্তার বারবার শানুকে চোখে ইশারা করে কাশিফের থালা দেখান। শানু আরেক পিস দেশী মোরগের রোস্ট তুলে দিতে গেলে কাশিফ মান করে।
‘ভাবী, খাওয়াতে খাওয়াতে হাতি বানিয়ে ফেলবে। ‘
‘প্রতিদিন কি আর খাস এসব। আর যাই বলিস, শানুর হাতের রান্নার জবাব নেই।’
‘তুমি ভাবীর রান্নার তারিফ করছো, ব্যাপার কি ভাইয়া।’
আসিফ কথা বলে না, মাছের তেল দিয়ে বেগুনের ঘাটি খেয়ে এবার সে বেশ তৃপ্ত। শানু গরুর সাদা কোরমা থেকে বেছে সুদ মাংস দেয় জায়ের ভাতের ওপর। কাশিফের বউ রুম্পা আরাম করে খায়। ভাবীর রান্না আসলেই মজা। কাশিফ ওত পেতে থাকে বড় ভাইয়ের বাসায় খাবার জন্যে। ছেলের স্কুলের পরীক্ষার শিডিউল আর কোচিং এর ঝামেলায় আসা হয় না৷
‘কোফতা বাটি করে রেখেছি, তোমরা সাদা ভাত দিয়ে পছন্দ করো।’
‘ভাবী, এত কিছুর পর ওটাও মনে রেখেছ? তুমি সত্যি ইউনিক।’
শানু নতুন কেনা নাশতার ট্রলি ঠেলে টেবিলের পাশে সেট করে। জুসের জন্য আলাদা দুই রকমের জার রয়েছে৷ ট্রলি ভরা নানান পদের ডেজার্ট। তার মাঝে শানুর স্পেশাল কুচো সন্দেশ রয়েছে। রুম্পা সন্দেশ তুলে নিয়ে কামড় বসায়।
‘উম, একদম সেইম টু সেইম। ভাবী, এটাই খেয়েছি বড় আপুর বাসায়। ওর ননদের আত্মীয়া নিয়ে গিয়ে ছিলেন। তোমার কিচেনের নাম কিন্তু ছড়িয়ে যাচ্ছে। ঘটনা কি!
শানু রুম্পার কাঁধ খামচে ধরে। আসিফ খাওয়া থামিয়ে তাকিয়ে আছে। কাশিফের সামনে আসিফ ঝামেলা করতে চায় না। শানুকে পরে ধরা যাবে। তবে, রুম্পার প্রশ্নের উত্তর যেন আসিফ জানে। শানু কিছু বলার আগে আলেয়া আক্তার বলেন,
‘খাও এখন। ওর একটু শখ হয়। এটা সেটা বানায়। তোমার শেখা লাগলে, এসে শিখে নিও।’
রুম্পারা চলে গেলে শানু ডেলিভারি বয়কে বিদায় করে। রাজু টেবিলে বসে ভাত খাচ্ছে। সবার সাথে এসে বসেনি। শানু ছেলের মাথায় হাত বুলায়।
‘খেয়ে চুল আঁচড়ে বাইরে থেকে ঘুরে আয়’।
রাজু খাওয়া থামিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মাকে এত ভালো হতে কে বলেছে। বন্ধুদের মায়ের মতো জাহাবাজ দজ্জাল মহিলা হলে বাবা কোনদিন এমন কাজ করার সাহস পেত না।
‘মা, আমার আয় রোজগার বাড়লে, ধরো কোন কারনে যদি আমার সাথে তোমাকে কোথাও যেতে হয়, যাবে?’
‘আমার সংসার ফেলে আমি কোথায় যাবো?’
‘ধরো, তুমি বেড়াতে যাবে। সেদিন, আমার সাথে গেলে।’
‘বেড়াতে যাওয়া আর তুই যেমন বললি, তেমন যাওয়া আলাদারে বাবা। এটা আমার ঘর, আমার সব এখানে, আমি এই সংসার ছেড়ে কোথাও যাবো না।’
রাজু খাওয়া শেষ করে মায়ের হাত নিজের মাথায় টেনে নেয়। শানু রাজুর কাজ দেখে হাসছে। ছেলেটা তার এত বড় হলো, তবু বাচ্চাপনা গেলো না। সেই ছোটবেলার মতন করে, মায়ের কাছ থেকে কথা আদায় করে নেবে।
‘যদি কোনদিন কোথাও চলে যেতে মন চায় মা, আমাকে ডাকবে। ‘
‘ডাকব না, তোর কানটা ধরে তোকে আর মিশুকে নিয়ে যাবো। রাজু, তোর পরীক্ষা শেষ হলে সিলেট বেড়াতে যাই। মিশুকে একটা ময়ূরপঙ্খী জামা বানিয়ে দেব। রেহানা ভাবী বেড়াতে গিয়ে ছিলো। তোর বাবাকে বলবো, আমাদের নিয়ে যেতে। আমি একটু একটু টাকা জমাচ্ছি ‘।
শানু আপন মনে সিলেট গিয়ে কি কি করবে তার ফিরিস্তি দেয়। রাজু মাকে লুকিয়ে নিয়ে আবারো চোখের পানি মোছে। আলেয়া আক্তার পর্দার আড়াল থেকে সবটা দেখেন। রাজুর আচরণ তার ভালো ঠেকে না। নাতিকে প্রশ্ন করতেও তিনি ভয় পান। পাছে, শাক দিয়ে ঢাকা মাছ প্রকাশে গন্ধ না বের হয়।
—–
‘ঘরে বিরিয়ানি রান্না থাকুক, পুরুষ লোক ঠিক বাইরে ঝোল চাটতে যাবে।’ শিউলি রোজীর হাত খামচে তাকে থামায়। শানু রেস্তোরাঁয় ঢুকেছে। ঝলমল করতে করতে এগিয়ে আসা শানুকে দেখে ওরা দু’জনে এ ওর মুখের দিকে তাকায়। এমন সুখী একজন মানুষ শানু। দুঃখ ভুলে সুখ নিয়ে বেঁচে থাকে।
‘বেশী দেরী করতে পারবো না। তুই দেশে এলি দেখে দৌড়ে দেখা করতে আসলাম।’
‘কি এমন কাজটা করিস সারাদিন, সেই তো থোড় বড়ি খাড়া খাড়া বড়ি থোড়া’।
‘কিচ্ছু করি না। সকালে ঘুম থেকে উঠে রান্নাঘরে ঢুকি, আর ঘুমতে যাবার আগে রান্নাঘর থেকে বের হই। মাঝে ছেলের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস এলে ওকে ডেকে তুলি। মেয়েকে কলেজ কোচিং এ পৌছে দেই। ‘
‘আর বিজনেসটা?’
শিউলি আগ্রহ করে জানতে চায়। শানু মেঝের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি আটকে নেয়।
‘আছে রে, অল্প করে ধরে রেখেছি। আসিফ একদম পছন্দ করে না তো। ও বলে, সংসার চালাবার দায় ওর। আমার এত রোজগারের ধান্দা করার দরকার কি।’
‘থাক, আয় গল্প করি। শোন, ফেরার পথে আমরা একটু যমুনা ফিউচার পার্ক হয়ে যাবো। তোর দেরী হলে চলে যাস।’
‘ বাসায় সব করে এসেছি। উপরতালার রেহানা ভাবী মিশুকে নিয়ে আসবে। মহিলাটা খুব ভালো, জানিস। আমি ওনার বাসায় গিয়ে ব্যবসার কাজগুলো করি। আমাকে কত কিছু এগিয়ে দেয়। আবার কাজে হাত লাগায়। ‘
‘আর ডেলিভারী ম্যানটার কথা বললি না?’ রোজি কপট রাগ দেখায়। শানুর গালে পড়ন্ত সূর্যের হালকা আলোয় আকাশে জমে ওঠা লালিমার আঁচ লাগে।
‘বাবু নিজ থেকে ডেলিভারি দিতে রাজী হয়েছে। সবাই এত সাপোর্ট দিলো, আমি কাজটা ছাড়তে পারলাম না। ‘
শিউলি আর রোজীর সাথে কথায় কথায় বেলা গড়িয়ে গেলে শানুরা বের হয় শপিং এ যাবার জন্য। রোজী আস্তে আস্তে শিউলিকে ডেকে বলে,
‘যাবে তো, সত্যি জানিস?’
‘আমার নিজের কানে শোনা। বদমা ইশ গুলো অনেকদিন থেকে লিভটুগেদার করে। বেশ বড়লোকের মেয়ে, শানুর জামাইয়ের সাথে সম্পর্কে ধরা খেয়ে ডিভোর্স হয়েছে।’ ‘বাচ্চাটা আবার ঐ ঘরের।’
‘শানুর জামাইয়ের তাহলে কি হয়, সুগার মাম্মী?’
‘কি শুনেছিস রে। আসিফকে জানিয়ে দেই, আমার যেতে দেরী হবে।’
‘একদম না। তুই চল আমাদের সাথে। পরেরটা পরে দেখিস।’
শিউলির কেনাকাটার বহর দেখে শানু চোখ কপালে তোলে। এত এত জিনিষ কিনেও নাকি কেনা বাকি রয়ে গেলো। শানু হাঁটতে হাঁটতে কাপড়ের দোকানে ঢোকে। দোকানটা দেখে তার শাশুড়ীর সাথে দোকান দেখতে যাবার দিনের কথা মনে পরে। হঠাৎ পরিচিত কন্ঠস্বর শুনে শানু চমকে ওঠে। আসিফের কথা শোনা যাচ্ছে। শানু ধীর পায়ে বাচ্চাদের সেকশনে ঢোকে। ঐ তো, এক সুন্দরী মহিলা আসিফের বাহু ধরে হাসতে হাসতে কাপড় দেখছে। মহিলার পরনের শাড়িটা হুবুহু যেন শানুর সেই গোলাপী কাতান। আসিফ মহিলার চুলে মুখ ডুবিয়ে আবার সোজা হয়ে দাঁড়ায়৷ বারবার মহিলার খোলা পিঠ আর কোমড়ে হাত রেখে আসিফ কথা চালিয়ে যাচ্ছে। সেলসগার্ল দু’জনের ভালোবাসা দেখে হাসে৷ কোথা থেকে আয়া গোছের একটা মহিলা ছোট বাচ্চা নিয়ে এগিয়ে এলে, বাচ্চাটা আসিফের কোলে ঝাঁপিয়ে পরে। আসিফও বাচ্চা কোলে নিয়ে মহিলা সাথে হাঁটে। শানু ওদের পিছু পিছু পুরো দোকান ঘুরে কাউন্টারে এসে থামে। বাচ্চাটা আসিফের কোলে থাকতে চাইছে না। মহিলাও সাজ নষ্ট হবার ভয়ে হয়ত সন্তানকে কোলে তোলে না। শানুকে দেখে শিশুটি তার দিকে হাত বাড়ায়। আসিফ হাসি মুখ করে শিশুটিকে নিয়ে পেছন ফিরতেই মুখোমুখি হয় তার অনেক বছরের চিরপুরাতন বহু ব্যবহৃত বিবাহিত স্ত্রী শানুর।
আসিফের চোখে চোখ রেখে শানু জীবনে প্রথম বারের মতো স্পষ্ট ভাষায় গলায় আওয়াজ তুলে প্রশ্ন করে, ‘ এই মহিলার সাথে তোমার কিসের সম্পর্ক? ওরা তোমার কে হয় আসিফ?’
চলবে।