শুভ্র রঙের প্রেম পর্ব-১৮

0
2017

#শুভ্র_রঙের_প্রেম
#রুবাইদা_হৃদি

পর্বঃ১৮
ভোরের হালকা আলোর সাথে শোঁ শোঁ শব্দে খোলা জানালা দিয়ে মৃদু বাতাসের হাতছানিতে রোমাঞ্চকর অনুভূতি হলেও পাশে থাকা মানুষটাকে দেখে হৃৎপিন্ডের কম্পন বেড়ে যাচ্ছে৷ শীতল পরিবেশেও ঘাম ছুটে যাচ্ছে সেই সাথে গলা শুকিয়ে কাঠ! আমি যথাসম্ভব বাসের জানালার সাথে একদন লেগে বসে আছি আর মনে মনে নীতিকে বকে উদ্ধার করছি৷
–‘ জানালা ভেঙে বের হয়ে যাওয়ার ইচ্ছা আছে নাকি তোমার?? ‘

–‘ আ..আমা..র গরম লাগছে ত..তাই হাওয়ার কাছাকাছি বসার চেষ্টায় আছি৷ ‘ মুখে জোরপূর্বক হাসি টেনে বললাম৷ আমার কথা শুনে জম মানে দ্যা ওয়ান এন্ড অনলি স্নিগ্ধ স্যার মৃদু হেসে কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন,
–‘ আমি স্নিগ্ধ তাই আমার আশেপাশের হাওয়া স্নিগ্ধ,কোমল! আমার কাছে এসে বসো তীব্র গরমের মাঝের স্নিগ্ধময় স্নিগ্ধতা অনুভব করবে৷ ‘
উনার কথা শুনে আমি পারলে জানালা ভেঙ্গে ছুটে পালাই৷ কেমন অসভ্য লোক রে বাবা! দিনে দিনে সভ্যতা হারিয়ে ফেলছে৷ শিক্ষকের এমন অবস্থা হলে দেশ তো গোল্লায় যাবে৷ একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে এই দেশের অবনতি মেনে নেওয়া যাবে না৷ আমি হাজার চেষ্টা করে কাট কাট গলায় বললাম,
–‘ স্নিগ্ধতা অনুভব করতে পারছি না স্যার৷ দ..দূরে সরে বসুন আমার বমি বমি পাচ্ছে৷ ‘

–‘ মাই গড হৃদি! শেষে কিনা বিনা কিছু করেই বাচ্চার বাবা হতে চলেছি৷ ‘ উনার কথা শুনে হেঁচকি উঠে গেল আমার৷ আমার অবস্থা বেগতিক! একনাগাড়ে হেঁচকি উঠেই চলেছে৷ আমার অবস্থা দেখে মূহুর্তেই ভ্রু জোড়া কুঁচকে পানির বোতল এগিয়ে দিলেন৷ আমি খপ করে নিয়ে পানি খেতে গিয়েও গলায় বেঁধে যেতেই আরেক কান্ড৷ চোখ বড় বড় করে পানিটুকু খাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করলেও বুকের মাঝে ব্যথা করে উঠে৷ মুখ দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না৷ আমার অবস্থা দেখে ভড়কে গেলেন উনি৷ মাথায় হাত দিয়ে অস্থির গলায় বললেন,
–‘ হোয়াট হ্যাপেন হৃদি?? কাম ডাউন! জোরে জোরে নিঃশ্বাস নাও৷ ‘ আমার পিঠের পেছন দিয়ে হাত দিয়ে শক্ত করে একহাতে জড়িয়ে ধরে অন্যহাতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
–‘ রিলাক্স৷ এখন ঠিক আছো?? ‘
সব কষ্ট দূর হয়ে গিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে আছি৷ উনি এখনো অস্থির চোখে তাকিয়ে আছেন৷ কেমন ভয় মাখা সেই দৃষ্টি৷ আমাকে একভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুচকি হেসে বললেন,
–‘ তাকিয়ে থেকো না প্রেমে পড়ে যাবে৷ ‘ আমি এক ঝটকায় উনার হাতের বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম৷ জোরে হেসে উঠতেই আমি বললাম, ‘ হুশশ! আস্তে হাসুন৷ ‘ আমার কথা শুনে চুপ করে গেলেও হেসেই চলেছেন৷ মহা বিরক্তকর তো! সব দোষ নীতির৷ এই সভ্য মানুষের সাথে মিলে ছলনা করেছে৷
ভোর সাড়ে চারটা নাগাদ সবাই ক্যাম্পাসের মাঠে উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও একমাত্র আমি লেট করেছি৷ নীতি কাল রাতের ঘটনার জন্য ডাকে নি আমাকে৷ এলার্মের আওয়াজে ঘুম ভাঙতেই লাফিয়ে উঠে বসে দেখি,০৪ঃ৪৩ বাজে! নীতিকে ডাকতেই ফোন বেজে উঠে৷ কল রিসিভ করতেই নীতি থমথমে গলায় বলল,
–‘ জলদি দৌড় লাগা৷ ব্যাগপত্র আমি নিয়ে এসেছি৷ বেশি দেরি করলে তোকে ফেলেই চলে যাবো৷ ‘
আমি ঝাঁঝালো কন্ঠে কিছু বলার আগেই ফোন কেটে দেয়৷ অগত্যা তাড়াহুড়ো করে অফ হোয়াইট কালারের কুর্তি আর লেডিস জিন্স পরে চুল গুলো উঁচু করে বেঁধে কোনো ধরণের প্রসাধনী ছাড়াই রেডি হয়ে দেখি অলরেডি পাঁচটা বেজে গেছে৷ হাতের ঘড়ি আর মোবাইল নিয়ে একছুটে ক্যাম্পাস মাঠে পৌছে দেখি কেউ নেই৷
বাসের কোনো চিহ্ন না দেখে ভ্যা ভ্যা করে হাত পা ছুঁড়ে কাঁদার জন্য উদ্যত হতেই পেছন থেকে অতি পরিচিত কন্ঠের ডাক শুনে মুখে হাসি ফুঁটে উঠে৷ যাক তাহলে কেউ রেখে যায় নি আমাকে৷ আমি হাসি মুখে পেছনে ঘুরতেই দেখি স্নিগ্ধ স্যার প্যান্টের পকেটে এক হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছেন৷ আমি উনার সামনে গিয়ে অপরাধী কন্ঠে বললাম,
–‘ আ’ম সো সর‍্যি স্যার! আই সোয়্যার আর কখনো লেট হবে না৷ বাস কোথায়?? মেইন রোডে?? চলুন তাহলে..! ‘
–‘ বাস চলে গেছে! ‘
–‘ মানে?? কোথায় গেছে?? ‘
আমার প্রশ্ন শুনে একটুও অবাক হলেন না উনি৷ আমি তাকে নিরলস ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাড়া দিয়ে বললাম,
–‘ স্যাররর.. যাবেন না?? আমার কক্সবাজার৷ প্লিজ বলুন বাস কোথায়??’
–‘ গুলশান এভিনিউ! ‘
উনার একটা কথায় চোখের পানি টুপ করে গাল বেয়ে পড়লো৷ ঘুমময় জীবন বিষাক্ত মনে হচ্ছে৷ ঘুম মানেই গুরুত্বপূর্ণ ট্যুর মিস৷ মন খারাপ হু হু করে বেড়ে গেলো৷ আমি শূন্য চোখে তাকিয়ে আছি৷ শূন্যতা নিয়ে মুখ ফুঁটে বললাম,
–‘ আপনি যাবেন না?? ‘
উনি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গায়ে জড়ানো ব্ল্যাক শার্টের হাতা গুলো ফোল্ড করতে করতে বলল,
–‘ অবশ্যই! না যাওয়ার কোনো কারণ তো দেখতে পাচ্ছি না৷ ‘
–‘ কিন্তু বাস… ‘
–‘ ঢাকায় কি বাসের অভাব?? অবশ্য তোমার মতো লেট লফিতদের সব কিছুর অভাব আছে৷ ‘ আমাকে মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে যেতে বললেন৷ আমি হতবিহ্বল ভাবে দাঁড়িয়ে আছি৷ আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঘুরে বললেন,
–‘ কক্সবাজার কি যাবে?? না এখানে দাঁড়িয়ে মনে মনে সমুদ্র বিলাস করবে?? ‘
–‘ কিন্তু…’
–‘ মুখ দিয়ে আর একটা শব্দ উচ্চারণ করলে তোমাকে ফেলেই চলে যাবো৷ ‘
ক্যাম্পাস থেকে সোজা সিএনজি তে করে আরামবাগ গিয়ে নন-এসি বাসে উঠে পরলাম৷ বাসে উঠের তার পাশে বসতে হবে ভেবে আরেকদফা কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়৷ বর্তমানে আমি চুপ মেরে বসে আঁছি আর সে আমার পাশে মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত৷
উঁকি দিয়ে দেখলাম কারো সাথে চ্যাটিং করছেন৷ মূহুর্তে ভ্রু জোঁড়া কুঁচকে এলো৷ উপরে নাম দেখলাম, ” জেসমিন মিম ”
মূহুর্তেই বিষাদ গ্রাস করলো আমাকে৷ উনার গার্লফ্রেন্ড নয়তো??
আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মোবাইল অফ করে দিয়ে সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পরলেন৷ না না গার্লফ্রেন্ড নয়৷ মেবি ফ্রেন্ড কিন্তু আমি তাকাতেই মোবাইল কেন অফ করে দিলেন??
অহেতুক ভাবনায় ঘুরে তাকিয়ে দেখি সে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন৷ গালের তিল টা জ্বলজ্বল করছে সূর্যের আলোতে৷ বাতাসের তালে সিল্কি চুল গুলো উড়োউড়ি করে আবার বাধ্যতা মেনে কপালে ল্যাপ্টে যাচ্ছে৷ চোখ বন্ধ করেও তার চোখ-মুখে হাসির ঝিলিক ৷গালের খোঁচা খোঁচা দাড়ি গুলো সারিবদ্ধ ভাবে গুছিয়ে আঁকা৷ ইশ!
ক্রাশ নামক শব্দটার প্রতি অনীহা থাকলেও আজ হাজার ক্রাশ খেয়ে বসে আছি৷
হুট করে চোখ খুলতেই ধরা পরে গেলাম আমি৷ লজ্জায় তাড়াহুড়ো করে জানালার দিকে মুখ ঘুরিয়ে রইলাম। মনে মনে আওড়ালাম,

” সময় থমকে যাক! থমকে যাক সব৷
লুকোচুরি চলুক এইভাবেই সর্বক্ষণ৷ ”

__________________________________

সূর্যের তীক্ষ্ণতা আরামদায়ক৷ বসন্তের প্রহর এখনো আনাচে কানাচে বিরাজ করছে৷ কোকিল উচ্চস্বরে ডেকে চলেছে৷ ঘুমের মাঝে চুল গুলো মুখের উপর এলোমেলো ভাবে আছড়ে পড়ছে৷ তাদের রাজত্ব! তাদের রাণী আমি৷ চোখের উপর পড়তেই ঘুম হালকা হয়ে আসতেই গাড়ির হর্ণ কানে আসতেই পুরো ঘুম ছুটে যায়৷ একে পরিবেশ দূষণ তার মধ্যে শব্দদূষণ৷ সব জায়গায় দূষণ! দূষণে দূষণে জীবন দূষণ৷ বিরক্তি নিয়ে আড়মোড়া ভেঙে সোজা হয়ে উঠে বসতেই অবাধ্য চুল গুলো ঝরঝর করে সামনে এবং পেছনে এসে পরে!
সকালে টাইট করে বেঁধে বের হয়েছিলাম খুললো কীভাবে?? আমি সন্ধিহান চোখে উনার দিকে তাকিয়ে দেখি চুলের কাটা তার হাতে৷ তীব্র রাগ নিয়ে বললাম,
–‘ আমার চুল এলোমেলো করেছেন কেন?? ‘
উনি কানে থেকে ইয়ারফোন খুলে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে বললেন,
–‘ প্রুফ আছে তোমার কাছে?? ‘

–‘ আমার চুলের কাটা আপনার হাতে এর চেয়ে বড় প্রুফ আর কি হতে পারে??’
আমার কথাকে পাত্তা না দিয়ে কানে আবারো ইয়ারফোন গুজতে গুজতে বললেন,
–‘ এক চেহারার মানুষ দুনিয়ায় সাতটা আছে আর সামান্য চুলের কাটা হাজার টা থাকতে পারে না বুঝি?? ‘
তার এমন উত্তর শুনে তব্দা মেরে বসে রইলাম৷ এমন উত্তর পাবো আশা করি নি৷ বাধ্য হয়ে চুল গুলো খোঁপা করতে গেলেই আড়চোখে তাকিয়ে বিরবির করে বললেন উনি,
–‘ থাকুক না ওইভাবে ক্ষতি কি তাতে?? ‘
আজ একদম পাশাপাশি থাকায় তার কথা কানে আসতেই আমি ত্যাড়া ভাবে বললাম,
–‘ ক্ষতি মানে প্রচুর ক্ষতি এই ক্ষতিতে পরে বাংলাদেশ চুলের রাজ্য হয়ে যাবে৷ আর সেই অন্যায় আমি কখনো হতে দিবো না৷ ‘
আমার জবাব শুনে ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন উনি৷ সেই শ্বাসের শব্দ বলছে,’ তুমি বড্ড বোকা! তুমি এমন একজন বোকা যে বুঝেও হাজার বাহানা দিয়ে না বুঝার চেষ্টা চালায়৷ ‘

কিছুক্ষণ পরে আমি মোবাইল হাতে নিয়ে লক খুলতেই আমার কাছে থেকে মোবাইল টেনে নিলেন উনি৷ রাগে শরীর রি রি করে উঠলেও দাঁতে দাঁত চেপে বললাম, ‘ মোবাইল দিন আমার৷ ‘
–‘ ওয়েট৷ ‘
আমি হাত উঁচু করে নিতে গেলেই সে অন্যদিকে ঘুরে যায়৷
উনাকে দেখে কে বলবে সে আমার স্যার?? হায় কঁপাল!দেশের অবনতি এইভাবে মেনে নেওয়া যাচ্ছে না৷
স্টুডেন্ট আদালতে উনাকে উঠাতে হবে৷ ব্যাটা বজ্জাৎ রাহাত একদম ঠিক বলে৷
আমি আবার নিতে গেলে একদম তার কাছাকাছি চলে যাই৷ উনি হঠাৎ করেই ঘুরতেই একদম তার বুকের সাথে ধাক্কা খাই৷ শরীরে তড়িৎ প্রবাহের মতো ঝাটকা লাগলো৷ হৃৎপিন্ড সুর তুলছে৷ লজ্জায় একদম লাল হয়ে সরে আসতেই উনি আমার মোবাইল হাতে দিয়ে সরু কন্ঠে বললেন,
–‘ অধৈর্য কেন তুমি?? তোমার এই অধৈর্যতার জন্য ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আল্ট্রা অধৈর্য হবে৷ স্ট্যাচু হয়ে বসে থাকবে৷ ঘুম পেলে তব্দা মেরে ঘুমিয়ে থাকবে বুঝেছো??’ উনার কথা শুনে বাধ্য মেয়ের মতো দু দিকে মাথা হেলিয়ে হ্যাঁ সূচক শব্দ বলতেই উনি তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললেন,’ গুড গার্ল! ‘

বাস চলছে তো চলছেই এর মাঝে ডেমরা নেমে উনি খাবার নিয়ে এলেন৷ আমি মোবাইলে লুডু খেলায় ব্যস্ত৷ আমার পাশে বসে বললেন,
–‘ কেউ একজন কি খাবার খাবে?? ‘ আমি মোবাইল থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে বললাম,
–‘ কেউ একজনের খিদে নেই তাই অন্য একজন খেয়ে নিতে পারে নো প্রবলেম৷ ‘ আমার কথা শুনে সশব্দে হেসে উঠলেন উনি৷ হাসির শব্দের মোহনীয়তা যেন তরঙ্গের সুর৷ আমি বিরবির করে বললাম, ‘ আপনার নামের মতোই আপনার হাসিতে স্নিগ্ধতা আছে মিস্টার! ‘
–‘ কারণ, সেই হাসির একমাত্র অংশীদার তুমি৷ ‘ আমি ভড়কে গেলাম৷ স্তব্ধতায় ঘিরে রইলাম৷ দিনটা অন্যধরণের৷ সকালে ঘুম থেকে দেরি করে উঠা সেই সাথে বাস মিস করা স্বার্থক মনে হচ্ছে৷ এই জন্যই কথায় বলে,’ আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন! ‘

সন্ধ্যা ০৬ঃ২৯ কক্সবাজার বাস স্ট্যান্ডে নামতেই মন প্রাণ জুড়ে পশ্চিম থেকে ভেসে আসা সামুদ্রিক বাতাসে সমস্ত ক্লান্তি মুছে গেলো৷ আমি আনন্দে কখন যে স্নিগ্ধ স্যারে হাত মুঠোয় ভরে নিয়েছি বুঝতে পারি নি৷ আমাকে উচ্ছ্বসিত দেখে তৃপ্তির হাসি হাসলেন উনি৷ আমার হাত ধরেই এগিয়ে গেলেন আমাদের টিম যেখানে আছে সেইদিকে৷
চারদিকে বিশাল ঝাউবন সেই সাথে সাদা বালির সমাহার৷ চোখেমুখে আছড়ে পরা খুশি আমার৷ এখনো শক্ত করে হাত ধরে রেখেছি আমি৷ একটু এগুলেই ছয়টা বাস চোখে পড়ে৷ আমার সেইদিকে নজর নেই একদম৷ সে যখন আমার কানের কাছে এসে এসে ফিসফিস করে বলল,’ হাত ছাড়বে না?? এমন ভাবে ধরে রেখেছো মনে হচ্ছে বাসর ঘর অবধি ধরে রাখবে৷ ‘ উনার লাগামহীন কথায় লজ্জা পেয়ে হাত ছেড়ে দিতেই আমাদের দিকে এগিয়ে এলো সবাই৷ রাজ্জাক স্যার এসেই প্রশ্ন ছুড়লো,
–‘ তুমি আর হৃদি একসাথে কীভাবে?? আমি জানি তুমি কক্সবাজার এসে পড়েছো আগেই৷ ‘

–‘ ইমার্জেন্সি কাজ পরে গিয়েছিলো৷ আসার কথা আগেই ছিলো বাট পরে ভাবলাম আপনাদের সাথেই আসবো কিন্তু আফসোস আমাকে ফেলেই চলে এসেছেন৷ ‘
উনার কথা শুনে সামির স্যার বললেন,
–‘ নাইচ জার্নি! আমি খুবই রোমাঞ্চকর মূহুর্ত উপলব্ধি করতে পারছি৷ ‘
তাদের কথা শুনে স্নিগ্ধ স্যার মাথা চুলকালেন৷ কি চলছে এইখানে??
আমি আমতা আমতা করে বললাম,’ আ..আমার টিম মেম্বাররা কোথায় স্যার?? ‘
–‘ টিমের কথা এখন মনে হলো হারামি! ‘ কোথায় থেকে রাহাত এসেই দাত কিড়মিড় করে বলেই হাত টেনে নিয়ে যায়৷ স্নিগ্ধ স্যার আমার দিকে তাকিয়ে আছেন সাথে বাকিরা৷ শুধু আসার আগে সামির স্যারের কথা কানে আসলো! সে বললেন, ‘ এই ধরণের প্রেম কিন্তু আমি নিজেও কর‍তে পারি নি৷ আপনার থেকে শেখার দরকার৷ ‘
উনি হাসছেন! ইশ,কি লজ্জা৷ লজ্জায় এই বালুর মধ্যে ডুবে যেতে ইচ্ছা হচ্ছে৷ বালুর মধ্যে বুঝি ডোবা যায়??
____________________________
আজকে রাত কক্সবাজারের পাশেই আবাসস্থলের হোটেল গুলোতে থাকবো আমরা৷ এখান থেকে বীচ অনেকটা দূরে৷ আমাদের যাওয়ার কথা ছিলো হিমছড়ি! কিন্তু সন্ধ্যে নেমে গেছে তাই সবাই হোটেলে উঠেছি৷
আমি নীতি আর আর ফার্স্ট ইয়ারের তিনজন মেয়ে একরুমে থাকবো৷ নীতি আমার সাথে কথা বলতে গেলেই কটমট চোখে তাকাচ্ছি৷ আমি ফ্রেশ হয়ে আসতেই আমার হাত ধরে মিনমিনে গলায় বলল,
–‘ মাফ করে দে আর হবে না এমন৷ আর আমার কি দোষ বলতো?? স্নিগ্ধ স…’
–‘ স্নিগ্ধ স্যার কি?? ‘ আমি চিৎকার করে বলে উঠতেই বাকি তিনটা মেয়ে তাকালো৷ নীতি আমার হাত ধরে আবারো কথা ঘুরিয়ে অনুনয় করে বলল,
–‘ রাগ করে থাকিস না প্লিজ! ইঞ্জয় করি আমরা?? ভার্সিটি ফিরে ইচ্ছা মতো বকিস মারিস তবে এখানে ফুল মুড ইঞ্জয় করি প্লিজজজ! ‘ নীতির কথা শুনে গাল টেনে দিলাম আমি৷ ওর সাথে রাগ করে একদম থাকা যায় না৷ এর মূল কাহিনি তে স্নিগ্ধ নামক ব্যাক্তির পদচারণ বেশ বুঝতে পারছি আমি৷
–‘ আসসালামু আলাইকুম আপু৷ ‘
মিষ্টি সুরের রিনঝিন আওয়াজে আমি আর নীতি ঘুরে তাকিয়ে দেখি স্কার্ট আর টপস পরা গোলগাল চেহারার মিষ্টি দেখতে একটা মেয়ে দাঁড়ানো৷ গাল গুলোতে লাল আভা ছড়িয়ে আছে মনে হচ্ছে কেউ লাল রঙ লাগিয়ে দিয়েছে৷ ফর্সা শরীরে লাল কালারটাতে তাকে মিষ্টি পরী লাগছে৷ আদর আদর চেহারা তার৷ আমি আর নীতি মিষ্টি হেসে সালামের উত্তর দিতেই মেয়েটা আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বলল,
–‘ আমি জান্নাতুল ফেরদৌস জান্নাত! ফার্স্ট ইয়ারে ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়ছি৷ ‘ মেয়েটার সৌজন্যতা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম আমরা দুজনেই৷ বাকি দুইটা মেয়ে রুড স্বভাবের তবে এই মেয়েটা মিশুক৷ আমি ওর সামনে গিয়ে গালে হাত দিয়ে মিষ্টি করে বললাম, ‘ আমি হৃদিয়া রহমান হৃদি৷ ‘
আর আমি, ‘ নীতি খন্দকার৷ এবং আমরা দুইজনেই সেকেন্ড ইয়ারে ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে আছি৷ ‘
মেয়েটা হাসলো সাথে আমরাও৷ মেয়েটা আমার হাত ধরে বলল,’আপু তুমি অনেক কিউট দেখতে৷ হাসলে কতো সুন্দর টোল পরে বা পাশের গালে। চোখ গুলো কত্তো সুন্দর টানা টানা৷ গাল গুলো কিউট বাচ্চাদের মতো৷ আর ভ্রু কুঁচকালে তোমার কালো তিল দুটো সেই সাথে কুঁচকে যায় জানো ??আই লাইক ইউ আপু অন্নেক৷ আর নীতি আপু তুমি আরো মা শা আল্লাহ৷ ‘
ওর প্রশংসা দেখে সশব্দে হেসে উঠলাম দুইজনে৷
–‘ তুমি আরো কিউট সেই সাথে মা শা আল্লাহ জান্নাত৷ ‘ বললাম আমি সেই সাথে নীতিও বলল৷ জান্নাত কিছু মূহুর্তেই একদম আপন হয়ে গেলো৷ বেচারি একা এসেছে ফ্রেন্ডস নেই কেউ৷ যাক ভালোই হলো আরেকটা ছোট আপু পেয়ে গেলাম৷ মিষ্টি পিচ্চি!

সবার সাথে থাকলেও একজনে দেখা নেই আসার পর থেকেই৷ কাউকে জিজ্ঞেস করতেও কেমন যেন লাগছে আমার৷ কোথায় হাওয়া হয়ে গেলেন উনি??
হোটেলের গার্ডেনে আমাদের টিম আগুন জ্বালিয়ে যে যার মতো ইঞ্জয় করছে৷ আমাদের গার্ড হিসেবে স্নিগ্ধ স্যার,মোহনা ম্যাম আর পরশ স্যার৷ উনারা দুইজন থাকলেও স্নিগ্ধ নেই!
আমি থাকতে না পেরে নীতি, রাহাত, জান্নাত,ফারিহা আর মাধবী কে রেখেই পরশ স্যারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম৷ আমাকে দেখেই চশমা নাকের ডগায় উঠিয়ে বললেন,’ কি হয়েছে তোমার?? ‘
–‘ স্যার, উনি স্যার কোথায়?? ‘ আমার কথা শুনে সরু চোখে তাকালেন৷ আমি ভড়কে গেলাম কিন্তু মূহুর্তেই হেসে উঠলেন পরশ স্যার সেই সাথে আমার সাহস বাড়লো৷
–‘ স্নিগ্ধের কথা বলো?? কেন ও তোমাদের সাথে নেই?? ‘
–‘ না নেই তো৷ কোথায় উনি বলতে পারবেন??’ আমার কন্ঠে ভয়৷ পরশ স্যার ভরসার কন্ঠে বললেন,’ আশেপাশেই আছে হয়তো৷ ও আসলে তোমার সাথে দেখা করতে বলবো৷ ‘
আমি হাসলাম৷ তবে মনের মাঝে কেমন করছে৷ কারণ আমি সারা হোটেল সেই সাথে আশেপাশে খুজেও উনাকে পাই নি৷ আমি ওখান থেকে নীতির কাছে গিয়েই কাঁদো কাঁদো স্বরে বললাম,’ তুই জানিস উনি কোথায়?? ‘
–‘ না তো৷ আমি স্যারকে আর দেখি নি৷ওয়েট ফোন করে দেখছি৷ ‘ নীতি বলেই ফোন দিলো৷ শূন্যতা বিরাজ করছে আমার মাঝে৷ হঠাৎ কোথায় গেলেন আর কেউ কেন জানে না?? নানা চিন্তায় অস্থির আমি৷ নীতি ফোন করতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও মূহুর্তেই দীর্ঘশ্বাসের কার‍ণ হয়ে দাঁড়ালো৷ ফোন অফ! কেউ জানে না তার খোজ৷
রাত বারোটা পেরিয়ে গেলেও সে আসে নি আর৷ আমি বারবার খুজেও হদিস পেলাম না৷ এইভাবে মাঝপথে থমকে যাবে সব??
চলবে……

~”