শুভ্রতা তোমার জন্য পর্ব-১১

0
312

#শুভ্রতা_তোমার_জন্য ( ১১)
কলমে ✍️ #রেহানা_পুতুল
আশপাশের মানুষ জড়ো হয়ে গেলো। রাস্তার কর্তব্যরত পুলিশ এগিয়ে এলো। তিনজনকেই নিকটস্থ হাসপাতালে ভর্তি করলো। আয়মানের মোবাইলের ডায়াল নাম্বার চেক করে ফোন করা হলো তার পরিবারের কাছে। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আয়মান ও শুভ্রতা।

উচ্চস্বরে উপমার মুঠোফোন বেজে উঠলো। সে ফোন রিসিভ করেই,

“হ্যাঁ ভাইয়া কতদূর এলে?”

এরপর অপরপ্রান্তের অপরিচিত পুরুষ কন্ঠের থেকে যা শুনলো,তাতে উপমা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলনা। বুক চাপড়ে বাড়ি কাঁপিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো। সবাই ছুটে এলো। আমিনা বেগম গগনবিদারী আর্তনাদ শুরু করলেন। উপমা পাগলের মতো কম্পিত হাতে হাসপাতালের ঠিকানা লিখে নিলো খাতায়। শুভ্রতার পরিবারকে জানানো হলো। আয়মানের খালাতো ভাইসহ তারা অল্পসময়ে পৌঁছে গেলো হাসপাতালে। ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে ভর্তি আয়মান ও শুভ্রতা। চালকের লোকজন ও এসে গিয়েছে। তার অবস্থাও শোচনীয়। তিনজনকেই ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালে নিয়ে গেলো ডাক্তারদের নির্দেশে ও পরামর্শে।
চালকের বুকের হাড় ভেঙ্গে গিয়ে রক্ত জমাট বেঁধে গিয়েছে বুকের ভিতর। প্রসেসিং করে নতুন রক্ত দিতে দিতে গাড়িচালক মারা গেলো সেদিন রাতেই। আয়মানের হাত ভেঙ্গে গিয়েছে। শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুরুতরভাবে চামড়া ছিলে গিয়েছে। সেলাই দিতে হয়েছে একাধিক স্থানে। তাকে রক্ত দিতে হয়েছে দুই ব্যাগ। পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হলো তাকে। আয়মানের পরিবার রয়েছে তার কাছে।

শুভ্রতার কাছে ঢাকা মেডিক্যালে রয়েছে তার পরিবারের লোকজন। শুভ্রতার শারিরীক অবস্থা ক্রিটিক্যাল। তার চোখের পাশ দিয়ে গালের একপাশে গাড়ির কাঁচের সাথে লেগে গভীরভাবে কেটে গিয়েছে। পাঁচ সেলাই দিতে হয়েছে মুখে। পায়ের তালুর নিচে মাঝ বরাবর কেটে গিয়েছে অনেকখানি লম্বালম্বিভাবে। সেখানে তেরো সেলাই দিতে হয়েছে। নয়তো ছেঁড়া চামড়া জোড়া লাগোনা যাচ্ছেনা। শুভ্রতার মাথা ফেটে গিয়ে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। সেলাই দিতে হয়েছে একাধিক। ছয়ব্যাগ রক্ত দিতে হয়েছে যোগাড় করে। দুই পরিবারের লোকজন আয়মান ও শুভ্রতার জন্য স্রস্টার কাছে দুহাত তুলে তাদের সুস্থতা ও প্রাণভিক্ষায় নিমগ্ন রয়েছে ধ্যানমগ্ন ঋষির মতো।

দুইদিন পর আয়মান মুখ খুললো। তার আগে কথা বলার মতো শক্তি বা হুঁশ কোনটাই ছিলনা তার। ব্যথায় কোঁকানো কন্ঠে শুভ্রতার কথা জিজ্ঞেস করলো তার মাকে। তারা তাকে বলল,

শুভ্রতার চিকিৎসা চলছে। তার সব লোকজন আছে। ডাক্তার বলছে ভয়ের কিছুই নেই। জ্ঞানও ফিরে এসেছে। তবে এখনো চোখ খুলতে ও কিছু বলতে পারেনি।

এক সপ্তাহ পরে আয়মানের রিলিজ হয়। হাতে প্লাষ্টার করা। এটা পনেরোদিন রাখতে হবে। তারা সবাই তাকে নিয়ে ঢাকা মেডিক্যালে গেলো। কেবিনে প্রবেশ করেই আয়মান দেখলো শুভ্রতার মা ,তার বোনের জামাই এবং আরো দুজন অপরিচিত মুরুব্বি বসা। শুভ্রতার মাকে ও তাদের আয়মান সালাম দিলো। শুভ্রতার মা দাঁড়িয়ে জামাইর পিঠে আশীর্বাদের হাত বুলিয়ে দিলেন আদ্রকন্ঠে।

আয়মান তাদেরকে শুভ্রতার কথা জিজ্ঞেস করলনা। নিজেই শুভ্রতার কাছে গিয়ে বেডের একপাশে শুভ্রতার মাথার কাছে বসলো। ওদের দুজনকে স্পেস দিয়ে মুরুব্বিসহ বাকিসবাই এদিক সেদিক চলে গেলো। কেউ হাসপাতালের নিচে, কেউ সামনের বারান্দায়, কেউ কেবিন লাগোয়া বারান্দায় চলে গেলো।

আমার শুভ্রতা, বলে আয়মান শুভ্রতার কপালে মোলায়েল চুমু খেলো। গালের সেলাইয়ের উপরে হাত বুলিয়ে দিলো। পায়ের পাতা ধরে দেখলো। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুভ্রতার সারা শরীরের জখমের স্থানগুলো দেখতে লাগল মায়াভরা দৃষ্টিতে। শুভ্রতার মাথায় আলতো করে হাত বোলাতে লাগলো আয়মান। শুভ্রতার দুচোখ বন্ধ। আয়মান শুভ্রতার কানের কাছে নিজের শুকনো ঠোঁটজোড়া নিলো। ফিসফিসিয়ে ডাকলো,

” শুভ্রতা চোখ খোলো। দেখো আয়মান তোমার কাছে এসেছে। সাড়া দাও আমার ভালোবাসা।”

শুভ্রতা দূর্বল আঁখিপল্লব মেলে ধরলো। নিবুনিবু প্রদ্বীপের মতো পিটপিট করে চাইলো আয়মানের দিকে।
আয়মান শুভ্রতার গালে তার হাতের পিঠ দিয়ে মায়া মায়া স্পর্শ দিতে দিতে বলল,

“বাবু কথা বলো একটু। কতদিন তোমার হৃদয় জুড়ানো আদুরে কন্ঠখানি শুনিনা। কতদিন তোমার সেই মাধকতাময় হাসি শুনিনা। যেনো যুগের পর যুগ তুমিহীনা আমি এই বিশ্ব মরু প্রান্তরে। যেদিকে তাকাই তুমি নাই। শুন্য বিরানভূমি। তুমি ছাড়া আমি যে বড় একেলা। নিঃশ্ব! সঙ্গী হারা ডাহুকের মতো। ”

শুভ্রতা নিশ্চুপ! নিশ্চল! ভাবলেশহীনভাবে নিষ্পলক চোখে চেয়ে আছে আয়মানের মুখপানে৷ তার দৃষ্টি অচেনা। নতুন। আয়মান অধৈর্য হয়ে উঠছে। অবসন্ন শরীর ও মন নিয়ে আবারো শুভ্রতাকে ডাকলো।

” কি ব্যপার পাখি। কথা বলছনা কেনো? কষ্ট হচ্ছে? নাকি কোন অভিমান আমার উপরে? দেখো আমিও অনেক ইনজুরড হয়েছি। আমার কথা তোমার মনে পড়েনি একবারও? জানতে চেয়েছো কারো কাছে আমার কথা?”

শুভ্রতা তার মেলানো শুষ্ক অধরযুগল আংশিক ফাঁক করলো। মরাকন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

” আপনি কে? আমাকে এতক্ষন এগুলো বলেছেন কেনো? ভুল করে এই কেবিনে ঢুকে পড়লেন বুঝি?”

” শুভ্রতা! কৌতুক করছো কেনো সিরিয়াস মুহূর্তে? ”

ভারকন্ঠে শক্ত চোয়ালে জিজ্ঞেস করলো আয়মান।

” কৌতুক? কি বলছেন আবোলতাবোল এসব? ওরা সব কই? আমি এখানে কেনো?”

আয়মান স্তব্দ!বাকহীন! হতভম্ব! চোখ বড় বড় হয়ে কপালে উঠে গেলো তার। স্তম্ভিত চাহনিতে পলকহীনভাবে চাইলো শুভ্রতার দিকে। তার মুখের উপর থেকে হাত সরিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গেলো। জমে গেলো হিমশীতল বরফখন্ডের ন্যায়। শরীরের ব্যথা নিয়ে কেবিনের বাইরে গিয়ে উপমাকে ডাক দিলো।

উপমা এলে সবাইকে ডাক দিতে বলল। সবাই এলো। আয়মান চিন্তিত গলায় প্রচন্ড আক্ষেপ নিয়ে শুভ্রতার মাকে বলল,

” মা শুভ্রতা অসংলগ্ন আচরণ করছে কেনো? আমাকে না চেনার ভান করছে কেনো?”

শুভ্রতার মা কিছু বলার আগেই আমিনা বেগম ও উপমা শুভ্রতার কাছে গিয়ে একথা ওকথা বলতে লাগল। কিন্তু ফলাফল শূন্য। শুভ্রতা তাদেরকেও চিনতে পারছেনা। উপমা কান্না জুড়ে দিলো। সাথে সাথে শুভ্রতার মাও কেঁদে ফেলল হুহু করে।

” মা কি হয়েছে বলেন প্লিজ।”

শুভ্রতার মা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের কোণে ঢলে পড়া অশ্রুস্রোত মুছতে মুছতে বলল,

” বাবা শুভ্রতার স্মৃতিশক্তি হারিয়ে গিয়েছে। ও কাউকেই চিনেনা বাবা।”

” কিহহ! নায়াআ…মা। নাহ! এ হতে পারেনা। এ অসম্ভব! আমি ডাক্তারের থেকে সত্যিটা জানতে চাই।”

” ডাক্তার বিকেলে আসবে বাবা। সব জেনে নিও। ”

আমিনা বেগম পুত্রকে থামতে অনুরোধ করলেন।

” বাবা তুই নিজেই অসুস্থ। ভাঙ্গা হাত তোর। পুরোপুরি সুস্থ হতে একমাস সময় লাগবে। এভাবে পাগলামো করলে সমাধান হবে? বল? মাথা ঠান্ডা রেখে আমাদের পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে। আল্লাহ যা করেন। তার বান্দার ভালোর জন্যই করেন। আমরা পাপী বান্দারা নগদে তা বুঝে উঠতে পারিনা। ”

সেদিন বিকেলে কর্তব্যরত ডাক্তার কেবিনে এলো শুভ্রতাকে দেখতে। আয়মান অস্থির কন্ঠে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলো,

” ডাক্তার। আমি পেশেন্টের হাজব্যান্ড। ও আমাকে চিনতে পারেনা কেনো?”

” দেখুন। কোনোকিছুর উপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই। সবকিছুর একমাত্র নিয়ন্ত্রক হচ্ছে স্রস্টা। আমরা ডাক্তাররা মাধ্যম মাত্র। আপনার স্ত্রীর মেমোরি টোটালি ড্যামেজ হয়ে গিয়েছে। কারণ উনার মাথার আঘাতটা বেশ বড় ধরনের ছিলো। ব্রেনে সংক্রমণ হয়েছে।”

ওহ নো! বলে আয়মান মৃদু আর্তচিৎকার করে উঠলো। কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,

” কি বলছেন ডাক্তার এসব! আর কোনদিন ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবেনা? আমাকে ও আমাদের সবাইকে চিনবেনা?”

” হয়তো চিনবে হয়তো চিনবেনা। পূনরায় ওরকম কোনো আঘাত পেলে হয়তো ফিরে আসতে পারে। বাইরে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা করাতে পারেন এবিলিটি থাকলে। ”

এই বলে ডাক্তার তাদের সবার দিকে চেয়ে শুভ্রতার বিষয়ে আরো কিছু কথা বলল, কিভাবে চলতে হবে তার সাথে। কি করতে হবে। কোথায় কোথায় ঘুরতে নিয়ে যেতে হবে।

ডাক্তার চলে গেলে আয়মান বারান্দায় গিয়ে বোনকে বুকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।

” জীবনটা এমন কেনো বোন বলতে পারিস? কেনো আমরা পেতে পেতে হারাই? হারাতে হারাতে পাই। আবার সেই পাওয়ার মাঝেও শত ঝড় ঝাপটা। কি অপরাধ আমাদের? জানিনা সামনে আরো বড় কোনো অশুভ কিছু হায়েনার মতো ওঁৎ পেতে আছে কিনা আমাদের জীবনে। ”

চলবে…১১