#শেষ_পাতায়_তুমি(Revenge story)
#ফাবিহা_নওশীন
|পর্ব-৩৬|
ফায়াজ বিরক্ত আর বিরস মুখে বিছানায় বসে আছে। ওর দৃষ্টি খোলা দরজার দিকে। রাত ১২টা পাড় হয়ে গেছে মেহেরের আসার খবর নেই। ফায়াজ ভাবছে এই অসুস্থ শরীর নিয়ে নিশ্চয়ই মাহির সাথে গল্প করছে। ফায়াজ আর ধৈর্য্যধারণ করতে পারছে না। উঠে দাঁড়াল। তারপর ধীর পায়ে রুমের বাইরে গেল।
.
মাহি সবেমাত্র মিশানকে ঘুম পাড়াতে পারল। পাশেই তূর্য ঘুমে বিভোর। মাহি আস্তে আস্তে বিছানা থেকে নামল। যাতে কোন প্রকার শব্দ না হয়। মিশানকে অনেক কষ্ট করে ঘুম পাড়িয়েছে। ও নিশব্দে পানির জগ হাতে নিল। তারপর পানি আনতে নিচে চলে গেল।
মাহি পানিভর্তি জগ হাতে যখন সিড়ির কাছে যাবে তখনই চোখ পড়ল সোফার দিকে। মেহের সোফায় ঘুমিয়ে আছে। এক হাতে রিমোট এমন ভাবে ধরে রেখেছে যে যেকোনো সময় পড়ে যেতে পারে। মাহি টিভির দিকে তাকাল। টিভি তো অফ। টিভি দেখতে দেখতে তো ঘুমায় নি। তাহলে এখানে এভাবে নিজের ঘর রেখে ঘুমিয়ে আছে কেন? ড্রয়িংরুমের লাইটও অফ ছিল মাত্রই ও পানি নেওয়ার জন্য জ্বালিয়েছে। মাহির ব্যাপারটা ভালো ঠেকছে না। কিন্তু সারাদিন ওদের দেখে মনে হয়েছে ওদের মধ্যে মধুর একটা সম্পর্ক রয়েছে। তাহলে সেটা কি ভুল ছিল?
মাহি মেহেরের দিকে আগাতে চাইলে কারো আসার শব্দ পায়। মাহি সিড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল ফায়াজ আসছে। মাহি আড়ালে লুকিয়ে গেল। ফায়াজ মাহি আর ওদের মায়ের রুমের সামনে ঘুরে এসেছে কিন্তু মেহের সেখানে নেই সে সম্পর্কে কোন ডাউট নেই। ফায়াজ নিচে এসে মেহেরকে সোফায় শুয়ে থাকতে দেখল।
ফায়াজ মেহেরের দিকে আগাতে আগাতে বিরবির করে বলছে,
“আমি ওর জন্য অপেক্ষা করছি। এ ঘর ও ঘর খুঁজে মরছি আর ও এখানে ঘুমাচ্ছে?”
ফায়াজ আস্তে আস্তে মেহেরকে কোলে তুলে নিল যাতে ওর ঘুম না ভাঙে। ফায়াজ মেহেরকে কোলে তুলে নিতেই মেহের নড়েচড়ে উঠে। ফায়াজ তাই দাঁড়িয়ে যায়। মেহের আবার ঘুমে বিভোর হয়ে ঘনঘন শ্বাস নিলে ফায়াজ ওকে নিয়ে আগায়। কিন্তু ফায়াজ দু-তিন পা আগাতেই মেহেরের ঘুম ভেঙে যায়। মেহের চোখ খোলে নিজের অবস্থান বুঝার জন্য এদিক সেদিক তাকালে ফায়াজকে দেখে চমকে যায়।
মেহের ফায়াজকে বলল,
“আমাকে এভাবে কোলে নিয়েছেন কেন? নামান নিচে। আমি নিচে নামব।”
ফায়াজ মেহেরকে নামাবে না তাই ওকে নিয়ে কোলে নিয়েই হাঁটা দিল। মেহের নামার জন্য ছটফট করছে এবং রীতিমতো হাত-পা ছড়াছড়িও করছে। ফায়াজ বাধ্য হয়েই মেহেরকে নিচে নামাল। নয়তো যেমন করছে যদি হাতে, পায়ে ব্যথা পায়?
ফায়াজ বিরক্তি নিয়ে বলল,
“আরে সমস্যা কি তোমার? এমন করছো কেন? ঘর রেখে এখানে ঘুমাচ্ছো কেন? অদ্ভুৎ কাজকর্ম!”
মেহের উত্তরে বলল,
“আমার ঘুম পাচ্ছে। আমি ঘরে যাচ্ছি।”
মেহের ঘরে যাওয়ার জন্য কয়েক পা এগুতেই ফায়াজ ওর হাত ধরে ঘুরিয়ে নিজের কাছে এনে শীতল কণ্ঠে বলল,
“কি হয়েছে তোমার মেহেরজান?”
মেহের মাথা চুলকে বলল,
“নেশা-টেশা করেছেন না কি? কিছুক্ষণ আগেই তো ধমকে কথা বললেন। এখন এত নরম সুরে কথা বলছেন কেন?”
ফায়াজ মুচকি হেসে মেহেরকে ঘুরিয়ে মেহেরের পিঠ নিজের সাথে মিশিয়ে নিল।
মাহি অস্বস্তিতে হাতে পানির জগ নিয়ে অন্যদিকে ঘুরে গেল। ছোট বোন আর তার বরকে এভাবে দেখে অস্বস্তি লাগছে। কিন্তু এখান থেকে যাওয়ার উপায়ও নাই। যেতে হলে ওদের সামনে দিয়েই যেতে হবে।
ফায়াজ মেহেরের গলায় আলতো করে চুমু খেল। মেহের আবেশে চোখ বন্ধ করে নিল। সারা শরীরে আলোড়ন বয়ে যাচ্ছে। মেহেরকে কেঁপে উঠতে দেখে ফায়াজ মেহেরের গলায় আবারও চুমু খেল।
মেহের নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“মাথা গেছে আপনার? ড্রয়িংরুমে আবার আলো জ্বলছে। কেউ চলে এলে কি ভাববে হা?”
ফায়াজ বাকা হেসে বলল,
“আমি তো বেডরুমেই রোমান্স করতে চেয়েছিলাম তুমি তো যেতে চাইছো না। আমার কি দোষ?”
মেহের ফায়াজের কথা শুনে নাক-ঠোঁট ফুলিয়ে চোখ সরু সরু করে তাকাচ্ছে। আর আনমনে ভাবছে,
“এই যে আমি রাগ করেছি সে দিকে খেয়াল আছে? না নেই। কেন থাকবে? আমাকে তো ভালোবাসে না। একটুও বাসে না।”
মেহের ঘুম ঘুম চোখ করে বলল,
“আমি যাচ্ছি ঘরে। ঘুম পাচ্ছে।”
তারপর হনহন করে চলে গেল। ফায়াজ তখনও দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর নিজেও উপরে চলে গেল। ওরা যেতেই মাহি যেন হাফ ছেড়ে বাচঁল। মাহিও গুটিগুটি পায়ে নিজের রুমে চলে গেল।
.
ফায়াজ ঘরে গিয়ে দেখে মেহের বিছানার এক সাইডে শুয়ে আছে। ফায়াজ গিয়ে ওর পাশে শুতেই মেহের অন্যদিকে ঘুরে চোখ বন্ধ করে নিল।
ফায়াজ মেহেরকে বলল,
“মেহের, ওপাশে ঘুরে গেলে কেন? এদিকে ঘুরো।”
মেহের ফায়াজের কথা শুনেও না শোনার ভান করে আছে। ফায়াজের রাগ হচ্ছে। ইচ্ছে করছে টেনে এদিকে ঘুরিয়ে নিতে। কিন্তু ফায়াজ রিয়েকশন দিচ্ছে না কোন। নেহাত মেহের অসুস্থ নয়তো বুঝিয়ে দিতো ফায়াজকে ইগনোর করার মজা। অসুস্থ বলেই ছাড় দিচ্ছে। ফায়াজ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সোজা হয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে নিল। ডান হাত কপালে দিয়ে রেখেছে।
মেহের কিছুক্ষণ পরে ফায়াজের দিকে ঘুরে দেখে ফায়াজ চোখ বন্ধ করে আছে।
মেহের দীর্ঘ সময় মনের সাথে যুদ্ধ করে শীতল কণ্ঠে বললো,
“আমাকে একটু আপনার বুকে ঘুমাতে দেবেন?”
ফায়াজ মেহেরের কন্ঠস্বর শুনে চমকে গেল। হাত সরিয়ে চোখ মেলে মেহেরের দিকে তাকাল। মেহেরের চোখেমুখে অনেক আকুতি দেখতে পাচ্ছে। মেহের অনেক আশা নিয়ে ওর দিকে চেয়ে আছে।
ফায়াজ মেহেরকে টেনে নিজের বুকে নিল।
মেহের দু’হাতে ফায়াজকে জড়িয়ে ধরল। ফায়াজও আগলে নিল দু’হাতে। ফায়াজ মনে মনে হাসছে আর বলছে,
“এই মেয়ে নিজেই দূরে যাব, দূরে যাব করে কিন্তু নিজেই আবার কাছে আসে। কিসের টানে? ভালোবাসার টানে ফায়াজ, ও তোকে ভালোবাসে।”
কিছুক্ষণ পরে ফায়াজ বুকে তরল পদার্থ অনুভব করল। উষ্ণ তরল পদার্থ। ফায়াজের বুঝতে বাকি নেই মেহের কাঁদছে। কিন্তু কেন কাঁদছে? অযথা কান্নাকাটি ফায়াজের ভালো লাগে না। আর এমনও না যে ফায়াজ ওকে জোর করেছে, মেহের নিজেই এসেছে। ফায়াজ মেহেরকে হুট করে সরিয়ে উঠে বসে চোখ গরম করে বলল,
“কি হয়েছে? হয়েছেটা কি? তুমি কাঁদছো কেন?”
মেহের চুপ করে আছে। কেঁদেই যাচ্ছে। ফায়াজের মাথায় যেন ধপ করে আগুন জ্বলে উঠল। রাগে গজগজ করছে। ফায়াজ চেচিয়ে ধমক দিয়ে বলল,
“চুপ! একদম চুপ! বিরক্ত লাগছে৷ জাস্ট বিরক্ত লাগছে। হোয়াটস ইউর প্রব্লেম?”
মেহের ফায়াজের ধমক শুনে চুপ করে গেল। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। ফায়াজ নিজের রাগ কন্ট্রোল করে মেহেরের গালে হাত রেখে মোলায়েম গলায় বলল,
“তুমি না বললে আমি কি করে বুঝব? কান্না থামাও তারপর বলো।”
মেহের কয়েক মিনিট সময় নিল। ফায়াজ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। মেহের কান্না থামিয়েছে কিন্তু এখনো ফুপানি কমে নি।
মেহের চোখ তুলে ফায়াজের দিকে তাকাল তারপর বলল,
“আপনি আমাকে ভালোবাসেন না। আপনি আমাকে মিথ্যা বলেছেন।”
মেহের আবারো কেঁদে ফেলবে এমন অবস্থা। ফায়াজ মেহেরের কথা শুনে অবাক হয়ে চেয়ে আছে ওর দিকে।
মেহের আবারও বলল,
“আমি মরে যেতে রাজি আছি কিন্তু আপনি আমাকে ভালোবাসেন না কিন্তু আপুকে ভালোবাসেন সেটা আমি মানতে পারব না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে এ-সব মানতে।”(মেহের নিচের চোখ বন্ধ করে নিল)
ফায়াজ মেহেরের কথা শুনে হতবাক। মেহের কোন আক্কেলে কেন এসব বলছে বুঝতে পারছে না।
ফায়াজ কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল,
” তুমি এ-সব কেন বলছো? আমি তোমার আপুকে ভালোবাসি সেটা কে বলল?”
মেহের কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আমি জানি আপনি আপুকে ভালোবাসেন। ভালো না বাসলে আপুকে দেখলে আপনি রেগে যেতেন না। আপুর উপস্থিতি আপনার উপর ইফেক্ট ফেলত না।”
মেহের হেচকি তুলে বলল,
“ফায়াজ, আমি দম নিতে পারছি না। আমার শ্বাস আটকে আসছে। আপনি বলেছিলেন না আপনি চান কেউ আপনাকে এমন ভাবে ভালো বাসুক যাতে আপনাকে ছাড়া তার শ্বাস আটকে আসে। আপনি আমাকে ভালোবাসেন না এটা ভেবেই আমার শ্বাস আটকে আসছে। আপনি যদি আমার কাছে, আমার সাথে না থাকেন তাহলে আমার কি হবে? আমার বুকের ভেতর কাটাছেঁড়া হচ্ছে। মনে হচ্ছে অদৃশ্য ধারালো ছুরি দিয়ে কেউ অনবরত আঘাত করে যাচ্ছে। আমি টিউমারের ব্যথা সহ্য করে নিয়েছি কিন্তু এই অদৃশ্য ব্যথা সহ্য করতে কেন পারছি না?”
ফায়াজ মেহেরের অবস্থা বুঝতে পেরে বুকে জড়িয়ে ধরল। তারপর বলল,
“মেহের, তুমি ভুল বুঝছ। অনুভব করো, আমার হৃদস্পন্দন শুনো। সেখানে শুধু তোমার নামের জপ হয়। সূচনাতে অন্য কেউ থাকলেও উপসংহারে তুমি আছো। শুধু তুমি। জীবন নামের উপন্যাসের প্রতি পাতায় হাজারো মানুষের আনাগোনা থাকলেও একদম #শেষ_পাতায়_তুমি আছো। সুন্দর একটা সমাপ্তিতে তুমি আছো। উপন্যাসের শেষ পাতা পাঠককে যেমন মোহনীয় ও আচ্ছন্ন করে রাখে তেমনি তুমি আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছো। আমি তোমাকে বিভোর হয়ে আছি আর থাকব।”
ফায়াজের কথা গুলো শুনে মেহেরের মনের মেঘাচ্ছন্ন আকাশে এক চিলতে রোদের দেখা পেল। মেহের কান্না কমিয়ে বলল,
“তাহলে আপুর ব্যাপারটা?”
“তুমি আজীবন বোকাই রয়ে গেলে। আমাকে কখনো দেখেছো মাহির জন্য কষ্ট পেতে? কখনো ছটফট করতে দেখেছো? তুমি না একদিন এ-সব প্রশ্ন নিয়ে আমার মুখোমুখি হয়েছিলে? তোমাকে সেদিন এড়িয়ে গিয়েছিলাম। তুমি বলেছিলে ওকে ভালোবাসি না। তাহলে আজ সেই তুমি কেন এ-সব উল্টো পালটা কথা মাথায় আনছো? আমি ওকে ভালোবাসি নি। কখনো ভালোবাসিনি। আমি যদি কারো জন্য কষ্ট পেয়ে থাকি, ছটফট করে থাকি, পাগলামি করে থাকি, কারো জন্য চোখের পানি ফেলে থাকি সে তুমি। আর মাহির প্রতি আমার রাগের কারণ জানতে চাও? তাহলে শুনো। মাহিকে আমার সহ্য হয় না কারণ ওর জন্য তুমি সবার চোখে অপরাধী হয়ে আছো। ওর জন্য তোমার প্রতি তোমার বাবার, তোমার পরিবারের এমন মনোভাব। ওর জন্য তুমি কষ্ট পাচ্ছো। কিন্তু ও তো তোমার বাবার চোখে সুশীল কন্যা হিসেবে পরিচিত। ও সবাইকে ঠকাচ্ছে, সবাইকে। তাই ওকে আমার সহ্য হয় না।”
মেহের মাথা তুলে বলল,
“শুধু এই জন্যই?”
ফায়াজ মুচকি হাসল। তারপর আবার জড়িয়ে ধরল।
আনমনে ভাবছে,
“ভেবেছিলাম আমিই শুধু ওর জন্য পাগল। কিন্তু মনে মনে মেহেরজানও আমার জন্য পাগল। আমি ওকে ভালোবাসি না ভেবে এমন কান্নাকাটি করছে। এত কষ্ট পাচ্ছে। ক্রেজি লাভারের ক্রেজি লাভারনী। উফফফ!! নিজেকে এত সুখী মনে হচ্ছে কেন?”
চলবে…..!
#শেষ_পাতায়_তুমি(Revenge story)
#ফাবিহা_নওশীন
|পর্ব-৩৭|
জানালার পর্দা ভেদ করে ভোরের নরম আদরমাখা রোদ মেহেরের চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙে যায়। ফায়াজ মেহেরকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। মেহের হাত দিয়ে ডান চোখ ডলে ভালো করে তাকাল। ফায়াজের আছে লেপ্টে আছে ও। হটাৎ করেই মেহেরের গতকালের কথা মনে পড়ল। গতকাল ফায়াজের সামনে যা করেছে যা বলেছে এর জন্য লজ্জা পাচ্ছে। ফায়াজ নিশ্চয়ই ওকে পাগল ভাবছে। ছিহ! ছিহ!
ফায়াজকে ছাড়িয়ে মেহের ধীরে ধীরে উঠে গেল। ঘড়ির কাটায় বেলা আটটা বেজে ২৪ মিনিট। এত বেলা হয়ে গেছে। মেহের দ্রুত বিছানা থেকে নেমে ফ্রেশ হয়ে এল। ফায়াজ তখনও ঘুমাচ্ছে। মেহের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আচড়াচ্ছে আর ফাঁকে ফাঁকে ফায়াজের দিকে তাকাচ্ছে।
মেহের টপাটপ রেডি হয়ে দরজার সামনে গিয়ে আবার ফিরে ফায়াজের দিকে তাকাল।
মেহের বিড়বিড় করে বলল,
“আপনি ঘুমিয়ে থাকুন। প্লিজ আপনি আজ সারাদিন ঘুমিয়ে থাকেন। উঠার একদম প্রয়োজন নেই। প্লিজ প্লিজ।”
মেহের নিঃশব্দে দরজা খুলে বাইরে চলে গেল। সকালের নাস্তা করার সময় হয়ে গেছে কিন্তু ফায়াজ তখনও উঠে নি। তাতে মেহেরের কিছু আসে যায় না। মেহের চায় আজ ফায়াজ সারাদিন ঘুমিয়ে থাকুক। নয়তো গতকালের ঘটনার জন্য ফায়াজ ওকে ইচ্ছাকৃত ভাবে লজ্জা দিতেই থাকবে। মেহের এতদিনে ফায়াজকে এতটুকু তো চিনেছে।
মেহের নাস্তা করার জন্য বসেছে। ওকে ওষুধ খেতে হবে তাই কেউ ফায়াজের জন্য অপেক্ষা করতে বলে নি। মেহের নাস্তা করছে আর সে সময় ডোরবেল বেজে ওঠে।
মেহেরের মায়ের কন্ঠ শুনে মেহের খাবার রেখে সে দিকে তাকায়। ফায়াজের বাবা এসেছে। মেহের খাবার রেখে টিস্যু দিয়ে হাত মুছে দ্রুত উঠে গিয়ে সালাম জানাল।
ফায়াজের বাবা সালামের উত্তর নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“কেমন আছো মা? এতকিছু হয়ে গেল আর আমি কিছুই জানি না। ফাইজা আমাকে রাতে ফোন দিয়ে জানাল।”
মেহের আলতো হেসে বলল,
“আমি ভালো আছি। ডাক্তার ওষুধ দিয়েছে। বলেছে ঠিকমত ওষুধ খেলে সুস্থ হয়ে যাব। আপনি আসুন বসুন। মা চা-নাস্তা নিয়ে এসো।”
মেহেরের মা বলল,
“হ্যাঁ হ্যাঁ আপনি বসুন। বসে কথা বলুন। আমি আপনার জন্য চা-নাস্তা নিয়ে আসছি।”
ফায়াজের বাবা বলল,
“আপা আপনি ব্যস্ত হবেন না। আমি নাস্তা করেই বের হয়েছি। আমি মেহেরকে দেখতে এসেছি। ওর সাথে একটু কথা বলেই চলে যাব।”
সাফায়েত নওয়াজ খান মেহেরের সাথে গিয়ে বসল।
তিনি আমতা আমতা করছেন। তারপর বলল,
“ফায়াজ তো এখানেই। ওকে দেখছি না কেন?”
মেহের একবার সিড়ির দিকে তাকিয়ে উনার দিকে স্নিগ্ধ চোখে চেয়ে বলল,
“অনেক টেনশনে ছিল। ঘুমাতে পারে নি। তাই ঘুমাচ্ছে। এতক্ষণে হয়তো উঠে গেছে। ডাকব? কথা বলবেন?”
ফায়াজের বাবা শুকনো হাসল। তারপর বলল,
“নাহ! ওর সাথে কি কথা বলব? নিজের ছেলে, নিজের বাড়িতে থাকে তখনই কথা বলি না। এখানে এসে আর কি বলব? আসলে আমি ওর সাথে ইচ্ছে করেই কথা বলি না। ওর সামনে দাঁড়াতে পারি না। ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালে আমি অপরাধবোধে ভুগি। ওর মুখ দেখলে মনে হয় আমার জন্য ছেলেটা পরিবারহীন। ওর খারাপ সময়েও ওর সামনে এসে দাঁড়াতে পারি না। ইনফ্যাক্ট ওর সাথে তোমার সম্পর্ক ভেঙে গেছে জানার পরেও ওর কাছে আসি নি। ওকে শাসনও করতে পারি নি। কি করে করব? যেখানে আমি নিজেই নিজের ঘর ভেঙে বসে আছি সেখানে ছেলেকে কোন মুখে শাসন করব? তবে তোমাকে পেয়ে একটা আশা জেগে উঠেছিল। ছেলেটা ঠিক হয়ে যাবে। তাই আমি শুধু এটুকু খোঁজ নিয়েছি তোমাদের ডিভোর্স হয়েছে কি না। পরে জানতে পারি ডিভোর্স হয় নি। আমার মনে আবারো নতুন করে আশার প্রদীপ জ্বেলে উঠল। আসলে সব সম্পর্ক ছিন্ন করা যায় না। আর স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক সে তো খোদার দান। এত সহজে মন থেকে মুছা যায় না। যেমনটা আমি পারি নি।”
মেহের অবাক হয়ে উনার কথা শুনছে। উনার এই গুরুগম্ভীর কথার মাঝে কোথাও একটা লুকোনো ব্যথা আছে। মেহের উনার চোখ মুখ পরখ করছে। বিষয়টা ফায়াজের বাবা খেয়াল করে দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“এই দেখো কোন কথা থেকে কোথায় চলে গেলাম? তুমি নিশ্চয়ই বিরক্তবোধ করছো? ওসব বাদ দেও। তুমি নিজের খেয়াল রেখ বুঝলে। শীঘ্রই তোমাকে সুস্থ হতে হবে। তারপর এই বুড়ো শ্বশুর আর আমার পাগল ছেলেটার দায়িত্ব নিতে হবে। তাই তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাও তো।” ( তারপর হেসে ফেললেন)
মেহের বুঝতে পারল উনি কৌশলে সব এড়িয়ে গেলেন। মেহেরও প্রশ্ন করে উনাকে বিব্রতবোধ করাতে চাইল না। তবে এটুকু বুঝতে পারল উনি সুখে নেই। কোথাও না কোথাও মনে মনে একটা ভরা সংসার চাইছে। যেখানে সবটা থাকবে।
মেহের আলতো হেসে বলল,
“আমি আপনার জন্য চা করে নিয়ে আসছি।”
মেহের চা আনতে উঠে গেল। মেহেরের মা ওদের শ্বশুর আর বউমার কথার মাঝে যেতে চায় নি। তাই দূরে দাঁড়িয়ে আছেন। মেহের মায়ের কাছেই ওর মা নাস্তা নিয়ে যেতে চাইল। আর তখনই ফায়াজ সিড়ি দিয়ে নামল। ফায়াজকে নামতে দেখে মেহেরের মা ওকে বলল,
“তুই জামাইয়ের সাথে থাক। দেখ ওর কি লাগবে। আমি তোর শ্বশুরকে নাস্তা দিচ্ছি।”
মেহের পড়ল বিপদে৷ ফায়াজ আর ও একা এক জায়গায় থাকা মানে ফায়াজের….
না না মেহের আর ভাবতে পারছে না। কি করবে এখন?
মেহের তাই দ্রুত বলল,
“মা, নাহহহ!”
মেহেরের হুট করে এত জোরে কথায় চমকে উঠল ওর মা। বড় বড় চোখ করে মেহেরের দিকে তাকাল।
মেহের মায়ের ভাব দেখে প্রশ্ন ছুড়ে মারার আগেই বলল,
“মা, আমার শ্বশুর এই প্রথম আমাদের বাড়িতে এসেছেন। গতবার তো আপুর বিয়েতে এসেছিল। সেটা অন্য ব্যাপার। আমি বাবাকে বললাম যে আমি চা নিয়ে আসছি। এখন যদি তুমি যাও তাহলে কেমন দেখায়? ফায়াজের নাহয় একদিন অসুবিধা হবে তাতে কি? আমার শ্বশুর বাবা তো আর রোজ রোজ আসবে না। আমিই বরং নাস্তাটা নিয়ে যাই। তুমি ফায়াজকে দেখো।”
মেহের মায়ের হাত থেকে এক প্রকার ছিনিয়েই ট্রে নিয়ে নিল। মেহেরের মা হটাৎ মেয়ের এহেন আচরণে অবাক না হয়ে পারল না।
।
ফায়াজ নাস্তার টেবিলের আশেপাশে মেহেরকে না দেখে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। মেহেরের মা প্লেটে খাবার দিতে দিতে বলল,
“তোমার বাবা এসেছেন মেহেরকে দেখতে।”
ফায়াজ বুঝতে পারল মেহের সেখানেই আছে। তাই চুপচাপ খেয়ে নিজের রুমে চলে গেল।
।
ফায়াজের বাবা যাওয়ার পর সামিরা এসেছে সাথে তুষারও। মেহের ভ্রু কুঁচকে সামিরার দিকে তাকিয়ে আছে। সামিরা মেহেরের দৃষ্টি দেখে দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,
“জানু, তোকে দেখতে এসেছি। আর তুই এমন রাক্ষুসির মত চেয়ে আছিস কেন? খেয়ে ফেলবি না কি আমায়? তোকে কেউ খেতে দেয় না?”
মেহের সামিরার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল এক পাশে। তারপর বলল,
” কি চলছে তোদের?”
সামিরা নিজের গালে আলতো ছুঁয়ে বলল,
“নাউজুবিল্লাহ! কি বলিস এসব?”
মেহের চোখ পাকিয়ে বলল,
“সত্যি করে বল?”
সামিরা আমতা আমতা করছে। তারপর মেহেরের দিকে তাকিয়ে আবারও দাঁত কেলিয়ে বলল,
“তোর এই দেবরটা এত কিউট কি করব?”
মেহের চোখ উল্টিয়ে মাথা নাড়িয়ে বলল,” হায় রে!”
।
সামিরা আর তুষার সারাদিন ছিল ওদের বাড়িতে। তাই ফায়াজ একটুও সুযোগ পায় নি মেহেরের মুখোমুখি হতে। যাও পেয়েছে মেহের এড়িয়ে গেছে।
মেহের মাগরিবের নামাজ পড়ে গার্ডেনে হাঁটাহাঁটি করছে। ফায়াজ উপর থেকে মেহেরকে দেখে মনে মনে বলছে,
“পেয়েছি সুযোগ৷ দাঁড়াও।”
মেহের হাঁটাহাঁটির মাঝে ফায়াজকে বাইরে আসতে দেখে দ্রুতপায়ে অন্যদিকে হেঁটে চলে গেল।
মেহের পেছনে ঘুরে দেখছে, ফায়াজ আসছে কি না। তখনই সামনের দিকে চোখ গেল। মাহি আর তূর্জ একে অপরকে আলিঙ্গন করে বসে আছে। একে অপরের সঙ্গে লেপ্টে আছে। তূর্জ মাহির মাথায় হাত বুলিয়ে কিছু বলছে। মেহের ওদের এভাবে দেখে বিষম খেয়ে উল্টো ভোঁ দৌড় দিল। একদম দৌড়ে ফায়াজের সামনে গিয়ে থামল৷
ফায়াজ মেহেরকে এভাবে দৌড়াতে দেখে এক ধমক লাগাল। মেহের আমতা আমতা করছে। ওর মুখটা থমথমে।
“এভাবে দৌড়াচ্ছ কেন?”
মেহের থমথমে মুখে বলল,
“না মানে ও দিকে…!”
ফায়াজ ভ্রু কুচকে বলল,
” ও দিকে কি? ভূত দেখেছো না কি?”
“না কিছু না। কিছু না।” (জোরপূর্বক হেসে)
ফায়াজের সন্দেহ লাগছে। মেহের কি যেন লুকাচ্ছে। ওখানে কি আছে? কি দেখে মেহের দৌড়ে পালাল?
“দাঁড়াও আমি দেখে আসছি।”
মেহের চোখ বড়বড় করে ফায়াজের হাত ধরে আটকিয়ে বলল,
“না যাবেন না।”
মেহেরের এমন বাঁধা দেওয়া দেখে আরো সন্দেহ বেড়ে গেল। ফায়াজ নাছোড়বান্দা তাই মেহের বলল,
“ওদিকে মাহি আপু আর তূর্জ ভাইয়া আছে। যাবেন না।”
ফায়াজ ভ্রু কুচকে বলল,”তো? ওরা আছে তো কি হয়েছে?”
মেহের চুপ করে আছে। ফায়াজ কয়েক সেকেন্ডের মাথায় ব্যাপারটা বুঝতে পারল। তারপর বাকা হেসে বলল,
“নিশ্চয়ই রোমান্টিক মুডে আছে। দেখেছো তুমি আর আমি ছাড়া সবাই রোমান্টিক মুডে আছে। এখন যেহেতু তোমার আর আমার মধ্যে সব ঠিকঠাক আছে তাই দিনরাত রোমান্টিক মুডে থাকার কথা।”
মেহের আমতা আমতা করে বলল,”কি ঠিক আছে? ”
ফায়াজ চোখ ছোট ছোট করে বলল,
“তোমার কি ভোলার রোগ আছে? যাক গে সে তুমি ভুলে যাও। তাতে আমার কি? আমার তো মনে আছে। আর আমি এখন রোমান্টিক মুডে আছি।”
ফায়াজ মেহেরের কোমড় জড়িয়ে ধরে আঙুল দিয়ে চুল নাড়ছে আর বলছে,
“গতকাল আমি আমার জীবনের সেরা কিছু শব্দ শুনেছি। বলতে পারো জীবনের সব চেয়ে সেরা সময় পাড় করেছি। সব পেয়ে গেছি আমি। সব সময় চেয়েছি আমার এমন একজন মানুষ থাকুক, যে আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসবে।”
ফায়াজ আলতো করে মেহেরের চোখের পাপড়িতে চুমু খেল। তারপর আকুতি নিয়ে বলল,
“তুমি হারিয়ে গেলে আমার বুকের জমিনটা শূন্য হয়ে যাবে। আর আমি শূন্যতা নিয়ে দম আঁটকে মরে যাব৷ তাই হারিয়ে যেও না।”
চলবে…