#শ্রাবণ_কিংবা_ফাগুন_একটুখানি_বর্ষণ
প্রভা আফরিন
[৭]
সিএনজিতে টুকটুকি ও নিশীথের ঝগড়ার বর্ণনা শুনে নন্দিনীর কণ্ঠে সীমাহীন বিরক্তি ঝড়ে পড়ে,
“তুই আবার ওই পোলার লগে ব’ল’দের মতো ঝগড়া করছিস, সিরিয়ালসি?”
টুকটুকি তার পুরু অধর দাঁতে চেপে ধরে সরল গলায় বলল,
“আমার দোষটাই দেখছিস? আর ওই লোক যে আমাকে খোঁচা দিয়ে কথা বলেছে তার বেলায়? খোঁচা না দিয়ে যদি ভালো করেই বলত চুল সরাতে, আমি কি সরাতাম না?”
“কইতে চাইছিল তুই হুনোছ নাই। সো আল্টিমেটলি দোষটা আমি ওই পোলারে দিমু না।”
ওরা দুইজন বসে আছে লেকের পাশে। সম্মুখের সবুজাভ জলের ওপর তখন ম’রা দুপুরের সোনালি কিরণ চুইয়ে পড়ছে। অনুভব গেছে পায়েলের সঙ্গে আর দিগন্ত গেছে চা আনতে। সেই সুযোগে টুকটুকি প্রথমে কথা পেড়েছিল নন্দিনীর কাছে। নন্দিনী তার বিপক্ষে অবস্থান করায় ছলছলে চোখে চেয়ে বলল,
“তুই আমার বন্ধু হয়ে ওই লোকের সাইড নিচ্ছিস?”
নন্দিনীর কণ্ঠ ঝংকার তোলে,
“কথা খুঁইজ্জা না পাইলে ভ্যাক ভ্যাক কইরা কান্দনের স্বভাবটা আমার বিলকুল না পাছান্দ। চব্বিশ বছরের মাইয়া কিনা পোলাপাইনের মতোন কিছু হইলেও কান্দন জুইড়া দেয়!”
“দোস্ত, কন্ট্রোল করতে পারি না। আমি তো তোর মতো শক্ত মনের না।”
“শক্ত মন নিয়ে কেউ জন্মায় না। পরিস্থির সঙ্গে মানিয়ে শক্ত গড়ে নিতে হয়। তুলু তুলু কইরা বড়ো হইছো তো, তাই আহ্লাদে ভাইসা বেড়াও।”
“এখন আমার ভয় করছে। ওই লোক যদি বাড়ি গিয়ে আন্টিকে ভুলভাল বোঝায়? আন্টি যদি আমাকে ভুল বুঝে ফেলে আমি ভীষণ কষ্ট পাব।”
“রিতা আন্টির বাড়িতে যাতায়াত করোছ অথচ তারই পোলার লগে এমন কান্ড কইরা ক্ষ্যাত কাম করছোস। আমরা কিন্তু উনার কাছে কৃতজ্ঞ। এক্সের বিয়া খাওনের সুযোগ দিয়া উনি আমার একটা সাধ পূরণ করছে।”
“রিতা আন্টি ভালো। কিন্তু উনার ছেলে হাড়ে হাড়ে ব’দ’মা’ইশ। বিয়ের দিন যদি আমায় অপমান না করত তবে এইসব কিছুই হতো না। শুরুটা উনিই করেছিল।”
নন্দিনী সরু চোখে পরখ করে মেয়েটিকে। ফোলা ফোলা গালে লেপ্টে আছে সীমাহীন রাগ। সুক্ষ্ম অভিমানও কি উঁকি দেয়? সেই বিয়ের দিন থেকে খেয়াল করছে টুকটুকি রিতা আন্টির ছেলেকে একটু বেশিই প্রাধান্য দিয়ে ফেলছে। বিয়ে বাড়িতে নিশীথের আকস্মিক উপেক্ষায় নিজের রূপ নিয়ে পর্যন্ত ক্ষণিকের হীনমন্যতায় পড়েছিল। নন্দিনীর অভিজ্ঞ চোখে আনাড়ি মেয়েটি সহজেই অনুমেয়।
“আমি তো অন্য গন্ধ পাইতাছি টুকি সোনা। তুমি কেন ওই লোকের কাছ থাইকা অ্যাটেনশন চাও?”
“আমি কেন অ্যাটেনশন চাইব?” টুকটুকি থতমত খেয়ে গেল।
“তাহলে সেই লোক পাত্তা দিল কিনা তাতে অত আপসেট হইছিলি ক্যান? সেই রাগেই তো প্রথম ঝগড়াটা বাধাইলি।”
ঠিক তখনই অনুভবকে আসতে দেখা গেল। তার চোখেমুখে খেলে বেড়াচ্ছে উজ্জ্বল দ্যুতি। ধপ করে সিমেন্টের থামে বসতেই দিগন্তও উপস্থিত হলো। সকলে কৌতুহলী দৃষ্টি একযোগে নিবদ্ধ হলো অনুভবের ওপর। অনুভব বুঝল সেই তিন জোড়া চোখের ভাষা। ঘাড় চুলকে বলল,
“হলেও হতে পারে।”
তিনজনে একসাথে জয়ধ্বনি দিয়ে উঠল। নন্দিনী বলল,
“আরে মামা, মিঙ্গেল গ্রুপে স্বাগত।”
অনুভব হাত উঁচিয়ে বলল,
“আগেই নাচিস না। সবে একবার দেখা হলো। অবশ্য ভালোই লাগল মেয়েটাকে। আরো দুয়েকবার দেখা করে এরপর ফাইনাল ডিসিশন নেব।”
টুকটুকি কপাল কুচকে চায়ে চুমুক দিল। হাত নাড়িয়ে ভাষণ দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
“এত খুঁতখুঁত করে প্রেম হয় না। প্রেম হবে ধপাস করে পিছলে পড়ার মতো। বুঝে ওঠার আগেই হয়ে যাবে। এরপর ধীরে ধীরে অনুভুতিরা ডালপালা ছড়াবে। তার সবকিছু মোটেও পারফেক্ট হবে না। বরং একে অপরের খুঁতগুলো প্রেম দিয়ে ঢেকে তার পরিপূরক হয়ে উঠবে। তবেই না প্রেমের মজা। সব পারফেক্ট হলে সেই প্রেম খুবই বোরিং হবে। না থাকবে ঝগড়া, না অভিমান। সেটা হবে অনেকটা তেল-মশলা ছাড়া খাবারের মতো। স্বাস্থ্যসম্মত কিন্তু স্বাদহীন।”
ওর কথায় নন্দিনী ঠোঁট টিপে ইঙ্গিতপূর্ণ হেসে বলল,
“মাইয়ার আজকাল প্রেম নিয়া বুলি ফুটতাছে। লক্ষণ তো সুবিধার না।”
দিগন্ত বিরোধ করল,
“আরেহ অত আবেগের বয়স নেই এখন। অনার্স শেষ হয়ে যাবে এ বছর। এরপর চাকরির দৌড়, বিয়ে-বাচ্চা। তাই দেখে-বেছে, বুঝেশুনেই কাউকে লাইফে আনতে হবে। সবার ফিলিং কি আর ইকরির মতো?”
নন্দিনী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
“হালুইম্মা, তুই কি আমারে ইনসাল্ট করলি?”
“তুই ইনসাল্ট ফিল করলি, ইকরি?”
নন্দিনী কাঁধ নাচিয়ে টুকটুকির গায়ে হেলান দিয়ে বসে। দিগন্তের উৎসুকতায় জল ঢেলে বলে,
“মোটেও না।”
অনুভব বলল,
“পায়েল কিন্তু খুলনা জেলার। ইকরির দেশের লোক।”
নন্দিনীর কপালে ভাজ পড়ে। টুকটুকির হঠাৎ মনে পড়তেই বলল,
“কিন্তু আসল কথাই তো জানা হলো না। এই ইকরি, তোর আজকের ব্ল্যাক ব্রেকাপ ডে’র কারণটাই তো জানা হলো না।”
নন্দিনী পা উঠিয়ে বসে বিতৃষ্ণা ভরে আওড়ায়,
“জুনিয়রগো লগে রিলেশনশিপে গিয়াও শান্তি নাই। সব ফা’জিল হইয়া গেছে। আজকে লাভিউ, কালকে মিস ইউ, পরশু কিস ইউ। আমিও তারে সসম্মানে এক্সের দলভুক্ত কইরা দিলাম।”
দিগন্ত দাঁত কিড়মিড় করে ওঠে,
“এমন হবে জেনেও প্রেম করিস কেন?”
“জীবনে শখ আহ্লাদ আছে না।” নন্দিনীর গা ছাড়া উত্তর।
“তাহলে ব্রেকাপ কেন করিস?”
“এই ধর খুশিতে, ঠ্যালায়, ভাল্লাগে।”
“এইসব ফান আর কত? তুই কি লাইফ নিয়ে কখনো সিরিয়াস হবি না?”
“উহুম। পুরুষ নারীদেহ নিয়ে খেলতে ভালোবাসে আর নন্দিনী পুরুষের মন নিয়ে।”
বলতে বলতে নন্দিনী চোখ টিপে হেসে ওঠে। বন্ধুরা একে অপরের মুখ চেয়ে হতাশ শ্বাস ফেলে। এই মেয়েকে বোঝা দায়।
_____________
সূর্য তখন আলোর আড়ং ভেঙে তল্পিতল্পা গুটিয়ে নিতে তৎপর। ব্যস্ত রাস্তা তখন জনারণ্যে গলা ডুবিয়ে গমগম করছে। শেষ বিকেলের মিঠে রোদে অবগাহন করে টুকটুকি শরীরটা চনমন করে উঠল। সে আপাদমস্তক সুখী মানবী। নির্ঝঞ্ঝাট জীবন, একগুচ্ছ বন্ধুবান্ধব, পরিবার নিয়ে সুখী দিনযাপন করে। যান্ত্রিক শহরের কোলাহল, কূটিলতা, জটিলতা তার কান ছুতে পারে না। টুকটুকি রিতা আন্টির বাড়ির সামনে এসে একবার ওপরতলায় দৃষ্টি হানে। আজ কোনো কাপড় মেলা নেই। টুকটুকি খেয়াল করল তার চনমনে বিকেলে হুট করেই একটা মলিন ছায়াপাত হলো।
নিপার বিয়ের পর টুকটুকি আর রিতা আন্টির বাড়িতে আসেনি। আজ হঠাৎ রিতা আন্টি ফোন করে তলব করায় আসতেই হলো। কলিংবেলে চাপ দিতে গিয়ে টুকটুকির বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করতে লাগল। সকালেই আন্টির একমাত্র অমাবস্যার চাঁদ, অসামাজিক, ইঞ্জিনিয়ার ছেলের সঙ্গে তুমুল ঝগড়া হয়ে গেছে। লোকটা কি আন্টিকে উল্টোপাল্টা বুঝিয়েছে। টুকটুকি এমনিতেই অনুভূতিকাতর। ওর রাগ, জেদ, আহ্লাদ, খুশি, অভিমান কিংবা কান্না সবটাই বেশি বেশি। এখন যদি রিতা আন্টি ভুল বোঝে? টুকটুকি ভীষণ দুঃখ পাবে।
দুইবার কলিংবেল বাজতেই দরজা খুলে দিলেন রিতা আন্টি। অভিমানী কণ্ঠে বললেন,
“আজকাল আমাকে কারোই মনে পড়ে না। বুড়ো মানুষ একা বাড়িতে থাকি। অসুখ-বিসুখের আলাপ করারও কেউ নেই।”
টুকটুকি হাসল। যাক, বিপদের আশঙ্কা নেই। সে পূর্ণ দৃষ্টিতে চাইল মধ্যবয়সী মানুষটার দিকে। ভারী চেহারার বেটে-খাটো এই মহিলাটি বয়সের ব্যবধান ঘুচিয়ে কীভাবে যে গল্পের সঙ্গী হয়ে গেছে তা বুঝতেই পারল না। সে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে অত্যন্ত সাবধানী গলায় বলল,
“আপনার ছেলে-মেয়েরা তো এখন বাড়িতেই আছে, আন্টি। বরং আমাকেই মনে না পড়ার কথা।”
“তারা সব সাহেব-ম্যাম বনে গেছে। মাসে দু-একবার দর্শন দেয় তাই ঢের বাবা। অত গল্প করার অভ্যাস তাদের নেই। দুটো ছেলে-মেয়েই মুখচোরা হয়েছে। একদম বাপের মতো।”
টুকটুকি বসার ঘরে গিয়ে বসল। চারপাশে তাকিয়ে বলল,
“বাড়িতে কেউ নেই?”
“নাহ। ছেলেটা সকালে বেরিয়ে গেল। মেয়েটাও সংসার ফেলে থাকতে পারল না। আমি আবারও একা। তোমার বন্ধুদের সঙ্গে তো সেদিন কথাই হলো না। আমার কিন্তু খুব ভালো লেগেছে। ছেলে-মেয়েরা এমন প্রাণবন্ত হলেই না মনটা ভরে থাকে। ওদের একদিন ডেকো আমার বাড়িতে। বোলো আন্টি দাওয়াত করেছি। জমিয়ে গল্প হবে।”
টুকটুকি কেন জানি গল্প করায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলল। মনের মাঝে শুধু একটা কথাই প্রকট হলো। লোকটা চলে গেছে।
চলবে…