শ্রাবণ কিংবা ফাগুন একটুখানি বর্ষণ পর্ব-০৮

0
456

#শ্রাবণ_কিংবা_ফাগুন_একটুখানি_বর্ষণ
প্রভা আফরিন
[৮]

সকাল প্রায় নয়টার কাছাকাছি। প্রিয়া বস্তির ঘিঞ্জি পথ মাড়িয়ে বড়ো রাস্তায় উঠতেই আচানক রঞ্জুর সামনে পড়ে গেল। রঞ্জুর হলদেটে চোখদুটি চকচক করে উঠল। সেই চোখের ভাষা যেন বলছে সকাল সকাল প্রিয়ার দর্শনে সে মুগ্ধ, কৃতার্থ। প্রিয়ার গতি সামান্যতম রোধ হলো না। চোখ তুলে এক পলক রঞ্জুকে দেখে আবারো হাঁটতে লাগল। রঞ্জু পিছু ধরল। খাকারি টেনে নিজের ঘ্যারঘ্যারে কণ্ঠস্বরটা পরিষ্কার করে বলল,
“প্রিয়া, ভালো আছো?”

প্রিয়া ভেতরে ভেতরে একটু নড়েচড়ে ওঠে। চলার গতি বৃদ্ধি করে। মুখ না ফিরিয়েই আস্তে করে বলে,
“জি, ভালো।”

রঞ্জু পায়ে পা মিলিয়ে এগোয়। বলে,
“আমি কেমন আছি জিগাইবা না?”

“তা জেনে আমি কী করব?”

রঞ্জু একটু থতমত খেয়ে গেল। পরক্ষণেই হেসে বলল,
“তাও ঠিক। আমি কেমন আছি তা দিয়া তোমার কী? তা আন্টি ভালো আছে? ছোটো বইন?”

“সবাই ভালা আছে।”

“নতুন পরিবেশে মানাইয়া নিতে কষ্ট হইতাছে? কোনো ঝামেলা হইলে জানাইতে পারো।”

“কেন?” প্রিয়া সরল মনেই প্রশ্ন করল।

রঞ্জু আবারো হেসে বলল,
“আমরা তো এখন প্রতিবেশী। আর প্রতিবেশীরাই প্রতিবেশীর খোঁজ নেয়। আমি তোমাগো খোঁজ নিমু, তুমি আমার।”

“ওহহ!”

“তুমি অনুভব ভাইগো বাড়িত কাম নিছো শুনলাম। তুমি নিজেই তো একটা বাচ্চা আবার আরেক বাচ্চা সামলাইবা কেমনে?”

“রঞ্জু ভাই, আমার বয়সে আপনার মায়ের কোলে আপনি ছিলেন।”

রঞ্জু আবারও হাসল। হাসিটা তার বাতিক। বিপরীতের মানুষটা যতই ধরাশায়ী, বিব্রতকর উত্তর দিক না কেন সে সর্বদাই হাসবে। রঞ্জু খেয়াল করল প্রিয়া অন্যদিকে তাকিয়ে তার সঙ্গে কথা বলছে। হাঁটতে হাঁটতে একবারও তার দিকে ফেরেনি। রঞ্জু আফসোসের সুরে বলল,
“মুখ ফিরাইয়া রাখলা ক্যান? আমি অশিক্ষিত, কালা মানুষ বইলা কি চাইয়াও দেখা যায় না?”

“সে জন্য না।”

“তাইলে? শরম পাও?”

“উহু, আপনার মুখে দুর্গন্ধ।”

রঞ্জুর পা থেমে গেল। চিরস্থায়ী হাসিও হুট করে মিলিয়ে গেল। কালচে, মোটা ঠোঁট দুখানি একে অপরকে চেপে ধরে মুখের কবাট আটকে দিল। প্রিয়া কথাটা বলে নিজেই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে। সে রঞ্জুর দিকে ফিরে দেখার সাহস পেল না। প্রায় ছুটে চলে গেল।
_______

অনুভব বসার ঘরে অসহায় হয়ে বসে আছে। একটু বাদেই তার জুম অ্যাপে গুরুত্বপূর্ণ একটা ক্লাস এটেন্ড হবে। অথচ কোলে আদরের ভাতিজা জাইম। ইতিমধ্যে জাইমের ছোটো অথচ ধা’রা’লো নখের দ্বারা অনুভবের ফরসা নাকে বেশ কিছু নকশা ফুটে উঠেছে। ওকে নিয়ে ক্লাস এটেন্ড করা অসম্ভব। এদিকে বাচ্চার ডাক্তার বাবা তার শ্বাশুড়িকে নিয়ে গেছে মে’ডি’কেল চেকাপে। অন্তরা ভাবীও একটু আগে বেরিয়ে গেল। অনুভবের নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হয়। তখনই প্রিয়াকে ঢুকতে দেখে সে বিরস বদনে বলল,

“দুদিন কাজে আসতে না আসতেই শুরু হয়ে গেছে ফাঁকিবাজি?”

প্রিয়া ঘর্মাক্ত মুখটা ওড়নার একাংশে মুছতে মুছতে দেয়াল ঘড়িটা দেখে নেয়। বলে,
“পাঁচ মিনিট লেট।”

“এক মিনিট লেট হলেও সেটা লেট-ই। জাইমকে নাও। নয়তো এবার আমার ক্লাসে লেট হবে।”

প্রিয়া হাত বাড়িয়ে দিতেই জাইম নিচের পাটির দাঁত দুখানি দেখিয়ে হেসে লাফিয়ে ওর কোলে আসে। বাচ্চাটা ইতিমধ্যে তাকে ভালোমতো চিনে ফেলেছে।

অনুভব ক্লাস শেষে বেরিয়ে এসে এক গ্লাস পানি খেল। রহমান স্যারের ক্লাসে একেবারে ঘাম ছুটে যায়। হেঁটে হেঁটে জাইমকে ঘুম পাড়াচ্ছিল প্রিয়া। অনুভব ডেকে বলল,
“এই হাসু শোনো।”

নামটা কর্ণকুহর ভেদ করতেই প্রিয়ার মুখে আঁধার নামল। মনে মনে বিড়বিড় করল,
“বাজে, সবচেয়ে বাজে নাম।”
গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসতেই অনুভব আবার বলল,
“জাইমের নখগুলো কে’টে দিয়ো তো। আমার নাকের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে।”

“আচ্ছা। কিন্তু বাবুর নেইল কা’টার কোথায় সেটা আমার জানা নেই। না বলে কোথাও খোঁজাটা ঠিক হবে না আমার। আপনি কি একটু খুঁজে দেবেন, অনু ভাইয়া?”

অনু ভাইয়া! অনুভবের মনে হলো তার নামটাকে কেউ ঢোলের ওপর ফেলে দুমদাম বাজিয়ে দিল। মেয়েটা কী নামের প্রতিশোধ নিচ্ছে? অনুভব ধমকে উঠল,
“এই মেয়ে ফা’জ’লামি পেয়েছো?”
“মানে?”
“আবার মানে মানে করছ? সেয়ানা ভাবো নিজেকে? অনু ভাইয়া আবার কী?”

প্রিয়া বুঝতে পেরে ঠোঁট টিপল। কথার স্রোতে শব্দটা বলে ফেলেছে। মেয়েটার হাসি লুকানোর চেষ্টা দেখে আরেকদফা ক্রো’ধের উত্তাপ উঠল অনুভবের দেহে।
“এই মেয়ে আবার হাসছো? আমার নামটাকে কি তোমার জোক মনে হয় যে পোক করবে?”

“আমি অতকিছু ভেবে বলিনি।”
“ইচ্ছে করেই বলেছো।”

আচ্ছা মুশকিল তো! এই লোক দেখি পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করে। প্রিয়া তর্ক করা পছন্দ করে না। তাই অত কথায় না গিয়ে সরাসরি বলল,
“তাহলে কী বলে ডাকব বলে দিন।”

“স্যার বলবে। ওসব ভাইয়া ডাকা যাবে না। এই বয়সী মেয়েদের খুব ভালো করে জানা আছে। আজ ভাইয়া, কাল সাইয়া। ওসব চলবে না। কাজ করতে এসেছো, মন দিয়ে কাজ করবে।”

প্রিয়ার মুখটা তখন অস্বস্তিতে লাল হয়ে উঠেছে। লোকটা নিজেকে একটু বেশিই প্রাধান্য দেয়। প্রথমে ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলে নামটাই বদলে দিল আর এখন তো সম্বোধনেও ইঙ্গিতপূর্ণ আচরণ। লোকটার মাথায় কি সারাক্ষণ এসবই ঘোরে? মেয়েরা উনার প্রেমে পড়তে ম’রে যাচ্ছে সব! প্রিয়া সে কথা আর মুখে আনল না।

অনুভব বড়ো ভাইয়ার ঘরে ঢুকল বাবুর নেইল কা’টার খুঁজতে। খুঁজতে খুঁজতেই তার মনে হলো মেয়েটা ফা’জিল হলেও এই দিকটা ভালো আছে। নিজে কোনোকিছুতে হাত না দিয়ে তাকে বলল খুঁজে দিতে। তাছাড়া মেয়েটা দরকার ছাড়া কথাও খুব একটা বলে না। আরো কিছু ভালো দিক আছে তবে অনুভব তা নিয়ে ভাবতে চাইল না। এদের যত কম পাত্তা দেওয়া যায় ততই মঙ্গল। অনুভব নেইল কা’টার প্রিয়ার হাতে দিতেই প্রিয়া জিজ্ঞেস করল,
“আপনি কোথায় পড়েন?”
“তা জেনে তুমি কী করবে?”
“নাহ, অনলাইন ক্লাস করতে দেখলাম বলে জানতে ইচ্ছে হলো।”

অনুভব সে কথার উত্তর না দিয়ে পাল্টা জিজ্ঞেস করল,
“তুমি কতদূর পড়েছো? ভাষা তো ঝরঝরে শোনায়।”
প্রিয়া মনোযোগী হয়ে ঘুমন্ত জাইমের নখ কা’টতে কা’টতে বলল,
“এইতো এবার এইচএসসি দিয়েছি।”

অনুভবের চোখ বড়ো হয়। পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় নির্লিপ্ত গোছের মেয়েটির দিকে। হলুদ রঙা সালোয়ার কামিজ পরনে উজ্জ্বল ত্বকের মেয়েটাকে দেখতে বেশ পরিপাটি। আচার-আচরণেও ভদ্র ঘরেরই মনে হয়। অনুভব ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করে,
“তোমার বয়স কত?”

“আঠারো। বয়সটাতেও আপনার সমস্যা থাকলে বাড়িয়ে নিতে পারেন স্যার। ওটাতে আমার সমস্যা নেই।”

অনুভব এ কথায় হেসে ফেলল। জানতে চাইল,
“সমস্যা নেই কেন?”

“সবাই বলে আমি নাকি বয়সের চেয়ে বেশি গম্ভীর।”

“পড়াশোনা করো তবে এই বয়সে তুমি এই কাজ কেন করছো? টিউশনি করাতে পারতে।”

“খুঁজছি। কখনো করাইনি তো। অভিজ্ঞতা নেই। হাত গুটিয়ে বসে থাকলে সংসার চলবে না। তাই বাবু সামলানোর কাজটা আগে পেয়ে নিয়ে নিলাম।”

“এতদিন সংসার চলল কী করে?”
অনুভবের কৌতুহল বেড়েই চলেছে। সেটাকে থামিয়ে দিতেই প্রিয়া বলল,
“চলেছে একভাবে। এখন আর চলছিল না বলে কাজে লাগা। আপনি আওয়াজ করবেন না স্যার, জাইমের ঘুম ভেঙে যাবে।”
___________

নন্দিনী প্রীতিলতা হলে তার বরাদ্দকৃত রুমের বিছানায় বসে আছে। সে সিনিয়র। কিছুটা উগ্র মেজাজের হওয়ায় সকলে তার উপস্থিতিতে কিছুটা তটস্থ থাকে। আজও তাই। নন্দিনী ঢোলা টিশার্ট ও পালাজো পরে আছে। তবুও গায়ের গরম কমছে না। বাইরে তখন বেলা পড়ে এসেছে। তার সম্মুখের বেডের মেয়েটি এই গরমে কাঁথার ভেতর ঢুকে ফিসফিস করে কথা বলছে। এক পর্যায়ে হি হি করে হাসতে লাগল। নন্দিনী ধমকে উঠল,
“এই পালক, রুমটাকে কী তোর পার্ক মনে হচ্ছে? নাকি লাফিং শো?”

সঙ্গে সঙ্গে হাসি থেমে গেল। কাঁথা থেকে মুখ বের করল পালক। বলল,
“অনিক একটা মজার কথা বলছিল তো, তাই হেসে ফেলেছি।”

নন্দিনী বিরক্ত হয়। পালক পেট পাতলা ধরনের মেয়ে। সারা দিন-রাত প্রেমিকের সঙ্গে গুজগুজ করতেই থাকে। বৃষ্টি শেষে গাছে হাওয়া লাগলে যেমন পাতায় সঞ্চিত বৃষ্টির ফোঁটা ঝরঝর করে ঝরে যায় তেমনই পালককে একটু নাড়া দিতেই সব বলে দেয়। যেমনটা এখন হলো। নন্দিনী বলল,
“কী এমন মজার কথা বলল তোর হাদা বয়ফ্রেন্ড?”

পালক ফোন রেখে কাঁথা থেকে বেরিয়ে আরাম করে বসে বলতে লাগল,
“কাল সন্ধ্যায় অনিকের সঙ্গে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম।”

“কোথায়? বাইরে?”

“উহুম ক্যাম্পাসেই। হাঁটতে হাঁটতে সুইজারল্যান্ডের কাছে যেতেই হুট করে নির্জন পেয়ে আমাকে চুমু খেয়ে বসেছে দুষ্টু ছেলেটা।”

“কোন জায়গায় খেয়েছে?” নন্দিনী চোখ বড়ো বড়ো করে জানতে চায়। পালক হেসে আঙুল দিয়ে দেখায়। যার অর্থ ঠোঁটে। নন্দিনী এবার দৃষ্টি সরু করে বলে,
“আর তুই কী করলি?”

পালক হেসে বলল,
“লজ্জা পেলাম।”

“আমাকে বলতে লজ্জা করছে না?”

“করছে কিন্তু বলতেও ইচ্ছে করছে।”

“তো এর সাথে এখনকার হাসির কী সম্পর্ক?”

“অনিক বলছে আমার ঠোঁটের লিপস্টিক নাকি মধুর চেয়েও মিষ্ট। ওতে চিনি আছে কিনা। আমি বললাম লিপস্টিকটা ফুটপাত থেকে ত্রিশ টাকায় কিনেছি।তখন অনিক বলে তাহলে স্বাদটা লিপস্টিকের নয় আমার ঠোঁটের। আমার ঠোঁটে যাই ছোয়ানো হবে মিঠে হয়ে যাবে।”

নন্দিনী বিতৃষ্ণা নিয়ে বলল,
“পরেরবার নির্জনে দেখা করতে গেলে আমাকে জানাস। তোকে একটা স্পেশাল পটি ফ্লেভারের লিপস্টিক লাগিয়ে দেব। এরপর অনিককে জিজ্ঞেস করবি পটি ফ্লেভারের লিপস্টিকের টেস্ট কেমন।”

নন্দিনী চটপট একটা জিন্স ও টপ পরে বেরিয়ে গেল হল ছেড়ে। গ্রুপে ম্যাসেজ এসেছে শহীদ মিনারের সামনে সবাই অপেক্ষা করছে ওর জন্য। নন্দিনী শহীদ মিনারের কাছাকাছি যেতেই দেখল শুধু বন্ধুরা নয়, অনুভবের সঙ্গে পায়েলও এসেছে। তাকে দেখেই পায়েল হুট করে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল। বন্ধুরা সব বিস্মিত। নন্দিনী স্তব্ধ। পায়েল খুশিতে ঝলমলিয়ে উঠে বলল,
“নন্দিনী আপু, কত বছর পর দেখলাম তোমায়।”

চলবে…