সবটা অন্যরকম পর্ব-৪১+৪২

0
4004

সবটা অন্যরকম♥
#পর্ব_৪১
Writer-Afnan Lara
.
চায়ের কাপটা নিয়ে দিবা আহনাফের সামনের টেবিলটার উপর রেখে চলে আসলো
সবাই ডিনার সেরে যে যার রুমে চলে গেছে।আহনাফ এখনও সোফাতেই আছে
দিবা পর্দার আড়াল থেকে ওকে দেখছে।খোলসা করে কথা বলবে নাকি বলবে না সেটা নিয়ে কনফিউজড্ সে
পরে ভাবলো সেধে কথা বলার দরকার নাই
হয়ত এমনি মজা করলেন উনি
আর করবেন না এরপরে।শুধু শুধু এত ভাবছি।
দিবা পর্দা টেনে মণিতার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লো।আজ সে দরজাও লাগিয়েছে।মিনি নইলে আবার গিয়ে আহনাফকে জ্বালাবে
পরেরদিন সকাল হতে না হতেই হইহুল্লড় আবারও শুরু হয়ে গেছে
মণিতাকে পার্লারে সাজানো হবে বলে তাকে নিয়ে তার চাচাতো বোন দুজন পার্লারে চলে গেছে।দিবা বাসায় এখন একা
একা বলতে ছাদে গিয়ে সবাই যে যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত আছে
দিবা তার পরার জন্য জামাটা বের করে রেখে গোসল করতে চলে গেলো
মিনি দরজা খোলা পেয়ে আহনাফকে আর আনাফকে খুঁজতে বেরিয়েছে
শেষে আহনাফের রুমেই পেয়ে গেলো আহনাফকে।কিন্তু আনাফকে পেলো না
যাক গে তাতে কি!! একেই জ্বালানো যায় আপাতত
.
আহনাফ তার ফেভারিট কালো জ্যাকেটটা পরে নিয়েছে টিশার্টের ওপর দিয়ে।
তারপর সোজা আদনান আর আরিফকে হেল্প করতে ছাদে চলে গেছে
দিবা গোসল সেরে বাহিরে বের হয়ে চুলে কয়েক ঝারা দিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে বললো”আমায় বাবার মতন দেখতে?আমার একটা ছবি নিয়ে একদিন ট্রাই করবো বাবার ছবি আঁকানোর।হুমমম”
.
ভেজাচুলে কোনো স্টাইল খাটে না।আঁচড়াতেও মহা কষ্ট তাই দিবা চুলগুলোকে ওভাবেই ছেড়ে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়েছে।খালামণি নিজের রুমে তৈরি হচ্ছেন
দিবা ফ্রি টাইম পেয়ে টিভিটা অন করে বসেছে।টিভি দেখা শেষ হলো খালামণির ডাকে।খাকামণি বললেন সে যেন খালুর সাথে বসে খাবার টা খেয়ে নেয়।মণিতা আসলে ওর সাথে সাথে থাকতে হবে তখন এমন করে আর খাওয়া হবে না
দিবা তাই গেলো খালুর সাথে।সঙ্গে করে মিনিকেও নিয়ে গেছে।মিনিকে আজ বেশি করে হাঁড় খাওয়াতে পেরেছে দিবা
কিন্তু আহনাফকে ছাদে দেখলো না।উনার তো ছাদেই থাকার কথা।
খাওয়া শেষ করে দিবা চলেই যাচ্ছিলো শেষের দিকে ওর নজরে পড়লো আহনাফ।
বাবুর্চির দের ওখানে সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের সব দেখিয়ে দিচ্ছে।কাজে মহা ব্যস্ত
অন্য দিকে তাকানোর সময় তার নেই
আদনান আর বাকিরা খাবারের প্লেট আনতে নিতে বিজি
দিবা তাই আর দাঁড়ালো না।মিনিকে নিয়ে চলে আসলো বাসায়।ততক্ষণে মণিতা ও এসে পড়েছে
ওকে ওর রুমে রেখে বাকিরা গেছে গেট দখল করতে।জামাই এখনই এসে পড়বে
দিবা মণিতার সাজটা মনযোগ দিয়ে দেখছে
একটা বউকে কাছ থেকে দেখলে একটা মেয়ের নিজেরও বউ সাজতে ইচ্ছে করে
দিবার ও হয়েছে তাই তবে নিজের সাথে এর উল্টো হতে পারে তাই ভেবে ভয়ে আর বিয়ে করতে মন চায় না তার
এক ঘন্টা পরে জন্টুদের পুরো পরিবার এসে পড়েছে বাসায়।
মণিতার চাচাতো বোনেরা গেট দখল করে টাকা পয়সা আদায় করে নিচ্ছে
দিবা দূর থেকে মজাটা নিয়েছে।কাছে যায়নি।এসবে তার ইন্টারেস্ট নাই বললেই চলে।আগে কখনও যায়নি বলে এখন আর ইচ্ছেটুকু ও হয় না
আদনানকে দেখলেও কি আর না দেখলেও কি।তবে আহনাফকে না দেখলে মনের মধ্য হাজার প্রশ্ন জাগে।কিন্তু কেন?
আমি এটাই বুঝে উঠে পারি না।আদনান ভাইয়া যেমন আহনাফ ভাইয়াও তো তেমন আমার কাছে।তাহলে উনার প্রতি আলাদা টান আলাদা প্রসঙ্গ কেন থাকে?
আচ্ছা যদি বাই চান্স উনি আমায় প্রোপোজ করে বসেন আমি কি আদনান ভাইয়ার মতন উনাকেও রিজেক্ট করে দিতে পারবো?
হ্যাঁ পারবো!মোট কথা উনি এমনটা করতে পারেন না।উনার পছন্দ তো আমি হতেই পারি না অন্তত।
.
-যদি হও?
.
আহনাফের গলা শুনে দিবা চমকে পিছন ফিরে তাকালো।নিজের ভাবনায় এতটাই ডুবে ছিল যে আহনাফ কি বললো সেটা সঠিক বুঝলো না তবে কিছু একটা বলেছে সেটা শুনেছে পাক্কা
তাই দিবা আহনাফের দিকে বোকার মতন চেয়েই রইলো।ওর চোখের হাবভাব দেখে বুঝেছে আহনাফ যে তার বলা কথাটা দিবা শুনেনি
তাই পাশ কাটিয়ে সে চলে গেলো
দিবা আবারও মণিতার কাছে এসে বসেছে
বিয়েটা সম্পন্ন হতে হতে পনে তিনটা বেজে গেলো।
মণিতাকে বিদায় দিতে দিতে আবার বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যাও হয়ে গেছে।
এবার সবার যার যার বাড়ি ফেরার পালা।কাল বৌভাত হবে
আহনাফদের বাসা থেকে জন্টুদের বাসা কাছে হওয়ায় তারা আজ বাসায় ফিরে যাবে আর কাল বাসা থেকে সোজা জন্টুদের বাসায় আসবে
আরিফ মা বাবাকে নিয়ে বাস ধরেছে।আর দিবা আহনাফের সাথে মিনিকে নিয়ে বাইকে আসছে
বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পরে দিবার মনে হলো কাল রাত থেকে তার মনে যে প্রশ্নটা জাগছে তা এখন জিজ্ঞেস করে নেওয়া উচিত
.
-একটা কথা বলতে চাই
.
-বলো
.
-কাল রাত থেকে আপনি ওরকম ব্যবহার করছিলেন কেন?
.
-কিরকম?
.
দিবা নড়েচড়ে বললো”না মানে ঐ যে হলুদ লাগানো,খাওয়ার সময় হাতের সাথে হাত লাগানো আর..
.
আহনাফ মুচকি হাসছে।তারপরেও একটা কথাও বলছে না উত্তরে
দিবা ব্রু কুঁচকে বাইকের ফ্রন্ট মিররে চোখ রেখে বললো”কি হলো কিছু বলছেন না যে?”
.
-কি বলবো?আমার কাছে তো ওসব নরমাল মনে হলো।তুমি এরকম বড় করে দেখছে ক্যান?
.
দিবা আর বললো না কিছু।আহনাফ তার বলা কথাটা যেন মাথাতেই নিলো না
হেসে খেলে উড়িয়ে দিয়েছে।দিবা ভাবলো এরপরে যদি আবার এমন করে তো তখন এর জবাব সুদে আসলে তুলে নেবো
এই বুদ্ধিটা মাথায় আসায় দিবাও হাসলো।আর তার কারণটা শুধু সে জানে
আহনাফের কাঁধের উপর রাখা হাতটাকে আরেকটু খিঁচিয়ে ধরলো সে।মোটামুটি খাঁমচেই ধরেছে আহনাফের ঘাঁড়টাকে
আহনাফ নড়েচড়ে বসেছে এবার।দিবা মাথাটা একটু এগিয়ে এনে বললো”আজ বলবেন না বুকের ভেতর ধুক করে ওঠে?”
.
-ধুক করে তো।তবে আজ আমি তার কারণ জেনে গেছি তাই আর বলছি না
.
-কেন কেন?
.
-ঐ যে..
.
-ঐ যে?
.
-বলবো না।আমাকে প্রশ্ন করা অফ করো।বাইক চালানোর সময় কথা বলা যায় না।বুঝলে?
.
দিবা মুখটা বাঁকিয়ে রাখলো।মিনি একবার বামে তাকাচ্ছে একবার ডানে।তার চোখে আহনাফের কালো চশমাটা
কিরকম একটা ভাব নিচ্ছে সে
আহনাফ ওর ভাব দেখে হাসছে আবার দিবার উদ্ভট প্রশ্নেও হাসছে
সব হাসাহাসির কান্ডকারখানা!!
বাসায় আসার পর খালামণি দিবাকে হালকা নাস্তা বানাতে বললেন কারণ তারা দুপুরে খাওয়ার পর আর কিছুই খাননি কেউ
দিবা গায়ের জামাটা চেঞ্জ করে এসে নাস্তা বানাতে শুরু করে দিলো
আহনাফ ফ্রেশ হয়ে ফোনে কথা বলছে বসের সাথে।বস বললেন কাল যেন ডিউটি মিস না হয়।আহনাফ রাজি হয়েছে কারণ কাল রাতে তার কোনো কাজ নেই সুতরাং ডিউটি জয়েন করাই যায়
.
-নিন আপনার চা!”
.
চায়ের কাপটা আহনাফের হাতে ধরিয়ে দিয়ে দিবা চলে যেতে নিতেই আহনাফ ওর গায়ে ঝুলানো সবুজ রঙের সুতোর ওড়নাটার কোণা মুঠো করে ধরে আটকালো ওকে
দিবা পিছন ফিরে কিছু একটা বলতে যেতে নিতেই আহনাফ বললো”নড়বা না একদম!।আমার ডান হাতে কিন্তু গরম চায়ের কাপ যেটা এখন থরথর করে কাঁপছে!”
দিবা একটু এগিয়ে এসে নিজের ওড়নাটার কোণা আহনাফের বাম হাতের মুঠো থেকে ছুটিয়ে ওর সেই হাতটাকে আলতো করে ধরে আঙ্গুল একটাকে চায়ের কাপে ডুবিয়ে দিলো
আহনাফ দিবার দিকে চেয়ে ছিল বলে এটা খেয়ালই করলো না
গরম তাপে আঙ্গুল জ্বলে ওঠতেই শেষে আঙ্গুলটা উঠিয়ে নিয়ে এক চিৎকার করে বসলো আহনাফ
দিবা হেসে দিয়ে একটু ঝুঁকে ফিসফিস করে বললো”আমার সাথে দুষ্টুমি করতে এলে এরকম ছ্যাঁকা খেতে হবে আপনাকে।বুঝলেন মিঃনাফি?”
.
আহনাফ আঙ্গুলটাকে মুখে পুরে মিষ্টি করে হেসে তাকিয়ে আছে।
দিবা আবারও বললো”বুকে ধুক করে ওঠার কারণটা এইবার বুঝলাম”
.
আহনাফ মাথা চুলকিয়ে চায়ের কাপটা শক্ত করে ধরে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে থাকলো মাথাটা নিচু করে
.
দিবা গিয়ে বাকিদের চা নাস্তা দিয়ে এসে নিজের কাপটা নিয়ে রুমে চলে এসেছে
ওদিকে মিঃ মিনি গাঁদা ফুলের গাছটার ঢালে ওঠার সব চেষ্টা চালাচ্ছে।
ধুরুম করে দশবার পড়েছে তাও হার মানবে না সে।তার লক্ষ্য সবার উপরের ফুলটা ছিঁড়বে মুখ দিয়ে তারপর সেটাকে টেনে হিঁচড়ে দিবার কাছে নিয়ে যাবে। তারপর দিবা তার মাথায় ফুলটা গুজে দিয়ে হাসবে
.
দিবা তখনকার কথা মনে করে এমনি এমনি শুধুই হাসছিল
পরে ওর মাথায় আসলো আদনানকে মানা করে দিয়েছিলো তাহলে আহনাফকেও তো মানা করে দেওয়ার কথা।অথচ সে আহনাফের সাথে ঘটে যাওয়া সেই মূহুর্ত গুলো ভেবে মনে মনে অকারণেই হাসছিলো
-আচ্ছা!উনার মতো আমিও উনাকে পছন্দ করে ফেলিনি তো?
নাহ নাহ তা কি করে হয়!
.
মিনি ঠুস করেই পড়েছে এবার।তবে চূড়ার সেই ফুলটা নিয়েই পড়েছে অবশেষে।তার পড়ে যাওয়া সার্থক
.
শব্দটা শুনতে পেয়ে দিবা ছুটে আসলো রুম থেকে
মিনিকে ফ্লোর থেকে উঠিয়ে ওর গায়ের সব পাতা ঝাড়তে ঝাড়তে দিবা বললো”তোর সারাদিন দুষ্টুমি করা লাগবে?কি সুন্দর একটা জরুরি বিষয় নিয়ে ভাবছিলাম।দিলি তো মাথা গুলিয়ে?
চল এখন!
দিবা মিনিকে ফ্লোরের উপর সোজা করে দাঁড় করিয়ে সেখানে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো
এরপর রুমের দিকে আসার পথে আহনাফের বারান্দার উপর চোখ পড়তেই দিবার মুখের কথা হাওয়া হয়ে গেছে
এ সময়ে এখানে আহনাফ থাকতে পারে তা একদমই ভাবতে পারেনি সে
আহনাফ ও দিবাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুখটা ফিরিয়ে নিয়েছে অন্য দিকে
আগে দিবা কিছু বুঝতো না তখনই ভাল্লাগতো কিন্তু এখন সে সবটা বুঝছে বলেই মনের ভেতর বিব্রতভাব হানা দিচ্ছে বারবার
দিবার চোখে চোখ রাখতেও এখন বুক কাঁপে।
কি ঝামেলা!!প্রেমে পড়লাম নাকি আবেগে?
মানুষ আবেগে পড়লেই তো প্রেমে পড়ে।আবেগ হলো প্রেমের চাচাতো ভাই
.
দিবা রুমে চলে এসে মুখে হাত দিয়ে এক কোণায় বসে ভাবছে কি করবে না করবে
আসলেই তার কি করা উচিত!!কেন আহনাফকে মুখের উপর না বলে দিতে সে পারছে না
কেন বলতে পারছে না যে সে এসবে নেই।
আদনানকে তো মানা করতে এক মিনিট সময় ও সে লাগায়নি
তাহলে আহনাফের বেলায় এত ভাবনা চিন্তা কেন?
.
এরপরে আর সেই রাতে তাদের দুজনের দেখা হয়নি
পরেরদিন সকাল সকাল বাকিরা ঘুমিয়ে থাকলেও শুধু দিবা আর আহনাফ উঠে পড়েছিলো
দিবা নামাজ পড়ে রান্নাঘরে গেছে আর আহনাফ মিনিকে নিয়ে জগিংয়ে গেছে
খালামণি ঘুম থেকে উঠে চোখ ডলতে ডলতে একটা শাড়ী হাতে বের হলো
দিবা তখন রান্নাঘরে রুটি বানাচ্ছিলো
খালামণি শাড়ীটা ওকে দেখিয়ে বললেন”কাল আলমারির সব কাপড় বের করেছিলাম আমার একটা শাড়ী খুঁজে পাচ্ছিলাম না বলে।শাড়ীটা বৌভাতে পরার কথা।
তো ওটা খুঁজতে গিয়েই পেলাম এটা
এই শাড়ীটা তোর মায়ের শাড়ী।
সম্ভবত এটা সাদাত তোর মাকে দিয়েছিলো।বাবা মায়ের কাছে ধরা খাবে বলে মৌসুমী এটা আমায় রাখতে দিয়েছিলো
আমার নিজের এত এত শাড়ী আছে বলে কখনও এই শাড়ীটা আমি পরে দেখিনি
এটার উপর হক শুধু তোর আছে।তুই রাখ এটা।নে ধর
চলবে♥

সবটা অন্যরকম♥
#পর্ব_৪২
Writer-Afnan Lara
.
দিবা রুটি বানাতে বানাতে বললো”এই শাড়ীটাকে তোমার পুড়িয়ে ফেলা উচিত ছিল।যে ব্যাক্তি শাড়ীটা দিয়েছেন তাকে আমি দেখিনি।তার অস্তিত্ব আমার জীবনে নেই
তার কারণে আমার জীবন মাঝপথে এসে থমকে আছে
আর আমি কিনা তার দেওয়া উপহার নিজের কাছে রাখবো?”
.
-দেখ মা,এরকম রাগ করে না।শাড়ীটা সাদাত দিয়েছে তো কি হয়েছে?শাড়ীটা তো তোর মা পরেছিলো। সেটা মনে করে তুই তোর কাছে শাড়ীটা রেখে দে নাহয়
.
দিবা চুপ করে আছে।খালামণির কথার উত্তরে আর কিছুই বললো না সে
আহনাফ জগিং শেষে বাসায় ফেরার সময় ওর ফোনে কল আসলো জিসানের
-কিরে কি খবর তোর?
.
-খবর চওড়া!!কাল যে ভার্সিটিতে নবীণ বরণ অনুষ্ঠান সেদিকে তোর খবর আছে?
.
-ওমা!সেটা তো আমি জানিই।এটা আবার ব্রেকিং নিউজ হিসেবে বলছিস কেন?
.
-তুই কি তোর সেই কালা পোশাকই পরে আসবি নাকি একটু লুক পাল্টাবি?
.
-হুম!ভাবতে হচ্ছে।বাকিরা কি পরবে?
.
-সবাই বাঙালী স্টাইলে আসবে বস!
.
-ওকে ডান।আহনাফ তাহলে বাঙালী স্টাইলেই আসবে

দিবা নাস্তা বানিয়ে সেসব টেবিলে এনে এনে রাখছিলো
কলিংবেলের আওয়াজ শুনে এবার গেলো দরজা খুলতে
দরজাটা খুলতেই আহনাফ দিবার চোখে চোখ রেখে সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নিলো
আস্তে করে দিবার পাশ কেটে চলে গেলো সে
দিবার গায়ের থেকে গরম তাপ আসছে
কারণ সে এতক্ষণ রান্নাঘরে কাজ করছিল
ঘেমে একাকার হয়ে গেছে ওর সারা শরীর।যা গরম পড়ছে আজকাল
আহনাফ থেমে গিয়ে বললো”যাও ফ্যানের নিচে বসো”
.
এটা বলেই সে চলে গেলো
.
মিনি ও ওর পিছু পিছু ড্যাং ড্যাং করে চলে যাচ্ছিলো
দিবা নিচু হয়ে মিনির পেট ধরে ওকে উঁচু করে বললো”কি?আমাকে আর চিনেন না আপনি?নতুন একজনকে পেয়ে আমাকেই ভুলে গেছেন?”
.
-মিঁয়াও!মিঁয়াও
.
-হ্যাঁ বুঝেছি।যা এখন।খাবার আমার সাথে পাবি
.
মিনিকে ছেড়ে দিয়ে দিবা নিজের রুমে এসে ফ্যানটা চালু করে বসলো।তার পাশেই ঐ শাড়ীটা রাখা
লাল রঙের তার উপর হলুদ রঙের বুনোফুল সুতো দিয়ে বানানো
সম্পূর্ন শাড়ী জুড়ে গুটিগুটি সেই ফুল
যেন বনের মধ্যে বসে চিত্রকর শাড়ীটার ডিজাইন বানিয়েছেন
দিবা শাড়ীটাতে হাত বুলিয়ে নিলো
আহনাফ দরজায় দুইবার টোকা দিয়ে বললো”হ্যাঁ!এই শাড়ীটাই পরিও”
.
দিবা কপাল কুঁচকে বললো”কেন পরবো?”
.
-কাল ভার্সিটিতে নবীণ বরণ অনুষ্ঠান আছে।সবাই বাঙালী সাজে আসবে।তুমি এই শাড়ীটা পরিও।”ভাল্লাগবে”
.
দিবা চুপ করে রইলো
হ্যাঁ ও বললো না আবার না ও বললো না
আহনাফ তার রুমে এসে দিবার সাথে মিলিয়ে নিজের লাল পাঞ্জাবিটা খুঁজে রাখলো।কাল ওর সাথে মিলিয়ে যাবে সে

-মা প্লিস!চলো আমরা খুলনাতে যাই।জাস্ট একবার আমি মৌসুমীকে দেখতে চাই।বুকে হাহাকার করে এক নজর ওকে দেখার জন্য
.
-আমি এমন অসুস্থ শরীর নিয়ে যেতে পারবো না।তুই গেলে যা।তবে এতবড় শহরে ওকে পাবি কোথায়?
.
-জসিমের পরিবারের খোঁজ আমি জানি।একজন অপরিচিত হয়েও পরিচিতর অভিনয় করে নাহয় ঠিকানাটা নেবো ওদের থেকে
তবে কাল তো ভার্সিটিতে অনুষ্ঠান
সেটা শেষ হলে নাহয় খুলনার জন্য রওনা হবো
.
-আচ্ছা যদি ওকে পাস তো আমায় একটা ফোন করিস।নিজের এত বড় ভুলের জন্য ক্ষমা চাইবো ওর কাছে।
হয়ত ক্ষমা চাওয়া বোকামি।কারণ আমি যা করেছি তার ক্ষমা নেই
মৌসুমীর মনে যে অভিমান আছে সেটা আমার কারণেই আছে
সেদিন আমি মানা করে দেওয়ায় তে দুইটা জীবন নষ্ট হয়ে গেছিলো
.
সাদাত জানালার গ্রিল ধরে সেটাতে মাথা ঠেকিয়ে চুপ করে আছে

সকালের নাস্তা সেরে আরিফ মা বাবাকে নিয়ে মণিতার শ্বশুর বাড়ির জন্য রওনা হয়েছে
আর মিনি,দিবাকে নিয়ে আহনাফ ও বেরিয়েছে
.
পথে দিবাও চুপ ছিল আর আহনাফ ও
তারা একটা কথাও বলেনি একে অপরের সাথে
দিবার চুপ থাকার কারণ হলো তার মাথায় ঘুরঘুর করছে বাবার দেওয়া শাড়ীটার ছবি
সেটাকে ফেলে দিয়ে পুরোনো স্মৃতি মুছে দেবে নাকি সেটা পরে কাল ভার্সিটিতে গিয়ে বাবার স্মৃতিকে আগলে রাখবে ওসব ভাবছিল সে
আহনাফের চুপ থাকার কারণ হলো সে এত সাহসী হওয়ার পরেও কেন দিবার চোখে চোখ রাখতে পারছে না।দু মিনিটের জন্য ও কেন তাকিয়ে থাকা সম্ভব হয় না
.
জন্টুদের বাসায় এসে আহনাফ দিবাকে হারিয়ে ফেলেছে
মানে দিবা বাইক থেকে নেমে চলে যাওয়ার পর কোথায় যে উধাও হয়ে গেলো।তাই আহনাফ ওকে খুঁজছে
তখন আসার পর থেকে এক ঘন্টার বেশি সময় হয়ে গেলো অথচ এখনও ওর মুখটাও দেখলো না সে
দিবা জন্টুদের বাসার ছাদে এসে একা একা বসে আছে
অবশ্য একেবারেই একা নয়।মিনিও আছে
ছাদ ফাঁকা পেয়ে এখানে এসে বসেছে দিবা
ডেকোরেশন বাসার সামনের খোলা জায়গায় হওয়াতে ছাদ গোটা খালি
মিনি এই ছাদটাতে একটা ফুলগাছ ও দেখতে না পেয়ে দিবার ওড়না নিয়ে খেলছে চুপচাপ
আহনাফ ওর মায়ের কাছেও দিবাকে পেলো না।হাঁপিয়ে গেছে সে
এদিক দিয়ে আদনানের কিছু বন্ধুরা ওকে ঝাপটে ধরে দুনিয়ার সব গল্প শুনিয়ে যাচ্ছে
আদনান দিবাকে ছাদে যেতে দেখেছিল।বেশ কিছুক্ষন হওয়ার পরেও দিবা আসছে না দেখে সে নিজেই গেছে দেখতে।দিবাকে ছাদের কোণায় একা বসতে দেখে সেও পাশে এসে দাঁড়ালো।দিবা আদনানের উপস্থিতি টের পেয়েছে
তাও কিছু বলছে না।শেষে আদনানই বললো”মন খারাপ?তার কার কি আমি?”
.
দিবা বললো”নাহ”
.
-তাহলে?
.
-কিছু না
.
দিবা উঠে চলে যেতে নিতেই আদনান আবারও বলে উঠলো”বিয়ে না করো অন্তত ফ্রেন্ড বানিয়ে ও তো রাখতে পারো”
.
-আমি একাই ভালো আছি
.
কথাটা বলার পর দিবা আহনাফকে সামনে দেখতে পেলো।ওকে দেখার পর তার ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটে উঠেছে
হেসে দিয়ে দিবা বললো”যদি একজন সঙ্গীর প্রয়োজন হয়ে থাকে আমার, তবে সেই সঙ্গী আমায় নিজ দায়িত্বে খুঁজে নেবে।আমার আর যেচে খুঁজার দরকার নাই”
.
আহনাপ দিবার কথা শুনে মুচকি হাসলো
কথাটা যে দিবা ওকেই মিন করে বলেছে তা ও বেশ বুঝতে পেরেছে
কিন্তু আদনান কিছুই বুঝলো না।মিনি দিবার পিছু পিছু চলে গেলো।আদনানের প্রতি তার এত টান নাই
যা টান আছে তার ৬০% দিবার জন্য।৩০% আহনাফের জন্য আর বাকি ৫% আরিফ,ও বাকি ৫% আনাফের জন্য
.
আহনাফ ও আসছে এদিকেই। দিবার সামনে এসে দাঁড়িয়ে ওর পথ আটকিয়ে বললো”কোথায় ছিলে?তোমায় কত খুঁজছিলাম আমি জানো?”
.
দিবা হাত ভাঁজ করে বললো”কেন খুঁজছিলেন?”
.
আহনাফের মুখের কথাই হাওয়া হয়ে গেছে এবার।মুখটা আটকে সে দিবার দিকে অসহায় লুক নিয়ে তাকিয়ে আছে
দিবা হেসে দিয়ে বললো”থাক আর বলতে হবে না।আমি বুঝি”
.
আহনাফ মুখ খুলে বললো”কি বুঝো?”
.
-ঐ যে আমায় কেন খুঁজছিলেন।থাক আর ঘটা করে কারণ বলতে হবে না।আপনার চোখ মুখই আমাকে ক্লিয়ার করে সব জানিয়ে দেয়

আহনাফ কথাটাকে আর ঘাটলো না।পরে যদি দিবা সত্যি কথাটা বলে দেয় তখন তো সে না ও করতে পারবে না আবার হ্যাঁ বললেও বিপদ
দিবাকে এত ভয় কেন পাচ্ছি?
.
-আমাকে এত ভয় পান কেন আপনি?এতদিন তো খুব কড়া করে কথা বলতেন।আমি বরং এতদিন আপনাকে ভয় পেতাম আর হুট করে দুদিনেই আপনার চেহারার ভাবগতি পাল্টে গেলো?যাকে পছন্দ করতেন না তার সাথে বসে তার হাতটাকেই খোঁচাচ্ছেন ইদানিং
ইন্টারেস্টিং!
.
-না মানে ও কিছু না।মা ডাকছে তোমায়।অনেকক্ষণ দেখছে না তো তাই
.
দিবা ঘাঁড় ঘুরিয়ে বললো”আপনি নিজ থেকে খুঁজছিলেন না?”
.
আহনাফ হাঁটা বন্ধ করে ফেলেছে
দিবা ব্রু নাচিয়ে বললো”জানি!এটার উত্তর দিতেও আপনার হার্টবিট বেড়ে যাওয়ার মতন অবস্থা তৈরি হয়ে যাবে।থাক আর প্রশ্ন করছি না।তবে একটা কথা!!আমায় সত্যিটাই বলবেন।কখনও মিথ্যে বলবেন না
ধোকা জিনিসের রেশ কতদূর থাকে তা আমায় দেখলেই বুঝতে পারবেন।আমি তার জলজ্যান্ত একটা প্রমাণ।ধোকার ফল!”
.
আহনাফ গম্ভীর গলায় বললো”ওসব কঠোর অতীত।তোমার মায়েরই সেটার প্রতি ঘৃনা রাখা খাটে।তুমি ওসব মনে করে কেন নিজেকে কষ্ট দিচ্ছো?”
.
-আমার খাটে না??আমি ঐ ধোকার সাথে সম্পৃক্ত নই?
.
-না সেটা বলিনি।
.
-বাদ দিন।আপনি বুঝবেন না।যার সাথে ঘটে সেই বুঝে।
.
-আমি বলিনি যে বুঝি না কিংবা বুঝার চেষ্টা করি না।তোমায় জাস্ট স্ট্রেস আউট থাকতে বলছি কারণ তুমি ভালো মোমেন্টেও কষ্ট পাও শুধুমাত্র সেই অতীত মনে করে
.
-চাইলেও ভুলতে পারি না কি করবো বলুন?
.
-থাক ভুলতে হবে না।যাও মায়ের সাথে গিয়ে খেতে বসো
আমি লেগ পিসের ব্যবস্থা করি
.
দিবা ভ্রু কুঁচকে বললো”আমি লেগ পিস খাই না”
.
আহনাফ ফিসফিস করে বললো”তোমার জন্য নয় বালিকা।আমার ব্রো মিনির জন্য”
.
দিবা ফিক করপ হেসে দিয়ে বললো”ব্রো?”
.
-হ্যাঁ তা নয়ত কি?ওটা শুধু মিনিকেই খাওয়াবে।তুমি নিজেও খাবে না।
.
বৌভাত শেষ হতেই আহনাফরা একেবারে বাসায় ফিরে এসেছে
দিবাকে বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে আহনাফ তার ডিউটি করতে চলে গেছে আর দিবা মিনিকে নিয়ে বাসার দিকে গেছে।
রাত এগারোটা পর্যন্ত দিবা অপেক্ষা করলো আহনাফের
অথচ আগে এরকম অপেক্ষা সে করত না।মাথায় আনতোই না আহনাফের জন্য অপেক্ষা করার কথা
আজ কেন যেন মন চাইলো অপেক্ষা করা দরকার
সোফায় বসে অপেক্ষা করতে করতে দিবা সোফাতেই ঘুমিয়ে পড়েছে
বারোটার দিকে আহনাফ বাসায় ঢুকলো চাবি দিয়ে লক খুলে।ভিতরে ডুকতেই দিবাকে দেখতে পেলো সে
দিবা হাত ভাঁজ করে তার উপর মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে
ডাইনিং টেবিলে দুটো প্লেটে খাবার ঢেকে রাখা।তার মানে সে এখনও খায়নি,মিনি সামনের সোফাতে ঘুমায়
আহনাফ আস্তে আস্তে নিজের রুমে গেছে ফ্রেশ হতে
হালকা আওয়াজ কানে আসতেই দিবা উঠে পড়লো ঘুম থেকে
চোখে পানি নিয়ে ছুটে আসলো আহনাফকে খাবার এগিয়ে দেবে বলে
আহনাফ মুখ ধুয়ে আসলো এদিকে
দিবা এ পাশে বসেছে আর আহনাফ ওপাশে
দুজনেই খাবারের প্লেটে হাত রেখে চুপ করে আছে।খাচ্ছে না
দিবা মাথা তুলে বললো”খান না।অনেক রাত হয়েছে।আবার ঘুমাবেন কখন?”
.
-আমার জন্য হঠাৎ ওয়েট করলে। তাও না খেয়ে?
.
দিবা মুখে একটা লোকমা পুরে চুপ করে আছে।কথার উত্তর ও দিচ্ছে না। খাবারটাও গিলছে না
.
আহনাফ বললো”থাক,উত্তর দিতে হবে না।উত্তর জানি আমি।আপনাকে এত কষ্ট করার দরকার নেই”
.
দিবা বাম হাত দিয়ে চুলগুলো কানের পেছনে গুজে দিয়ে বললো”আমার কথা আমাকেই ফিরিয়ে দিচ্ছেন?”
.
-কি করবো বলো।তুমিও যে আমার মতন শুরু করেছো।

খাওয়া শেষ করে দিবা প্লেট গুলো রান্নাঘরে এসে ধুয়ে ধুয়ে রাখছিলো
আহনাফ পাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে বললো”ছাদে যাবে?”
.
দিবা প্লেট সাজিয়ে রেখে হাত মুছতে মুছতে বললো”কেন?”
.
-একটু চাঁদের আলো খেতাম
.
-চাঁদের আলো খাওয়া যায়?
.
-হা করলে যদি হাওয়া খাওয়া যায় তবে চাঁদের আলোতে হা করলে চাঁদের আলো ও খাওয়া যাবে
.
-টেস্ট কেমন হবে জানেন?আগে খেয়েছেন কখনও?
.
-একবার খেয়েছিলাম।টেস্ট কেমন যেন।চিবানোর সময় মনে হয় কিছুই নাই মুখে।
.
-হাহা!!
.
-আমি দরজা খুলছি।মিনিকে একজায়গায় রেখে আসো।নাহলে পিছু নিয়ে ছাদে পৌঁছে যাবে।হারিয়েও যেতে পারে
চলবে♥