#সম্পর্কের_মায়াজাল
#ফারজানা_আফরোজ
#পর্ব_২৭
হাত পা বাঁধা অবস্থায় এই শীতে মেঝেতে শুয়ে আছে সাধনা। বেল্টের মারের আঘাতে শরীর থেকে রক্ত কয়েক ফোঁটা ফ্লোরে গড়িয়ে পড়েছে। শরীরের পক্ষে এই আঘাত মেনে নেওয়া কষ্টকর তার উপর গর্ভবতী। কখন কিভাবে সেন্সলেস হয়ে গিয়েছে বুঝতে পারে নাই সাধনা। হটাৎ মুখের উপর পানির ছিটা পড়াতে ক্লান্ত মুখ দু-চোখ মেলে তাকিয়ে মুগ্ধকে দেখে ভয়ে আত্মা শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম সৃষ্টি হয় সাধনার। মার খাবার ভয়ে কাঁপতে থাকে। মুগ্ধ সাধনার সামনাসামনি বসে শান্ত চোখে তাকিয়ে বলল…..
—” আমাকে যেহেতু এত ভয় পাও তাহলে কেন পালাচ্ছিলে?”
সাধনা ভয়ে মুখ খুলল না। দুই বার একই কথা বলার পরেও যখন সাধনা চুপ করে থাকে তখন মুগ্ধ চেঁচিয়ে উঠে বললো…..
—” আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস না তুই? উত্তর দে আমার কথার।”
এই প্রথম মুগ্ধর মুখে তুই নামক শব্দটি শুনতে পেল সাধনা। মুগ্ধ কি তাকে ভালোবাসে ঠিক বুঝতে পারছে না। ভয় পাওয়া সত্বেও চুপ করে থাকলো এইবারও। কেন যেন মুগ্ধর সাথে কথা বলতে ওর ঘৃনা হচ্ছে।
—” আমাকে কঠোর করো না সাধনা। জানো না, আমি এক কথা বার বার বলতে পছন্দ করি না। তোমাকে কতবার বলেছি বাড়ি থেকে আমার অনুমতি ছাড়া একদম বের হবে না। কথা কি কান পর্যন্ত পৌঁছায় নাই তোমার? ”
—” আমি তোমাকে অনেকবার বলেছি আমি ঘুরতে বের হয়েছি তাহলে বার বার কেন একই প্রশ্ন করছো।”
সাধনা শুভ্রতার কথাগুলো বলতে চাচ্ছে না। মুগ্ধ যে ডেঞ্জারাস ছেলে শুভ্রতার ক্ষতি করে ফেলতে পারে।
—” আমি মিথ্যা কথা একদম সহ্য করতে পারি না সাধনা।”
—” এইখানে মিথ্যা কথার কি আছে? তোমার সাথে কি আমার ঝগড়া, মান অভিমান হয়েছে না-কি যে আমার পালাতে হবে তাছাড়া পালিয়ে আমি কোথায় যাবো আমার তো যাওয়ার মত কোনো জায়গা নেই।”
—” নিজেকে খুব চালাক মনে কর তাই না? এই মুগ্ধর চোখে ফাঁকি দেওয়া এত সহজ না।”
সাধনার কথা বলার শক্তিটুকু গায়ে নেই। মুগ্ধর মার খেয়ে আর কান্নাকাটি করে নিজের অবস্থা করুন করে ফেলেছে। সাধনা বাড়ি থেকে পালিয়ে বাহিরে বের হয়ে জঙ্গলের রাস্তা কিছু না চিনে জঙ্গলের পথ ধরে দৌঁড়াতে থাকে। শরীরের যা অবস্থা ঠিক মত দৌড়াতে পারে না। জঙ্গলটা একদম গোলক ধাঁধার মত। যেদিকেই যায় ঘুরে ফিরে বাড়ির সামনে চলে আসে। কিছুতেই রাস্তা খুঁজে পায় না। হাল ছেড়ে দিয়ে গাছের নিচে বসে বিশ্রাম নিয়ে আবার হাটতে থাকে। যেকোনো সময় মুগ্ধ চলে আসতে পারে। কথায় আছে না যেখানে বাঘের ভয় সেখানে রাত হয় যখন সে রাস্তা পেয়ে রাস্তার দিকে ছুটে চলল মুগ্ধর সামনে পড়লো সাধনা। সাধনাকে এই অবস্থায় দেখে মুগ্ধর রাগ তিনগুণ বেড়ে গেলো।
—” তোমার এত সহজে মুক্তি নেই আমার কাছ থেকে। পালানোর শাস্তি তো তোমাকে এখন দিবো না কেননা এখন কষ্ট দিলে আমার বাবু-টাও কষ্ট পাবে। বাবুকে তো তার বাবা কিছুতেই কষ্ট পেতে দিবে না। কষ্টগুলো তোলা রইলো তোমার।”
হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিয়ে সাধনাকে খাটে শুয়ে দিল। সাধনা ঘৃনা চক্ষু দৃষ্টিতে তাকিয়ে মনে মনে বললো….
—” এত মারার পরেও না-কি শাস্তি দেওয়া হয় নি। সন্তানের কষ্টের কথা ভাবলে কেউ এইভাবে মারতে পারে? হিংস্র পশুর থেকেও ভয়ানক তুমি মুগ্ধ তোমার কাছ থেকে তো আমি যেভাবেই হোক পালাবো। তোমার কাজের জন্য আমাকে ব্যাবহার করছো বুঝে গেছি আমি। তোমার মত হিংস্র পশুর সাথে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”
সাধনা চোখ বন্ধ করে রইলো। কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে চোখ খুলে প্লেট হাতে নিয়ে মুগ্ধকে দেখে সরে যেতে নিলে মুগ্ধ গভীর গলায় বলল…..
—” তুমি না খেয়ে থাকলে আমার বাবু সোনাটা যে না খেয়ে থাকবে এতে যে তার বড্ড কষ্ট হবে আমি যে তার কষ্ট সহ্য করতে পারবো না তাই ভালো ভাবে বলছি চুপচাপ উঠে ফ্রেশ হয়ে খাবার খাও।”
সাধনা দ্বিমত পোষণ করলো না। না খেয়ে থাকলে তার আর তার সন্তানের জন্য খুব ক্ষতিকর তাছাড়া চলা ফেরা করার জন্য তার শক্তির প্রয়োজন তাই উঠে বসলো। মুগ্ধ ধরে নিয়ে ওয়াশ রুমে নিয়ে গেল। হাত, পা, মুখ ভালো করে পরিষ্কার করে খাবার খেয়ে নিল। মুগ্ধ সাধনার খাবার শেষ হলে মেডিসিন দিল। মেডিসিন খেয়ে ঘুমিয়ে পরলো সাধনা।
মুগ্ধ দরজা লক করে বাড়ির বাহিরে এসে ফোনে থাকা স্পন্দনের ছবির দিকে তাকিয়ে বললো…..
—” তুই আমার কাছ থেকে আমার সব’চে প্রিয় ব্যাক্তিকে কেড়ে নিয়েছিস তোকে আমি ভালো থাকতে দিবো না স্পন্দন। আজ তোর জন্য আমি মাতৃহারা। আমিও তোকে মায়ের ভালোবাসা,আদর পেতে দিবো না। তোকে শেষ না করা পর্যন্ত আমার শান্তি নেও স্পন্দন।”
রাগে মুগ্ধর চোখ দুটি আগুনের মত লাল হয়ে গেল। মনে হচ্ছে চোখ দিয়ে আগুনের তীর বের করছে।
।।
।।
।।
বাসায় এসে স্পন্দন আর শুভ্রতা ঘুমিয়ে পরলো। সকাল দশটায় মিসেস সাবিনা বেগম সন্ধ্যাকে পাঠালো স্পন্দনের কাছে। সারারাত ঘুরাঘুরি করে ভোরের দিকে বাসায় এসেছে তাই মিসেস সাবিনা বেগম ডাকেনি। কিন্তু এত বেলা পর্যন্ত না খেয়ে থাকলে শরীর খারাপ করবে বলে সন্ধ্যাকে পাঠালো। এক হাতে চকলেট অন্য হাতে ফোন কানে ইয়ার ফোন গুজে দিয়ে স্পন্দনের রুমের দরজায় পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে চিল্লা-তে লাগলো…..
—” ভাইয়া এই ভাইয়া আম্মু ডাকছে ।”
চিল্লানো-র শব্দে শুভ্রতা আর স্পন্দন দুইজনের ঘুম ভেঙ্গে যায়। শুভ্রতা স্পন্দনের দিকে তাকিয়ে বলল….
—” মাশা-আল্লাহ আপনার বোনের গলা তো নয় যেন কারেন্টের শক। এক চিৎকারেই আমরা মরা মানুষ থেকে জীবিত মানুষ হয়ে গেছি।”
শুভ্রতার কথা শুনে স্পন্দন হেসে দিয়ে দরজা খুলে সন্ধ্যাকে রুমের ভিতর নিয়ে আসলো…..
—” চকোলেট পাগলী একটা । বল কেন এসেছিস?”
—” আম্মু ডাকছে তোমাদের। ভাইয়া তোমরা রাতে ঘুরতে গিয়েছিলে?”
স্পন্দন শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে দু হাত কানে ধরে বলল…..
—” সরি।”
সন্ধ্যা মুখ ফুলিয়ে বললো……
—” আমাকে একা রেখে কিভাবে ঘুরতে গিয়েছ তোমরা? আমায় আর ভালোবাসো না তুমি?”
—” অনেক ভালোবাসি আমার এই সন্ধ্যা তারাকে কিন্তু সন্ধ্যা তারা কি বুঝে না রাতে ঘুরতে যাওয়া ঠিক না।”
—-” তাহলে তোমরা কেন গিয়েছ?”
—” একদিন তোকে তোর বর রাতে নিয়ে ঘুরবে। সেদিন বুঝবি কারা রাতে ঘুরাঘুরি করে।”
সন্ধ্যা ভাবতে লাগলো তার ভাই তাকে কি বুঝিয়েছে। অবুঝ মেয়ের মাথায় স্পন্দনের কথাগুলোর অর্থ ঢুকলো না। স্পন্দন সন্ধ্যার সামনে থেকে এসে শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে বললো…..
—” আজ ভালো থাকলে তোর জন্যও বিয়ের প্রস্তাব আসতো এতদিনে বিয়ে হয়ে যেত বা হবে হবে সময় থাকতো।”
দু এক ফোঁটা অশ্রু অবাধ্য চোখ থেকে গড়িয়ে পরলো। শুভ্রতা স্পন্দনের মন ঠিক করার জন্য সন্ধ্যার কাছে গিয়ে বসলো……
—” খাবার খাওয়া হয়েছে এই পিচ্চিটার?”
সন্ধ্যা শুভ্রতার ব্যাপারে সব ভুলে গিয়েছে। শুভ্রতা কথা শুনে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল….
—” হুম আম্মু ডিম আর দুধ দিয়েছে ছিঃ কত্ত বাজে খেতে এই খাবার গুলো। চকোলেট খেতে তো সেই লাগে আমার ইয়াম্মী।”
—” স্যার, আপনি সন্ধ্যার হাত থেকে একটু চকোলেট মুখে দিয়ে দেখবেন প্লিজ।”
সন্ধ্যা চকোলেট হাত দিয়ে দূরে রাখে আর বলে…..
—” আমি দিবো না চকোলেট। ভাইয়া তুই খাবি না ঠিক আছে।”
—” স্যার একটু খান প্লিজ।”
—” এইটা কি হচ্ছে শুভ্রতা জানোই তো ও কেমন। তাছাড়া আই ডোন্ট লাইক ইট।”
—” প্লিজ স্যার একটু।”
শুভ্রতার কথা রাখার জন্য জোর করে সন্ধ্যার হাত থেকে একটু চকোলেট নিয়ে মুখে দিল। সন্ধ্যা তো সেই কান্নাকাটি করা শুরু করে দিয়েছে। স্পন্দন চকোলেট মুখে দিয়ে থু থু করে সব চকোলেট ফেলে দিল।
—” ছিঃ কি বিশ্রী গন্ধ। সন্ধ্যা কিভাবে খাচ্ছিস এই বাজে চকোলেট। মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে মেবী এই চকোলেটের দে ফেলে দেই।”
সন্ধ্যার হাত থেকে চকোলেট ফেলে দিতে চাইলে সন্ধ্যা স্পন্দনের হাতে কামড় দিয়ে চকোলেট নিয়ে দৌঁড়ে পালিয়ে যায়। স্পন্দন সন্ধ্যার এই আচরণ দেখে অবাক হলো ভীষণ।
—” এইটা কি করলো সন্ধ্যা?”
—” স্যার আমার মনে হয় সন্ধ্যার চকোলেটে ড্রাগ জাতীয় কিছু ইউজ করা হয়। সন্ধ্যা তার এক আপু সম্পর্কে কিছু…..!”
চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে কদম তলায় কে……
নাদিয়ার ফোন দেখে ফোন রিসিভ করল…
—” আবার কি সমস্যা হলো তোদের?”
—” শোন আমরা সব সময় সমস্যা নিয়ে ফোন দেই না।”
—” তাহলে কেন দিলি এখন?”
—” তুই কি আজ বাসায় আছিস?”
—” হুম। কেন?”
—“আমি আর ভাইয়া ভাবছিলাম আজ আসবো । তুই কি বলিস?”
সমুদ্র আর নাদিয়ার আসার কথা শুনে শুভ্রতা প্রায় নাচার উপক্রম। এত খুশি তার যা বলার বাহিরে। স্পন্দন শুভ্রতার এই রিয়েক্ট দেখে তাকিয়ে রইলো। কি এমন কথা শুনেছে যার জন্য সে এত খুশি তাকে তো জানতেই হবে।
—” তাড়াতাড়ি চলে আয় আর শোন আসার সময় আমার জন্য হালিম কিনে নিয়ে আসিস।”
—-” কি নির্লজ্জ রে তুই এখনও তোর শ্বশুড় বাড়ি যেতে পারলাম খাবারের নাম আগে বলে দিচ্ছিস।”
—” তাড়াতাড়ি আয় কতদিন পর দেখা হবে। শোন আজ আড্ডা হব্বে ওকে।”
—” তোর জামাই মারবে আড্ডা দিলে।”
—” মারবে না উনি খুব ভালো।”
—” জিজ্ঞাসা করে দেখ আমাদের কথা।”
—” ওকে প্রুভ দিচ্ছি।”
স্পন্দনের কাছে গিয়ে বলল শুভ্রতা……
—” স্যার, আমার দুইজন ফ্রেন্ড আসবে এইখানে আপনি কি বিরক্ত হবেন?”
—” বিরক্ত হবো কেন এইটা তো ভালো কথা যে তোমার ফ্রেন্ড-রা আসবে। কখন আসবে?”
—” ওই কখন আসবি তোরা?”
—” খুব তাড়াতাড়ি আসবো তুই আমার জন্য আলু পিঠা বানিয়ে রাখ।”
—” রাক্ষসী একটা।”
—” তোর হাতের আলু পিঠা খাওয়ার জন্য রাক্ষসী কেন পেত্নী, ডাইনোসর, ভুতের বউ, টিকটিক তেলাপোকা সব উপাধি পেতে এই নাদু অল টাইম রাজি। তোর হাতের স্পেশাল আলু পিঠা তো আমার চাই চাই।”
—” ওকে ওকে বানিয়ে রাখবো তাড়াতাড়ি চলে আসুন।”
—” ওকে দেখা হচ্ছে।”
ফোন কেটে দেওয়ার পর স্পন্দন শুভ্রতার গলা জড়িয়ে ধরে বললো….
—” ওরা কি আমার শালা না-কি শালী?”
—” দুটোই। এখন ফ্রেশ হয়ে আসুন অনেক কাজ আছে আমার।”
—” ওকে।”
।।
।।
।।
দু ঘন্টা পর কলিং বেলের শব্দে সন্ধ্যা দরজা খুলে দিয়ে সামনে একজন ছেলে আর মেয়েকে দেখে বলল…..
—” ভাবির ফ্রেন্ড তোমরা?”
—” হুম।”
—” আসো ভাবী ভিতরে আছে।”
প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েরা স্বভাবগত ভাবে অপরিচিত কাওকে দেখলে আপনি করে বলে বিশেষ করে ছেলেদের কিন্তু সন্ধ্যা সমুদ্রকে তুমি করে বলাতে সমুদ্র অবাক হওয়ার সাথে সাথে মনে মনে খুশি হলো। যখন কোনো মেয়ে কোনো ছেলেকে তুমি করে বলে তখন সেই ছেলের মনে লাড্ডু ফোটে তার মনে অন্য কিছু ধারণ করে(জাস্ট গল্পের জন্য বলা হয়েছে) ।
—” শুভ্রুর ননদ তো অনেক অ্যাডভান্স ভালোই হলো সিঙ্গেল নামক উপাধি এইবার গোছাতে পারবো। শুভ্রু তুই সব সময় মজা করিস আমার সাথে এখন তোকেই আমার শালা বউ করবো।”
মনে মনে কথাগুলো বলে হেসে দিল। এইরকম জটিল ও কঠিন কথা কিভাবে তার মনে আসলো ভেবে পাচ্ছে না সে।
চলবে…..
বানান ভুল হলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। এইবার বুঝেছেন কেন বলেছি সমুদ্র বড় একটি চরিত্র। আর গতপর্বে ১৮+ এলার্ট লিখে সত্যিই বেক্কল হয়ে গেছি আমি। কিস শব্দটি লিখার জন্য আমি ১৮+ লিখেছিলাম 🙆🏻♀️। মুগ্ধর কি নিয়ে শত্রুতা এখন বুঝতে পারছেন তো?