#সম্পর্কের_মায়াজাল
#ফারজানা_আফরোজ
#পর্ব_২৯
—” বুঝতে পেরেছিস নিজের ভালো এই জন্য তোকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।”
সাধনা এতদিন পরে বড় বোনকে দেখে জাপটে ধরলো। মুগ্ধর চোখে ফাঁকি দিয়ে ও পালিয়ে এসেছে। দুপুরে মুগ্ধর পানিতে অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে মুগ্ধকে পান করিয়ে সে পালিয়ে এসেছে। সাধনাকে ডক্টর ঘুমের মেডিসিন দিয়েছিল সেই মেডিসিন গুলোই সে ব্যাবহার করেছে। আগের বার পালানোর সময় রাস্তা চিনে এসেছে তাই কষ্ট করতে হয় নি। পালিয়ে সবার আগে বাবার বাড়িতে গিয়েছিল কিন্তু সাধনার বাবা বাসায় জায়গা দেয় নি তাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে কান্না করছিল স্পন্দন আসার পথে রাস্তায় সাধনাকে দেখতে পেয়ে নিয়ে আসে। সাধনা রাস্তায় সব সত্য বলে দিয়েছে স্পন্দনকে আর এইটাও বলেছে শুভ্রতা সব কিছু জানে। স্পন্দন শুভ্রতার প্রতি খুব রাগ হয় সত্যিটা জেনে সে তাকে কিছু কেন বলল না। সেদিন মুগ্ধর নাম বলেছে কিন্তু কারণ বলেনি তাই রাগে সে শুভ্রতার ফোন ধরেনি।
স্পন্দন শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে বলল…..
—” ওর অনেক্ষন ধরে কিছু খাওয়া হয় নি এই অবস্থায় না খেয়ে থাকা ঠিক না তুমি ওকে খাবার দেও।”
স্পন্দন আর কিছু না বলে হনহন করে রুমের দিকে হাঁটা শুরু করলো। শুভ্রতা ভেবেছে স্পন্দন টায়ার্ড তাই পিছু ডাকেনি। সাধনাকে ড্রয়িং রুমে থাকা গেস্ট রুমে পাঠিয়ে ফ্রেশ হতে বলে সে স্পন্দনের কাছে গেল।
স্পন্দন হাত থেকে ঘড়ি খুলে ড্রেসিং টেবিলের উপরে রাখছিল শুভ্রতা দরজার কাছে এসে স্পন্দনের দিকে তাকিয়ে কেশে উঠল…..
—“এহেম এহেম আপনার কি চোখে ছানি পড়েছে মিস্টার স্যার?”
স্পন্দন নিজের কাজ গুলো করতে লাগলো এমন একটা ভাব নিচ্ছে যেন শুভ্রতার কোনো কথাই তার কানে এসে পৌঁছায়নি।
—” এক্সকিউজ মী স্যার, আপনার কি চোখের সাথে সাথে কানেও কি সমস্যা সৃষ্টি হলো স্যার?”
—” আপনার কোনো কথাই শুনতে ভালো লাগছে না আমার মিস শুভ্রতা।”
—” স্যার আপনার কান, চোখের সাথে দেখছি এখন ভুলে যাওয়া রোগ সৃষ্টি হলো। আমি কি এই রাতে ডক্টর-কে ফোন দিবো?”
—” মিথ্যা কেন বললে আমার সাথে?”
এক ঝটকায় শুভ্রতার হাত ধরে টান দিয়ে নিজের সমস্ত ভর শুভ্রতার উপরে হেলিয়ে দিয়ে দুই হাত শক্ত করে চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে ধরে বলল। শুভ্রতা ভয়ে চুপসে গিয়ে বলল…..
—” কোথায় মিথ্যা বলেছি স্যার?”
—” এখনও তো বলছো।”
—” আমি বুঝতে পারছি না স্যার আমি কি মিথ্যা বলেছি আপনার সাথে।”
—” বুঝতে পারছ না তাই না? সাধনার বাচ্চা এতদিন আমি আমার ভেবে এসেছি। সাধনার প্রতি অন্যায় করেছি এই ভেবে মনে মনে নিজেকে কত ঘৃনা করে এসেছি জানো তুমি? বার বার তোমার কাছে ঘনিষ্ট হতে চেয়েও সাধনার মুখ ভেসে আসতো আর মন বলতো তুই কিন্তু সাধনার বাচ্চার বাবা কিন্তু হটাৎ করে আজ জানলাম এতদিন যাকে নিজের বাচ্চা ভেবে এসেছি সে আমার বাচ্চাই না। ওরা আমার সাথে গেম খেলেছে আর সেই গেমের একজন সদস্য তুমিও ছিলে। এখন কি বলবে যে তুমি জানতে না ওই বাচ্চা আমার না অন্য একজনের, বলো?”
শুভ্রতা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। সত্যতা যে সে পরিবারের কথা ভেবে বলেনি কিন্তু এখন তো স্পন্দন তাকে ভুল বুঝে আছে কিভাবে সে স্পন্দনকে বলবে তার চুপ করে থাকার কারণ।
—” উত্তর দেও তুমি জানতে না ওই বাচ্চা আমার না মুগ্ধ নামের এক ব্যক্তির বাচ্চা । তুমি কি এই জন্যই ওই রাতে মুগ্ধর নাম বলেছিলে যে মুগ্ধ নামের কাওকে চিনি বা জানি কি-না? উত্তর দাও চুপ না থেকে।”
—” হুম আমি জানতাম কিন্তু আমি আমার পরিবারের কথা ভেবে বলি নি আমাকে বিশ্বাস করুন।”
—” ওহ্ এইজন্যই সেদিন আমার সাথে খারাপ ব্যাবহার করার পর, পরে ভালো ব্যাবহার করেছো। দেখেছো কত পাগল আমি। আমি তো ভেবেছিলাম তুমি আমায় ভালোবাসো তাই আমার অন্যায়টা মেনে নিয়ে আমাকে মেনে নিয়েছ। তোমরা দুই বোনে-ই আমার সাথে খেলা খেলেছ। তোমাকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবো না আমি । ”
শুভ্রতা কান্না করে বলতে লাগলো…..
—” তাহলে সাধনাকে কেন নিয়ে এসেছেন? যাকে ঘৃনা করেন তার বোনকে কেন নিজের বাড়িতে নিয়ে এসেছেন?”
—” বিপদগামী কাওকে রাস্তায় দেখলে তাকে সাহায্য করতে হয় হোক সে শত্রু। আমি অন্যদের মতো না যে সব কিছু মনে গেঁথে নিয়ে মুখ ফিরিয়ে চলে আসবো। এই স্পন্দন এতটাও খারাপ না।”
স্পন্দন রাগ দেখিয়ে ছাদের দিকে চলে যায়। গাঢ় কাজল চোখগুলো কাজলে লেপ্টে গিয়েছে। হটাৎ কারো পায়ের শব্দ পেয়ে পিছনে তাকিয়ে সাধনাকে দেখে মুখে হাসির রেখা টেনে বললো…..
—” এই শরীর নিয়ে কে বলেছে তোকে উপরে আসতে। আমি তো এক্ষুনি চলে যেতাম নিচে। জানিস এই অবস্থায় কত সতর্ক থাকতে হয়।”
—” স্পন্দন কিছু বলেছে তোকে, আপু? ”
—” নাহ ও কি বলবে। আর স্পন্দন কেন বলছিস ও এখন তোর দুলাভাই সো সম্মান দিয়ে কথা বল।”
হাসতে চেয়েও হাসতে পাচ্ছে না সে। স্পন্দনের কথাগুলো বড্ড কষ্ট দিয়েছে তাকে।
—” আপু তোকে আমি খুব ভালো করে চিনি। স্পন্দন ভাইয়া কি কিছু বলেছে প্লিজ বল আমায়। আমি চাই না আমার জন্য তুই কষ্ট পেয়ে মন খারাপ করে থাকিস। ”
শুভ্রতা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। সাধনা শুভ্রতা-কে সামলিয়ে খাটের উপরে বসে সব কিছু জানতে চাইলো। শুভ্রতা সব কথাগুলো সাধনাকে বলল। সাধনা নিরব দর্শকের মতো কথা গুলো হজম করে মনে মনে বললো…..
—” আমার সংসার করা তো আর হলো না এখন আমার জন্য আমার আপুর সংসারও শেষ হতে চলেছে। সত্যিই আমি অলুক্ষুণে। যেখানেই যাই সব শেষ করে দেই।”
—” এই তুই তো অনেক্ষণ ধরে না খেয়ে আছিস চল নিচে তোকে খাবার বেড়ে দিচ্ছি।”
—” আপু তুই গিয়ে আমাদের তিনজনের জন্য খাবার বেড়ে রাখ আমি , তুই আর স্পন্দন ভাইয়া একসাথে বসে খাবার খাবো। চিন্তা করিস না স্পন্দন ভাইয়া ঠিকই আসবে।”
জোর করে শুভ্রতা-কে নিচে পাঠিয়ে দিয়ে সে ছাদের দিকে উঠলো। তিন মাসের প্রেগনেন্ট সে। কিছুদিন ধরে তার সাথে যা ঘটছে এরফলে শরীরের অবস্থা একদম ঠিক নেই। অন্ধকারে একটি ছায়া মূর্তি দেখে ডাক দিল…..
—” স্পন্দন ভাইয়া।”
এই প্রথম সাধনা স্পন্দনকে ভাইয়া বলে ডাকছে। সাধনার কণ্ঠ শুনে পিছনে তাকিয়ে বলল…..
—” এই অবস্থায় এইখানে কেন এসেছ আর জানো না এই সময় রাত বেড়াতে চলাচল করা ঠিক না।”
—” বিশ্বাস করো তুমি এইসব?”
—” পৃথিবীতে মানুষ যেমন সত্য তেমন সত্য কিন্তু জ্বীন। ভুত আছে কি নাই আমি এইসব ট্রাস্ট করি না কিন্তু জ্বীন আছে। মানুষের মধ্যে যেমন ভালো খারাপ আছে তেমনি জ্বিন-দের মধ্যেও ভালো খারাপ আছে। আমার ছোট বোন যখন আম্মুর গর্ভে ছিল তখন দেখেছি উনি ম্যাচ(আগুন) নিয়ে ঘুরাঘুরি করেছেন। খুব সাবধানে চলেছেন। সন্তান গর্ভে থাকার সময় মায়েদের অনেক নিয়ম মানতে হয় হোক তা পুরনো দিনের নানী দাদিদের কথা। তাছাড়া অনেক বাতাস আছে যার প্রভাব একদম ভালো না।”
স্পন্দনের কথা শুনে হাসলো সাধনা। এইসব পুরনো কথা এখন কেউ মানে না আর শহুরে মানুষ তো মানেই না। স্পন্দন শিক্ষিত মানুষ হয়ে এই ধরনের কথা বলছে সাধনার কাছে হাস্যকর ছাড়া আর কিছু মনে হলো না।
—” হাসছো তাই না? আমরা যারা এখন ডিজিটাল যুগ বলে সব কিছু ডিজিটাল ভাবী এবং এইসব পালন করে নিজেদের ক্ষতি নিজেরাই করছি। আগের মানুষরা নামাজ, কুরআন তেলাওয়াত করে সকাল শুরু করতো আর এখন মানুষরা ডিজে গান দিয়ে সকাল শুরু করে। আগের সকালের খাবার হতো বিভিন্ন ধরনের রাজকীয় পিঠা,ভাত,রুটি আর এখন সকালের খাবার হলো পরোটা, পাউরুটি, জেলি। আগের মানুষরা নিজেদের ভেজাল মুক্ত গাছের ফল, মাছ, দেশীয় মুরগি,ডিম,দুধ খেতো আর এখন বাজারের ফর্মুলা দেওয়া ফল, ব্রয়লার মুরগি,নানান জাতের রাসায়নিক সার দিয়ে দ্রুত বড় করা মাছ, ব্রয়লার মুরগির ডিম, বাজারের কিনা দুধ খাচ্ছে। জানো আগের মানুষ অনেকদিন বাঁচতো তাদের অসুখ বিসুখ কম হতো কিন্তু এখনকার মানুষ দুইদিন পর পর ডক্টরের কাছে যাওয়া লাগে তার কারণ এই যে আমরা ডিজিটাল যুগের মানুষ হয়ে গেছি।”
স্পন্দনের কথা গুলো মনোযোগ সহকারে শুনতে লাগলো সাধনা। খুব গুছিয়ে কথা বলে স্পন্দন। সাধনা তখন স্পন্দনের দিকে তাকালো যদিও বা অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না……
—” ভাইয়া আমি সত্যিই খুব দুঃখিত। আমার ভুলের জন্য আমার আপুকে কষ্ট দিবেন না ও খুব ভালোবেসে আপনাকে। সামান্য ভুল বুঝাবুঝির জন্য যদি যাকে ভালোবাসেন তাকে কান্না করতে বাধ্য করেন তাহলে এই ভালোবাসার কোনো মূল্য আছে কি? ভালোবাসা যদি খাঁটি হয় তাহলে ভালোবাসার মানুষের চোখের পানি আসতে দিবেন না। চোখের পানি আসার আগে সেই চোখে আনন্দের বন্যা বানিয়ে ফেলুন। ”
—” খুব সুন্দর ভাবে কথা বলো তো তুমি। হুম জানি শুভ্রতার সাথে খারাপ ব্যাবহার করেছি আসলে রাগ উঠলে মাথা কাজ করে না। আচ্ছা পাগলী-টা কি রেগে আছে?”
—” ভীষণ ভাবে রেগে আছে।”
—” তাহলে কি করা যায় এখন?”
—” কি করা যায় মানে এক্ষুনি গিয়ে রাগ ভালোবাসায় পরিণত করুন। তার আগে চলুন আমরা খেয়ে নেই খুব ক্ষিধে পেয়েছে। ”
—” সাধনা তুমি আমাকে তুমি করেই বলতে পারো। তোমার বড় ভাইয়া তো এখন আমি তাই না? সো তুমি করেই বলো।”
—” ধন্যবাদ ভাইয়া। এইবার চলো খেতে যাই।”
—“হুম।”
রাতে মুগ্ধর ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলো না স্পন্দন সকালে সব কিছু জানবে কে এই মুগ্ধ কেন তার ক্ষতি চায় কি করেছে ও সব সকালে জিজ্ঞাসা করবে এত রাতে কষ্ট বাড়ানোর দরকার নেই।
খাবার টেবিলে সেই কখন থেকে বসে আছে শুভ্রতা। স্পন্দন আর সাধনাকে আসতে দেখে প্লেটে খাবার বেড়ে দিতে লাগলো। স্পন্দন সাধনার দিকে তাকালো….
—” কি দেখছ শালী-কা তোমার বোনের কি রিয়েক্ট?”
—” বেচারি কষ্ট পাওয়ার সাথে সাথে ভীষণ রেগে আছে।”
—” কি করবো আমি?”
—” আপাতত খাবার খেয়ে নিজেদের রুমে গিয়ে রাগ আনন্দে রূপান্তরিত করুন।”
সাধনা আর স্পন্দনের ফিসফিস করে কথা বলার জন্য শুভ্রতা বাঁকা চোখে তাকিয়ে বললো…..
—” কি এত কথা হচ্ছে। খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে খেতে আয়।”
শুভ্রতা ইচ্ছা করেই উল্টো দিকে বসলো। সাধনা আর স্পন্দন একসাথে বসে আছে। স্পন্দন এমন একটা ভাব করছে যেন কিছুই হয় নি।
খাবার খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে শুভ্রতার পায়ে স্লাইড করছে পা দিয়ে স্পন্দন। স্পন্দনের ঠান্ডা পা শুভ্রতার পায়ের কাছে আসলেই শুভ্রতা পা দিয়ে সরাতে চায় কিন্তু ফাজি স্পন্দন আবারো শুভ্রতার পায়ে স্লাইড করে। সাধনা খাবার টেবিলের নিচের রহস্যের ব্যাপারে সব বুঝতে পেরে মিটমিট করে হাসছে। হটাৎ শুভ্রতা হেঁচকি তুলতে শুরু করে স্পন্দন তাড়াতাড়ি নিজের হাতে শুভ্রতা-কে পানি খাওয়াতে লাগলো। এই দৃশ্য দেখে সাধনার চোখ দুটি ভিজে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। মুগ্ধর কেয়ার গুলো বার বার চোখের সামনে ভাসতে লাগল। মুগ্ধর এখন কি অবস্থা তা জানার জন্য মন আকুল হয়ে আছে তার। এতগুলো ট্যাবলেট একবারে দেওয়া একদম ঠিক হয় নি এখন যদি মুগ্ধর কিছু হয়ে যায় সেই কথাই ভেবে সাধনার বুক কেঁপে উঠছে। হাজার হোক স্বামী তার, ভালোবাসার মানুষ আর তার অনাগত সন্তানের বাবা। খাবার রেখে মিথ্যা বলে গেস্ট রুমের ভিতর চলে গেলো। সাধনার এই অবস্থায় সিড়ি বেয়ে উঠা নামা করা ঠিক হবে না তাই তাকে গেস্ট রুমে থাকতে দেওয়া হয়েছে।
সাধনা চলে যাওয়ার পরেই শুভ্রতা আর স্পন্দন খাবার খেয়ে নিল। শুভ্রতা সব কিছু ঠিক করে উপরে যেতে নিলে স্পন্দন আচমকাই কোলে তুলে নিলো শুভ্রতা-কে…….
চলবে……